সকল মানুষের জন্য সর্বোত্তম কল্যাণ কর্ম :
ভক্তদেরকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে দেখে অনেকে তাদের বলে, “আপনারা কেবল সারাক্ষণ হরেকৃষ্ণ জপ করেন, দরিদ্র মানুষদের জন্য আপনারা কিছু করেন না কেন? রোগাক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বা দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরী করেন না কেন? অন্ততঃ এভাবে তো মানুষের কিছু সেবা করা যায়?” আপনি যদি ভক্ত হন তাহলে প্রায়ই আপনাকে এই প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হবে। তার কারণ হচ্ছে, কেউ যদি কৃষ্ণভক্তির অমৃতময় আস্বাদন সামান্য মাত্রও লাভ না করে, তাহলে সে প্রথমে কৃষ্ণভাবনামৃতের দিব্য মহিমা অনুভব করতে পারবে না।
জড় শরীরটির যত্ন গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু দেহটি ব্যক্তি নয়; প্রকৃত ব্যক্তি আত্মার যত্ন গ্রহণ না করলে, আত্মার প্রয়োজনগুলিকে অবহেলা করে কেবল নশ্বর জড়শরীরের পরিচর্যা আত্মহত্যারই নামান্তর মাত্র। জড় শরীরের যত্নগ্রহণের পাশাপাশি অকৃত্রিম শুদ্ধ পারমার্থিক শিক্ষা প্রদান ও অনুশীলনের দ্বারা আত্মার পুষ্টিবিধানের গুরুত্ব বোঝাতে শ্রীল প্রভুপাদ কৃপাপূর্বক বহু বহু দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছেন। তার মধ্যে একটিঃ এক মহিলা একটি সুন্দর তোতা পাখী পুষতে শুরু করেন। সুন্দর ঐ পাখীটির জন্য তিনি একটি বহুমূল্য সোনার খাঁচা কেনেন। সেই খাঁচায় পাখীটিকে রেখে তিনি গভীর মনোযগ সহকারে বহুমূল্য খাঁচাটির যত্ন নেওয়া শুরু করেন। প্রত্যেক দিন তিনি খাঁচাটি মুছতেন, পরিষ্কার করে উজ্জ্বল ঝকঝকে করে রাখতেন। এক সপ্তাহ পরে যখন তাঁর এক বান্ধবী তাঁর বাড়ীতে আসেন, তিনি সব দেখে তাঁকে ডেকে সবিস্ময়ে বলেন, “একি! তুমি পাখীর খাঁচাটিকে তো খুবই পরিচর্যা করছ, কিন্তু এতে পাখীটির কি উপকার হচ্ছে? পাখীটার কি হাল হয়েছে একবার দেখেছ? ওটাতো মৃত্যুপথযাত্রী!”বর্তমান যুগে ঠিক একইভাবে মানুষ সম্পূর্ণভাবে দেহ-সচেতন, বাহ্যিক দেহ- খাঁচাটির পরিচর্যায় মশগুল। তারা দেহ পরিচর্যার জন্য বছরের পর বছর শিক্ষা গ্রহণ করে; এর জন্য খাদ্য ও বিলাসবহুল বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। দেহকে সুস্থ রাখতে গিয়ে তারা জিমে গিয়ে কসরৎ করে। দেহের জন্য তারা কত ব্যয় করে, ভালো পোশাকে, অলংকারে এটিকে সাজায় এবং দেহের সবরকম সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করার জন্য সর্বদাই কর্ম-তৎপর থাকে; তারা জানে না যে এই জড় দেহটি আসলে ব্যক্তি আত্মার একটি অস্থায়ী আচ্ছাদন মাত্র। এইজন্য যেহেতু তারা আত্মার জন্য পারমার্থিক খাদ্যের ব্যবস্থা করে এর পুষ্টিবিধান করে না, সেজন্য তারা তাদের সবরকম প্রয়াস সত্ত্বেও সুখী হতে পারে না; তারা জানে না যে যথার্থ আনন্দময় জীবন হচ্ছে পারমার্থিক জীবন।
প্রকৃত কল্যাণ কর্ম হচ্ছে আত্মোপলব্ধি লাভ করে নিজ কর্তব্য পালন করা এবং অপরদের মধ্যে একই পারমার্থিক শিক্ষার বিস্তার করা। একজন ধনবান, কোটিপতি জমিদার ছিলেন। একবার তিনি সাঁতার কাটতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হন- স্রোত তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তাকে ডুবে যেতে দেখে সবাই চিৎকার করতে লাগল, “বাঁচাও, বাঁচাও! – জমিদারমশাইকে বাঁচাও!” তখন একজন সবল-দেহী যুবক এগিয়ে এলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই, সে দেখল যে জমিদার একটি বহু মূল্য সোনালী কোট পরে আছেন। তা দেখে যুবকটি তৎক্ষণাত জলে ঝাঁপ দিল। সে গিয়ে ডুবন্ত জমিদারের দেহ থেকে সুদক্ষভাবে কোটটি নিয়ে তীরে উঠে এল। অল্পক্ষণের মধ্যেই, বলা বাহুল্য, জমিদার অদৃশ্য হয়ে গেলেন- তার সলিল সমাধি হল। তখন সেই যুবক ঐ সোনালী কোটটি সকলকে দেখিয়ে বলল, ‘যাক্, বহুমূল্য কোটটাকে বাঁচাতে পেরেছি! একেবারে নষ্ট হয়ে যেত!’
