ক্ষত্রিয় আমার আপনার তৈয়ারী কিছু নহে – ক্ষত্রিয় ঈশ্বর বা প্রকৃতির সৃষ্টি। আপনার রক্ত কণিকার মধ্যেও বাস করে কতকগুলি ক্ষত্রিয়। আপনার দেহের বিষ্ফোটকে অস্ত্রোপচার করিয়া চিকিৎসক যখন কতকগুলি পূঁজ ফেলিয়া দেন, তখন আপনি হয়ত ভাবিবার সময় পান না যে উহারা আপনার রক্তপ্রবাহনিবাসী ক্ষত্রিয় শহীদগণের মৃতদেহগুলি মাত্র। উহারা প্রাণ দিয়াছে বলিয়া আপনার প্রাণ বাঁচিয়াছে।
৮। ভোগবাদী বলেন, কোন দার্শনিক মতবাদই চরম সত্য নহে। সকলই আপেক্ষিক সত্য, দেশ ও কালের অধীন। মানুষের আবেষ্টনী তাহার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত করে। সুতরাং সকল দার্শনিক সিদ্ধান্তই কোনও কালে কোনও আবেষ্টনির মধ্যে সত্য। সার্ব্বজনীনতা, সার্ব্বকালীনতা কোন সত্যের থাকিতে পারে না।
এই যুক্তি যদি সত্য হয়, ভোগবাদীর দর্শনও চরম সত্য নহে। তাহা কেবল তাহার বিশিষ্ট দেশ-কাল-পাত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যাহা সার্ব্বজনীন নহে, তাহা অন্যের উপর চাপাইবার চেষ্টাও ভোগবাদীর পক্ষে অকর্তব্য। যে ত্রুটি অন্যে দেখান হয়, তাহা যে নিজেরও আছে, ইহা ভুলিয়া যাওয়া উচিত হয় না।
বিজ্ঞান চরম সত্যের দাবি রাখে না, সত্যই। তাহার সকল সত্যই পরীক্ষাধীন (hypothetical)। কোন সত্যই পরম (absolute) নহে। এইরূপ সত্য লইয়া বিজ্ঞান পথ চলিতে পারে বটে, কিন্তু ধর্ম্ম পারে না। আলোর মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আলোকণা (light particle) নাও থাকিতে পারে। হয়তো সকলই তরঙ্গতুল্য (wave)। এই বিষয় লইয়া দিনের পর দিন গবেষণা চলিতে পারে। কিন্তু ধর্ম্মের রাজ্যের মধ্যে শাশ্বত সত্য অপরিহার্য্য। পরমাণু সত্য না হইলেও পদার্থ বিদ্যা চলিতে পারে। কিন্তু ঈশ্বর না থাকিলে পূজা প্রার্থনা চলিতে পারে না। Help me O God, if there be any- ভগবান্ যদি থাকো, তবে রক্ষা কর- এইরূপ প্রার্থনা ব্যর্থ। প্রার্থনা যাঁর কাছে, তিনি নিশ্চয়ই আছেন ও শুনিতেছেন, এই অনুভব ছাড়া প্রার্থনা চলিতে পারে না। ঈশ্বর যে আছেনই, ইহা সাধক জানেন আধ্যাত্মিক অপরোক্ষ অনুভূতি দ্বারা। এই অনুভূতি বিজ্ঞানের এলাকার বহু দূরে। সুতরাং এ বিষয়ে নীরবতা অবলম্বনই ভোগবাদীর কর্ত্তব্য। ‘য পশ্যতি স পশ্যতি’- যে ঈশ্বরকে জানিয়াছে, সে ঠিকই জানে, সমগ্র জীবন দিয়া জানে যে, তিনি আছেনই। অন্যের গলাবাজিতে তাহা টলিতে পারে না।
