সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বিষয়ঃ

নিজের ধর্ম সম্পর্কে আগে ভালোভাবে জানুন এবং অন্যকেও জানতে উৎসাহিত করুন।

আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন। আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো দেখতে এই লিংকে ক্লিক করুন ।
Krishna vs Arjun @ Gita



Bhogoban Krishner Picture
  • For Ad Contact
    0191 22 086 22









  • Bhogoban Krishner Picture
  • For Ad Contact
    0185 977 97 98



  • গীতার ধর্ম্মঃ-( শ্রীমদ্ভগবদগীতার সারমর্ম )
    -ডঃ শ্রীমন্ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী

    যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া দুইটি পরস্পর বিরোধী কর্ত্তব্যের চাপে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন অর্জ্জুন। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি কর্ত্তব্য বলিতেছে, ‘যুদ্ধ কর’। পারিবারিক কর্ত্তব্য দাবি করিতেছে, পিতামহ, গুরু, আত্মীয়-স্বজনকে মারা উচিত নয়। যাঁহারা পূজার পাত্র ভীস্ম দ্রোণ তাঁহাদের বধসাধন কেবল অন্যায় নয়, অত্যন্ত বেদনাদায়কও বটে। সমস্যা এই- কর্তব্যের মধ্যে বিরোধ। একটা কর্ত্তব্য পালন করিতে গেলে, অন্যটা সম্ভব হয় না। কোনটা শ্রেয়, করা উচিত, তাহা অর্জ্জুন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। তাই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন, বিষাদিত হইয়াছে তাহার চিত্ত।

    জীবনে সকলেরই সমস্যা এই, একটা দিক রাখিতে গেলে, অন্যটি ছাড়িতে হয়। অর্থ উপার্জ্জন করিতে যে ভয়ানক খাটুনি, তাহাতে শরীর থাকে না, আবার শরীর রাখিতে গেলে অর্থাভাবে না খাইয়া মরিতে হয়। বিদ্যালাভের যোগ্যতা ছিল। কিন্তু সংসারের প্রয়োজন মিটাইতে বিদ্যালাভ হইল না। শ্রীরামচন্দ্রের সমস্যা- প্রজারঞ্জন করিতে গেলে স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করিতে হয়, স্ত্রীর প্রতি কর্ত্তব্য করিতে গেলে প্রজারঞ্জন হয় না। স্বাধীনতা লাভ করিতে গেলে ভারত দ্বিখণ্ডিত করিতে হয়, দেশের অখণ্ডতা রাখিতে গেলে স্বাধীনতা লাভ হয় না। সর্ব্বত্রই এই দ্বন্দ্ব। কিসে আমাদের কল্যাণ, তা বুঝিতে না পারিয়া জীবন হয় সমস্যাসঙ্কুল এবং বিষাদময়।

    অর্জ্জুনের রথের সারথি ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের জীবনরথের সারথিও তিনি। তাঁহার বাণী শুনিতে পাইনা আমরা, সংসারের কোলাহলে বধির বলিয়া। সকল মানবের প্রতিনিধি অর্জ্জুন, আমাদের হইয়া শুনিয়াছেন সেই বাণী। শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের কৃপায় কুরুক্ষেত্রের কোলাহলে সেই বাণী আজিও হারাইয়া যায় নাই। শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনের এই রোমাঞ্চকর অদ্ভুত পূত সংবাদই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা।

    গীতার আঠারটি অধ্যায় যেন আঠারটি সিড়ি; বিষাদ হইতে মোক্ষে উত্তীর্ণ হইবেন, তবেই গীতা-মায়ের শান্তিময় ক্রোড়ে পৌঁছানো যাইবে। মৃত্যুর পর মুক্তিলাভ গীতার লক্ষ্য নয়, এই জীবনেই মোক্ষের অবস্থা লাভ, ইহাই আদর্শ। এই জীবনে যিনি মুক্তি পাইয়াছেন, পরলোকে তিনি তো মুক্তি পাইবেনই।

    ডাক্তার যেমন রোগীকে জিজ্ঞাসা করে- ওষুধ ঠিকমত খাইয়াছ কিনা? রোগ সারিয়াছে কিনা? গীতার শেষে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে জিজ্ঞাসা করিলেন- তুমি সব মনোযোগ সহকারে শুনিয়াছ তো? তোমার অজ্ঞানতা-জনিত মোহ দূর হইয়াছে কিনা? রোগী কেমন অনুভব করিতেছে, সেটাই বড় কথা। অর্জ্জুন বলিলেন- আমার মোহ দূর হইয়াছে, সংশয় চলিয়া গিয়াছে, ফিরিয়া পাইয়াছি কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যজ্ঞান। এখন তোমার উপদেশ মতোই কাজ করিব-

    নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা তৎপ্রসাদান্ময়াচ্যুত। স্থিতোহস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।। ১৮/৭৩

    ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র শুনিলেই কাজ হইবে না। তদনুযায়ী কাজ করিতে হইবে। শিক্ষালাভ করিলেই মানুষ হয় না, আধুনিক বিজ্ঞানের নৃশংস প্রয়োগে জগৎ প্রায় ধ্বংসের কিনারায় আসিয়াছে। বুদ্ধি, জ্ঞানের অনুশীলন করিলেই হইবে না, ইচ্ছাশক্তিকে কল্যাণমুখী করিতে হইবে। বুদ্ধির সঙ্গে শুভ ইচ্ছার যোগ হওয়া চাই। বেদে এইরূপ প্রার্থনা আছে- বুদ্ধি, ইচ্ছা মঙ্গলপ্রয়াসে যেন পর্য্যবসিত হয়। গীতার আঠারটি অধ্যায় অনুশীলন করিলে মনে হইবে – যিনি আমার বুদ্ধি চালনা করিতেছেন, তাঁহার ইচ্ছায় চলাই কল্যাণকর।

    গীতা-মায়ের যে স্তনধারা আঠার অধ্যায় ধরিয়া বর্ষিত হইয়াছে, উহা ‘অদ্বৈত অমৃত’। বিশ্বে সকল বিভেদ বিদ্বেষ দূর করিয়া পরাশান্তি দান করিতে সমর্থ। ‘অদ্বৈত’ তত্ত্বের অনুভবই অমৃত। উহা মরণধর্মী জীবকে অমৃতত্ব এবং দুঃখী জীবকে আনন্দের অধিকারী করে। এই তত্ত্বের জ্ঞান না থাকায় আমরা বহু দেখি- লোকজন, হাতিঘোড়া, পশুপাখী ইত্যাদি। সবার মধ্যে যিনি এক ও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ রূপে বিরাজিত, তাঁহাকে দেখি না, অনুভব করি না। গীতা আঠার অধ্যায়ে এই তত্ত্বে আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দেন।

    অনেক পাণ্ডিত্য যাহার আছে, গীতা তাহাকে পণ্ডিত বলেন নাই। বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, গাভী, হাতি, কুকুর প্রভৃতিতে যিনি সমদর্শী, কোনও পার্থক্যবোধ করেন না, গীতায় তাঁহাকেই পণ্ডিত বলা হইয়াছে। অদ্বৈততত্ত্বজ্ঞানী অনুভব করেন, সর্ব্বভূতে সর্ব্বজীবে এক পরমাত্মাই বিলাস করিতেছেন। তিনি আত্মাকে সর্ব্বভূতে এবং সর্ব্বভূতকে নিজ আত্মায় দর্শন করেন (‘সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং সর্ব্বভূতানি চাত্মনি ঈক্ষতে যোগ যুক্তাত্মা সর্ব্বত্র সমদর্শিনঃ।।’ ৬/২৯)

    শুধু তাই নয়, তিনি শ্রীভগবানকে সর্ব্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং শ্রীভগবানের মধ্যে অবস্থিত দেখেন সর্ব্বভূতকে (‘যো মাং পশ্যতি সর্ব্বত্র, সর্ব্বং চ ময়ি পশ্যতি। ৬/৩০) তিনি সকল দ্বন্দ্বের পারে চলিয়া যান। সুখদুঃখ, শত্রুমিত্র, মান-অপমান, লাভ অলাভ সবই তাঁহার নিকট সমান মনে হয়। তিনি সদা সর্ব্বদা শ্রীভগবানে অবস্থান করেন এবং অমৃতত্ব আস্বাদন করেন।

