" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের মুখবন্ধ

  • পুরাকালীন ভারত - ইতিহাসে রাণী কুম্ভীর জীবন বিরহপূর্ণ হলেও , তিনি বীরাঙ্গনারূপে চিত্রিত হন । ১,১০,০০০ শ্লোক সমন্বিত ভারতের মহাকাব্য মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী কুন্তী ছিলেন পাণ্ডুপত্নী , এবং বিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবের মাতা । পাঁচ হাজার বছর পূর্বে কুরুক্ষেত্রের সর্বগ্রাসী প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধে বিশ্বের ইতিহাসের গতি পরিবর্তিত হয়েছিল । এই জটিল নাটকীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি ছিলেন একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই এই পরিস্থিতির চরম অবস্থা । নীচে মহাভারতে বর্ণিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে-

       পাণ্ডু রাজত্ব লাভ করেছিলেন , কিন্তু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় , তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজসিংহাসন থেকে বঞ্চিত হন । কিন্তু কিছুকাল পরে পাণ্ডু রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন । ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে বিবাহ করেন এবং একশত পুত্র লাভ করেন । কৌরব - বংশের এরাই ছিল শাসনকর্তা । তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন ছিল অত্যন্ত বিষয়াভিলাষী ও ক্রূর ।

       পাণ্ডু ইতিমধ্যে মাদ্রী ও কুন্তী এই দুজনকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন । বিখ্যাত যদুকুলাধিপতি সুরসেনের কন্যা ছিলেন কুন্তীদেবী । তার পূর্বনাম ছিল পৃথা । মহাভারতে কুন্তীদেবী সম্বন্ধে বলা হয় , “ তিনি ছিলেন দিব্য সুন্দরী ও সতীসাধ্বী । তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণা ও সত্যব্রতা । ” তিনি একটি অসাধারণ বর প্রাপ্ত হন । শৈশবে তার পিতা তাঁকে সন্তানহীন ভ্রাতুষ্পুত্র ও অন্তরঙ্গ সখা কুন্তীভোজকে দত্তক কন্যারূপে প্রদান করেন । এই জন্য তাঁর নাম হয় কুন্তী পালক পিতার গৃহে অতিথিসেবার ভার তার উপর অর্পিত হয় । একদিন প্রবল পরাক্রম ঋষি ও যোগী দুর্বাসা মুনি সেখানে আসেন এবং কুম্ভীর নিঃস্বার্থ সেবায় তুষ্ট হন । দুরদর্শী ঋষি কুন্তীর সপ্তান লাভ কঠিন হবে বুঝতে পেরে দুর্বাসা মুনি তাঁকে আশীর্বাদ করেন , যাতে তিনি যে কোন দেবতাকে আহ্বান করে তার দ্বারা সন্তান লাভ করতে পারেন ।

       কুন্তীদেবী পাণ্ডুকে বিবাহ করলে , পাণ্ডু যাতে সন্তান উৎপাদন না করতে পারে , সেই জন্য তিনি অভিশাপ প্রাপ্ত হন । তাই পাণ্ডু সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং সপত্নী কনবাসে জীবন যাপন করেন । পতির অনুরোধে , বিশেষ আশীর্বাদ প্রাপ্ত কুন্তী প্রখ্যাত তিনটি সন্তান গর্ভে ধারণ করতে সক্ষম হন । প্রথমে কুন্তী ধর্মরাজকে আহ্বান করেন । তাঁকে পূজা করার পর এবং দুর্বাসা মুনি প্রদত্ত মধু উচ্চারণ করে তিনি ধর্মরাজের সঙ্গে মিলিত হন এবং এক সন্তান লাভ করেন । সন্তান জন্ম হওয়া মাত্রই এক দৈববাণী হয় , “ এই সন্তানের নাম হবে যুধিষ্ঠির , তিনি অত্যন্ত ধার্মিক হবেন । তিনি হবেন অত্যুত্তম , দৃঢ়প্রতিজ্ঞ , বিষয়বিরাগী ও ত্রিভুবনখ্যাত । "

       এই রকম গুণবান পুত্র লাভের সৌভাগ্য অর্জন করে , পাণ্ডু তখন এক অত্যন্ত শক্তিমান সন্তানের জন্য কুম্ভীকে নির্দেশ দেন । তখন কুন্তীদেবী বায়ুদেবতাকে আহ্বান করেন , যিনি শক্তিমান ভীমকে জন্মদান করেন । ভীমের জন্ম হলে দৈববাণীতে ঘোষিত হয় যে , এই সন্তান সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিমান হবে ।

       তারপর পাণ্ডু তপোবনে ঋষিদের পরামর্শে কুন্তীকে এক বছর কঠোর ব্রত পালনের নির্দেশ দেন । দ্রুত শেষ হওয়ার পরে পাণ্ডু কুন্তীকে বলেন , “ স্বর্গরাজ ইন্দ্র তোমার প্রতি তুষ্ট হয়েছেন , তুমি তাকে আহ্বান কর । ” কুন্তীদেবী তখন ইন্দ্রকে আহ্বান করলে , ইন্দ্র কুম্ভীর কাছে আসেন এবং অর্জুনের জন্ম হয় । রাজপুত্রের জন্ম হওয়া মাত্রই সেই দৈববাণী আকাশে গুরু - গম্ভীরভাবে ঘোষণা করে , “ এই শিশু কার্তবীর্য ও শিবি রাজের মতো পরাক্রমশালী ও রণক্ষেত্রে ইন্দ্রের মতো অজেয় হবে । সে তোমার যশ সর্বত্র বিস্তার করবে এবং বহু দিব্য অস্ত্র প্রাপ্ত হবে । ” পরবর্তীকালে পাণ্ডুর কনিষ্ঠ পত্নী মাদ্রী নকুল ও সহদেব নামে দুই সন্তান লাভ করেন । যুধিষ্ঠির , ভীম , অর্জুন , নকুল ও সহদেব — পাণ্ডুর এই পাঁচ পুত্র তারপর পঞ্চপাণ্ডব নামে অভিহিত হয় ।

       তখন , পাণ্ডু সিংহাসন ত্যাগ করে বনবাস গ্রহণ করায় , পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠির বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র সাময়িকভাবে সিংহাসন গ্রহণ করেন । কিন্তু এই ঘটনার বহুকাল পুর্বেই অভিশাপের ফলে পাণ্ডুর মৃত্যু হয় এবং মাদ্রী পাণ্ডুর শবদাহে আরোহণ করে জীবন বিসর্জন দেন । তার ফলে পঞ্চপাণ্ডব কুন্তীদেবী র প্রযত্নে রক্ষিত হয় ।

       পাণ্ডুর মৃত্যুর পর বনবাসী ঋষিরা কুম্ভীসহ পঞ্চপাণ্ডবকে হস্তিনাপুরে কৌরব সভায় নিয়ে আসেন । পাণ্ডুর মহান বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রের অভিভাবকত্বে পঞ্চপাণ্ডব রাজকীয় পরিবেশে পালিত হয় ।

       কিন্তু সাবলীলভাবে রাজ্যশাসন ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার নয় । ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব হেতু উত্তরাধিকার স্বীকার করলেও পরবর্তীকালে , যুধিষ্ঠিরের পরিবর্তে রাজসিংহাসন লোভী ও ক্ষমতা লোলুপ তার জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনের প্রচেষ্টায় সহায়তা করেন । দুর্জয় ঈর্ষার তাড়নায় দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে , এবং দুর্বল ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিধাগ্রস্ত অনুমোদনে পাণ্ডবদের উপর বহু নির্যাতন ও উৎপীড়ন করে । পাণ্ডবদের জীবননাশে হস্তিনাপুরে সে কয়েকবার প্রয়াসী হয় এবং তারপর সে তাদের এক আঞ্চলিক প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করে । এই সকল ঘটনার সময় তাদের সাহসিনী মাতা কুন্তীদেবী সর্বদাই পাণ্ডবদের সঙ্গেই ছিলেন । প্রিয় সন্তানদের সঙ্গে তিনি দুর্যোধনের এই বর্বরতা সহ্য করেছিলেন ।

       কিন্তু অলৌকিকভাবে কুন্তী ও পাণ্ডবরা বরাবরই মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত হন , কেন না ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লীলা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে জগতে অবতরণ করে তাদের নিজ প্রীতিচ্ছায়ায় আশ্রয় দান করেন । অবশেষে ধূর্ত কূটনীতিবিৎ দুর্যোধন দ্যূতক্রীড়ায় রাজ্য ও স্বাধীনতা থেকে পাণ্ডবদের প্রবঞ্চিত করে । দ্যূতক্রীড়ার ফলে পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদী কৌরবদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন এবং পাণ্ডবরা তের বছর বনবাসে যেতে বাধ্য হন । কুন্তীদেবী এ ঘটনায় শোকে অভিভূত হন ।

       দীর্ঘ ১৩ বছরব্যাপী বনবাসের অবসান ঘটলে , রাজ্য পুণরায় দাবি করার জন্য পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্তন করেন । কিন্তু দুর্যোধন রাজ্যশাসন ক্ষমতা ত্যাগ করতে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে । তারপর যুদ্ধবিগ্রহ দমনের কয়েকটি নিষ্ফল প্রয়াস করে , যুধিষ্ঠির পাণ্ডবদের রাজ্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে স্বয়ং কৃষ্ণকে প্রেরণ করেন । কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় , কারণ হচ্ছে দুর্যোধনের গোঁড়ামি ও জেদী মনোভাব এবং উভয় পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় । বিশ্বযুদ্ধের দৃশ্য রচনা করে , যুধিষ্ঠিরকে রাজসিংহাসনে স্থাপন বা তার বিরোধিতা করে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মহান যোদ্ধারা সমবেত হয় ।

       কুরুক্ষেত্রের ঐতিহাসিক স্থানে ১৮ দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে ; অবশেষে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া কোটি কোটি যোদ্ধা মৃত্যুবরণ করে । এই নির্মম , নিষ্ঠুর গণহত্যায় একমাত্র ভগবান কৃষ্ণ , পাণ্ডবরা ও কয়েকজন রক্ষা পায় । দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা সহ কৌরবপক্ষ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় । প্রতিহিংসা চরিতার্থতায় বেপরোয়া কৌরবপক্ষীয় জীবিত অশ্বত্থামা ঘুমন্ত অবস্থায় দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে । এইভাবে পৌত্রদের জীবনহানির ফলে কুন্তীদেবী অন্তরে গভীর আঘাত পান ।

       পশুর মতো রজ্জুবন্ধনে আবদ্ধ করে অশ্বত্থামাকে পাণ্ডবদের শিবিরে আনা হয় । কুন্তীদেবীর পুত্রবধূ ও নিহত সন্তানদের মাতা অপার করুণাময়ী দ্রৌপদী অশ্বত্থামার প্রাণ ভিক্ষা করে তাকে মুক্ত করে দেন । কিন্তু নির্লজ্জ অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের ( উত্তরাধিকারী শেষ বংশধর উত্তরার গর্ভস্থ পৌত্রকে সজোরে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে

       নিহত করার আর একবার প্রয়াস করে । তার প্রতি ধাবিত ক্ষেপণাস্ত্রটি দেখে , উত্তরা পরম ঐশ্বর্যপূর্ণ রাজধানী দ্বারকার উদ্দেশ্যে যাত্রায় উদ্যোগী ভগবান কৃষ্ণের শ্রীচরণে আশ্রয় গ্রহণের জন্য তৎক্ষণাৎ ধাবিতা হন । কৃষ্ণ তাঁর সুদর্শনচক্র দ্বারা দুর্দমনীয় তাপ ও আলোককে দমন করে পাণ্ডব ও তাঁদের মাতা কুন্তীদেবীকে আসন্ন মৃত্যু থেকে রক্ষা করেন ।

