আমাদের বিশেষ বিশেষ ধরণের স্বভাব, আচরণ কেন?
আমরা সাধারণতঃ ভেবে থাকি যে আমরাই আমাদের কার্যকলাপের নিয়ামক এবং আমরাই আমাদের চলা-ফেরা কাজকর্মের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন যে বিষয়টি আদৌ তা নয়। তিনি বলেন যে আমরা সম্পূর্ণভাবে তাঁর অপরা প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; আমারা প্রকৃতির ক্রীড়নক (পুতুল) মাত্র। তারের দ্বারা যেমন উপর থেকে পুতুল নাচানো হয়, তেমনি প্রকৃতির ত্রিগুণ-রূপ রজ্জু বা দড়ির দ্বারা আমরা নিয়ন্ত্রিত হই; আমাদের আচার-আচরণ, কাজকর্ম জড়গুণগুলির দ্বারা উদ্রিক্ত হয়, সেজন্য বিভিন্ন মাত্রার বিভিন্ন গুণে আচ্ছাদিত থাকায় বিভিন্ন মানুষের – সকল বদ্ধজীবের স্বভাব, আচরণের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “সকলেই অসহায়ভাবে মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম করতে বাধ্য হয়। তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না।” (ভ.গী.)৩/৫)। কেবল আপনি আমি নই, শ্রীকৃষ্ণ বলেনঃ “এই পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে অথবা স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে এমন কোন জীব নেই, যে প্রকৃতির গুণ থেকে মুক্ত”।
পূর্বে প্রদত্ত সত্ত্বগুণের দৃষ্টান্তে ফিরে আসা যাক। আমাদের বিজ্ঞ চিকিৎসক ডঃ ব্রাইট নিজেকে খুব জ্ঞানী বলে জানেন এবং তাঁর সুন্দর ঘরে, তাঁর লাইব্রেরীতে জীবন অতিবাহিত করে তিনি জড়জাগতিকভাবে সুখী মনে করেন। যদিও আপাতঃদৃষ্টিতে তাঁর জীবন আনন্দময় মনে হয়, তাঁর ধারণা সত্যি মনে হয়, কিন্তু বাস্তব চিত্রটি সম্পূর্ণ অন্য। তিনি দেহাত্মবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন, জড়জাগতিক ভ্রান্ত ধারণায় প্রভাবিত; নিজের নশ্বর, অস্থায়ী দেহটিকে তিনি ‘আমি’ মনে করেন, অথচ সেটি কিছু জড় উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত জড়াপ্রকৃতির তৈরী একটি যন্ত্র মাত্র, যা অচিরেই বিশ্লিষ্ট হয়ে প্রকৃতির ভৌত উপাদানে মিশে যাবে। দেহাত্মবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন থাকায় তিনি মোহগ্রস্ত, অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন। তিনি নিজেকে ভাবছেন তিনি হচ্ছেন “ডঃ ব্রাইট”, একজন ‘আমেরিকান’, ‘মধ্য বয়স্ক’, ‘স্বামী’, ‘পিতা’, ‘সুশিক্ষিত’, ‘ভদ্রলোক’। তিনি এখনো এই উপলব্ধি লাভ করতে পারেন নি যে বাস্তবে তাঁর ক্ষণস্থায়ী দেহটিও নন, মনও নন; তিনি শুদ্ধ চিন্ময় আত্মা, জীবাত্মা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাস। যেহেতু তিনি নিজেকে তাঁর দেহের সংগে সম্পৃক্ত করে ফেলেন, এক, অভিন্ন বলে ভাবেন, সেজন্য তিনি অবশ্যই ঐ শরীরের নিয়ামক প্রকৃতির আইন বা নিয়মগুলির প্রভাবাধীন, বদ্ধ।
সেজন্য তিনি অবশ্যই জড় শরীরের সমস্যাগুলি- জন্ম-জরা-ব্যাধি দ্বারা পীড়িত হতে থাকবেন, এগুলি থেকে তিনি অব্যাহতি পাবেন না।
সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত, আবদ্ধ হলে যদি এই পরিণতি হয়, তাহলে যারা নিম্নতর গুণগুলির দ্বারা আবদ্ধ তাদের কথা আর বলার কি আছে? স্মিথদের মতো যাঁরা রজোগুণে আচ্ছাদিত, তাঁরা তাঁদের অন্তহীন বিষয়বাসনা, জড় ভোগ-তৃষ্ণা আর কর্ম-প্রবণতার দ্বারা আবদ্ধ হন। আর মিঃ ডাল ও মিস গ্রাম্বেলের মতো যারা তমোভাবাচ্ছন্ন, তারা প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা জড়া প্রকৃতিতে আবদ্ধ থাকে ও নিরন্তর জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু দ্বারা ভঙ্গুর জড় শরীরে নিষ্পেষিত হতে থাকে।
