স্থুল দেহ ও সূক্ষ্ম দেহ
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় বলেছেনঃ
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বং ইদং ততম্।
বিনাশং অবিনাশ্যস্য ন কিঞ্চিৎ কর্তুমর্হসি।।
“সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে যে অক্ষয় আত্মা, জেনে রেখো তাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।” (ভ.গী.– ২/১৭)
ভগবদগীতা অনুসারে, আপনি এই দেহ নন। আপনি মন নন। আপনি বুদ্ধিও নন, আপনি মিথ্যা অহঙ্কারও নন। আপনি এই জড় দেহের সমস্ত জড় পদার্থের অতীত বস্তু। আপনি হচ্ছেন সেই চেতনা, সারা দেহে যা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। আপনি হচ্ছেন চির অবিনাশী আত্মা। এরপর শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
“ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কারং ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।”
“ভূমি, জল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার- এই অষ্ট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।” (ভ.গী. ৭/৪)
এই উপাদানগুলি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। স্থূল শরীর তৈরী হয়েছে উপরোক্ত প্রথম পাঁচটি উপাদান দিয়েঃ ‘ভূমি’ বলতে বোঝায় সমস্ত কঠিন পদার্থকে। জল বলতে বোঝায় সমস্ত তরল পদার্থ। অগ্নি হচ্ছে আলোক ও তেজ (তাপ)। বায়ু হচ্ছে সমস্ত গ্যাসীয় পদার্থ। আকাশ হচ্ছে শূন্যস্থান (ইথার) এবং শব্দ। স্থূল দেহে এই পাঁচটি পদার্থ রয়েছে।
সূক্ষ্ম শরীর তিনটি সূক্ষ্ম উপাদান দ্বারা গঠিতঃ মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহংকার (ভ্রান্ত ‘আমি’ বোধ)। প্রকৃত অহঙ্কার হচ্ছে এই উপলব্ধিঃ ‘আমি চিন্ময় আত্মা, কৃষ্ণের নিত্য দাস’। মিথ্যা অহঙ্কার হচ্ছে মোহগ্রস্ত অবস্থায় এই রকম চিন্তা করা, “আমি এই দেহ।” সূক্ষ্ম দেহ ও স্থূল দেহ হচ্ছে চেতনার উপর জড়ীয় আবরণ। এইরকম সূক্ষ্ম এবং স্থূল দেহে বদ্ধ একটি জীবাত্মাকে বলা হয় ‘বদ্ধ জীব’। যিনি এইরকম আবরণ থেকে মুক্ত এবং ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হন, তাঁকে বলা হয় মুক্তাত্মা। তারপর শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্।
জীবভূতং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।
“হে মহাবাহো ! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে।” (ভ.গী. ৭/৫)
মানুষ কি কেবল একটি শক্তিশালী কম্পিউটার/ রোবট?
কম্পিউটারের হার্ডওয়ারটি কতকগুলি নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (এই সব নির্দেশগুচ্ছের জন্য নানারকম ভাষাও রয়েছে, যেমন ফরট্রান, বেসিক, অথবা সি প্লাস প্লাস, ইত্যাদি)। এটি স্পষ্ট যে একটি কম্পিউটারকে কার্যক্ষম হওয়ার জন্য অবশ্যই একজন বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা নির্দেশিত (প্রোগ্রাম্ড্) হতে হয়। যে-ক্ষমতাই একটি কম্পিউটারের থাকুক না কেন, তা সে সংখ্যার কচকচি, তথা সংরক্ষণ, বস্তু সনাক্তকরণ, বা স্বাভাবিক ভাষার প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি যাই হোক না কেন- তার সমস্ত ক্রিয়াক্ষমতাই একজন সংবেদনশীল চেতন মানুষ-এর দ্বারা প্রদত্ত। অন্য কথায়, যদি কম্পিউটারের কার্যনির্দেশক বা প্রোগ্রামার কম্পিউটার-সিস্টেমকে দুই যোগ দুই = পাঁচ, এই অঙ্ক কষতে প্রোগ্রাম করে রাখে, তাহলে কম্পিউটার ঐরকমই করবে। ঠিক সেই রকম দেখার ক্যামেরা-ব্যবস্থার সংগে সংযুক্ত কোনো কম্পিউটারকে যদি কোনো ঘনকাকৃ্তি (স্কয়ার)বস্তুকে গোল বলে সনাক্ত করার প্রোগ্রাম করা থাকে, তাহলে সেটি তাই-ই করবে। কম্পিউটার নিজে থেকে কোনো কিছুই বুঝতে পারে না। প্রোগ্রাম করা না থাকলে শুধু কম্পিউটারটি কেবল একটি বোবা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি নাটকাভিনয়ের কথা মনে করুন। একদল বিচারকমণ্ডলী নাটকটি দেখছেন, আর একটি ভিডিও ক্যামেরার দ্বারা পুরো নাট্যাভিনয়টি রেকর্ড করা হচ্ছে। বিচারক অভিনীত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করতে তাঁর চোখকে ব্যবহার করছেন, আর ভিডিও ক্যামেরাটি সমস্ত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করছে লেন্সের মাধ্যমে, যা চোখেরই যান্ত্রিক রূপায়ণ বা মেশিন-এনালগ। ঐ দর্শন –যন্ত্র এবং মানুষ – উভয় পর্যবেক্ষক তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করছে, কিন্তু মানুষ-পর্যবেক্ষক পরিদৃশ্যমান ঘটনাবলীকে “উপলব্ধি”-ও করছে। দৃষ্টন্তস্বরূপ, বিচারকমণ্ডলী একটি আবেগময় নাটকের সমগ্র আবেগমথিত দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করলেন, তাঁরা নাটকে গর্ব, দুঃখ, প্রকাশিত হতে দেখলেন। অপরদিকে ভিডিও ক্যামেরাটি আবেগ-অনুভূতিহীনভাবে কেবল কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন ও শব্দাবলী রেকর্ড করল। নাটক সমাপ্ত হলে বিচারকমণ্ডলী তাঁদের চোখের সামনে দৃশ্যায়িত দৃশ্য-চিত্রের ভিত্তিতে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়কারীকে নিরূপণ করলেন। কিন্তু ভিডিও ক্যামেরাটি কি ঐরকম কোন সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম- যদিও সে নাটকের প্রতিটি দৃশ্যই অভ্রান্তভাবে রেকর্ড করে রেখেছে?
পার্থক্যটি হচ্ছে এই যে, যদিও মানুষ ও ক্যামেরা – উভয় পর্যবেক্ষকই নাটকটি নিরীক্ষণ করছে, মানুষ হচ্ছে “চেতন”, কিন্তু ক্যামেরাটি সম্পূর্ণরূপে চেতনাহীন। সুতরাং মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে চেতনা- চেতনাগত পার্থক্য।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )