ভক্ত অর্জ্জুন মিশ্র তাহার জীবন্ত প্রমাণ। মিশ্র ছিলেন পরম পণ্ডিত, ভক্ত ও দরিদ্র। সে যু ছাপা পুস্তক ছিল না। হস্ত লিখিত পুঁথিতে ‘বহাম্যহম্’ দেখিয়া সংশয় হয়, ভাবেন ভগবান্ নিজে বহন করেন না, কারও মাধ্যমে দান করেন। তাই ‘বহাম্যহম্’ শব্দটি কাটিয়া সেখানে ‘দদাম্যহম্’ লিখিয়া রাখেন।
একদিন গরীব ব্রাহ্মণের ঘরে কিছুই খাদ্যবস্তু নাই। ব্রাহ্মণী বলিলেন, ভিক্ষা না করিলে গোবিন্দের ভোগ হইবে না, আমাদের না খাইয়া কাটাইতে হইবে। অর্জ্জুন মিশ্র তাই ভিক্ষায় বাহির হইয়াছেন। কিছু পরে একটি কৃষ্ণবরণ ও অপরটি গৌরবরণ, দুইটি ছেলে অনেক জিনিষপত্র মাথায় লইয়া উপস্থিত। তাহারা বলিল, আমরা রাজার বাড়ী হইতে আসিয়াছি, অর্জ্জুন মিশ্র এই সব পাঠাইয়াছেন, আরও অনেক জিনিষ আছে আমরা শীঘ্র আনিতেছি। জিনিষপত্রে ঘর ভরিয়া গেল। হঠাৎ মিশ্রের পত্নী লক্ষ্য করিলেন, ছেলে দুইটির পিঠ কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি করিয়া কাটিল। তাহারা বলিল, আমরা ভার বইতে পারি না, তাই অর্জ্জুন মিশ্র প্রহার করিয়াছেন। পত্নী অবাক্ হইলেন, তার স্বামী তো অত্যন্ত শান্ত প্রকৃ্তির মানুষ, তবে কি রাজবাড়ীতে এতসব জিনিষ পাইয়া মাথা খারাপ হইয়া গেল। ছেলে দুইটিকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিলেন কিন্তু তাহারা দাঁড়াইল না, অনেক কাজ আছে বলিয়া চলিয়া গেল। স্ত্রী বহু প্রকারের খাবার তৈয়ারী করিয়া প্রাণভরে শ্রীগোবিন্দের ভোগ দিয়া স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। ভাবিতেছেন, এত বেলা হইল, এখনও স্বামী ফিরিয়া আসিতেছেন না, তিনি তো বাইরে কোথায়ও খান না।
এদিকে, অর্জ্জুন মিশ্র ভিক্ষায় বাহির হইয়া অনেক ঘুরিলেন কিন্তু কিছুই মিলিল না। ক্লান্ত হইয়া এক বৃক্ষতলে বসিয়াছেন, একটু পরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। ঘুম ভাঙ্গিলে দেখিলেন, দুপুর প্রায় গড়াইয়া গিয়াছে। ভিক্ষা কিছু না পাইয়া একটু বিষন্ন মনে ঘরে ফিরিলেন। স্ত্রী অনুযোগ করিয়া বলিলেন, এত দেরী কেন করিলে? কখন সব রান্না করিয়া, গোবিন্দের ভোগ দিয়া, বসিয়া আছি। অর্জ্জুন মিশ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, ঘরে কিছু ছিল না, কি দিয়া ভোগ হইল? স্ত্রী বলিলেন, কেন, তুমি রাজবাড়ী হইতে কত জিনিষ পাঠাইয়াছ, দেখ ঘর ভর্ত্তি হইয়া গিয়াছে। দুইটি খুব সুন্দর ছেলে, একটি কালো, একটি ফরসা, সব জিনিষ বহন করিয়া আনিয়াছে। কত না কষ্ট হইয়াছে তাহাদের! তারপর দেখি, তাহাদের পিঠ কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। তাহারা বলিল- আমরা ভার বহন করিতে পারিনা, এইজন্য অর্জ্জুন মিশ্র মারিয়াছেন। অর্জ্জুন মিশ্র তখন বলিলেন, আমি রাজবাড়ী মোটেই যাই নাই এবং কিছু ভিক্ষাও আজ পাই নাই। এ নিশ্চয় কৃষ্ণ-বলরাম, নিজেরা সব জিনিষ বহন করিয়া আনিয়াছেন, তুমি দেখিয়াও চিনিতে পার নাই। আর পিঠ কাটিয়া যে রক্ত পড়িতেছে দেখিয়াছ, তাহার কারণ, আমি গীতার ‘বহাম্যহম্’ কাটিয়া ‘দদাম্যহম্’ লিছিয়াছি। গীতা তো তাঁহার হৃদয় (গীতা মে হৃদয়ং পার্থ), সেখানে আঘাত লাগিয়াছে। কী অসীম করুণা তাঁহার! ভাবিয়া স্বামী-স্ত্রী আকুল হইলেন কাঁদিয়া। মিশ্র তখনই যাইয়া গ্রন্থের ‘দদাম্যহম্’ কাটিয়া তিনবার লিখিলেন ‘বহাম্যহম্’। নিজে ভক্তের যোগক্ষেম যে বহন করেন তিনি, আমি অর্জ্জুন মিশ্র তাহার সাক্ষী!
গীতার সার-কথা ইহাই। এই কথা আমরা শুনিয়াও শুনি না, বুঝিয়াও বুঝি না। অহঙ্কার অনেক প্রকারের, তাহা দূর করিবার চেষ্টা করি না। শাস্ত্রের কথা, শাস্ত্রের ভাষা আমাদের মন স্পর্শ করে না। আমাদের অবস্থা, যেমন নদীর স্রোতে পড়িয়াছে এক বিরাট হাতি, প্রবল স্রোতে প্রাণ ওষ্ঠাগত, কিছুতেই উঠিতে পারিতেছে না! সেই নদীর স্রোতে ছোট ছোট মাছ আনন্দে সাঁতার কাটিয়া চলিতেছে। মাছ হাতিকে বলিতেছে, কেন এত কষ্ট পাইতেছ, এস না আমাদের মত। মাছের ভাষা হাতি বুঝিতে পারে না, তার পথে চলিতে পারে না। ভক্তের ভাষা অভক্তেরা বুঝে না। বিষয়ীরা কর্ণপাতও করে না। তাহাদের কাছে জীবনটা মনে হয় সংগ্রামময়, দুঃখভরা। কিন্তু যিনি পুরুষোত্তমকে ভালবাসিয়াছেন, মঙ্গলকামী সুহৃদ বলিয়া জানিয়াছেন, তাঁহার জীবনে কোন দুঃখ নাই, বিপদ আপদ যাহাই আসুক, তাঁহাকে উদ্বেগ দিতে পারে না, তাঁহার শান্তি নষ্ট করিতে পারে না। এই দুঃখ ভরা সংসারেই ঋষিরা অনুভব করিয়াছেন আনন্দভরা মধুময়তা। ‘মধু বাতা ঋতয়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ’ – অফুরন্ত মধু, অনাবিল আনন্দ; কারণ মধুব্রহ্মের সঙ্গে, আনন্দময় ভগবানের সঙ্গে, তাঁহারা ছিলেন নিত্যযুক্ত। শ্রীভগবানকে আপন জন, প্রিয় ও সর্ব্বভূতের সুহৃদ বলিয়া যিনি জানেন, তিনিই শান্তিলাভ করেন- গীতায় ইহাই ভগবানের বাণী-
“সুহৃদং সর্ব্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি”
জয় জগদ্বন্ধু!
এর পর দেখুনঃ আত্মা প্রকৃতপক্ষে কি?
আপনার পছন্দমত
যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।