    ঘট আছে পুকুরে জলের মধ্যে, আবার ঘটের মধ্যেও রহিয়াছে জল। বিরাট চৈতন্যের মধ্যে আমরা আছি, আবার আমাদের মধ্যেও আছেন ঐ চৈতন্য। কাউকে আঘাত করিলে নিজেকেই আঘাত করা হয়। ঘট ভাঙ্গিলে ঘটের জল আর পুকুরের জল এক হইয়া যায়। সর্ব্বজীবেই একই চৈতন্যের স্থিতি। এই অনুভব হইলে নশ্বর দেহভাণ্ড ভাঙ্গিয়া গেলে সেই পূর্ণ চৈতন্যে স্থিতিলাভ হয়। এই জ্ঞান না হইলে দেহভাণ্ড যতবার ভাঙ্গিবে, ততবার এই মায়াময় সুখদুঃখপূর্ণ সংসারে ফিরিয়া আসিতে হইবে। গীতায় শ্রীভগবান্ শরণাগত শিষ্যের প্রতি অত্যন্ত দরদমাখান ভাষায় এই তত্ত্ব উদ্ঘাটিত করিয়াছেন। হৃদয়ে দরদ থাকিলে উপদেশে কাজ হয়। বেদ উপনিষদে এই উপদেশ থাকিলেও তাহা তেমন গ্রহণযোগ্য হয় নাই, কারণ সেখানে নাই এই দরদ, ভক্তের জন্য ভগবানের বেদনাবোধ।

    গীতায় শ্রীভগবানের বক্তব্যের ভাষা অতি মধুর, প্রাণস্পর্শী। ভক্তের জন্য প্রাণ কাঁদিয়াছে ভগবানের, তাই দরদ দিয়া তাহার রোগ নিরাময় করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছেন। অপূর্ব্ব মধুর কথা, অর্জ্জুন শুনিয়াছেন মন-প্রাণ দিয়া। মুখে কোন কথা নাই, দুই একটি জিজ্ঞাসা ছাড়া। বিষাদগ্রস্ত রোগী আঠার অধ্যারের শেষে অনুভব করিয়াছেন, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। জীবনের বিশাল কর্মক্ষেত্রে আমরা সকলেই পীড়িত, বিষাদিত। আমাদের জন্য ঐ একই ঔষধ।

    শাস্ত্র দুঃখমুক্তির জন্য বাসনা কামনা ত্যাগের কথা বলিয়াছেন। গীতার উপদেশ তাহা নয়। চিত্তের বহুমুখী বৃত্তি দুঃখ দিবে, উৎপাটন করাও যাইবে না। সব কামনার মূলে একটি কামনা আছে, ভিত্তিভূমি আছে। সেই লক্ষ্য জানিয়া, দৃষ্টি সেইদিকে স্থির রাখিয়া চলিতে হইবে। জীবনে অনেক প্রয়োজন অপরিহার্য্য হইয়া দেখা দেয়, তাহাতে যেন লক্ষ্যহারা না হই।
    জীবনের লক্ষ্য স্থির হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাহা হইলে, দুঃখ লাঘব হইয়া যাইবে। গীতা কৃপা করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন, সেই লক্ষ্য কি-

    যং লব্ধা চাপরলাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ যস্মিন্ স্তিত্বা ন দুঃখেন গুরণাপি বিচাল্যতে।। ৬/২২
    যাঁহাকে পাইলে জগতের অন্য কিছু লাভ শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে হয় না।, যাঁহাকে পাইলে গুরুতর দুঃখ আসিয়াও বিন্দুমাত্র বিচলিত করিতে পারে না, সেই শ্রীভগবান লাভই জীবনের লক্ষ্য। সেই আমাদের সাধ্য-বস্তু। তাঁহার দিকে লক্ষ্য স্থির রাখিয়া আমাদের চলিতে হইবে জীবনপথে।

    লক্ষ্য স্থির থাকে না। অহঙ্কার প্রবল হইয়া সব গোলমাল করিয়া দেয়। রজস্তমোগুণ বর্ধিত হইলে মানুষ অহঙ্কারী, ক্রোধী ও দুর্বিনীত হইয়া পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্যায় কর্ম্ম হইতে বিরত হওয়ার চেষ্টা করিয়াও মানুষ পারে না ভাল হইতে বা ভাল থাকিতে।
    অর্জ্জুন যে প্রশ্ন করিয়াছেন ভগবানকে, সে প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনেও উদয় হয়। অনিচ্ছাসত্বেও কে যেন বলপূর্ব্বক আমাদের পাপকার্যে নিয়োজিত করে-
    অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ। অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।। ৩/৩৬