       এই চরম দুর্দশা থেকে পাণ্ডবদের উদ্ধার করে এবং নিজের সকল পরিকল্পনাগুলি সফল হতে দেখে , ভগবান কৃষ্ণ আবার বিদায় নিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন । বহু বছরব্যাপী দুর্যোধন কুন্তীদেবী র পরিবারকে উৎপীড়ন করে । কিন্তু প্রতিটি বিপদের মুহূর্তেই কৃষ্ণ তাঁদের রক্ষা করেছেন । আর তিনিই আজ তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন । কুন্তীদেবী অভিভূত হয়ে তার হৃদয়ের অস্তস্তল থেকে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বন্দনা করেন ।

       কুন্তীদেবী ছিলেন কৃষ্ণের পিতৃষ্বসা । ভগবানের সঙ্গে এই সামাজিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভগবানের সর্বোত্তম দিবা স্বরূপ তিনি সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন । কুন্তীদেবী জানতেন যে , আসুরিক সামরিক শক্তির কবল থেকে জগৎকে উদ্ধার করে ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ নিজালয় ভগবদ্ধাম থেকে অবতরণ করেছিলেন । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অনতিপূর্বে কৃষ্ণ ভগবদ্গীতার ( ৪ / ৭-৮ ) অমরবাণীর মাধ্যমে কুন্তীপুত্র অর্জুনকে এই সত্য প্রকাশ করেছেন ।

       হে ভারত , যখন ধর্মের গ্লানি হয় ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয় , তখন আমি জগতে অবতরণ করি । ধর্ম পরায়ণদের উদ্ধার , দুর্বৃত্তদের বিনাশ ও ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আমি যুগে যুগে স্বয়ং আবির্ভূত হই ।

       অসাধু কৌরবদের বিনাশ দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লক্ষ্য— ' দুর্বৃত্তদের নাশ ' কার্য সম্পন্ন করেন । তারপর পাণ্ডব - শাসন স্থাপনের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন এবং মৃত যোদ্ধাদের স্বজনদেরকে সান্ত্বনা প্রদান করেন । কৃষ্ণের আসন্ন বিদায় দৃশ্যে কুন্তীদেবীর মহিমাময় কৃষ্ণবন্দনা রচিত হয় ।

       কুন্তীদেবী ভগবানের রথের দিকে অগ্রসর হন এবং তাঁকে বন্দনা করতে শুরু করেন । তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণকে হস্তিনাপুরে থাকতে অনুপ্রাণিত করা এবং প্রতিহিংসা পরায়ণদের হাত থেকে পাণ্ডব শাসনকে রক্ষা করা । কুন্তীদেবী ভাবে আবিষ্ট হয়ে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বলেন-

       হে ভগবান, ... আজ যখন আমরা শত্রুকুল দ্বারা পরিবেষ্টিত , আমাদের যখন কোন রক্ষাকর্তা নেই , আমরা যখন সম্পূর্ণভাবে তোমার কৃপাচ্ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে আছি , তখনই কি তুমি আমাদের পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছো ? ( ভাঃ ১/৮/৩৭ )

       কুন্তীদেবীর এই হৃদয়স্পর্শী আবেদনকে স্বার্থান্বেষী মনে করে আমাদের ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত করা উচিত নয় । সাধারণের অসহনীয় এই দুঃসহ মর্মবেদনা থেকে শান্তির জন্য তিনি কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেননি । পক্ষান্তরে তিনি এমন কি আরও দুঃখক্লেশ প্রার্থনা করেছেন , কেননা তার যুক্তি হচ্ছে , এই মর্মবেদনাই কৃষ্ণের প্রতি তার অনন্যা ভক্তিকে আরও গভীর করে তুলে তাকে পরম সিদ্ধি প্রদান করবে ।

