দেহ এবং আত্মার সম্বন্ধঃ দেহ একটি গাড়ীর মতো; আত্মা তার চালক
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
দেহকে একটি গাড়ীর সংগে তুলনা করা হয়, আত্মাকে তুলনা করা হয় চালকের সংগে। যদি একটি বোধশক্তিহীন কুকুরের ছানা রাস্তায় কোন একটি বড় গাড়ীকে আসতে দেখে, তাহলে সে এই ভেবে ভয় পেতে পারে যে ওটি একটি চার চাকার চলমান বড় কোন জন্তু। কিন্তু বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারে যে ওটি জন্তু নয়- একটি মৃত ব্যক্তিত্বহীন গাড়ী যা একজন চেতন চালকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। গাড়ীতে রাস্তা দেখার জন্য হেডলাইট রয়েছে, ঠিক যেমন আপনি আপনার চোখের সাহায্যে দেখেন। গাড়ী হর্ণের সাহায্যে আওয়াজ করে, আপনি মুখের সাহায্যে। গাড়ীর চারটি চাকা রয়েছে, আপনার দেহটির দুটি হাত ও দুটি রয়েছে। গাড়ীটি এক জায়গা হতে অন্যত্র চলাফেরা করে, আপনিও সেটাই করেন। কিন্তু গাড়ীতি থেকে চালক নেমে যাওয়ার পর ঐ গাড়ীটি এমনকি দশ লক্ষ বছরেও এক ইঞ্চি চলতে পারে না। ঠিক তেমনি, যখন একজন মানুষ মারা যায়, শরীরটি তখন পুরোপুরিই ঐ চালক-বিহীন গাড়ীটির মতোই – নিশ্চল, অনড়। সুতরাং আমরা যে দেহটিকে দেখি তা সবসময়ই মৃত। আত্মার উপস্থিতির জন্যই দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়। আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন দেহটি সম্পূর্ণ চলচ্ছক্তিহীন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
একবার একজন বিজ্ঞানী একটি মৃতদেহ নিয়ে সেই দেহটির সমস্ত রাসায়নিক পদার্থকে পৃথক করে তার বাজার মূল্য যাচাই করে রিপোর্ট করে দিলেন যে ঐ দেহটির দাম দাঁড়াচ্ছে ১১০ টাকা (যদি সেটিকে বাজারে বিক্রী করা হয়)! তা, আপনি কি এমন মনে করেন যে আপনার মূল্য ১১০ টাকা? কিন্তু যখন একজন জীবিত ব্যক্তি তাঁর দেহের ছোট্ট একটি আঙুল হারায়, কিংবা তাঁর কিডনীটিকে বদলাতে হয়, তাহলে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে থাকেন। জীবিত দেহের মধ্যে এমন কোন পদার্থ রয়েছে যা এই দেহকে এত মূল্যবান করে তোলে? আর একটি মৃতদেহে কি অনুপস্থিত যা ঐ দেহকে মূল্যহীন জঞ্জালে পরিণত করে? উত্তর হচ্ছেঃ আত্মা।
আত্মা (জীবনী শক্তি), উদ্ভিদ, পশুপাখী এবং মানুষ সকলের মধ্যেই রয়েছে। যেখানেই জীবন রয়েছে, সেখানে অবশ্যই আত্মা রয়েছে, কেননা আত্মাই হচ্ছে জীবন। অ্যামিবাই হোক, হাতি হোক, অথবা একটি মানুষ হোক- সব জীবিত দেহের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে আত্মা।
মানুষ কি কেবল একটি শক্তিশালী কম্পিউটার/ রোবট?
কম্পিউটারের হার্ডওয়ারটি কতকগুলি নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (এই সব নির্দেশগুচ্ছের জন্য নানারকম ভাষাও রয়েছে, যেমন ফরট্রান, বেসিক, অথবা সি প্লাস প্লাস, ইত্যাদি)। এটি স্পষ্ট যে একটি কম্পিউটারকে কার্যক্ষম হওয়ার জন্য অবশ্যই একজন বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা নির্দেশিত (প্রোগ্রাম্ড্) হতে হয়। যে-ক্ষমতাই একটি কম্পিউটারের থাকুক না কেন, তা সে সংখ্যার কচকচি, তথা সংরক্ষণ, বস্তু সনাক্তকরণ, বা স্বাভাবিক ভাষার প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি যাই হোক না কেন- তার সমস্ত ক্রিয়াক্ষমতাই একজন সংবেদনশীল চেতন মানুষ-এর দ্বারা প্রদত্ত। অন্য কথায়, যদি কম্পিউটারের কার্যনির্দেশক বা প্রোগ্রামার কম্পিউটার-সিস্টেমকে দুই যোগ দুই = পাঁচ, এই অঙ্ক কষতে প্রোগ্রাম করে রাখে, তাহলে কম্পিউটার ঐরকমই করবে। ঠিক সেই রকম দেখার ক্যামেরা-ব্যবস্থার সংগে সংযুক্ত কোনো কম্পিউটারকে যদি কোনো ঘনকাকৃ্তি (স্কয়ার)বস্তুকে গোল বলে সনাক্ত করার প্রোগ্রাম করা থাকে, তাহলে সেটি তাই-ই করবে। কম্পিউটার নিজে থেকে কোনো কিছুই বুঝতে পারে না। প্রোগ্রাম করা না থাকলে শুধু কম্পিউটারটি কেবল একটি বোবা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি নাটকাভিনয়ের কথা মনে করুন। একদল বিচারকমণ্ডলী নাটকটি দেখছেন, আর একটি ভিডিও ক্যামেরার দ্বারা পুরো নাট্যাভিনয়টি রেকর্ড করা হচ্ছে। বিচারক অভিনীত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করতে তাঁর চোখকে ব্যবহার করছেন, আর ভিডিও ক্যামেরাটি সমস্ত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করছে লেন্সের মাধ্যমে, যা চোখেরই যান্ত্রিক রূপায়ণ বা মেশিন-এনালগ। ঐ দর্শন –যন্ত্র এবং মানুষ – উভয় পর্যবেক্ষক তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করছে, কিন্তু মানুষ-পর্যবেক্ষক পরিদৃশ্যমান ঘটনাবলীকে “উপলব্ধি”-ও করছে। দৃষ্টন্তস্বরূপ, বিচারকমণ্ডলী একটি আবেগময় নাটকের সমগ্র আবেগমথিত দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করলেন, তাঁরা নাটকে গর্ব, দুঃখ, প্রকাশিত হতে দেখলেন। অপরদিকে ভিডিও ক্যামেরাটি আবেগ-অনুভূতিহীনভাবে কেবল কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন ও শব্দাবলী রেকর্ড করল। নাটক সমাপ্ত হলে বিচারকমণ্ডলী তাঁদের চোখের সামনে দৃশ্যায়িত দৃশ্য-চিত্রের ভিত্তিতে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়কারীকে নিরূপণ করলেন। কিন্তু ভিডিও ক্যামেরাটি কি ঐরকম কোন সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম- যদিও সে নাটকের প্রতিটি দৃশ্যই অভ্রান্তভাবে রেকর্ড করে রেখেছে?
পার্থক্যটি হচ্ছে এই যে, যদিও মানুষ ও ক্যামেরা – উভয় পর্যবেক্ষকই নাটকটি নিরীক্ষণ করছে, মানুষ হচ্ছে “চেতন”, কিন্তু ক্যামেরাটি সম্পূর্ণরূপে চেতনাহীন।
সুতরাং মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে চেতনা- চেতনাগত পার্থক্য।
আধুনিক যুগঃ খাঁচা-পরিচর্যার সংস্কৃতি
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
শরীরকে একটি খাঁচার সংগেও তুলনা করা হয়, আর খাঁচার টিয়া পাখীকে তুলনা করা হয় শরীরস্থ আত্মার সংগে। ধরুন কেউ খাঁচায় এইভাবে একটি পাখী পুষে কেবল খাঁচাটিকে সুন্দরভাবে তদ্বির করছে – যেমন বিশেষ ডিজাইনের সুন্দর সোনার খাঁচায় পাখীটিকে রেখে প্রতিদিন খাঁচাটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, খাঁচাটিকে ভালভাবে ঘষে-মেজে পালিশ করে ঝকঝকে করা ইত্যাদি। সকলে খাঁচাটিকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে, এবং তাতে উৎসাহিত হয়ে সে আরো ভালভাবে খাচাটির যত্ন নিতে থাকে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সে পাখীটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। পাখীটিকে দেয় না খাদ্য জল। ঠিক তেমনি, বর্তমান যুগে, আধুনিক সভ্যতায় প্রত্যেকে দেহের জন্য সমস্ত রকম আরাম স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতার ব্যবস্থা করার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত, কিন্তু আত্মার প্রয়োজনের দিকে কেউ দৃষ্টিপাত করছে না। সেজন্য প্রত্যেকেই পারমার্থিকভাবে ‘অনশনে’ ভুগছে। প্রত্যেকেই অন্ত্ররে বিষণ্ন, নিরানন্দ, এবং প্রত্যেকেই অজ্ঞান-তমসায় আবৃত হয়ে দুর্দশা ভোগ করছে। দেহ-খাঁচাটি যে অচিরেই ছাড়তে হবে, সে সম্বন্ধে অধিকাংশেরই কোনো জ্ঞান নেই, আর সে শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে না কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে, বিশ্বজুড়ে এই দেহতদ্বিরের, খাঁচাটি-পালিশের গভীরতাহীন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে।
আত্মা-সম্পর্কিত জ্ঞান
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আত্মা অবিনশ্বর
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥২৩॥ অর্থাৎ অনুবাদ:- আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না।” ভ. গী. ২/২৩
আত্মা একজন ব্যক্তি
প্রত্যেক আত্মাই পৃথক পৃথক চেতনা-সমন্বিত এক একজন ব্যক্তি। আপনি আপনার দেহ, মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহঙ্কার সম্বন্ধে সচেতন। আপনার মাথাব্যথা আমি অনুভব করতে পারি না, আবার আমি কি চিন্তা করছি আপনি তা জানেন না। কিন্তু ভগবান সৃষ্টির প্রত্যেকটি কণিকা সম্বন্ধে সচেতন; ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ॥১২॥ “এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না । ” (ভ. গী. ২/১২) মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ। মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ॥৭॥ ‘এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্র্রাম করছে।’ (ভ. গী. ১৫/৭)
আত্মার রূপ আছে
আত্মা ‘নিরাকার নির্গুণ জ্যোতি’ বা ‘শূন্য’ কিছু মানুষ যেমন ভুল করে ভেবে থাকেন। আত্মা হচ্ছে এক সুন্দর ব্যক্তিত্ব, যার দেহ সৎ-চিৎ-আনন্দময়। আত্মা কেবল শক্তি মাত্র নয়, আত্মা একজন পূর্ণচেতন ব্যক্তি।