শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 106
সমাশ্রিতা যে পদপল্লবপ্লবং
মহৎপদং পুণ্যযশো মুরারেঃ ।
ভবাম্বুধির্বৎসপদং পরং পদং
পদং পদং যদ্বিপদং ন তেষাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৫৮)
অনুবাদঃ- মহৎ-তত্ত্বের আশ্রয় এবং মুরারি নামে খ্যাত শ্রীভগবানের পদ-পল্লবরূপ নৌকাকে যাঁরা আশ্রয় করেছেন, তাঁদের কাছে এই ভবসাগর গোষ্পদের মতো ক্ষুদ্র হয়ে যায়। পরম পদ বৈকুণ্ঠ লাভই তাঁদের লক্ষ্য। পদে পদে বিপদসঙ্কুল এই জড় জগৎ তাঁদের জন্য নয়। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 107
এতাং স আস্থায় পরাত্মনিষ্ঠা-
মধ্যাসিতাং পূর্বতমৈর্মহর্ষিভিঃ ।
অহং তরিষ্যামি দুরন্তপারং
তমো মুকুন্দাঙ্ঘ্রিনিষেবয়ৈব ।।
(ভাগবত ১১/২৩/৫৭)
অনুবাদঃ- প্রাচীন মহাজনদের উপাসিত এই পরাত্মনিষ্ঠারূপ সন্ন্যাস-আশ্রম অবলম্বন করে, শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের সেবা করে, আমি এই দুস্তর সংসাররূপ অজ্ঞান-অন্ধকার অতিক্রম করব।
(অবন্তীদেশীয় ব্রাহ্মণ)
শ্লোক: 108
মুক্তির্হিত্বান্যথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ ।
(ভাগবত ২/১০/৬)
অনুবাদঃ- মায়িক স্থূল-সুক্ষ্ম রূপ পরিহার করে শুদ্ধ স্বরূপে অবস্থানের নাম মুক্তি ।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 109
ভবেহস্মিন্ ক্লিশ্যমানানামাবিদ্যাকামকর্মভিঃ ।
শ্রবণস্মরণার্হাণি করিষ্যন্নিতি কেচন ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৫)
অনুবাদঃ- আবার অন্য আরও অনেকে বলেন যে, অবিদ্যাজনিত কাম ও কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ জড়-জাগতিক দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত বদ্ধ জীবেরা যাতে ভক্তিযোগের সুযোগ নিয়ে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই শ্রবণ, স্মরণ, অর্চন আদি ভক্তিযোগের পন্থাসমূহ পুনঃপ্রবর্তনের জন্য তুমি অবতরণ করেছিলে ।
(শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুন্তিদেবী)
শ্লোক: 110
বিক্রীড়িতং ব্রজবধূভিরিদং চ বিষ্ণোঃ
শ্রদ্ধান্বিতোহনুশৃণুয়াদথ বর্ণয়েদ্ যঃ ।
ভক্তিং পরাং ভগবতি প্রতিলভ্য কামং
হৃদরোগমাশ্বপহিনোত্যচিরেণ ধীরঃ ।।
(ভাগবত ১০/৩৩/৩৯)
অনুবাদঃ- যিনি অপ্রাকৃত শ্রদ্ধান্বিত হয়ে এই রাস পঞ্চাধ্যায়ে ব্রজবধূদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত ক্রীড়া বর্ণনা শ্রবণ করেন বা বর্ণন করেন, সেই ধীর পুরুষ ভগবানে যথেষ্ট পরা ভক্তি লাভ করে হৃদরোগরূপ জড় কামকে দূর করেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 111
অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ ।
তীব্রেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ।।
(ভাগবত ২/৩/১০)
অনুবাদঃ- সর্বপ্রকার কামনা যুক্ত হোন, অথবা সম্পূর্ণ নিষ্কাম হোন, অথবা মুক্তিকামীই হোন, সুবুদ্ধিমান মানুষ তীব্র শুদ্ধ ভক্তিযোগে পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করবেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 112
