ঈশ্বর সম্বন্ধীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বিষয়ঃ- দেখতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর ক্লিক করুন-
সত্যিই কি ঈশ্বর আছেন?
-শ্রী পতিত উদ্ধারণ গৌর দাস ব্রহ্মচারী
সমগ্র সৃষ্টির ব্যাপারে বৈদিক সিদ্ধান্ত
অভ্রান্ত বৈদিকশাস্ত্রে এর উত্তর প্রদান করা হয়েছে। বেদান্তসূত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে “জন্ম-আদি অস্য যতঃ”। অর্থাৎ প্রকাশিত ব্রহ্মাণ্ডসমূহের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের মূল কারণ হচ্ছেন বাসুদেব অর্থাৎ বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণ। তিনিই পরমেশ্বর। ব্রহ্মসংহিতায়ও বলা হয়েছে-
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্ব্বকারণকারণম্।।
“যে কৃষ্ণকে আমরা গোবিন্দ বলি, তিনিই পরমেশ্বর। তাঁর দেহ সৎ, চিৎ এবং আনন্দময়। তিনিই সবকিছুর আদি উৎস এবং সর্বকারণের পরম কারণ।” শ্রীমদ্ভগবদগীতায় (১০/৮) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে ।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাব সমন্বিতাঃ ॥৮॥
অর্থাৎ “আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সবকিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন। ”
তাই যারা জড়বিদ্যার গর্বে নিজেকে পণ্ডিত বলে মনেকরে কোনোদিন সাধুদের শ্রীমুখ থেকে হরিকথা শ্রবণ করে না, এমনকি নিজে কোনো দিন প্রামাণিক বৈদিকশাস্ত্র অধ্যয়ন করে না বা অধ্যয়ন করলেও নিজের মনের মতো অর্থ করে নেয়, তাদের ঈশ্বর সম্বন্ধে যথার্থ ধারণা নেই। কিন্তু যথার্থ পণ্ডিত এবং ভগবদ্ভক্ত জানেন যে, সত্যিই ঈশ্বর আছেন এবং তিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে ভগবান বিষয়ক সুবিস্তৃত জ্ঞানের সম্যক আলোচনা সম্ভব নয়, এমনকি জাগতিক জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজন হয়। ক্রমান্বয়ে উচ্চতর শ্রেণীতে একই বিষয়ের ওপর গভীর থেকে গভীরতর জ্ঞানের আলোচনা হয়। তাই সাধারণ পদার্থ বা রসায়ন সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের জন্য যদি অ আ ক খ অধ্যয়ন থেকে শুরু করে মোটামুটি ১০-১২ বছরের ধারাবাহিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় এবং বহু বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জ্ঞান লাভের প্রয়াস করতে হয়; তারপরও সেবিষয়ে কেবল সাধারণ কিছু ধারণা পাওয়া যায়; আবার সে বিষয়ের উপর স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পরও সে বিষয়ে সম্যক জানা যায় না।
এ তো গেল প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের একটি অতি ক্ষুদ্র শাখার কথা। তবে পাঠকগণের কাছেই প্রশ্ন- সমস্ত সৃষ্টির অধীশ্বর পরমেশ্বর ভগবান, তাঁর সম্বন্ধে আমরা কেবল ছোট্ট একটা প্রবন্ধ পাঠ করেই কি সম্যক জেনে যাব? এর জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। যদিও এই জ্ঞান অসীম তবুও এ প্রবন্ধে মূলত আমরা প্রকৃতপক্ষেই ভগবানের যে অস্তিত্ব রয়েছে, কেবল সে সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। সে সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। আশা করি এর মাধ্যমে পাঠকগণ সত্যিই যে ভগবানের অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাঁর সম্বন্ধে জানার পন্থা কী? সে সম্বন্ধে একটি পরিষ্কার ধারণা পাবো।
ধারাবাহিকভাবে আমরা ভগবান সম্বন্ধীয় বিভ্রান্তিকর বিষয় সম্বন্ধে শাস্ত্রের আলোকে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করার চেষ্টা করব, যাতে করে পাঠকগণের মধ্যে যাদের ভগবানের প্রতি বিশ্বাস আছে, তাদের বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় হয় এবং যারা ভগবান সম্বন্ধে অজ্ঞ বা কতিপয় ভ্রান্ত মতবাদের স্বীকার হয়ে ভগবানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে, তাদের ভগবানের প্রতি বিশ্বাস জন্মে। এই প্রবন্ধ সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন থাকলে অমৃতের সন্ধানের ঠিকানায় আপনার মতামত ব্যক্ত করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
জয় শ্রীকৃষ্ণ।।
সমগ্র সৃষ্টির রহস্য ও উৎস সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান
ভেবে দেখুন-
কারো যতই ঐশ্বর্য্য (ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা) থাকুক না কেন, তা যদি তিনি কাউকে দেখাতে না পারেন, কাউকে দান করতে না পারেন, সে ঐশ্বর্য্য যদি কারো কাজে না লাগে, কেউ যদি সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশংসা না করেন, তাহলে কি তিনি প্রকৃত তৃপ্তি পাবেন? অবশ্যই না।
