শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 76
যন্নামধেয়শ্রবণানুকীর্তনাদ্
যৎপ্রহ্বণাদ্ যৎস্মরণাদপি ক্বচিৎ ।
শ্বাদোহপি সদ্যঃ সবনায় কল্পতে
কুতঃ পুনস্তে ভগবন্নু দর্শনাৎ ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৬)
অনুবাদঃ-
হে ভগবন্ যাঁর নাম শ্রবণ, অনুকীর্তন, প্রণাম ও স্মরণ করা মাত্র চণ্ডাল ও যবন কুলোদ্ভূত ব্যক্তিও তৎক্ষণাৎ বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের যোগ্য হয়ে উঠে, এমন যে প্রভু তুমি, তোমার দর্শনের প্রভাবে কি না হয়?
শ্লোক: 77
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্
যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যা
ব্রহ্মানূচুর্নাম গৃণন্তি যে তে ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৭)
অনুবাদঃ-
হে ভগবান ! যাঁদের জিহ্বায় আপনার নাম বিরাজ করে, তাঁরা যদি অত্যন্ত নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। যাঁরা আপনার নাম কীর্তন করেন, তাঁরা সব রকম তপস্যা করেছেন, সমস্ত যজ্ঞ করেছেন, সর্বতীর্থে স্নান করেছেন এবং সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন, সুতরাং তাঁরা আর্য মধ্যে পরিগণিত।
শ্লোক: 78
শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্ত্যভীক্ষ্নশঃ
স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং
ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৬)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ ! যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন, অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত করতে পারে।
শ্লোক: 79
জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য নমন্ত এব
জীবন্তি সন্মুখরিতাং ভবদীয়বার্তাম্ ।
স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতিগতাং তনুবাঙ্মনোভি-
র্যে প্রায়শোহজিত জিতোহপ্যসি তৈস্ত্রিলোক্যাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৩)
অনুবাদঃ- যাঁরা তাঁদের সামাজিক পদে স্থিত হয়েও মনোধর্মী জল্পনা-কল্পনামূলক জ্ঞানকে দূরে নিক্ষেপ করেন, দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে আপনার লীলাকথা শ্রবণ করেন এবং আপনি ও আপনার শুদ্ধ ভক্তদের মুখনিঃসৃত হরিকথা শ্রবণ করে জীবন ধারণ করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে আপনাকে জয় ক্রেন্ম, যদিও ত্রিলোকের কোনও ব্যক্তি অন্য কোন উপায়ে আপনাকে জয় করতে পারে না।
শ্লোক: 80
নিবৃত্ততর্ষৈরুপগীয়মানাদ্
ভবৌষধাচ্ছ্রোত্রমনোহভিরামাৎ
ক উত্তমশ্লোকগুণানুবাদাৎ
পুমান্ বিরজ্যেত বিনা পশুঘ্নাৎ ।।
(ভাগবত ১০/১/৪)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয় গুরু-পরম্পরার ধারা অনুসারে। এই জড় জগতের ক্ষণস্থায়ী মিথ্যা গুণকীর্তনে যাঁরা আদৌ আগ্রহী নয়, তাঁরাই ভগবানের মহিমা কীর্তনে আনন্দ লাভ করেন। ভগরোগের অধীনে যারা জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই সব দেহবদ্ধ জীবদের পক্ষে ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তন হল যথার্থ ঔষধ। তাই, পশুঘাতক বা আত্মঘাতী ছাড়া ভগবৎ-কথা শ্রবণ-কীর্তনে আর কে-ই বা বিরত হবে?
শ্লোক: 81
শৃণ্বতাং স্বকথা কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎ সতাম্ ।।
(ভাগবত ১/২/১৭)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং তিনি হচ্ছেন সাধুদের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ ও কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।
শ্লোক: 82
এতন্নির্বিদ্যমানানামিচ্ছতামকুতভয়ম্ ।
যোগিনাং নৃপ নির্ণীতং হরের্নামানুকীর্তনম্ ।।
(ভাগবত ২/১/১১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! মহান আচার্যদের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে নিরন্তর ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা সকলের জন্য সিদ্ধি লাভের নিশ্চিত তথা নির্ভীক মার্গ। এমন কি যাঁরা সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, যাঁরা সব রকম জড়-জাগতিক সুখভোগের প্রতি আসক্ত এবং যাঁরা দিব্যজ্ঞান লাভ করার ফলে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন, তাঁদের সকলের পক্ষে এটিই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
শ্লোক: 83
আপন্নঃ সংসৃতিং ঘোরাং যন্নাম বিবশো গৃণন্ ।
ততঃ সদ্যো বিমুচ্যেত যদ্বিভেতি স্বয়ং ভয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/১/১৪)
অনুবাদঃ- জন্ম-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর আবর্তে আবদ্ধ মানুষ বিবশ হয়েও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম উচ্চারণ করতে করতে অচিরেই সেই সংসারচক্র থেকে মুক্ত হয়, সেই নামে স্বয়ং মহাকালও ভীত হন।
