তমোগুণঃ, তমোগুণের প্রভাবের দৃষ্টান্তঃ
তমোগুণ হচ্ছে সত্ত্বগুণের ঠিক বিপরীত। তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত হলে মানুষ অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন হয়, কোন কিছু সম্বন্ধে সে যথার্থভাবে অবগত হতে পারে না। তমোগুণে আচ্ছাদিত মানুষ অত্যন্ত অলস এবং তাদের পারমার্থিক জীবনের প্রতি, আধ্যাত্মিকতার প্রতি কোনো আকর্ষণ থাকে না। রজোগুণ-সম্পন্ন মানুষের মতো তামাসিক মানুষেরা অত সক্রিয়ও নয়। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘুমানো তাদের অভ্যাস। ৬ ঘন্টা ঘুমালেই যথেষ্ট, অথচ তমোভাবাপন্ন মানুষেরা দশ-বারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকে। বিশেষতঃ এরা কখনই ভোরে শয্যা ত্যাগ করতে পারে না- সকাল ৮/৯ টা অবধি ঘুমায়। তমো-আচ্ছন্ন মানুষকে হতাশ ও বিষণ্ণ মনে হয়, এবং সাধারণতঃ এঁরা মাদকাসক্ত হয়ে থাকে। চা-কফি, ধুমপান থেকে শুরু করে নানাবিধ নেশায় এঁরা আসক্ত থাকে, নেশার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসার মানসিক বল তারা হারিয়ে ফেলে। এঁরা পচা, বাসী, দুর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য আহার করতে ভালবাসে। তমোভাবাপন্ন মানুষ যা-কিছুই করুক তাতে তাঁর নিজের বা অপরের- কারোর কোনো কল্যাণ হয় না।
তমোগুণের প্রভাবের দৃষ্টান্তঃ
জন ডাল ও বেটি গ্রাম্বেলের জীবনধারা তমোগুণে প্রভাবিত হবার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এঁরা বিবাহ না করেও নিউইয়র্ক শহরের একটি সস্তা অপরিচ্ছন্ন কামরায় একসংগে থাকে। জন নেশার দ্রব্য ফেরি করে বিক্রি করে। ধর্ম সম্বন্ধে তারা বহু পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এর কোনো উপযোগিতা তাদের জীবনে নেই। তারা প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে সময় কাটায়, নতুবা কড়া নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে কামরায় পড়ে থাকে। খিদে পেলে রসুন মেশানো সসেজ খেয়ে আর মদ্যপান করে তাদের উদর পূর্তি করে। বহু বছর ধরে তারা স্পেনে গিয়ে একটি কমিউন (সমভাবাপন্ন কিছু মানুষকে নিয়ে তৈরী একটি ছোট গোষ্ঠী, যারা একসংগে থাকে) শুরু করার স্বপ্ন দেখে, অবশ্য তা রূপায়িত করার জন্য তারা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না, কেবল স্বপ্নিল আশাতেই তৃপ্ত থাকে।
রজোগুণ
সমাজে তাঁর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সে হাসপাতাল খোলা, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় অর্থদান ইত্যাদি করে।
বাড়ী করতে চাইলে সে প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরী করতে চায়, সকলের উপর প্রভুত্ব করতে চায়, সবকিছুই তার ইচ্ছায় পরিচালিত হোক –
সকলের উপর প্রভুত্ব করতে চায়, সবকিছুই তার ইচ্ছায় পরিচালিত হোক – এইরকম সে আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে, এবং এইসব আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সে চেষ্টার ত্রুটি করে না। এইভাবে রজোগুণের প্রভাবে তার মন সর্বদাই নানা দুষ্পূরণীয় বাসনায় অধীর থাকে। আধুনিক মানব সমাজ সভ্যতা বিশেষভাবে রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত; গগনচুম্বী অট্টালিকা, বিশাল বিশাল শহর, অতিকায় সব কলকারখানা, অতি দ্রুতগতি যানবাহন, রকেট, অতি ভয়ংকর বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র – সবই রজোগুণের প্রকাশ। এই সভ্যতা রজোগুণের পরিপ্রেক্ষিত ‘উন্নত’, সত্ত্বগুণের ভিত্তিতে বিচার করলে এই সভ্যতা কেবল উৎকট কামনার প্রকাশ। সমগ্র জড়জগত কম-বেশি রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত এবং আধুনিক জড়সভ্যতা বিশেষভাবে রজোগুণের দ্বারা আশ্লিষ্ট। প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা ছিল সত্ত্বগুণভিত্তিক।