কেউ যতই শক্তিশালী হোন না কেন, তা যদি তিনি কাউকে দেখাতে না পারেন, কেউ যদি সে শক্তিমত্তার পরিচয় না পায়, সে শক্তি কারো কাজে না লাগে এবং সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশংসা না করে, তাহলে কি তিনি সত্যিই আনন্দিত হবেন? অবশ্যই না। এমনিভাবে কেউ যতই সুন্দর - সুশ্রী বা সুন্দরী দেখতে হোন না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কেউ তাঁর রূপের প্রশংসা না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি প্রকৃত আনন্দ পাবেন না। অর্থাৎ কেউ যতই গুণবান হোন না কেন, যখন অন্য কেউ সেই গুণের প্রশংসা করবেন তখনই তিনি প্রকৃত আনন্দ পাবেন।
ঠিক এই কারণেই সচ্চিদানন্দময় সর্বশক্তিমান ভগবান নিজেই প্রথমে নিজেকে শ্রীমতি রাধারাণীরূপে সৃষ্টি করলেন এবং উভয়ে এক অপ্রাকৃত আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন।
পরবর্তীতে উভয়ে মিলে সৃষ্টির নব নব আনন্দ আস্বাদনের জন্য একে একে অন্যান্য সকল প্রাণী তথা সমগ্র সৃষ্টিজগৎ রচনা করেন।
"সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই জগতের স্থাবর-জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা তাঁরাই সৃষ্টি করেছেন"
(গীতা-১০/৭)।
সৃষ্টির আদিতে একজনই আছেন বিধায় সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটি সুনির্দিস্ট নিয়মেই চলছে। এক্ষেত্রে একাধিক ভগবান থাকার বা হওয়ার কোন সুযোগই নেই। এপ্রসঙ্গে বলে রাখি ব্রহ্মা, বিষ্ণু , মহেশ্বর (শিব) সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই বিভিন্ন প্রকাশ এবং যত অবতার তাঁরই অংশপ্রকাশ। এছাড়া বিভিন্ন দেব-দেবী, মহাত্মা-ঋষি, এমনকি মানুষ, পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ সকলেই তাঁরই অনন্ত গুণ বা শক্তির অংশ মাত্র। প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ কর্তব্য কর্মে নিয়োজিত থাকার মাধ্যমে তাঁরই ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছেন মাত্র !!!
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দেহে ধারণ করে আছেন। তাইতো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন-
" হে অর্জুন ! আমার এই বিরাট শরীরে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যা কিছু দেখতে ইচ্ছা কর, তা এক্ষণে দর্শন কর।"
(গীতা-১১/৭)
অর্জুন বললেন- " হে দেব ! তোমার দেহে দেবতাদের, বিবিধ প্রাণীদের, কমলাসনে স্থিত ব্রহ্মা, শিব, ঋষিদের ও দিব্য সর্পদেরকে দেখছি।"
(গীতা-১১/১৫)
অর্জুন বললেন-
"আমি দেখছি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত নেই৷ তুমি অনন্ত বীর্যশালী ও অসংখ্য বাহুবিশিষ্ট এবং চন্দ্র ও সূর্য তোমার চক্ষুদ্বয়৷ তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত অগ্নির জ্যোতি এবং তুমি স্বীয় তেজে সমস্ত জগৎ সন্তপ্ত করছ।" (গীতা-১১/১৯)
" তুমি আদি দেব, পুরাণ পুরুষ এবং এই বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি সবকিছুর জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞেয় এবং তুমিই গুণাতীত পরম ধামস্বরূপ৷ হে অনন্তরূপ ! এই জগৎ তোমার দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।"
(গীতা-১১/৩৮)
সেই সৃষ্টির আনন্দ আস্বাদনের সাথে সাথে এক অতি সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত বিধান রচনা করে আমাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে এবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কর্মচক্রে ছেড়ে দিলেন। এবং তাঁর সৃষ্টির শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মায়া সৃষ্টি করলেন ( যাতে আমরা তাঁকে ভুলে না যাই) ।
" দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া । মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।। (গীতা-৭/১৪) অর্থাৎ- আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন। যদিও "কৃষ্ণ ভুলি' সেই জীব অনাদি- বহির্মুখ। অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ ।(চৈ.চঃ মধ্য ২০/১১৭)।। অতএব এ থেকে একটা কথা স্পস্ট যে, আমাদের কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম হল- নিত্য ভগবানের স্মরণ করা, তাঁর গুণগান করা, ( তাঁর মহিমা কীর্তন করা), তাঁর নিকটেই সব কিছু প্রার্থনা করা। এবং সমস্ত প্রকার কর্ম তাঁকে সমর্পণ করে (
কর্মবন্ধন-শূন্য হয়ে কর্ম করে) জীবন পথে এগিয়ে চলা । জয় শ্রীকৃষ্ণ।।
আপনার পছন্দমত
যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন
আপনাদের পোস্টকরা লেখাগুলো দেখতে এই লিংকে ক্লিক করুন ।