আমি কি ভগবান?
ভারতবর্ষে বর্তমানে অদ্বৈতবাদ, অর্থাৎ “আমি ভগবান। তুমি ভগবান। প্রত্যেকেই ভগবান” – এই দর্শন খুবই প্রচলিত। এই ধরণের দর্শন সেই সব বদ্ধ জীবাত্মাদের অন্তরে অসীম সন্তোষ প্রদান করে থাকে, যাদের ভোক্তা ও নিয়ন্তা হবার বাসনা প্রবল। বদ্ধ জীবাত্মা এমন ভোক্তা ও নিয়ন্তা হতে চায়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কেউ কি আছে যে নিয়ন্ত্রণাধীন, নিয়ন্ত্রিত নয়? সংজ্ঞানুসারে ভগবান পরম স্বরাট্, স্বাধীন স্বতন্ত্র পুরুষ এবং তিনি কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নন। তিনিই পরম নিয়ন্তা। জীব অবিনাশী, শাশ্বত, অব্যক্ত এবং অচিন্ত্য, কিন্তু তবুও সে কি ভগবান হতে পারে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর আপনার পারমার্থিক জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ভগবদগীতা এ-বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে জীব কখনো ভগবান নয়, কখনো সে ভগবান হতেও পারবে না; সমস্ত জীবসত্তা ও ভগবান নিত্য স্বতন্ত্র, যদিও উভয়ে চিন্ময়, সেজন্য গুণগতভাবে উভয়েই এক। জীব ক্ষুদ্রচিদ্ অণু, তাই সূর্যের কিরণকণা যেমন সূর্যের মতো ধর্ম বিশিষ্ট হলেও স্বয়ং সূর্য নয়, তেমনি চিৎ-কণাজীব ভগবানের মতো চিদ্ধর্ম বিশিষ্ট হলেও পরিমাণগতভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। ভগবদগীতায় এটাও দ্বার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে এমনকি মোক্ষ বা মুক্তিলাভের পরও জীব আত্মস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ভগবানে একীভূত হয়ে যায় না; প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বই শাশ্বত। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে (১৫/১৬)ঃ
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ।
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।
“ক্ষর এবং অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতে প্রতিটি জীবই ক্ষর এবং চিজ্জগতে প্রতিটি জীবই অক্ষর।”
এই জগতে আমরা যারা আমাদের শাশ্বত চিন্ময় স্বরূপ সম্বন্ধে অসচেতন, তারা ক্ষর (পরিবর্তনশীল দেহ-সম্পন্ন জীব)। এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মা থেকে শুরু করে নগণ্য একটি পিঁপড়ে পর্যন্ত যে জীব-সত্তাই জড়ের সংস্পর্শে এসেছে, জড়-পদার্থের আবরণে তৈরী দেহাবয়ব ধারণ করেছে, সে ক্ষর। কিন্তু চিন্ময় জগতে দেহটি জড় পদার্থের তৈরী নয়, সেজন্য সেই দেহে কোনো পরিবর্তন হয় না; ঐ চিদ্-দেহ চির-শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়। ঐ দেহে কখনো জরা-ব্যাধি-বার্ধক্য আসে না, সেই দেহের জন্ম-মৃত্যুও নেই। যে সব জীবসত্তা চিন্ময় জগতে পরম পুরুষ ভগবানের সংগে আনন্দবিলাসরত, তাঁরা সকলেই অক্ষর (অপরিবর্তনীয়), তাঁরা অনন্তকালের জন্য অপরিবর্তনীয় শাশ্বত আনন্দময় স্বরূপ-বিশিষ্ট।
উত্তম পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃঢ়ঃ।।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।।
“এই উভয় পুরুষ থেকে ভিন্ন, পুরুষোত্তম, পরমাত্মা রূপে সমগ্র বিশ্বে প্রবেশ করে তাদের পালন করেন” (ভ. গী. ১৫/১৭)। এখানে এটা অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে অগণিত জীবসত্তা-সমূহের মধ্যে কিছু জীব বদ্ধ, এবং অন্য সমস্ত জীব মুক্ত; এবং এই বদ্ধ ও মুক্ত (ক্ষর ও অক্ষর) উভয় জীবসত্তার মধ্যে পরম পুরুষোত্তম হচ্ছেন পরমাত্মা, ভগবান।
পরমাত্মাঃ জীবাত্মার বন্ধু
যখন জীবাত্মা এই জড় জগতে পতিত হয়, তখন তাকে নানা দেহে দেহান্তরিত করা, তার তত্ত্বাবধান করা এবং তাকে পথনির্দেশ দানের জন্য পরমপুরুষ ভগবানের এক প্রকাশ জীবাত্মার সঙ্গী হন। শ্রীকৃষ্ণের এই প্রকাশ প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন- ঈশ্বর সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঃ অর্জুন তিষ্ঠতি- ভ. গী. ১৮/৬১), এবং প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যেও তিনি প্রবেশ করেন (পরমাণুচয়ান্তরস্থং, ব্রহ্মসংহিতা – ৩৫)। তাঁকে বলা হয় পরমাত্মা।