আপনার কি মনে হয়- মানুষ এর জন্য কি তাকে খুব বাহবা দেবে? লোকেরা তাকে ভৎর্সনা করে বলল, “মূর্খ! তুমি যদি স্বয়ং জমিদারকে বাঁচাতে, তাহলে তার কিছু ভাল করতে পারতে। তিনি ডুবে যাচ্ছেন, আর তাঁর কোটটা নিয়ে তুমি চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছো! তিনি বেঁচে ফিরলে তো তোমাকে লক্ষ লক্ষ টাকা বকশিশ দিতেন!”
উপরের দুটি গল্পের নীতিকথা হচ্ছে এই যে আত্মার প্রয়োজনগুলিকে অবহেলা করে কেবল দেহের আরাম-বিলাসগুলি বৃদ্ধি করে চলা উচিত নয়। এই জড়দেহটি একটি জামার চেয়ে খুব বেশি ভাল কিছু নয়। অবশ্য মানুষ প্রায়ই এই বিখ্যাত প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করে, “আগে পেট না ভরলে মানুষ কিভাবে ভগবানের আরাধনা করবে বলে আপনি আশা করেন?” আমরা বলি, “হ্যাঁ, আমরা মানুষকে সুস্বাদু কৃষ্ণপ্রসাদ ভোজন করাব- আত্মা ও দেহ উভয়েরই এর ফলে পুষ্টি হয়।” বিখ্যাত সেই প্রবাদ বাক্যে যেমন বলা হয়েছে,
“ভগবান প্রত্যেকের যা প্রয়োজন, তা দিয়েছেন, যতটা লোভ, ততটা দেন নি।”*
পৃথিবীতে খাদ্য ও অর্থের কোনো অভাব নেই; পর্যাপ্ত পরিমাণে তা রয়েছে। কিন্তু তবু পৃথিবীর মানুষ নানা সমস্যায় কবলিত, কেননা তাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের কর্তৃত্ব স্বীকার করে না,
এবং তাঁরা আইন লঙ্ঘন করে নানাবিধ পাপকর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। তাঁরা লোভী, বিষয়ভোগ তৃষ্ণায় আকুল;
আরো আরো ধন সম্পদ সঞ্চয় করার জন্য তাঁরা একে অপরকে শোষণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আজাকাল যদি আপনি কোনো ভিখারীকে কিছু খাবার দেন,
সে নিতে চাইবে না সে টাকা চাইবে, কেননা টাকা হলে ধুমপান সহ নানারকম নেশা ভাঙ করা যায়।
সুতরাং মানুষ যতক্ষণ পাপময় কার্যকলাপ বন্ধ না করছে, ততক্ষণ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান কাজ-অর্থ-স্বাচ্ছন্দ্য – কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না, মানুষের জীবন যাপনে শান্তি আসবে না।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, “পাপকর্মের মূল কারণ হচ্ছে ভগবানের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার মাধ্যমে ভগবৎ-প্রদত্ত আইনগুলিকে সুপরিকল্পিতভাবে অমান্য করা।”
সুতারং ভগবানের কর্তৃত্ব, তাঁর অধীনতা স্বীকার করতে না চাওয়ার এই বিদ্রোহী স্বভাবের জন্য জীবসত্তাসমূহ এ-জগতে দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত হতে থাকে।
আজ আমি একজনকে কিছু খাদ্য দিলাম, কিন্তু কাল আবার সে ক্ষুধার্ত হবে। ভিখারীকে যদি চাকরী বা ব্যবসা করতে দেওয়া হয়, আর কিছু দিন পর যদি সে বছরে কয়েক কোটি টাকাও মুনাফা করে, সে আরো চাইবে- এতে তৃপ্ত হবে না। সে অর্থচিন্তায়, নানা পরিকল্পনায় আমৃত্যু মশগুল থাকবে- শান্ত হতে পারবে না। পরম পরিতৃপ্তি, সন্তোষ একজন ভক্তই কেবল লাভ করতে পারেন, কেননা শ্রীভগবানের প্রীতিবিধান ব্যতীত তাঁর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তিনি ধনীই হোন বা দরিদ্র হোন, ভগবান তাঁকে যা দিয়েছেন, সেটাকে তিনি ভগবানের করুণা রূপে গ্রহণ করেন এবং সুখে জীবন কাটান। অন্তহীন তৃষ্ণার আগুন তাঁর মনকে নিরন্তর দগ্ধ করে না, শত শত আশা-বাসনা তাঁর চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে না। সুতরাং, জনগণকে প্রকৃত ধর্ম-শিক্ষা দানের মাধ্যমে তাদেরকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। বিশ্বজুড়ে ভগবৎ-চেতনার প্রসারই হচ্ছে বিশ্বের মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির একমাত্র উপায়। কৃষ্ণভাবনামৃত দর্শন পৃথিবীর সকল সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক সমস্যার সমাধান। ব্যক্তিগতভাবে যেকোন মানুষ যখন ভগবানের কর্তৃত্ব স্বীকার করে, কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে, তখন সে শান্তি লাভ করে, হৃদয়ে যথার্থ সুখ অনুভব করে।
যিনি ভগবৎচেতনা দান করেন, তিনিই যে সর্বশ্রেষ্ঠ শুভানুধ্যায়ী, সে বিষয়ে একটি সুন্দর গল্প আছে। একবার একজন কোটিপতি ধনী ব্যক্তি একটি বড় উৎসবের সময় তাঁর ছোট শিশুপুত্রকে হারিয়ে ফেলেন। তিনি সমস্ত সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন, কিন্তু তাঁর পুত্রের কোনো সংবাদ পেলেন না। উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর একাকী শিশুটি একটি ভিখারী অনাথের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পরপর চারজন লোক তাকে দেখলেন। প্রথম মানুষটি দেখলেন যে শিশুটি ক্ষুধার্ত। তার প্রতি করুণাপরবশ হয়ে তিনি তাকে কিছু খাবার দিলেন। দ্বিতীয় মানুষটি দেখলেন যে শিশুটির জামা-প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে, শীতের পোশাকও নেই। দয়াপরবশ হয়ে তিনি তাকে এক সেট নতুন পোশাক, চাদর কিনে দিলেন। তৃতীয় মানুষটি দেখলেন যে শিশুটির দেহে একটি ক্ষত স্থান রয়েছে, সেটি নিরন্তর তাকে কষ্ট দিচ্ছে; তিনি সেখানে লাগানোর জন্য কিছু ওষুধ-পত্র তাঁকে এনে দিলেন। কিন্তু যখন চতুর্থ মানুষটি তাঁকে দেখলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যে শিশুটি একজন ক্রোড়পতির পুত্র, যাকে তিনি চিনতেন। তিনি ঐ শিশুটির প্রতি প্রবল করুণা অনুভব করলেন। তাঁকে সংগে নিয়ে তিনি ক্রোড়পতি পিতার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, এবং পরিশেষে শিশুটিকে তাঁর পিতার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। এই চারজনের মধ্যে কাকে আপনি ঐ শিশুটির সবচেয়ে বড় কল্যাণকারী বলে মনে করেন?
স্পষ্টতঃই চতুর্থ মানুষটিই ঐ শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গল করেছেন, কেননা,
যখন শিশুটি গৃহে ফিরে এল, পিতা অপরিসীম স্বস্তি ও আনন্দ অনুভব করলেন। তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে আলিঙ্গন করে প্রেম প্রীতিতে তাঁকে নিঃস্নাত করলেন। শিশুটির সকল কষ্ট তিরোহিত হল; তার যখন খাবার প্রয়োজন হল, অজস্র সুস্বাদু অন্ন-ব্যঞ্জনে তাঁকে ভুরিভোজন করানো হল। তাকে একঘর ভর্তি সুন্দর পোশাক পত্র দেওয়া হল- ইচ্ছামত বেছে নেওয়ার জন্য। তার অন্যান্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-বিলাসের কোনো অভাব ছিল না- পর্যাপ্ত পরিমাণে সে পেতে থাকল। গভীর পিতৃস্নেহে তাঁর পূর্বের দুঃখময় স্মৃতি মন থেকে মুছে গেল। এইভাবে তাঁর পিতার সংগে মিলিত হওয়ার ফলে শিশুটি সর্বতোভাবে সুখী হল।
এই উপমাটিতে, প্রথম যে তিনজন মানুষ শিশুটিকে খাদ্য, বস্ত্র ওষুধ দিয়েছিল, তাদের তুলনা করা যায় সমাজসেবীদের সংগে। সমাজসেবীরা মানুষের জন্য কতরকম ‘ভাল’ কাজ করে থাকেনঃ দরিদ্রদেরকে খাওয়ানো, দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরী, বিদ্যালয় স্থাপন ইত্যাদি। মানুষ এই সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে ক্ষণস্থায়ী সুখ লাভ করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান যে জড় দেহজাত চারটি সমস্যা - জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি-
এগুলিকে বন্ধ করা যাবে কিভাবে? কে তাদেরকে ভগবৎ-তত্ত্ব জ্ঞান দান করবে? অজ্ঞান্তার গভীর তমিস্রা থেকে মুক্ত করে কে তাদের জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করবে, ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে সাহায্য করবে?
যিনি শিশুটিকে তার পিতার কাছে, তার নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন একজন ভগবদ্ভক্তের মতো। ভগবানের শুদ্ধভক্ত কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের মাধ্যমে জীব-সত্তাকে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাকে পরমপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে, তাঁর ধামে কৃষ্ণলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যান, আর শ্রীকৃষ্ণই আমাদের চির-শুভাকাঙ্ক্ষী, শাশ্বত পিতা। আর একবার যদি আপনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যান, তখন আপনার সমস্ত প্রয়োজন, অভাব, চাহিদা পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
“জয় শ্রীকৃষ্ণ”।।