আমাদের প্রকৃত জীবন হচ্ছে চিন্ময়, এবং সেজন্য তা শাশ্বত, দিব্যজ্ঞানময় ও আনন্দময়। সত্ত্বগুণে প্রভাবিত হলে আমরা ঐ শাশ্বত পারমার্থিক বাস্তবতার আভাস আমাদের জড় জ্ঞান ও জড় সুখের মধ্যে আস্বাদন করার চেষ্টা করি; রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত হলে আমরা কাম ও ধন-সম্পদের মাধ্যমে তা পেতে চাই (ঐ চিন্ময় বাস্তবতাকে প্রতিফলিত দেখতে চাই), আর তমোগুণে প্রভাবিত হলে আমরা নিদ্রা ও মাদকাসক্তির মাধ্যমে তা আস্বাদন করি। এইভাবে আমাদের জড়াপ্রকৃতির গুণগুলির প্রভাবে উৎপন্ন দূষিত বাসনাগুলির প্রভাবে আমাদের শুদ্ধ চিন্ময় স্বরূপ এই জড় জগতে বিকৃতভাবে প্রতিভাত হয়।
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ‘স্বরাট’, অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ রূপে স্বাধীন। তিনি তাঁর যা ইচ্ছা, তাই-ই করতে পারেন। আর আমরা যেহেতু ভগবানের ক্ষুদ্র অংশ, সেজন্য আমাদের মধ্যেও স্বতন্ত্রতা-বোধ, স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে – তবে তা অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে। সেজন্য আমাদের বাসনা অনুসারে আমাদের দেহ সত্ত্ব, রজো বা তমো গুণে, অথবা এইসব গুণের মিশ্রণের প্রভাবে ক্রিয়া-আচরণ করতে থাকে, কেননা এই বাসনাগুলি জড়। এই বাসনাগুলি পূরণের চেষ্টা করি তাও জড়।
ভ্রান্ত তত্ত্বঃ একটি পাপময় জীবনের বিনিময়ে অনন্তকাল নরক বাস?
পৃথিবীর কিছু কিছু ধর্ম-সম্প্রদায়ে এই মত প্রচলিত রয়েছে যে জীবন একটিই, এবং এই জীবন সৎকর্ম করে অতিবাহিত করলে অনন্ত কালের জন্য স্বর্গ-বাস লাভ হয়, আর পাপকর্মে অতিবাহিত করলে অনন্ত কালের জন্য নরকের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়, যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটি কেবল ধর্মীয় মতান্ধতা ছাড়া কিছুই নয়, কেননা জীবন একটি নয়; জীবন একটি হলে পৃথিবীতে বিভিন্ন জীবনের যে অসাম্য রয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না, বিধাতা পক্ষপাত-দুষ্ট হয়ে পড়েন; তাছাড়া কেউ সম্পূর্ণভাবে পাপী নয়, আবার পরিপূর্ণভাবে সৎকর্মকারীও খুবই বিরল; সুতরাং তাদের পুণ্য ও পাপের ফল লাভ ঘটবে কিভাবে? স্পষ্টতঃই, সংবেদনশীল, ভগবৎ-সচেতন মানুষের কাছে এই ধরণের চরম বিচারের ব্যবস্থাটিকে ঈশ্বরীয়র থেকে বরং আসুরিক ধরণের মনে হয়। এটা কি সম্ভব যে মানুষও যখন অন্যদের প্রতি করুণা, দয়া প্রদর্শন করে থাকে, তখন ভগবানের মধ্যে এইরকম অনুভূতি নেই, তিনি নিষ্করুণ? ভগবান ও তাঁর নিজ অবিচ্ছেদ্য অংশ জীবসমূহের মধ্যে যে শাশ্বত প্রেমের বন্ধন রয়েছে, ঐসব অযৌক্তিক ধর্মীয় শিক্ষা তার পরিপন্থী। সংজ্ঞানুসারে (মানুষ ঈশ্বরের অনুরূপে তৈরী- ম্যান ইজ মেড ইন দ্য ইমেজ অব্ গড), সমস্ত গুণাবলী ভগবানের মধ্যে পূর্ণতার পরম মাত্রা পর্যন্ত থাকতে হবে। এর মধ্যে একটি গুণ হচ্ছে করুণা।
একটি সংক্ষিপ্ত মানব জীবনের শেষে অনন্ত কাল নরকে দগ্ধ হওয়ার এই ধারণা অত্যন্ত করুণার অধিকারী একজন পুরুষের ধারণার সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
একটি সংক্ষিপ্ত মানব জীবনের শেষে অনন্ত কাল নরকে দগ্ধ হওয়ার এই ধারণা অত্যন্ত করুণার অধিকারী একজন পুরুষের ধারণার সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমনকি একজন সাধারণ পিতাও তার পুত্রের জীবনকে সুন্দর করার জন্য ঐ পুত্রের অনেক ভুল ক্ষমা করেন, একাধিক সুযোগ তাকে দিয়ে থাকেন।