দুই প্রকারের আত্মা রয়েছেঃ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিৎ-কণ (অণু-আত্মা, জীবাত্মা), এবং পরম আত্মা (বিভু-আত্মা, পরমাত্মা)। জীবাত্মার অর্থ একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা, পরমাত্মার অর্থ একজন পরম ব্যক্তিসত্তা। জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়েরই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে, উভয়েই ব্যক্তিত্ব সমন্বিত। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, জীবাত্মা কেবল একটি বিশেষ দেহে আবদ্ধ, পক্ষান্তরে পরমাত্মা সর্বত্র বিরাজমান। কঠোপনিষদেও একথা সমর্থিত হয়েছেঃ
অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্
আত্মাস্য জন্তোর্নিহিত গুহায়াম্।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো
ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্মনঃ।।
“পরমাত্মা এবং জীবাত্মা উভয়েই বৃক্ষসদৃশ জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত। যিনি সব রকম জড় বাসনা এবং সব রকমের শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবানের কৃপার ফলে আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন।”
পরমাত্মার কৃপার ফলেই অণু আত্মা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। বন্ধু যেমন বন্ধুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে, পরমাত্মাও তেমনি অণু আত্মার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। মুণ্ডকোপনিষদ্ ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে আত্মা এবং পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখী (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল ভক্ষণ করছে, অপর পাখীটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এই দুটি পাখী গুণগতভাবে যদিও এক, (উভয়েই সচ্চিদানন্দময়, অ-জড়), তবুও তাদের একজন (জীবাত্মা) সেই জড়জগৎ-রূপ গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ। কখনো সে তিক্ত ফল আস্বাদন করে শোক করছে, কখনো বা সে মিষ্টি ফল খেয়ে আনন্দ করছে। পক্ষান্তরে অন্যজন তার সখাটির কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
অর্জুন হচ্ছেন ফল-আহারে রত পাখী, আর পর্যবেক্ষণরত পাখীটি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু, তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্যজন হচ্ছেন ভৃত্য। পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই জীবাত্মা-রূপ পাখী এক গাছ থেকে অন্য গাছে, অর্থাৎ এক দেহ থেকে আরেক দেহে ঘুরে বেড়ায়। এই জড়দেহ-রূপ বৃক্ষে জীবাত্মা তার কর্মের ফল-স্বরূপ নানা রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে পরমাত্মার নিত্য দাসত্ব বরণ করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে- সেই মুহূর্তে সে জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এবং তার সবরকম দুঃখ-কষ্টের নিবৃত্তি ঘটে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্জুনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারি। কঠোপনিষদ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আছে-
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
“দুটি পাখী একই গাছে বসে, কিন্তু যে পাখীটি ফল আহারে রত, সে তাঁর কর্মের ফলস্বরূপ সর্বদাই শোক, আশঙ্কা এবং উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখীটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।”
পদ্মপূরাণ
থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট ৮৪ লক্ষ ধরণের জীব-শরীর বা প্রজাতি রয়েছে এদের মধ্যে ৯ লক্ষ প্রজাতি হচ্ছে জলচর জীব, ২০ লক্ষ উদ্ভিদ প্রজাতি, কীট-পতঙ্গ হচ্ছে ১১ লক্ষ প্রজাতির, পাখী-প্রজাতি হচ্ছে ১০ লক্ষ, পশু ৩০ লক্ষ প্রজাতির, এবং মানুষ ৪ লক্ষ প্রজাতির। জীবসত্তা নানা প্রজাতির বিভিন্ন রকম জীব-শরীরে অবিরাম দেহান্তরিত হয়ে চলে, কিন্তু পরমাত্মা একান্ত সখার মতোই সর্বদাই তার সঙ্গে থাকেন; সেই জীবসত্তা মানবদেহে বা একটি কীট দেহে- যে দেহেই অবস্থান করুক না কেন, ভগবান সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন।