ক্ষত্রিয় আমার আপনার তৈয়ারী কিছু নহে – ক্ষত্রিয় ঈশ্বর বা প্রকৃতির সৃষ্টি। আপনার রক্ত কণিকার মধ্যেও বাস করে কতকগুলি ক্ষত্রিয়। আপনার দেহের বিষ্ফোটকে অস্ত্রোপচার করিয়া চিকিৎসক যখন কতকগুলি পূঁজ ফেলিয়া দেন, তখন আপনি হয়ত ভাবিবার সময় পান না যে উহারা আপনার রক্তপ্রবাহনিবাসী ক্ষত্রিয় শহীদগণের মৃতদেহগুলি মাত্র। উহারা প্রাণ দিয়াছে বলিয়া আপনার প্রাণ বাঁচিয়াছে।
প্রাণ দিয়া প্রাণ বাঁচান যার কর্ত্তব্য, সে ক্ষত্রিয়। সে রাজা, সে নৃপ- নরগণের পালন তার স্বধর্ম্ম। এই স্বধর্ম্মে জীবন আহুতি দিয়া সে ইহকালে যশঃ ও পরকালে স্বর্গ অর্জ্জন করে। সমাজের নরনারীর স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রায় কেহ আঘাত হানিতেছে দেখিয়া, দাঁড়াইয়া তামসা দেখা বা ভাষণ দিয়া শোক প্রকাশ করা, ক্ষত্রিয়ের কর্ম্ম নয়- রাজধর্ম্ম নয়। রাজশক্তির একমাত্র ধর্ম্ম তখন নীতিগতভাবে আঘাত হানা।
দুইটি বিষয় লক্ষ্য করিবেন। যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য নরনারীর পালন; পীড়ন বা শোষণ নহে। আর লক্ষ্য করিবেন যে, ক্ষাত্রবীর্য্যশালী ক্ষত্রিয়েরাই যুদ্ধে শক্তির পরীক্ষা করিবেন। উহা সর্ব্বগ্রাসী হইবে না। সাধারণ নর-নারীর সহজ জীবনযাত্রা উহাতে ব্যাহত হইবে না।
যদি বলেন, এখনকার দিনে ঐরূপ যুদ্ধ সম্ভব নয়। তাহাতে আমি একমত হইব। শুধু এই বলিব, এখনকার দিনের যুদ্ধ যুদ্ধই নয়। বিরাট দস্যুতা। যাহার উদ্দেশ্য ধনলোভ ও রাজ্য বিস্তার। দস্যুতা চিরকালই পাপ। ব্যাপক দস্যুতাকে সকল সভ্য সমাজেরই কর্ত্তব্য মহাপাপ বলিয়া ঘৃণা করা। সমাজরক্ষা হেতু নৈতিক প্রয়োজনে ও আদর্শে যুদ্ধ করা রাজশক্তির চিরকালই কর্ত্তব্য। এইরূপ যুদ্ধও যাহাতে না বাধে, সেজন্য যাঁহারা সজ্জন, তাঁহারা পূর্ব্বাহ্নে যথাশক্তি চেষ্টা করিবেন। শেষ পর্য্যন্ত উহা অপরিহার্য্য হইলে কর্ত্তব্যরূপে গ্রহণ করিতে ভীত হইবেন না। কাপুরুষের মত পলায়নপর হইবেন না। ধর্ম্মজ্ঞ নীতিজ্ঞের মত পবিত্র কর্ত্তব্যের সম্মুখীন হইবেন।
গীতার বক্তা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ কখনও যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না। যুদ্ধের জন্য তৎকালীন ঘটনাপরম্পরা দায়ী। শ্রীকৃষ্ণ নহেন। বরং তিনি শান্তির প্রস্তাব লইয়া কৃতকার্য্য হইবার আশায় সাড়ম্বরে দুর্য্যোধনের সভায় আসিয়াছিলেন। যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হইবার জন্য বহু উপদেশ দিয়াছিলেন। শান্তিদূতের মহাবাণী দুর্য্যোধনের বধির কর্ণে প্রবেশ করে নাই। সে দূতকে বন্দী করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, শ্রীকৃষ্ণ তাহা বুঝিতে পারিয়া কৌশলে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
যুদ্ধ যখন অপরিহার্য্য হইয়া উঠিল, তখন তিনি প্রথমে ভাবিলেন, নিরপেক্ষ থাকিবেন, কোন পক্ষেই যোগ দিবেন না। পরে গভীর চিন্তা করিয়া দেখিলেন- নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নহে। বাহিরে নিরপেক্ষতা দেখাইলেও মন এক পক্ষের জয়কামনা করিতে থাকিবে। ইহা একরূপ মিথ্যাচার। অন্তরবাহিরে নিরপেক্ষতা যখন সম্ভব নহে, তখন উভয়পক্ষেই সমভাবে থাকিবেন। এক পক্ষে দিলেন তাঁহার বিপুল নারায়ণী সেনা। অপর পক্ষে দিলেন নিজের বুদ্ধি ও সারথ্য। ঘোড়া চালাইবেন, অর্জ্জুনের বুদ্ধি চালাইবেন, নিজের হাতে অস্ত্র কখনও চালাইবেন না। অর্জ্জুন যখন নারায়ণী সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করেন, তখনও তিনি নিজে সারথ্য করিয়াছেন। এইরূপ উভয় পক্ষে সমভাব রক্ষা মানবেতিহাসে আর কোন ব্যক্তি করিয়াছেন –এইরূপ দৃষ্টান্ত কেহ দিতে পারিবেন বলিয়া মনা হয় না।
