পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা'র পর -
মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মোহাচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠে তার দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন হয়ে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অনুসন্ধান করছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে বুঝতে পারছে যে, সে দুঃখ-দুর্দশা চায় না, ততক্ষণ তাকে যথার্থ মানুষ বলে গণ্য করা চলে না। মানুষের মনুষ্যত্বের সূচনা তখনই হয়, যখন তার মনে এই সমস্ত প্রশ্নের উদয় হতে শুরু করে। ব্রহ্মসূত্রে এই অনুসন্ধানকে বলা হয় ব্রহ্মজিজ্ঞাসা। অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা। মানব-জীবনে এই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা ব্যতীত আর সমস্ত কর্মকেই ব্যর্থ বা অর্থহীন বলে গণ্য করা হয়। তাই যারা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, “আমি কে?” “আমি কোথা থেকে এলাম?” “আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি?” “মৃত্যুর পরে আমি কোথায় যাবো?” তাঁরাই ভগবদ্গীতার প্রকৃত শিক্ষার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এই তত্ত্ব যিনি আন্তরিকভাবে অনুসন্ধান করেন, তিনিই ভগবানের প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি অর্জন করেন। অর্জুন ছিলেন এমনই একজন অনুসন্ধানী শিক্ষার্থী।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানব-জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে দেবার জন্যই এই পৃথিবীতে অবতরণ করেন। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার তত্ত্বানুসন্ধানী মানুষের মধ্যে কোন ভাগ্যবান ব্যক্তি কেবল ভগবত-তত্ত্ব পূর্ণরূপে উপলব্ধি করে নিজের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হন, এবং এমন মানুষের জন্যই ভগবান ভগবদ্গীতা শুনিয়েছেন। অজ্ঞতারূপ হিংস্র জন্তুটি আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলেছে, কিন্তু ভগবান করুণাময়, বিশেষ করে মানুষের প্রতি তাঁর করুণা অপার। তাই তিনি তাঁর বন্ধু অর্জুনকে শিক্ষার্থীরূপে গ্রহণ করে ভগবদ্ গীতার মাধ্যমে মানুষকে ভগবৎ-তত্ত্ব দান করে গেছেন।
অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সহচর, তাই জড় জগতের অজ্ঞতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছানুসারে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় তিনি সাময়িকভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যাতে তিনি তাঁর সেই সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণের স্মরণাপন্ন হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন, এবং তার মাধ্যমে ভগবান আগামী দিনের মানুষের উদ্ধারের উপায় স্বরূপ ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান সমন্বিত ভগবদ্গীতা বর্ণনা করলেন। অপার করুণাময় ভগবান মানব-জীবনকে সার্থক করে তুলবার জন্য মানুষকে তাঁর স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত করলেন, আর তাদের নির্দেশ দিলেন কিভাবে জীবন অতিবাহিত করা উচিত।
ভগবদ্ গীতার বিষয়বস্তুতে আমরা পাঁচটি মূল তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারি। সর্বপ্রথমে ভগবানের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে জীবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঈশ্বর আছেন এবং তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন, আর জীব প্রতিনিয়তই তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যদি কেউ বলে যে, সে কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না, সে মুক্ত, তা হলে বুঝতে হবে সে উন্মাদ। জীব সর্বদাই, বিশেষ করে বদ্ধ অবস্থায় সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই ভগবদ্ গীতায় পরম নিয়ন্তা ঈশ্বর ও সর্বদা নিয়ন্ত্রিত জীবের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচিত হয়েছে। তাছাড়া প্রকৃতি (জড়া প্রকৃতি), কাল (সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব ও জড়া প্রকৃতির অভিব্যক্তির অস্তিত্বের স্থিতিকাল) এবং কর্মও (কার্যকলাপ) আলোচনা করা হয়েছে। ভৌতিক জগতের প্রকাশ বিভিন্ন কার্যকলাপে পরিপূর্ণ। সমস্ত জীবেরা বিভিন্ন কার্যকলাপে লিপ্ত। তাই ভগবদ্ গীতা থেকে আমাদের জানতে হবে ভগবান কে? জীব কি? প্রকৃতি কি? ভৌতিক জগত কি? আর কিভাবে তা মহাকালের করার পরিচালিত হয় এবং জীবের কার্যকলাপ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