শ্লোক: 84
এবংব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্ নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ।।
(ভাগবত ১১/২/৪০)
অনুবাদঃ- কেউ যখন ভক্তিমার্গে যথার্থ উন্নতি সাধন করে এবং তার অতি প্রিয় ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করে আনন্দমগ্ন হন, তখন তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম কীর্তন করেন। তিনি কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন এবং কখনও উন্মাদের মতো নৃত্য করেন। বাইরের লোকেরা কে কি বলে সেই সম্বন্ধে তাঁর কোন জ্ঞান থাকে না।
শ্লোক: 85
তত্তেহনুকম্পাং সুসমীক্ষমাণো
ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্ ।
হৃদ্বাগ্বপুর্ভির্বিদধন্নমন্তে
জীবেত যো মুক্তিপদে স দায়ভাক্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৮)
অনুবাদঃ- যিনি আপনার কৃপা লাভের আশায় সকর্মের মন্দ ফল ভোগ করতে করতে মন, বাক্য ও শরীরের দ্বারা আপনার প্রতি ভক্তি বিধান করে জীবন যাপন করেন, তিনি মুক্তিপদে দায়ভাক্ অর্থাৎ তিনি আপনার ঐকান্তিকী শুদ্ধ ভক্ত হবার উপযুক্ত প্রার্থী। (ব্রহ্মা)
শ্লোক: 86
মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা নাবিবিক্তাসনো ভবেৎ ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি ।।
(ভাগবত ৯/১৯/১৭)
অনুবাদঃ- মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে এবং কন্যার সঙ্গে নির্জন স্থানে উপবেশন করা উচিত নয়, কেন না বলবান ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান ব্যক্তিরও মন আকর্ষণ করতে পারে। (দেবযানির প্রতি মহারাজ যযাতি)
শ্লোক: 87
পুংসঃ স্ত্রিয়া মিথুনীভাবমেতং
তয়োর্মিথো হৃদয়গ্রন্থিমাহুঃ ।
অতো গৃহক্ষেত্রসুতাপ্তবিত্তৈ-
র্জনস্য মোহোহয়মহং মমেতি ।।
(ভাগবত ৫/৫/৮)
অনুবাদঃ- স্ত্রী ও পুরুষের প্রতি আকর্ষণ জড়-জাগতিক জীবনের ভিত্তি। এই ভ্রান্ত আসক্তিই স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের হৃদয়গ্রন্থি-স্বরূপ এবং তার ফলেই জীবের দেহ, গৃহ, সম্পত্তি, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও ধন-সম্পদ আদিতে “আমি ও আমার” বুদ্ধিরূপ মোহ উৎপন্ন হয়।
শ্লোক: 88
যন্মৈথুনাদি গৃহমেধিসুখং হি তুচ্ছং
কণ্ডূয়নেন করয়োরিব দুঃখদুঃখম্ ।
তৃপ্যন্তি নেহ কৃপণা বহুদুঃখভাজঃ
কণ্ডূতিবন্মনসিজং বিষহতে ধীরঃ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৫)
অনুবাদঃ- চুলকানি কমানোর উদ্দেশ্যে দুহাতের ঘর্ষণের সঙ্গে যৌনজীবনের তুলনা করা হয়। গৃহমেধি বা তথাকথিত গৃহস্থদের কোন পারমার্থিক জ্ঞান নেই। তাই তারা মনে করে যে, এই চুলকানিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখের স্তর, যদিও বাস্তবে তা শুধু দুঃখেরই উৎস। ব্রাহ্মণদের বিপরীতধর্মী কৃপণগণ পুনঃ পুনঃ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করেও কখনও তৃপ্ত হয় না। কিন্তু যাঁরা ধীর এবং যাঁরা এই চুলকানি সহ্য করেন, তাঁদেরকে কখনও গণ্ডমূর্খদের প্রাপ্য দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় না।
শ্লোক: 89
তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শমেন চ দমেন চ ।
ত্যাগেন সত্যশৌচাভ্যাং যমেন নিয়মেন বা ।।
(ভাগবত ৬/১১/১৩)
অনুবাদঃ- মনকে সংযত করতে হলে অবশ্যই ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে এবং পতিত হওয়া চলবে না। স্বেচ্ছায় ইন্দ্রিয়ভোগ ত্যাগরূপ তপস্যা বরণ করতে হবে। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়কে অবশ্যই সংযত করতে হবে । দান করতে হবে, সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন এবং জপ করতে হবে।
শ্লোক: 90
প্রায়েণ দেব মুনয়ঃ স্ববিমুক্তিকামা
মৌনং চরন্তি বিজনে ন পরার্থনিষ্ঠাঃ ।
নৈতান্ বিহায় কৃপণান্ বিমুমুক্ষ একো
নান্যং ত্বদস্য শরণং ভ্রমতোহনুপশ্যে ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৪)
অনুবাদঃ- হে নৃসিংহদেব! বাস্তবিকই আমি কতো মুনি-ঋষিদের দেখি, যাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের মুক্তির ব্যাপারেই আগ্রহী। বড় বড় শহর ও নগরের কথা বিবেচনা না করে, তাঁরা হিমালয়ে কিংবা নির্জন বনে মৌনব্রত অবলম্বন করে ধ্যান করে থাকেন। অন্যদের মুক্ত করার ব্যাপারে তাঁদের কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি এই সমস্ত কৃপণদের পরিত্যাগ করে একা মুক্তি পেতে চাই না। আমি জানি কৃষ্ণভাবনামৃত ছাড়া, আপনার চরণ-কমলের আশ্রয় গ্রহণ না করে কেউ সুখী হতে পারে না। তাই তাদেরকেও আপনার চরণ-কমলের আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমি পোষণ করি।
(ভগবান নৃসিংহদেবের প্রতি প্রহ্লাদ মহারাজ)
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।