রজোগুণের প্রভাবের দৃষ্টান্তঃ
শহরতলীর একটি অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধাযুক্ত বাড়ীতে বাস করেন স্মিথ পরিবার। প্রতিদিন সকালে ল্যারি স্মিথ অতি দ্রুত প্রাতরাশ গলাধঃকরণ করে ছোটেন যানবাহন ধরে যথাসময়ে অফিসে পৌঁছাতে। সেখানে সারাদিন তাঁকে বিস্তর ঝক্কি ঝামেলায় ব্যস্ত থাকতে হয়। তাঁর কাজটা বেশ কঠিন, কিন্তু তিনি এটাকে মেনে নেন এজন্য যে এই চাকরি তাঁকে এমন রোজগার দেয় যা দিয়ে তিনি বিলাসিতার সংগে কাটাতে পারেন, এবং তারপরও কিছু টাকা থাকে যা দিয়ে তিনি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেন এবং পাশাপাশি রহস্যময় কিছু ব্যবসাও করে থাকেন। “মুদ্রাই মধু” (মানি ইজ হানি), ল্যারির দর্শন। তাঁর স্ত্রী গ্লোরিয়া সকালে উঠে তার ছেলেমেয়েদের সাজগোজ করিয়ে স্কুলে পাঠান (পারিবারিক সম্মান স্মিথদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ), গ্লোরিয়ার সারা দিনের সঙ্গী তাঁর শিশুটি (“যাকে আমরা চাইনি”, ল্যারী বলেন)। গ্লোরিয়া বাড়ীতে থাকার সময় টিভি চলতে থাকে; তিনি খেলার মাঠে অন্যান্য গৃহবধু ও ছেলেমেয়েদের সংগে সময় কাটান, বিউটি পার্লারে যান, কিংবা শপিং বা কেনাকাটা করতে বেরোন (কখনো মনে হয় যে এটির কোনো শেষ নেই)। সারা দিনটা এভাবে স্মিথেরা কর্মমুখর, ব্যস্ত থাকেন, রাত্রে তাঁরা বিশ্রাম নেন; কিন্তু দিনের ধকল সুব বেশি হওয়ার জন্য প্রায়ই রাত্রে তাদের সুনিদ্রা হয় না। কখনো তাঁরা অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কথা কাটাকাটি করতে থাকেন। তবে মি. ল্যারি এবিষয়ে বিজ্ঞের অভিমত প্রকাশ করে বলেন, “এমন কোনো সমস্যা নেই, রতিক্রিয়ায় যার সমাধান হয় না!” সপ্তাহ শেষে রবিবার তাঁরা নিজেদেরকে ধার্মিক প্রতিপন্ন করতে গীর্জায় যান, কিন্তু এটা আসলে একটি সামাজিক ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়, কেননা তাঁরা সচরাচর ধর্মগ্রন্থের নির্দেশের পরিপন্থী আচরণ করে থাকেন। এই পরিবারটি আদর্শ রজোগুণ সম্পন্ন পরিবার।
সত্ত্ব, রজো, ও তমোগুণে প্রভাবিত মানুষের লক্ষণ :
সত্ত্ব গুণঃ
সত্ত্ব গুণসম্পন্ন মানুষ অন্যদের থেকে জ্ঞানী হন। যেহেতু তিনি শাস্ত্র-নির্দেশ অনুসারে জীবনযাপন করেন, সেজন্য তিনি জড় দুঃখ-দুর্দশার দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হন না। তিনি নিজেকে জ্ঞানী মনে করেন। নিজেকে জড়-বিষয়ক জ্ঞানে অন্যদের থেকে তিনি সুখী ভাবেন, কেননা তিনি পাপকর্মের কু-ফল থেকে অনেকটা মুক্ত থাকেন। সত্ত্বগুণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন একজন যথার্থ ব্রাহ্মণ।