ভগবদ্ গীতায় এই পাঁচটি বিষয়বস্তু আলোচনা করার মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ করা হয়েছে যে, ভগবান বা শ্রীকৃষ্ণ বা পরব্রহ্ম বা পরম নিয়ন্তা বা পরমাত্মা যে নামেই তাকে সম্বোধন করা হোক, তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। সকল জীবই পরম নিয়ন্তার মতোই গুণগতভাবে সমান। যেমন, প্রকৃতিজাত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সব কিছু ভগবান নিয়ন্ত্রণ করছেন যা ভগবদ্গীতার শেষ অধ্যায়গুলিতে বর্ণনা করা হয়েছে। জড়া প্রকৃতি স্বাধীন নয়। পরমেশ্বরের নির্দেশে তাঁকে কাজ করতে হচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেছেন ময়াধ্যক্ষেণ প্রক্রিতিঃ সূয়তে সচরাচরম্- “এই জড়া প্রকৃতি আমার নির্দেশনায় ক্রিয়াশীল।” আমরা যখন ভৌতিক জগতে বিস্ময়কর কোন কিছু ঘটতে দেখি, তখন আমাদের বোঝা উচিত যে, এর পেছনে একজন নিয়ন্তা রয়েছেন। নিয়ন্ত্রিত না হলে কোনো কিছুরই প্রকাশ হতে পারে না। যদি কেউ মনে করে যে, কোন পরিচালক ব্যতীতই প্রকৃতি পরিচালিত হচ্ছে, তবে তা শিশুসুলভ নির্বুদ্ধিতা। একটি শিশু যেমন একটি মোটর গাড়ি চলতে দেখে মনে করতে পারে যে, কোন ঘোড়া বা পশু দ্বারা পরিচালিত না হয়ে মোটর গাড়িটি নিজে নিজে চলছে, কিন্তু পরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন যে কোন মানুষই মোটর গাড়ির কারিগরি ব্যবস্থার ব্যাপারটি জানে। সে জানে যে, একজন চালক কলকব্জা নাড়িয়ে সেই গাড়িটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তেমনই, পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন এই ভৌতিক জগতের সমস্ত কিছুর পরিচালক। তাঁরই তত্ত্বাবধানে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। জীব হচ্ছে ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং ভগবদ্গীতাতে তার বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এক বিন্দু সমুদ্রের জল যেমন গুণগতভাবে সমস্ত সমুদ্রের জল থেকে অভিন্ন, এক কণা সোনাও যেমন সোনা, ঠিক তেমনই জীব পরম নিয়ন্তা বা ঈশ্বর বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপরিহার্য অংশ হবার ফলে, ভগবানের সমস্ত গুণই তার মধ্যে অণু পরিমাণে বিদ্যমান, কেন না প্রতিটি জীব ক্ষুদ্র ঈশ্বর, নিয়ন্ত্রণাধীন ঈশ্বর। আমরা প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করছি, যেমন এখন আমরা অন্তরীক্ষ অথবা অন্যান্য গ্রহ নিয়ন্ত্রিত করবার চেষ্টা করছি। এই প্রচেষ্টা স্বাভাবিক, কারণ কর্তৃত্ব করার এই গুণ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করার বাসনা আমাদের মনে থাকলেও আমাদের বোঝা উচিত যে, আমরা পরম নিয়ন্তা নই। ভগবদ্ গীতাতে এর বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
জড়া প্রকৃতি কি? গীতায় তাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তা হচ্ছে নিকৃষ্টা প্রকৃতি আর জীবকে বলা হয়েছে উৎকৃষ্টা প্রকৃতি। উৎকৃষ্ট হোক বা নিকৃষ্টই হোক, প্রকৃতি সব সময় নিয়ন্ত্রণাধীন। স্ত্রী যেমন স্বামীর দ্বারা পরিচালিত হয়, নারীসরূপা প্রকৃতিও তেমনই ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত হয়। জীব ও জড়া প্রকৃতি উভয়কে পরমেশ্বর পরিচালিত করেন। গীতাতে বলা হয়েছে, জীব যদিও ভগবানের অপরিহার্য অংশ, তবুও তাকে প্রকৃতি বলেই স্বীকার করতে হবে। ভগবদ্ গীতার সপ্তম অধ্যায়ে তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ।
/জীবভূতাম্- “এই জড়া প্রকৃতি আমার নিম্নতর প্রকৃতি, এই নিম্নতর প্রকৃতির অতীত আর একটি প্রকৃতি আছে- জীবভূতাম্ অর্থাৎ জীবসত্তা।
জড়া প্রকৃতি গঠিত হয়েছে সত্ত্ব, রজ ও তম- এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে। এই গুণত্রয়ের উর্ধ্বে আছে অনন্ত কাল এবং অনন্তকালের প্রভাবে ও পরিচালনায় এই গুণগুলির সমন্বয় ঘটে এবং তার ফলে প্রকৃতি সক্রিয় হয়ে ওঠে- একে বলা হয় কর্ম। অনন্তকাল ধরে এই কর্মপ্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। আমরা আমাদের কর্মের ফল স্বরূপ সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করি। যেমন, মনে করা যাক যে, আমি একজন ব্যবসায়ী, তখন আমি যদি বুদ্ধি খাটিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করি, তবে আমি সেই অর্থ উপভোগ করতে পারি। কিন্তু আমি যদি আমার সমস্ত সম্পদ অপচয় করে ফেলি তবে আমাকে ক্লেশ স্বীকার করতেই হবে। সেই রকম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের কর্মের ফলস্বরূপ সুখ অথবা দুঃখ পেয়ে থাকি।
পরবর্তী পৃষ্ঠা