শ্রীকৃষ্ণ ও জীবসত্তার মধ্যে পার্থক্য:-
জীবসত্তা অণু-সদৃশ ক্ষুদ্র, কিন্তু কৃষ্ণ অসীমঃ
বৈদিক শাস্ত্রে, যেমন কঠোপনিষদে ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বদ্ধ ও মুক্ত সকল জীবসত্তার মধ্যে একজন পরম চেতন ব্যক্তি রয়েছেন, পরম পুরুষোত্তম ভগবান, যিনি সকল জীবকে পালন করেন এবং তিনি একাকী সেই অনন্ত-সংখ্যক জীবসত্তার ভিন্ন ভিন্ন বাসনা পুরণ করার সুযোগ প্রদান ক্রেনঃ “নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাং একো বহুনাং যো বিদধাতি কামান্”। শ্রীকৃষ্ণ নিত্য, এবং জীবসত্তা সমূহও নিত্য। শ্রীকৃষ্ণের যেমন একটি সচ্চিদানন্দময় দেহ রয়েছে, তেমনি সমস্ত জীবসত্তার প্রত্যেকেরই এক একটি সচ্চিদানন্দময় দেহ রয়েছে। কিন্তু জীব ও শ্রীকৃষ্ণের পার্থক্য হচ্ছে, কৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান, প্রভু ও সকল জীবসত্তার পরম নিয়ন্তা ঈশ্বর। আর জীব নিত্যকালের জন্য শ্রীকৃষ্ণের দাস, সেবক।
অতএব সিদ্ধান্ত এই যে, জীব শ্রীকৃষ্ণের সংগে এক কেবল গুণগতভাবে (উভয়ই সৎ-চিৎ-আনন্দময়), কিন্তু পরিমাণগতভাবে জীব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিদ্ অণু, আর শ্রীকৃষ্ণ অসীম, বিভু। একে বলা হয় ‘অচিন্ত্য-ভেদাভেদ-তত্ত্ব’, যার অর্থ জীব ও শ্রীকৃষ্ণ ‘যুগপৎ ভিন্ন আবার অভিন্ন, যা অচিন্তনীয়’। এই অভিন্নতা বা অভেদত্ব হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ ও জীবসত্তার গুণগত একত্ব, আর ভিন্নতা, ভেদত্ব হচ্ছে পরিমাণগত (যেমন সূর্য ও তার কিরণ কণা – উভয়ের গুণগত ধর্ম এক, কিন্তু পরিমাণগতভাবে অসীম প্রভেদ)।
জীবসত্তা তার নিজ দেহটির জ্ঞাতা
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ দেহ সমূহের জ্ঞাতা
দেহ ও দেহের জ্ঞাতা- বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন তিনটি মুখ্য বিষয় পাইঃ ভগবান, জীব-সত্তা, এবং জড় পদার্থ। প্রত্যেক জীব-শরীরে দুটি আত্মা রয়েছেঃ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। আর পরমাত্মা যেহেতু পরম পুরুষ ভগবানেরই অংশপ্রকাশ, সেজন্য শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “আমিও জ্ঞাতা, আমি পরমাত্মারূপে প্রত্যেক জীবদেহে অবস্থান করি” (ভ. গী.- ১৩/২-৩, ১৫/১৫)।
আত্মার জড় শরীরকে বলা হয় ‘ক্ষেত্র’, আর ঐ শরীরটিকে যিনি জানেন, সেই আত্মাকে বলা হয় ‘ক্ষেত্রজ্ঞ’। একজন জীবাত্মা হিসাবে আমি আমার শরীরটি সম্বন্ধে, জ্ঞাত, অবগত। ঠিক তেমনি আপনি (জীবাত্মা) আপনার শরীরটির জ্ঞাতা, আপনি আপনার শরীরের সংবেদনশীলতা অনুভব করেন। কিন্তু আপনার যদি মাথা যন্ত্রণা হয়, আর আপনি যদি আমাকে না বলেন, তাহলে আমি সে বিষয়ে কিছুই জানতে পারি না। তেমনি আমি যদি কোন বিষয়ে চিন্তা করতে থাকি, আপনি জানতে পারেন না কোন বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবছি। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সকল জীব শরীরে পরমাত্মারূপে বিরাজিত থাকায় তিনি সকল জীব শরীরের সবকিছুই জ্ঞাত, অবগত। তিনি সকল ধরণের প্রজাতির সবরকমের শরীরের জ্ঞাতা। সেই জন্য প্রত্যেক শরীরে বিরাজিত পরমাত্মাকে বলা হয় ‘পরম ক্ষেত্রজ্ঞ’।
ঠিক যেমন আত্মা তার চেতনাকে পরিব্যপ্ত করার মাধ্যমে সমগ্র শরীরটিতে বিরাজিত, তেমনি পরমাত্মা তাঁর পরমচৈতন্যকে সারা সৃষ্টি জুড়ে বিরাজমান। সীমিত-চেতন জীবাত্মা কখনোই এই অসীমরূপে সর্বব্যাপ্ত পরমচৈতন্যের অনুকরণ করতে পারে না। আমার সীমিত শরীরটিতে কি চলছে, আমার অনুভবের পরিধি কেবল সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ; অন্যের শরীরে কি ঘটছে তা আমার উপলব্ধির অতীত। আমার চেতনার মাধ্যমে সারা শরীরটিতে উপস্থিত, কিন্তু আমি আমার চেতনার দ্বারা অন্যের শরীরে উপস্থিত নই। পক্ষান্তরে পরমাত্মা সকল জীব শরীরে ও সকল পরমাণুতে – সর্বত্র বিরাজ করায় তিনি অস্তিত্বশীল সবকিছু সম্বন্ধে সচেতন তিনি পরম চেতন, পরম ক্ষেত্রজ্ঞ।
সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম।