শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত অন্ত্য ১৬, শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত
শ্লোক: 36
আঁঠি-চোষা সেই পাটুয়া-খোলাতে ভরিয়া ।
বাহিরে উচ্ছিষ্ট-গর্তে ফেলাইলা লঞা ।।৩৬।।
অনুবাদঃ- চোষা আঁঠিগুলি কলার পাতা এবং খোলায় ভরে তিনি বাইরে উচ্ছিষ্ট-গর্তে সেগুলি ফেলে দিলেন।
শ্লোক: 37
সেই খোলা, আঁঠি, চোকলা চুষে কালিদাস ।
চুষিতে চুষিতে হয় প্রেমেতে উল্লাস ।।৩৭।।
অনুবাদঃ- সেই কলার খোলা, আমের আঁঠি ও চোকলা কালিদাস উচ্ছিষ্ট-গর্ত থেকে তুলে নিয়ে এসে চুষতে লাগলেন, এবং চুষতে চুষতে তিনি কৃষ্ণপ্রেমানন্দে উল্লসিত হলেন।
শ্লোক: 38
এইমত যত বৈষ্ণব বৈসে গৌড়দেশে ।
কালিদাস ঐছে সবার নিলা অবশেষে ।।৩৮।।
অনুবাদঃ- এইভাবে কালিদাস গৌড়দেশের সমস্ত বৈষ্ণবদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেছিলেন ।
শ্লোক: 39
সেই কালিদাস যবে নীলাচলে আইলা ।
মহাপ্রভু তাঁর উপর মহাকৃপা কৈলা ।। ৩৯ ।।
অনুবাদঃ- সেই কালিদাস যখন নীলাচলে এলেন তখন মহাপ্রভু তাঁকে বিশেষভাবে কৃপা করলেন।
শ্লোক: 40
প্রতিদিন প্রভু যদি যা’ন দরশনে ।
জল-করঙ্গ লঞা গোবিন্দ যায় প্রভু-সনে ।।৪০।।
অনুবাদঃ- প্রতিদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন মন্দিরে জগন্নাথদেবকে দর্শন করতে যেতেন, তখন গোবিন্দ তাঁর জলপাত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে যেতেন।
শ্লোক: 41
সিংহদ্বারের উত্তরদিকে কপাটের আড়ে ।
বাইশ ‘পাহাচ’-তলে আছে এক নিম্ন গাড়ে ।।৪১।।
অনুবাদঃ- সিংহদ্বারের উত্তর দিকে, দরজার পিছন দিকে, বাইশটি সিঁড়ির তলায় একটি ডোবা আছে।
শ্লোক: 42
সেই গাড়ে করেন প্রভু পাদ-প্রক্ষালনে ।
তবে করিবারে যায় ঈশ্বর-দরশনে ।।৪২।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেই ডোবায় পাদ-প্রক্ষালন করে, তারপর মন্দিরে শ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করতে যেতেন।
শ্লোক: 43
গোবিন্দেরে মহাপ্রভু কৈরাছে নিয়ম ।
‘মোর পাদজল যেন না লয় কোন জন’ ।।৪৩।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গোবিন্দকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমার পা ধোয়া জল যেন কেউ না নেয়।”
শ্লোক: 44
প্রাণিমাত্র লইতে না পায় সেই জল ।
অন্তরঙ্গ ভক্ত লয় করি’ কোন ছল ।।৪৪।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কঠোর নির্দেশের ফলে কোন প্রাণী তাঁর সেই পা ধোয়া জল গ্রহণ করতে পারত না। তাঁর কোন কোন অন্তরঙ্গ ভক্তই কেবল কোন ছলে সেই জল গ্রহণ করতে পেরেছিলেন।
শ্লোক: 45
একদিন প্রভু তাঁহা পাদ প্রক্ষালিতে ।
কালিদাস আসি’ তাঁহা পাতিলেন হাতে ।। ৪৫ ।।
অনুবাদঃ- একদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন সেখানে তাঁর পাদ প্রক্ষালন করছিলেন, তখন কালিদাস বসে সেই জল ভিক্ষা করে হাত পাতলেন।
শ্লোক: 46 -47
এক অঞ্জলি, দুই অঞ্জলি, তিন অঞ্জলি পিলা ।
তবে মহাপ্রভু তাঁরে নিষেধ করিলা ।।৪৬।।
“অতঃপর আর না করিহ পুনর্বার ।
এতাবতা বাঞ্ছা-পূরণ করিলুঁ তোমার ।।” ৪৭।।
অনুবাদঃ- তিনি একে একে তিন অঞ্জলি ভরে সেই জল পান করলেন, এবং তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে নিষেধ করে বললেন, “আমি তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি, আর কখনও এরকম কর না। ”
শ্লোক: 48
সর্বজ্ঞ-শিরোমণি চৈতন্য ঈশ্বর ।
বৈষ্ণবে তাঁহার বিশ্বাস, জানেন অন্তর ।। ৪৮।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সর্বজ্ঞ-শিরোমণি পরমেশ্বর ভগবান, তাই তিনি জানতেন যে কালিদাস অন্তরে বৈষ্ণবদের প্রতি কত শ্রদ্ধা-পরায়ণ ছিলেন।
শ্লোক: 49
সেইগুণ লঞা প্রভু তাঁরে তুষ্ট হইলা ।
অন্যের দুর্লভ প্রসাদ তাঁহারে করিলা ।। ৪৯ ।।
অনুবাদঃ- তাঁর সেই গুণের ফলে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে, অন্য সকলের দুর্লভ প্রসাদ তাঁকে দান করেছিলেন।
শ্লোক: 50
বাইশ ‘পাহাচ’-পাছে উপর দক্ষিণ-দিকে ।
এক নৃসিংহ-মূর্তি আছেন উঠিতে বামভাগে ।। ৫০।।
অনুবাদঃ- দক্ষিণ দিকে, বাইশটি সিঁড়ির পশ্চাতে উপরিভাগে এবং মন্দিরে উঠাকালীন বাঁ দিকে নৃসিংহদেবের একটি শ্রীবিগ্রহ আছে।
শ্লোক: 51
প্রতিদিন তাঁরে প্রভু করেন নমস্কার ।
নমস্করি’ এই শ্লোক পড়েন বারবার ।। ৫১ ।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রতিদিন সেই নৃসিংহদেবকে প্রণতি নিবেদন করে বারবার নিম্নলিখিত শ্লোক দুটি আবৃত্তি করতেন।
শ্লোক: 52
নমস্তে নরসিংহায় প্রহ্লাদাহ্লাদদায়িনে ।
হিরণ্যকশিপোর্বক্ষঃশিলাটঙ্ক-নখালয়ে ।।৫২।।
অনুবাদঃ- "“হে নৃসিংহদেব, আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আপনি প্রহ্লাদ মহারাজকে আনন্দ দান করেন, এবং পাথর কাটার ধারাল টঙ্কের মতো আপনার নখের দ্বারা আপনি হিরণ্যকশিপুর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিলেন।”
এই শ্লোকটি এবং পরবর্তী শ্লোকটি নৃসিংহ-পুরাণ থেকে উদ্ধৃত।
শ্লোক: 53
ইতো নৃসিংহঃ পরতো নৃসিংহো
যতো যতো যামি ততো নৃসিংহঃ ।
বহির্নৃসিংহো হৃদয়ে নৃসিংহো
নৃসিংহমাদিং শরণং প্রপদ্যে ।।৫৩।।
অনুবাদঃ- “নৃসিংহদেব এখানে রয়েছেন এবং তিনি অন্য দিকেও রয়েছেন। যেখানেই আমি যাই, সেখানেই আমি শ্রীনৃসিংহদেবকে দর্শন করি। তিনি আমার হৃদয়ে রয়েছেন এবং তিনি বাহিরেও রয়েছেন। তাই আমি আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের শরণ গ্রহণ করি।”
শ্লোক: 54
তবে প্রভু করিলা জগন্নাথ দরশন ।
ঘরে আসি’ করিলা মধ্যাহ্ন ভোজন ।।৫৪।।
অনুবাদঃ- এইভাবে শ্রীনৃসিংহদেবকে বন্দনা করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেবকে দর্শন করলেন, এবং তারপর তাঁর ঘরে ফিরে গিয়ে তিনি মধ্যাহ্ন ভোজন করলেন।
শ্লোক: 55
বহির্দ্বারে আছে কালিদাস প্রত্যাশা করিয়া ।
গোবিন্দেরে ঠারে প্রভু কহেন জানিয়া ।।৫৫।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রসাদ পাওয়ার প্রত্যাশায় কালিদাস দ্বারের বাহিরে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। তা জেনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গোবিন্দকে ইঙ্গিতে কিছু বললেন।
শ্লোক: 56
মহাপ্রভুর ইঙ্গিত গোবিন্দ সব জানে ।
কালিদাসেরে দিল প্রভুর শেষপাত্র-দানে ।।৫৬।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ইঙ্গিত গোবিন্দ বুঝতে পারতেন, এবং তাই তিনি তৎক্ষণাৎ মহাপ্রভুর অবশিষ্ট পাত্র নিয়ে কালিদাসকে দিলেন।
শ্লোক: 57
বৈষ্ণবের শেষ-ভক্ষণের এতেক মহিমা ।
কালিদাসে পাওয়াইল প্রভুর কৃপা-সীমা ।।৫৭।।
অনুবাদঃ- বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণের এমনই মহিমা যে তার ফলে কালিদাস শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরম কৃপা লাভ করলেন।
শ্লোক: 58
তাতে ‘বৈষ্ণবের ঝুটা’ খাও ছাড়ি’ ঘৃণা-লাজ ।
যাহা হৈতে পাইবা নিজ বাঞ্ছিত সব কাজ ।।৫৮।।
অনুবাদঃ- তাই, সমস্ত ঘৃণা এবং লজ্জা পরিত্যাগ করে, বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ কর, তাহলে তোমার সমস্ত অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।
শ্লোক: 59
কৃষ্ণের উচ্ছিষ্ট হয় ‘মহাপ্রসাদ’ নাম ।
‘ভক্তশেষ’ হৈলে ‘মহা-মহাপ্রসাদাখ্যান’ ।।৫৯।।
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের উচ্ছিষ্টকে বলা হয় মহাপ্রসাদ, এবং তা যখন ভক্ত কর্তৃক আস্বাদিত হয় তখন তাকে বলা হয় মহা-মহাপ্রসাদ।
শ্লোক: 60
ভক্তপদধূলি আর ভক্তপদ-জল ।
ভক্তভুক্ত-অবশেষ, --তিনি মহাবল ।।৬০।।
অনুবাদঃ- ভক্তের পদধূলি, ভক্তের পা ধোয়া জল এবং ভক্তের ভুক্তাবশিষ্ট—এই তিনটি বস্তু মহাশক্তিশালী।
শ্লোক: 61
এই তিন-সেবা হৈতে কৃষ্ণপ্রেমা হয় ।
পুনঃ পুনঃ সর্বশাস্ত্রে ফুকারিয়া কয় ।।৬১।।
অনুবাদঃ- এই তিনের সেবার ফলে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়। সমস্ত শাস্ত্রে বার বার সে কথা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা হয়েছে।
শ্লোক: 62
তাতে বার বার কহি, -- শুন ভক্তগণ ।
বিশ্বাস করিয়া কর এ-তিন সেবন ।।৬২।।
অনুবাদঃ- তাই, হে ভক্তগণ, বিশ্বাস সহকারে এই তিনের সেবা করুন।
শ্লোক: 63
তিন হৈতে কৃষ্ণনাম-প্রেমের উল্লাস ।
কৃষ্ণের প্রসাদ, তাতে ‘সাক্ষী’ কালিদাস ।।৬৩।।
অনুবাদঃ- এই তিনের প্রভাবে জীবনের পরম উদ্দেশ্য – কৃষ্ণ-প্রেম লাভ হয়। এইটিই শ্রীকৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রসাদ। তার প্রমাণ কালিদাস স্বয়ং।
শ্লোক: 64
নীলাচলে মহাপ্রভু রহে এইমতে ।
কালিদাসে মহাকৃপা কৈলা অলক্ষিতে ।।৬৪।।
অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইভাবে নীলাচলে অবস্থান করছিলেন, এবং অলক্ষিতে তিনি কালিদাসকে মহাকৃপা করলেন।
এরপর দেখুন=
বিভিন্ন পূরাণ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।