যখন কোন জীবসত্তা সত্ত্বগুণে প্রভাবিত হয়ে মানব শরীর ধারণ করে, তখন তিনি নিজেকে অন্যদের তুলনায় বেশী জ্ঞানী ও সুখী বলে অভিমান করেন এবং এইভাবে জ্ঞানাসক্তি ও সুখাসক্তি দ্বারা আবদ্ধ হন। এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ হচ্ছে বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকগণ। এঁদের প্রত্যেকেই তাঁর নিজের জ্ঞানের জন্য খুবই গর্বিত, এবং যেহেতু তাঁরা ধীরে ধীরে তাঁদের জীবনের অবস্থার উন্নতি সাধন করতে থাকেন, সেজন্য তাঁরা এক ধরণের জড় সুখ অনুভব করতে থাকেন। উন্নত সুখের এই ধারণার ফলে তাঁরা জড়া প্রকৃ্তির সত্ত্বগুণের দ্বারা আবদ্ধ হন। যতদিন তাঁরা এইভাবে কর্ম সম্পাদনে আগ্রহী থাকবেন, জ্ঞানাসক্তি (জড় জ্ঞান) ও সুখাসক্তি দ্বারা আবদ্ধ থাকবেন, ততদিন তাঁদেরকে একের পর এক এইরকম জড় শরীর ধারণ করতে হবে। এইভাবে মুক্তিলাভ করে চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তাঁদের থাকে না। এইভাবে বার বার একজনকে বিজ্ঞানী হয়ে জন্মাতে হয়, কাউকে বা বার বার দার্শনিকের জন্ম গ্রহণ করতে হয়, এবং প্রত্যেক জন্মে জন্ম জরা, মৃত্যু-রূপ ভয়ঙ্কর অসুবিধাগুলি তাঁদের সহ্য করতে হয়। কিন্তু মায়াময় জড়াশক্তির দ্বারা মোহিত হবার ফলে প্রত্যেক জীবনকেই তাঁরা অত্যন্ত সুখময় বলে মনে করেন। সেইজন্য, “ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, হে নিষ্পাপ ! এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অপক্ষাকৃত নির্মল, প্রকাশক এবং পাপশূন্য । এই সত্ত্বগুণ ‘আমি সুখী’ এই প্রকার সুখাসক্তি এবং ‘আমি জ্ঞানী’ এই প্রকার জ্ঞানাসক্তির দ্বারা আত্মাকে আবদ্ধ করে। ”
(ভ.গী. ১৪/৬)
সত্ত্বগুণে প্রভাবিত হবার দৃষ্টান্তঃ
ডঃ ব্রাইট ও তাঁর স্ত্রী মিসেস ব্রাইট তাঁদের দুটি সন্তান সহ একটি শান্ত গ্রাম্য শহরে একটি ছোটখাট কিন্তু সুন্দর একটি গৃহে থাকেন। ডঃ ব্রাইট একজন স্থানীয় এম. ডি; তিনি খুব চিন্তাশীল, গুণবান মানুষ এবং তাঁর দায়িত্ব সততার সংগে নিঃস্বার্থভাবে পালন করার জন্য তিনি তাঁর অঞ্চলে অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁর সখ হচ্ছে দর্শন, কাব্য ও বিজ্ঞান-সম্বন্ধীয় বই পড়া। ছেলেমেয়েরা যখন বাড়িতে থাকে, তখন মিসেস ব্রাইট তাঁদেরকে নিয়ে বাড়ীর চারপাশের বাগান দেখাশনা করেন, শাক-সব্জি চাষ করেন এবং তাঁদের গরুটির যত্ন নেন। এই ব্রাইটেরা বেশ সচ্ছল, সম্পন্ন পরিবার; এবং ঈশ্বর তাঁদের যা দিয়েছেন সেজন্য তাঁরা তাঁকে ধন্যবাদ জানান, এবং ধর্ম আচরণকে এক অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে মনে করেন। যে কেউ-ই তাঁদেরকে অত্যন্ত পুণ্যবান বলে নিঃসন্দেহে অভিহিত করবেন। তাঁরা জুয়া বা লটারী খেলেন না, সবরকম নেশা তাঁরা কঠোরভাবে বর্জন করেছেন; মদ্যপান বা ধূমপান দূরে থাকুক, তাঁরা চা কিংবা কফিও পান করেন না। চিকিৎসক ব্রাইট তাঁর অনেক রুগীদেরকে তাদের অবৈধ যৌন সংসর্গের জন্য নানা রোগে ভুগতে দেখেছেন; তাঁদের পরিবার সম্পূর্ণভাবে অবৈধ সংসর্গ থেকে মুক্ত। তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত, তাঁর স্ত্রীও তাঁর প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। বহু পূর্বেই ব্রাইট ও তাঁর স্ত্রী স্থির করেছিলেন যে, যেহেতু পশুহত্যা সংগঠিট পাপকর্ম, সেজন্য তাঁরা পশুদের দেহ ভক্ষণ করবেন না। সুতরাং তাঁরা নিরামিষ আহার করেন- মাছ-মাংস কখনই গ্রহণ করেন না। এইভাবে, ব্রাইটেরা খুব পরিচ্ছন্ন, সরল ও সুখী জীবন যাপন করেন। কিন্তু ব্রাইট সম্পত্তি সুখ ও জ্ঞানের অভিমানের দ্বারা প্রভাবিত; তাঁরা তাঁদের স্বপ্নিল সুখময় জগতের প্রতি আসক্ত; সেজন্য তাঁরা সত্ত্বগুণের দ্বারা জড়াপ্রকৃ্তিতে আবদ্ধ রয়েছেন।