কামদ্ দ্বেষাদ্ ভয়াৎ স্নেহাদ্ যথা ভক্তেশ্বরে মনঃ ।
আবেশ্য তদঘং হিত্বা বহবস্তদ্ গতিং গতাঃ ।।
(ভাগবত ৭/১/৩০)
অনুবাদঃ- ভগবানের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে যেমন তাঁর ধাম প্রাপ্ত হওয়া যায়, তেমনই অনেকেই কাম, দ্বেষ, ভয় ও স্নেহের প্রভাবে তাঁর প্রতি মনকে আবিষ্ট করে, তাঁদের পাপ কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে সেই গতি প্রাপ্ত হয়েছেন।
(মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদ মুনি)
শ্লোক: 113
কামং ক্রোধং ভয়ং স্নেহমৈক্যং সৌহৃদমেব চ ।
নিত্যং হরৌ বিদধতো যান্তি তন্ময়তাং হি তে ।।
(ভাগবত ১০/২৯/১৫)
অনুবাদঃ- যে সমস্ত ব্যক্তি অবিশ্রান্তভাবে তাঁদের কাম, ক্রোধ, ভয়, স্নেহ, নিরাকার ব্রহ্মের সঙ্গে ঐক্য অনুভব এবং সখ্যভাব আদি অনুভূতিকে ভগবান শ্রীহরির অভিমুখে চালিত করেন, বাস্তবিকই তাঁরা শ্রীহরির চিন্তায় তন্ময়তা লাভ করেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 114
ন সাধয়তি মাং যোগো ন সাংখ্যং ধর্ম উদ্ধব ।
ন স্বাধ্যায়স্তপস্ত্যাগো যথা ভক্তির্মমোর্জিতা ।।
(ভাগবত ১১/১৪/২০)
অনুবাদঃ- [পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন--] “হে উদ্ধব, আমার প্রতি প্রবলা ভক্তি যেমন আমাকে বশীভূত করতে পারে, অষ্টাঙ্গ-যোগ, অভেদ ব্রহ্মবাদ-রূপ সাংখ্য-জ্ঞান, বেদ অধ্যয়ন, সব রকম তপস্যা ও ত্যাগরূপ সন্ন্যাস আদির দ্বারা আমি সেই রকম বশীভূত হই না ।”
(উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
শ্লোক: 115
ক্বচিন্নিবর্ততেহভদ্রাৎ ক্বচিচ্চরতি তৎ পুনঃ ।
প্রায়শ্চিত্তমথোহপার্থং মন্যে কুঞ্জরশৌচবৎ ।।
(ভাগবত ৬/১/১০)
অনুবাদঃ- পাপকর্ম না করার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তিও কখনও কখনও পুনরায় পাপকর্মে লিপ্ত হয়, তাই আমি এই প্রায়শ্চিত্তের পন্থাকে হস্তীস্নানের মতো নিরর্থক বলে মনে করি। কারণ হস্তী স্নান করার পর ডাঙ্গায় উঠে এসেই তার মাথায় ও গায়ে ধূলি নিক্ষেপ করে।
শ্লোক: 116
কর্মণা কর্মনির্হারো ন হ্যাত্যন্তিকঃ ইষ্যতে ।
অবিদ্বদধিকারিত্বাৎ প্রায়শ্চিত্তং বিমর্শনম্ ।।
(ভাগবত ৬/১/১১)
অনুবাদঃ- (বেদব্যাস-নন্দন শ্রীল শুকদেব গোস্বামী উত্তর দিলেন—) হে রাজন! যেহেতু পাপকর্মের ফল নিষ্ক্রিয় করার এই পন্থাটিও সকাম কর্ম, তাই তার দ্বারা কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। যারা প্রায়শ্চিত্তের বিধি অনুসরণ করে, তারা মোটেই বুদ্ধিমান নয়। প্রকৃতপক্ষে, তারা তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তমোগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত না হয়, ততক্ষণ একটি কর্মের দ্বারা অন্য কর্মের প্রতিকারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়, কেন না তার ফলে কর্মবাসনা সমূলে উৎপাটিত হয় না। আপাতদৃষ্টিতে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের পুণ্যবান বলে মনে হলেও তারা পুনরায় পাপকর্মে লিপ্ত হবে, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। তাই প্রকৃত প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে বেদান্তের পূর্ণজ্ঞান লাভ করা, যার দ্বারা পরম সত্য পরমেশ্বর ভগবানকে হৃদয়ঙ্গম করা যায়।