    শ্রীভগবান্ বলিলেন, ইহার হেতু কাম ও ক্রোধ। রজোগুণ হইতেই ইহাদের উৎপত্তি, ইহা দুষ্পুরণীয় এবং সংসারে ঘোর শত্রুস্বরূপ। মূলে আছে অহঙ্কার (অহঙ্কার বিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে ৩/২৭) এই দেহ কেন্দ্র করিয়া যে অহঙ্কার, সেই দেহের উপর কি অধিকার আছে আমাদের? ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া, গাছের একটি পাতাও নড়ে না। অহঙ্কার সাজে না আমাদের। বর্ণের আদিতে ‘অ’ এবং অন্তে ‘হ’ বিশ্বের আদিতে ও অন্তে যিনি আছেন ও থাকেন, তাঁহারই শুধু হওয়া সাজে ‘অহং’ আর কাহারও নয়। ‘আমি’, ‘আমার’- ইহা হইতেই আমাদের যত গোলমাল, যত অশান্তি। সব ‘আমিত্ব’, তাঁহাকে সমর্পণ করিয়া তাঁহার শরণাগত হইলেই, কল্যাণ। ‘আমি’ গেলে, ঘুচিবে জঞ্জাল। সংসারে অহঙ্কার আনে, পদে পদে আঘাত, দুঃখ। চরম আঘাত পাইয়া মনে হয়- ঠাকুর, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।
    অহঙ্কারশূন্য হইয়া যাহা কিছু তোমার, তাহা ঈশ্বরে সমর্পণ কর-

    যৎ করোষি যৎ অশ্নাসি যজ্জুহোসি দদাসি যৎ। যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুস্ব মদর্পণম্।। ৯/২৭
    অর্পণেও অহঙ্কার যেন প্রবেশ না করে, সেজন্য সদা সাবধান থাকিতে হইবে। বিশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করিয়া সুরম্য মন্দির করিয়াছেন রাজা। সেই মন্দির ত্যাগ করিয়া সাধুশ্রেষ্ঠ নরোত্তম ঠাকুর ভক্তগণ সঙ্গে মন্দির ছাড়িয়া রাস্তার ধারে নাম-সংকীর্ত্তন করিতেছেন। রাজা সুধাইলেন, মন্দির ছাড়িয়া কেন রাস্তায় কীর্ত্তন করিতেছেন? নরোত্তম বলিলেন- ‘সে মন্দিরে দেব নাই’। তখন রাজা কহে রোষে-

    ‘দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মত কথা কহ। রত্নসিংহাসন’পরে দীপিতেছে রতনবিগ্রহ- শূন্য তাহা? ‘শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ’, সাধু কহে, ‘আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে।’ ‘দীন দান’- রবীন্দ্রনাথ।

    সৎকাজও মন্দ হইয়া যায়, যদি সেখানে অহঙ্কার জাগে। তাই শ্রীভগবান্, গীতার শেষ অধ্যায়ে শুনাইলেন চরম কথা-
    সর্ব্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যঃ মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।। ১৮/৬৬
    সব ধর্ম্ম ছাড়িয়াও যদি কেবল আমার শরণ লও, সেজন্য যদি তোমায় পাপ স্পর্শ করে, আমি তোমাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিব। সর্ব্বতোভাবে তাঁহার হইতে হইবে, তখন আর কোনও কর্ত্তব্য থাকিবে না। তখন, সবই ভগবানের কাজ, তুমি কেবল নিমিত্ত মাত্র (নিমিত্তমাত্র ভব সব্যসাচিন্)। সর্ব্বতোভাবে তাঁহার শরণাগতি, ইহাই শ্রেষ্ঠ পন্থা। এই শরণাগতি আসিলেই পরম কল্যাণ। পায়ের জুতা সেবা করিতে পারে তখনই, যখন সে চরণে স্থান পায়। যতক্ষণ অহঙ্কার আছে, ততক্ষণ এই শরণাগতি, জুতার মত অভিমানশূন্যতা, আসে না। শরণাগতি আসিলে, তখন আমার কিছু নয়, সবই তাঁহার- ‘তোমারি গরবে গরবিনী হাম্, রূপসী তোমার রূপে’। এই বোধে, স্মরণে, উপাসনায়, তাঁহার উপর ঐকান্তিক নির্ভরতায় নামিয়া আসে তাঁহার অপার করুণার ধারা। তখন তিনিই সাধকের, ভক্তের সকল ভার গ্রহণ করেন। ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহম্,’ নিজেই সকল ভার গ্রহণ করেন, এই তাঁহার বাণী।