শান্তিময় ভগবান্ কর্ত্তব্যবিমূঢ় ভক্তকে কর্ত্তব্যে উদ্বুদ্ধ করিয়াছেন- সমগ্র গীতা ভরিয়া ইহাই দেখিতে পাইবেন, ইহাতে অশোভনতা কোথায়? বরং সংসারকর্ম্মক্ষেত্রে কর্ত্তব্যপরাঙ্মুখ জীবের প্রতি ইহাই পরম শোভন উপদেশ। এইজন্যই এই বিশাল কর্ম্মক্ষেত্রে যে যেখানে কর্ত্তব্যের ভূমিকায় দুর্ব্বল, বিভ্রান্ত বা বিমূঢ় হইয়া পড়ে, তখনই গীতার উপদেশ তাহার পক্ষে সঞ্জীবনী-সুধার কার্য্য করে। দিশাহারা মানুষকে পথের সন্ধান দিতে গীতার মত গ্রন্থ আর নাই। সর্ব্বশ্রেণীর মানুষের সর্ব্বপ্রকার অবস্থায় গীতার বাণী জীবনপথের সর্ব্বোজ্জ্বল বর্ত্তিকা।
আলোচনার মধ্যে গীতার কথা আপনাদিগকে বলিয়াছি। আর একবার গীতার সার নির্য্যাস শুনাইব। আমরা সসীম, ক্ষুদ্র, খণ্ড জীব। জগতের যাহা কিছু দেখি- খণ্ড খণ্ড দেখি। ইহা ভ্রান্ত দৃষ্টি। নিখিল বস্তুকে অখণ্ডভাবে দেখা, এক বিরাট দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গরূপে দেখাই ঠিক দেখা। সেই দেখার নাম বিশ্বরূপ দর্শন। বিশ্বের যেটি প্রকৃ্ত রূপ, তাহা যে মহাচৈতন্য সত্তার অবিভক্ত বিশাল রূপ- তাহা দেখাই বিশ্বরূপ দর্শন। অর্জ্জুন তাহা দেখিয়াছেন। কৃষ্ণের –দেওয়া দিব্যদৃষ্টিতে দেখিয়াছেন। দেখিয়া অর্জ্জুন বলিয়াছেন-“হে দেব, তোমার এক দেহে নিখিল বিশ্ব দেখিতেছি”(১১/১৫)
এই দিব্যদৃষ্টি দিয়া, দিব্যদর্শন করাইয়া শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন- অখিল বিশ্বের যাহা কিছু, সবই আমি করি। সবই করা হইয়া রহিয়াছে, তবু তোমাকে কর্ম্ম করিতে হইবে-“নিমিত্তমাত্র” হইয়া (১১/৩৩)।
সমগ্র জগৎ ভগবানের। জগতের যাহা কিছু, সবই তাঁহার কাজ। যাহা করিবার তিনিই করেন। আমি নিমিত্তমাত্র- এই একটি উপদেশই বিশ্বমানবের জীবনে শান্তির বাতাস বহাইবার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী। আমরা শুধু এই একটি কথা নিয়ত স্মরণপথে রাখিয়া চলিব। এই বিশ্বরূপ –বিশ্বের যাহা কিছু, আমি, আপনি, বিশ্বেশ্বরেরই রূপ। তিনিই কর্ত্তা, তিনিই কর্ম্ম, তিনিই কারণ। আমরা সকলে তাঁহার হাতের ক্রীড়ণক। তাঁহার হাতের ক্রীড়াযন্ত্র। যন্ত্রী যেমন বাজাইবেন, ঠিক তেমনি বাজিব। তাঁহার সত্তাই আমার সত্তা। তাঁহার কর্তৃ্ত্বেই আমার কর্তৃ্ত্ব। আমি অধীন, তিনিই স্বাধীন। তাঁহার স্বাধীনতার সঙ্গে এক হইয়াই আমার স্বাধীনতা, তাঁহার সঙ্গে যুক্ততাতেই আমি কৃ্তার্থ। বিযুক্ততায় অপদার্থ। কেশ মাথায় থাকিয়াই সুন্দর। বিচ্যুত হইলে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
শেষ কথাটুকু বলিবার সঙ্গে সঙ্গেই, সভাপতি ওয়েলার সাহেব হাততালি দিয়া উঠিলেন। আমি তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়াই কথা বলিতেছিলাম। সভাপতির হাততালির সঙ্গে সঙ্গে সভাশুদ্ধ লোক সোল্লাসে হাততালি দিয়া উঠিল। সভান্তে প্রশ্নকর্ত্তা আমার করমর্দ্দন করিয়া কহিলেন-“আপনার সূক্ষ্ম বিচারে সুখী হইয়াছি। একটা সংশয় কাটিয়া কাটিয়া গিয়াছে।”
এর পর দেখুনঃ ধর্ম কি বিজ্ঞান ছাড়া ? ভোগবাদীদের কতিপয় যুক্তি!
আপনার পছন্দমত
যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।