শ্লোক: 117
ব্রহ্মচারী গুরুকুলে বসন্দান্তো গুরুর্হিতম্ ।
আচরন্ দাসবন্নীচো গুরৌ সুদৃঢ়সৌহৃদঃ ।।
(ভাগবত ৭/১২/১)
অনুবাদঃ- (নারদ মুনি বললেন--) বিদ্যার্থীর কর্তব্য পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়-সংযম করার অভ্যাস করা। তার কর্তব্য বিনীতভাবে শ্রীগুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধাসহকারে সৌহার্দ্য পরায়ণ হওয়া এবং দাসবৎ আরচণ করা। এভাবেই মহান ব্রত সহকারে, কেবলমাত্র শ্রীগুরুদেবের হিতসাধনের জন্য ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে বাস করা উচিত।
(মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট নারদ মুনি)
শ্লোক: 118
এবং জনং নিপতিতং প্রভবাহিকূপে
কামাভিকামমনু যঃ প্রপতন্ প্রসঙ্গাৎ ।
কৃত্বাত্মসাৎ সুরর্ষিণা ভগবান্ গৃহীতঃ
সোহহং কথং নু বিসৃজে তব ভৃত্যসেবাম্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/২৮)
অনুবাদঃ- হে ভগবান! একের পর এক জড় বাসনার সঙ্গ প্রভাবে আমি সাধারণ মানুষদের অনুসরণ করে সর্পপূর্ণ অন্ধকূপে পতিত হয়েছি। আপনার সেবক নারদ মুনি কৃপা করে আমাকে তাঁর শিষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন এবং দিব্য স্থিতি প্রাপ্ত হওয়ার শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাই আমার সর্বপ্রথম কর্তব্য তাঁর সেবা করা। তাঁর সেবা আমি কি করে পরিত্যাগ করতে পারি?
(ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের প্রতি প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 119
তস্মাদ্ গুরুং প্রপদ্যেত জিজ্ঞাসুঃ শ্রেয় উত্তমম্ ।
শাব্দে পরে চ নিষ্ণাতং ব্রহ্মণ্যুপশমাশ্রয়ম্ ।।
(ভাগবত ১১/৩/২১)
অনুবাদঃ- অতএব কেউ যদি আন্তরিকভাবে প্রকৃত আনন্দ কামনা করেন, তাহলে তাঁকে দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একজন সদ্গুরুর আশ্রয় অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। সদ্গুরুর যোগ্যতা হচ্ছে যে, তিনি গভীরভাবে শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত উপলব্ধি করেছেন এবং অন্যদেরও সেই সব সিদ্ধান্ত বিষয়ে প্রত্যয় উৎপাদন করতে সক্ষম। যাঁরা জড় সুখ সুবিধাকে অগ্রাহ্য করে পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করেছেন, সেই ধরনের মহান ব্যক্তিদেরই যথার্থ গুরু বলে বুঝতে হবে।
শ্লোক: 120
বেত্থ ত্বং সৌম্য তৎসর্বং তত্ত্বতস্তদনুগ্রহাৎ ।
ব্রূয়ুঃ স্নিগ্ধস্য শিষ্যস্য গুরবো গুহ্যমপ্যুত ।।
(ভাগবত ১/১/৮)
অনুবাদঃ- যেহেতু আপনি শ্রদ্ধাশীল ও বিনীত, তাই আপনার গুরুদেবেরা বিশেষভাবে অনুগ্রহ করেছেন। কারণ, স্নিগ্ধ স্বভাবসম্পন্ন অর্থাৎ প্রীতিশীল শিষ্যের কাছেই গুরুবর্গ অতি নিগূঢ় রহস্য ব্যক্ত করেন।
(সূত গোস্বামীর প্রতি মুনি-ঋষিরা)
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।