৯। আমাদের জীবন-নীতি (ethics) সর্ব্বমানবীয় নহে- ভোগবাদীর এই কথাও ঠিক নহে। রীতি ও নীতি দুইটি স্বতন্ত্র ব্যাপার। রীতি দেশ-কাল-পাত্র অনুগত থাকিয়া সর্ব্বদা পরিবর্তিত হইতেছে। কিন্তু নীতে তাহা নহে। মহামূল্যবান জীবনের ধ্রুব নীতিগুলির মূল্য সর্ব্বদেশে, সর্ব্বকালে সমান। সত্যরক্ষা, কল্যাণ-কামনা, আনন্দানুসন্ধান, অচৌর্য্য, অহিংসা, পবিত্রতা প্রভৃতি জীবনের মূলনীতিগুলি চিরকালই মানব জীবনের ভিত্তিস্বরূপ। এই নীতিগুলি বিশ্বজনীন (cosmic), বিশ্বের মূল অখণ্ড কনস্টিটিউসনের মধ্যে ইহাদের বিদ্যমানতা। বিশ্বের অন্যান্য যাবতীয় খণ্ডনীতি ঐ নীতির অধীন থাকিলে, তবে কল্যাণ আসে। ইহার বিরুদ্ধে চলিলে, চরম বিনষ্টি ঘটে।
ঐ সকল পরম নীতিগুলি যে স্থানে পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাই ঈশ্বরীয় ভুমি। যিনি সত্যস্বরূপ, কল্যাণ-স্বরূপ ও আনন্দঘন, যেখানে হিংসাদি অপগুণ নাই- কেবল প্রেম, ঔদার্য্য ও বিশ্বজনীনতা যাঁহাতে মূর্ত- তিনিই ঈশ্বর। শাশ্বতী নীতিগুলিকে স্বীকার করিলেই তাহার সুদৃঢ় ভিত্তিভূমি, সকল সৌন্দর্য্য-মাধুর্য্যের আধার-ভূমিকে স্বীকার করিতে হয়। এইরূপ একজন ঈশ্বর থাকাই সম্ভব, এই পর্য্যন্ত বলিবে বুদ্ধি-প্রধান বিজ্ঞান। তিনি যে আছেনই, তাঁহাকে দর্শন করিয়াছি- একথা বলিবে সাধক ঋষি। বিজ্ঞানী ঋষি আইনস্টাইন বলিয়াছেন- ঈশ্বর নিশ্চয় আছেন।
১০। জড়বাদী বলেন, স্বাধীনতা বলিয়া কিছু নাই, সবই পূর্ব্বনিয়ন্ত্রিত। এইরূপ কথা বিজ্ঞানীর নিকট হইতেও পূর্ব্বে শোনা যাইত। এখন আর বলে না। উন্নত-বিজ্ঞান পরমাণুর মধ্যস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইলেকট্রনের মধ্যে চেতনার অবস্থিতি অনুমান করিতেছে। ইলেকট্রনের গতি ও স্থিতি কিছুতেই নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা যায় না এবং একটা স্বাধীন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।
স্বাধীন ইচ্ছা আছে কিনা, ইহা লইয়া পাশ্চাত্ত্য জগতে গবেষণার অন্ত নাই। স্বাধীন ইচ্ছা আছে, এই পক্ষেও বহু যুক্তি আছে। ইহার বিপক্ষেও বহু যুক্তির অবতারণা হইয়াছে। আর্য্য ঋষি এই প্রশ্ন অন্য দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন। স্বাধীন ইচ্ছা আছে কি নাই, প্রশ্ন ইহা নহে। প্রশ্ন হইল, উহা কে কতটুকু অর্জন করিয়াছে। যে ব্যক্তি জড় বস্তুর সঙ্গে নিজেকে এক মনে করিয়াছে, তাহার স্বাধীনতা ঠিকই নাই। আর যিনি পূর্ণ চৈতন্যের সহিত একত্বের