    ভক্ত অর্জ্জুন মিশ্র তাহার জীবন্ত প্রমাণ। মিশ্র ছিলেন পরম পণ্ডিত, ভক্ত ও দরিদ্র। সে যু ছাপা পুস্তক ছিল না। হস্ত লিখিত পুঁথিতে ‘বহাম্যহম্’ দেখিয়া সংশয় হয়, ভাবেন ভগবান্ নিজে বহন করেন না, কারও মাধ্যমে দান করেন। তাই ‘বহাম্যহম্’ শব্দটি কাটিয়া সেখানে ‘দদাম্যহম্’ লিখিয়া রাখেন।

    একদিন গরীব ব্রাহ্মণের ঘরে কিছুই খাদ্যবস্তু নাই। ব্রাহ্মণী বলিলেন, ভিক্ষা না করিলে গোবিন্দের ভোগ হইবে না, আমাদের না খাইয়া কাটাইতে হইবে। অর্জ্জুন মিশ্র তাই ভিক্ষায় বাহির হইয়াছেন। কিছু পরে একটি কৃষ্ণবরণ ও অপরটি গৌরবরণ, দুইটি ছেলে অনেক জিনিষপত্র মাথায় লইয়া উপস্থিত। তাহারা বলিল, আমরা রাজার বাড়ী হইতে আসিয়াছি, অর্জ্জুন মিশ্র এই সব পাঠাইয়াছেন, আরও অনেক জিনিষ আছে আমরা শীঘ্র আনিতেছি। জিনিষপত্রে ঘর ভরিয়া গেল। হঠাৎ মিশ্রের পত্নী লক্ষ্য করিলেন, ছেলে দুইটির পিঠ কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি করিয়া কাটিল। তাহারা বলিল, আমরা ভার বইতে পারি না, তাই অর্জ্জুন মিশ্র প্রহার করিয়াছেন। পত্নী অবাক্ হইলেন, তার স্বামী তো অত্যন্ত শান্ত প্রকৃ্তির মানুষ, তবে কি রাজবাড়ীতে এতসব জিনিষ পাইয়া মাথা খারাপ হইয়া গেল। ছেলে দুইটিকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিলেন কিন্তু তাহারা দাঁড়াইল না, অনেক কাজ আছে বলিয়া চলিয়া গেল। স্ত্রী বহু প্রকারের খাবার তৈয়ারী করিয়া প্রাণভরে শ্রীগোবিন্দের ভোগ দিয়া স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। ভাবিতেছেন, এত বেলা হইল, এখনও স্বামী ফিরিয়া আসিতেছেন না, তিনি তো বাইরে কোথায়ও খান না।

    এদিকে, অর্জ্জুন মিশ্র ভিক্ষায় বাহির হইয়া অনেক ঘুরিলেন কিন্তু কিছুই মিলিল না। ক্লান্ত হইয়া এক বৃক্ষতলে বসিয়াছেন, একটু পরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। ঘুম ভাঙ্গিলে দেখিলেন, দুপুর প্রায় গড়াইয়া গিয়াছে। ভিক্ষা কিছু না পাইয়া একটু বিষন্ন মনে ঘরে ফিরিলেন। স্ত্রী অনুযোগ করিয়া বলিলেন, এত দেরী কেন করিলে? কখন সব রান্না করিয়া, গোবিন্দের ভোগ দিয়া, বসিয়া আছি। অর্জ্জুন মিশ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, ঘরে কিছু ছিল না, কি দিয়া ভোগ হইল? স্ত্রী বলিলেন, কেন, তুমি রাজবাড়ী হইতে কত জিনিষ পাঠাইয়াছ, দেখ ঘর ভর্ত্তি হইয়া গিয়াছে। দুইটি খুব সুন্দর ছেলে, একটি কালো, একটি ফরসা, সব জিনিষ বহন করিয়া আনিয়াছে। কত না কষ্ট হইয়াছে তাহাদের! তারপর দেখি, তাহাদের পিঠ কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। তাহারা বলিল- আমরা ভার বহন করিতে পারিনা, এইজন্য অর্জ্জুন মিশ্র মারিয়াছেন। অর্জ্জুন মিশ্র তখন বলিলেন, আমি রাজবাড়ী মোটেই যাই নাই এবং কিছু ভিক্ষাও আজ পাই নাই। এ নিশ্চয় কৃষ্ণ-বলরাম, নিজেরা সব জিনিষ বহন করিয়া আনিয়াছেন, তুমি দেখিয়াও চিনিতে পার নাই। আর পিঠ কাটিয়া যে রক্ত পড়িতেছে দেখিয়াছ, তাহার কারণ, আমি গীতার ‘বহাম্যহম্’ কাটিয়া ‘দদাম্যহম্’ লিছিয়াছি। গীতা তো তাঁহার হৃদয় (গীতা মে হৃদয়ং পার্থ), সেখানে আঘাত লাগিয়াছে। কী অসীম করুণা তাঁহার! ভাবিয়া স্বামী-স্ত্রী আকুল হইলেন কাঁদিয়া। মিশ্র তখনই যাইয়া গ্রন্থের ‘দদাম্যহম্’ কাটিয়া তিনবার লিখিলেন ‘বহাম্যহম্’। নিজে ভক্তের যোগক্ষেম যে বহন করেন তিনি, আমি অর্জ্জুন মিশ্র তাহার সাক্ষী!

    গীতার সার-কথা ইহাই। এই কথা আমরা শুনিয়াও শুনি না, বুঝিয়াও বুঝি না। অহঙ্কার অনেক প্রকারের, তাহা দূর করিবার চেষ্টা করি না। শাস্ত্রের কথা, শাস্ত্রের ভাষা আমাদের মন স্পর্শ করে না। আমাদের অবস্থা, যেমন নদীর স্রোতে পড়িয়াছে এক বিরাট হাতি, প্রবল স্রোতে প্রাণ ওষ্ঠাগত, কিছুতেই উঠিতে পারিতেছে না! সেই নদীর স্রোতে ছোট ছোট মাছ আনন্দে সাঁতার কাটিয়া চলিতেছে। মাছ হাতিকে বলিতেছে, কেন এত কষ্ট পাইতেছ, এস না আমাদের মত। মাছের ভাষা হাতি বুঝিতে পারে না, তার পথে চলিতে পারে না। ভক্তের ভাষা অভক্তেরা বুঝে না। বিষয়ীরা কর্ণপাতও করে না। তাহাদের কাছে জীবনটা মনে হয় সংগ্রামময়, দুঃখভরা। কিন্তু যিনি পুরুষোত্তমকে ভালবাসিয়াছেন, মঙ্গলকামী সুহৃদ বলিয়া জানিয়াছেন, তাঁহার জীবনে কোন দুঃখ নাই, বিপদ আপদ যাহাই আসুক, তাঁহাকে উদ্বেগ দিতে পারে না, তাঁহার শান্তি নষ্ট করিতে পারে না। এই দুঃখ ভরা সংসারেই ঋষিরা অনুভব করিয়াছেন আনন্দভরা মধুময়তা। ‘মধু বাতা ঋতয়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ’ – অফুরন্ত মধু, অনাবিল আনন্দ; কারণ মধুব্রহ্মের সঙ্গে, আনন্দময় ভগবানের সঙ্গে, তাঁহারা ছিলেন নিত্যযুক্ত। শ্রীভগবানকে আপন জন, প্রিয় ও সর্ব্বভূতের সুহৃদ বলিয়া যিনি জানেন, তিনিই শান্তিলাভ করেন- গীতায় ইহাই ভগবানের বাণী- “সুহৃদং সর্ব্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি” জয় জগদ্বন্ধু!

    এর পর দেখুনঃ আত্মা প্রকৃতপক্ষে কি?

    আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।

    প্রাসঙ্গিক বিষয়ঃ

    * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।