ভগবান পূর্ণ, সুতরাং তাঁর গুণাবলীও পূর্ণ। এরকম একটি গুণ হচ্ছে তাঁর করুণা। ভগবান পরম করুণাময়, সেজন্য কোনো জীবকে তিনি অনন্ত নরকবাসের শাস্তি দিতে পারেন না। বৈদিক শাস্ত্রে বার বার ভগবানের করুণাপরতার কথা বলা হয়েছে। ভগবান প্রত্যেক জীব-হৃদয়ে অবস্থান করেন, এবং তাদের সমস্ত আকাঙ্ক্ষার কথা জানেন; সেজন্য তাদের উপলব্ধির বিকাশের জন্য তিনি তাদের ঐসব আকাঙ্ক্ষাগুলি চরিতার্থ করার সুযোগ দেন। প্রকৃতপক্ষে, ভগবানের করুণার কোনো অবধি নেই, শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সুহৃদ, প্রত্যেক জীবাত্মাকে তিনি ভালবাসেন, তাই তিনি অসীম করুণাময়। আমাদের যোগ্যতা না থাকলেও তিনি আমাদের বার বার সুযোগ দান করেন যাতে আমরা আত্মোপলব্ধির স্তরে উপনীত হই, জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে অব্যহতি লাভ করি।
পুনর্জন্মের তত্ত্ব অনুসারে, এমনকি একজন কুক্রিয়াসক্ত ব্যক্তিও যদি সামান্য একটুও সৎকর্ম করেন, শ্রীকৃষ্ণ তা বিস্মৃত হন না, তিনি তা সঞ্চিত রাখেন। কেউই সম্পূর্ণতঃ একশো ভাগ পাপী নয়। তেমনি কোন জীবাত্মা যদি সামান্য একটুও পারমার্থিক উন্নতি করে, সেটি ধ্বংস হয় না; পরজন্মে তাকে আরো পারমার্থিক উন্নতি করার জন্য অধিকতর উন্নত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে করে সে তার অন্তর্নিহিত চিন্ময় গুণাবলী বিকশিত করার সুযোগ পায়। এভাবে ভগবৎচেতনা লাভ করলে তার আর জড় দেহের প্রয়োজন হয় না, সে শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় চিন্ময় জগতে তার নিত্য আলয়ে ফিরে যায়।
কর্মবন্ধন-শূন্য কর্ম করা যায় কিভাবে?
তাহলে, কুকর্ম করলে দুঃখভোগ করতে হবে, আবার সৎকর্ম করলেও ফলভোগের বন্ধনে, কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জন্ম-মৃত্যু-প্রভৃতি দুর্দশাভোগ করতে হবে, তাহলে কেমন ধরণের কর্ম করা উচিত আমাদের? উত্তর হচ্ছে, কর্ম সম্পাদিত হওয়া উচিত জড়ীয় ত্রিগুণের প্রভাবহীন, অ-প্রাকৃত, চিন্ময় স্তরে। যখন সচ্চিদানন্দবিগ্রহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য কোনো কর্ম সম্পাদিত হয়, কার্যকলাপ যখন কৃষ্ণ-সম্বন্ধযুক্ত হয়, তা তখন প্রকৃতির গুণের স্পর্শ-লেশশূন্য, চিন্ময় হয়ে ওঠে। এইভাবে কৃতকর্মের ফলভোগে কর্মকর্তা বাধ্য থাকেন না; এই কর্মে কর্মবন্ধন হয় না, বরং জড়বন্ধন স্তব্ধ হয়। এজন্য এই ফলবন্ধন-রহিত কর্মকে বলা হয় অ-কর্ম। কর্ম করেও ‘কর্ম’ না করা, অর্থাৎ কর্মফলে বিজড়িত না হবার একমাত্র উপায় এইটি, শ্রীকৃষ্ণ যা শিক্ষা দিয়েছেন। সম্পাদনকারী জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে, জড়া প্রকৃতির ভঙ্গুর আবরণ – জড় দেহ হতে বিমুক্ত হয়ে চিন্ময় জগতে ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তন করেন, সেখানে নিত্য – শাশ্বত আনন্দময় জীবন উপভোগ করেন।
উদাহরণস্বরূপ, ক্লাসে কোনো দুজন ছাত্রের একজন ভক্ত, অন্য জন জড়-বিষয়াসক্ত সকাম কর্মী। ভক্ত ছাত্রটি শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে পড়াশুনা করে। কেমন করে তা সম্ভব? ক্লাসে যে-সমস্ত বিষয় সে অধ্যায়ন করে তা সবই জড় বস্তু সম্বন্ধীয়; তাহলে এই পড়াশুনা কিভাবে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম হবে? ভক্ত ছাত্রটি উপলব্ধি করতে পারে যে তার এই কলেজের শিক্ষা অবশেষে তাকে একটি কাজ বা চাকরী দেবে, যার সাহায্যে সে তার পরিবারের সদস্যদের, তার উপর যারা নির্ভরশীল তাদের ভরণ-পোষণের সংস্থান করতে পারবে; কিন্তু প্রকৃত জীবন, প্রকৃত বাস্তব ও শাশ্বত সম্পর্ক হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে, জাগতিক সমস্ত