       হে কৃষ্ণ , বিষময় পিষ্টক , অগ্নিদাহ , নরখাদক রাক্ষস , দুরভিসন্ধিময় সভাসদ , বনবাস ক্লেশ এবং যুদ্ধে মহারথীদের আক্রমণ থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করেছিলে ..... … ..... আমি কামনা করি যে , ঐসব বিপর্যয় আমাদের জীবনে বারবার আসুক , তা হলে আমরা তোমার শুভ দর্শন প্রাপ্তির সৌভাগ্য লাভ করব । কারণ , তোমার মঙ্গলময় দর্শনের ফলে আমরা আর জন্ম - মৃত্যুময় ভব সংসার দর্শন করব না । ( ভাঃ ১ / ৮ / ২৪-২৫ ) এক সাধ্বী , মহিয়সী ভগবদ্ভক্ত দেবী কুন্তীর সরল ও আবেগময় দিব্যজ্ঞানপ্রদ কথাগুলি ভগবানের প্রতি তার গভীরতম ভালবাসা ব্যক্ত করছে । তেমনিই এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে তার গভীর তত্ত্বজ্ঞান ও বিদ্বৎপ্রতীতি প্রকাশিত হয়েছে । তার এই আবেগময়ী কথাগুলি জ্ঞানগর্ভ ভগবৎ - প্রেম প্রণোদিত এক অদ্বিতীয় কৃষ্ণবন্দনা ।

       হে মধুপতি , গঙ্গা যেমন অব্যাহতভাবে সমুদ্র অভিমুখে ধাবিতা হয় , ঠিক তেমনই অন্যমুখী না হয়ে তোমার প্রতি আমার ভক্তি অপ্রতিহতভাবে প্রবাহিত হোক । ” ( ভাঃ ১/৮/৪২ )

       কুন্তীদেবীর এই পরমার্থ সাধনের বর্ণনা ও তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত কৃষ্ণবন্দনাগুলি মহাভারত ও ভাগবত পুরাণে অমর হয়ে আছে । হাজার হাজার বছর ধরে মুনি ঋষিরা এগুলি প্রার্থনা করেছেন , গান গেয়েছেন ও কীর্তন করেছেন ।

       শ্রীমদ্ভাগবতের ২৬ টি শ্লোক সমন্বিত কুন্তীদেবীর এই কৃষ্ণবন্দনাগুলি প্রথম স্কন্ধে আবির্ভূত হলেও দর্শন তত্ত্ব ও ভগবৎ - সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বলে বিবেচিত । বর্তমান কালের যুগাচার্য ও বৈদিক জ্ঞান ভাণ্ডারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকারী আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীশ্রীমৎ অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ Teaching of Queen Kunti ( কুন্তীদেবীর শিক্ষা ) নামক গ্রন্থটিতে কৃষ্ণভক্তি উদ্দীপক এই শ্লোকগুলির উপর দিব্য জ্ঞানপ্রদ অপুর্ব ভাষ্য রচনা করেছেন । প্রথমে ১৯৬২ সালে এই শ্লোকগুলির তাৎপর্য লেখা হলেও পরবর্তীকালে ভাষণের মাধ্যমে শ্রীল প্রভুপাদ এই গ্রন্থের শ্লোকগুলির আরও বিশদ বিশ্লেষণ করেন । ১৯৭৩ সালে পাশ্চাত্য জগতে ইস্কনের প্রধান কার্যালয় লস এঞ্জেলেসে প্রদত্ত এই হরিকথামৃত

       পরিবেশনের সময় , প্রভুপাদ শ্লোকগুলির আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে এই প্রসঙ্গে আরও আলোকপাত করেন ।

       রঙিন ও অদ্বিতীয় চিত্র সমন্বিত ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্টের প্রকাশিত এই নতুন গ্রন্থটি জীবন - রহস্য সম্পর্কে গভীরভাবে তত্ত্বান্বেষী সকলের গ্রন্থাগারে এক অমূল্য সম্পদরূপে গণ্য হবে । একজন তত্ত্বদর্শী মহাভাগবতের লেখা এই গ্রন্থটি দিব্যজ্ঞান ও পরমতত্ত্ব উপলব্ধির পথে প্রত্যেক পাঠককে নিশ্চিত পথনির্দেশ প্রদান করবে । -শ্যামরূপ দাস ব্রহ্মচারী

  • এখন দেখতে পারেন => কুন্তীদেবীর শিক্ষা গ্রন্থের মুখবন্ধ অথবা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ১ ) আদি পুরুষ –
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।

    Say something

    Please enter name.
    Please enter valid email adress.
    Please enter your comment.