অনুভব করিয়াছেন বা তাঁহার সহিত ঘনিষ্টতা করিয়াছেন, তাঁহার স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ, অখণ্ড ও পরিপূর্ণ। এই দুই প্রান্তের মধ্যে যে যতখানি ব্রহ্মের নিকটবর্তী হইয়াছে, যে যতটুকু উন্নত হইয়াছে, তার ততটুকু স্বাধীনতা। স্বাধীন ইচ্ছার অর্থ হইল মুক্তি। মুক্তির জন্যই ত জীবনের সাধনা। দেহের বন্ধন, সংস্কারের বন্ধন, মায়া-মোহ ও বাসনা কামনাদির বন্ধন প্রভৃতি শত সহস্র বন্ধনে আবদ্ধ সংসারী জীব। বন্ধন হইল দুঃখের জনক। মুক্তিই আনন্দ। সংসারে কেহ একান্তভাবে বদ্ধ, কেহ পূর্ণ মুক্ত। বদ্ধাবস্থা হইতে মুক্তাবস্থায় যাইবার জন্যই সকল সাধনা। সেই সাধনায় যে যতখানি সিদ্ধ, সে ততখানি মুক্ত। পূর্ণ স্বাধীন, স্বরাট, স্বেচ্ছাময় ব্রহ্মবস্তুর যে যত নিকট, সে তত মুক্ত। বদ্ধভাব হইতে মুক্তভাবে পৌঁছান, ইহাই প্রকৃ্ত জীবন যাত্রা। অর্জ্জুন ছিলেন বিষাদবদ্ধ- গীতা শ্রবণে তিনি হইলেন মুক্ত। তাই বিষাদ যোগ হইতে মোক্ষ যোগ পর্য্যন্ত গীতার যাত্রা। ইহা আমাদেরই জীবন যাত্রার কাহিনী।
বিষাদিত, মোহগ্রস্ত, আত্মসংবিৎ-স্মৃতিভ্রষ্ট, অশান্ত, সন্দেহদোলায় দোদুল্যমান জীব গীতার উপদেশ শুনিয়া, জীবন দিয়া গ্রহণ করিয়া, বলিতে পারে- মোহ গিয়াছে। স্মৃতি ফিরিয়াছে, স্থিরতা ও শান্তি পাইয়াছি। গতসন্দেহ হইয়াছি- এখন চলিব হে পূর্ণ স্বাধীন পুরুষোত্তম! তোমারই সঙ্কেতে, তোমারই ছায়ার মত। বদ্ধ জীবই সদা দুঃখগ্রস্ত, মুক্ত জীবই ব্রহ্মভূত। কি লৌকিক কি আধ্যাত্মিক, জগতের সকল চেষ্টার মূলে দুঃখী জীবের আত্যন্তিক দুঃখ-নিবৃত্তির প্রেরণা। কেবল তাহাই ব্রহ্মভূত অবস্থা, পরাশান্তির ও পরমানন্দের সোপান। দুঃখ নিবৃত্তি কেবল নয়, আনন্দ লাভই জীবের মৌলিক বাসনা। এই প্রেরণাই ধর্ম্মের জনক। এই প্রেরণাই সর্ব্বকার্য্যের জনক। সুতরাং প্রকৃ্ত অর্থপূর্ণ জীবনের সকল কার্য্যই ধর্ম্ম-মূলক। জীবন থাকিবে ধর্ম্ম থাকিবে না, একথা বলা যা, আর রামায়ণ থাকিবে রাম থাকিবে না, একথা বলাও তা। ধর্ম্ম ও শাশ্বত নীতির বোধ যতই মানুষের জাগিবে, ততই প্রকৃষ্ট কল্যাণ নিকটবর্তী হইবে। ধর্ম্ম-স্বরূপ যোগেশ্বরের সঙ্গে যুক্ত থাকিলেই, শাশ্বতী নীতিজ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত হইবে ইহাই গীতার চরম উপদেশ।
এর পর দেখুনঃ শ্রীমদ্ভগবদগীতার সারমর্ম তথা গীতার সার-কথা কি?
আপনার পছন্দমত
যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।