সম্পর্কই অস্থায়ী। সুতরাং সে প্রতিদিন যে নির্দিষ্ট সংখ্যায় হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করে, চারটি বিধিনিষেধ পালন করে, শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ অধ্যায়ন করে; সাপ্তাহিক গীতা বা ভাগবত ক্লাসে যোগদান করে- এইভাবে সে চেতনার পবিত্রতা রক্ষা করে। এছাড়াও, কেবল শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে কর্তব্য পালনের জন্য সে তাঁর কলেজের শিক্ষা গ্রহণ করে। সে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য জানেঃ শুদ্ধ কৃষ্ণচেতনা, শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভ করে শ্রীকৃষ্ণের শাশ্বত ধামে ফিরে যাওয়া।
অপর ছাত্রটি জানে যে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান; কিন্তু প্রবলভাবে সে জড়জগতের ভোগবিলাসের প্রতি আকৃষ্ট। সে তার ভোগ বাসনাগুলি পূরণের উদ্দেশ্যে অধ্যায়ন করে – কঠোর প্রচেষ্টা। বিধিনিয়মগুলি সে পালন করে না, এবং সবসময়ই ভবিষ্যতের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনায় – নিজের, বা পরিবারের জন্য – ব্যস্ত থাকে। এইভাবে, সে হচ্ছে সকাম কর্মী, অর্থাৎ জড়ীয় ভোগবাসনা পূরণের জন্য সে কর্ম পড়াশুনা করে।
আপাতঃদৃষ্টিতে দুজন ছাত্র একই কর্ম – কলেজশিক্ষা গ্রহণ করছে বলে মনে হলেও তাদের চেতনার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ পরিণতিও হবে ভিন্ন। সকাম কর্মী ছাত্রটি তার ভবিষ্যতের জন্য, অর্থাৎ আমৃত্যু বিষয় ভোগ করে যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করার জন্য বহুরকম পরিকল্পনায় নিমগ্ন থাকায় জড়া প্রকৃতির গুণগুলির দ্বারা, বিশেষতঃ রজোগুণের দ্বারা- আরো বেশি বেশি করে প্রভাবিত হতে থাকবে। পক্ষান্তরে ভক্তিযোগী ছাত্রটি কলেজে বা উত্তর জীবনে কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করতে থাকবে, এবং ধীরে ধীরে জড়গুণগুলির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধসত্ত্ব, অর্থাৎ নির্গুণ বা চিন্ময় অবস্থা লাভ করবে। এইরকম শুদ্ধসত্ত্ব-চেতনাসম্পন্ন ভক্ত সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। তার উপর জড়ীয় গুণগুলির ক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং তার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের করুণাধারা প্রবাহিত হতে শুরু করে।
অর্জুন ও দুর্যোধনঃ আদর্শ দৃষ্টান্ত হচ্ছে অর্জুন ও দুর্যোধন। অর্জুন ও দুর্যোধন উভয়েরই রথ ছিল; দুজনেরই তীর-ধনুক ছিল; দুজনেই ছিল ক্ষত্রিয়; দুজনেই প্রবল পরাক্রমের সংগে যুদ্ধ করার জন্য তৈরী ছিল। বাইরে থেকে দুজনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বলে মনে হয়। কিন্তু উভয়ের চেতনার মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য। দুর্যোধন তার নিজের বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করছিলেন, আর অর্জুন যুদ্ধ করছিলেন শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানের জন্য। দুর্যোধন নিজেকে সবকিছুর নিয়ন্তা বলে মনে করত এবং পাণ্ডবদের শেষ করার জন্য সে বহু বহু মাস্টার-প্ল্যান তৈরী করেছিল। পক্ষান্তরে অর্জুন জানতেন যে সবকিছুই চলছে, কার্য করছে শ্রীকৃষ্ণের পরম ইচ্ছার প্রভাবে, এবং তিনি কেবল শ্রীকৃষ্ণের হাতের একটি যন্ত্র বা পুতুল মাত্র, শ্রীকৃষ্ণ যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে তাঁকে ব্যবহার করতে পারেন। এই হচ্ছে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার পন্থা।