ভক্ত ও ভক্ত সম্বন্ধীয়ঃ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 51
অসৎসঙ্গত্যাগ, -- এই বৈষ্ণব-আচার ।
‘স্ত্রীসঙ্গী’—এক অসাধু, ‘কৃষ্ণাভক্ত’ আর ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৮৭)
অনুবাদঃ- বৈষ্ণবকে সর্বদাই অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীর প্রতি আসক্ত এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিহীন ব্যক্তিরাই অসাধু। এই অসৎসঙ্গ ত্যাগই বৈষ্ণব আচার।
শ্লোক: 52
তত্তেহনুকম্পাং সুসমীক্ষমাণো
ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্ ।
হৃদ্বাগ্বপুর্ভির্বিদধন্নমন্তে
জীবেত যো মুক্তিপদে স দায়ভাক্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৮)
অনুবাদঃ- যিনি আপনার কৃপা লাভের আশায় সকর্মের মন্দ ফল ভোগ করতে করতে মন, বাক্য ও শরীরের দ্বারা আপনার প্রতি ভক্তি বিধান করে জীবন যাপন করেন, তিনি মুক্তিপদে দায়ভাক্ অর্থাৎ তিনি আপনার ঐকান্তিকী শুদ্ধ ভক্ত হবার উপযুক্ত প্রার্থী। (ব্রহ্মা)
শ্লোক: 53
নারীস্তনা ভারং নাভিদেশং
দৃষ্ট্বা মা গা মোহ বেশ্যাম্ ।
এতাং মাংস বাসাদি বিকারা
মনসি বিচিন্তায় ভারং ভারম্ ।
(শঙ্করাচার্য)
অনুবাদঃ- নারীদের স্তনভার ও সরু নাভিদেশের তথাকথিত সৌন্দর্য দর্শন করে মোহগ্রস্ত বা উত্তেজিত হয়ো না। কারণ, এই আকর্ষণীয় অঙ্গগুলি শুধু চর্বি, মাংস আদি জঘন্য বস্তুর সমন্বয় মাত্র। এই কথা মনে মনে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করা উচিত।
শ্লোক: 54
মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা নাবিবিক্তাসনো ভবেৎ ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি ।।
(ভাগবত ৯/১৯/১৭)
অনুবাদঃ- মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে এবং কন্যার সঙ্গে নির্জন স্থানে উপবেশন করা উচিত নয়, কেন না বলবান ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান ব্যক্তিরও মন আকর্ষণ করতে পারে। (দেবযানির প্রতি মহারাজ যযাতি)
শ্লোক: 55
যুবতীনাং যথা যূনি যুনাং চ যুবতৌ যথা ।
মনোহভিরমতে তদ্বন্ মনো মে রমতাং ত্বয়ি ।।
(বিষ্ণু পুরাণ ১/২০/১৯)
অনুবাদঃ- যুবকদের দর্শনে যুবতীদের মন যেমন উৎফুল্ল হয় এবং যুবতীদের দর্শনে যুবকেরা যেমন উৎফুল্ল হয়, হে কৃষ্ণ! আমার মনও যেন শুধু তোমাতেই সেই রকম আনন্দ লাভ করে।
শ্লোক: 56
পুংসঃ স্ত্রিয়া মিথুনীভাবমেতং
তয়োর্মিথো হৃদয়গ্রন্থিমাহুঃ ।
অতো গৃহক্ষেত্রসুতাপ্তবিত্তৈ-
র্জনস্য মোহোহয়মহং মমেতি ।।
(ভাগবত ৫/৫/৮)
অনুবাদঃ- স্ত্রী ও পুরুষের প্রতি আকর্ষণ জড়-জাগতিক জীবনের ভিত্তি। এই ভ্রান্ত আসক্তিই স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের হৃদয়গ্রন্থি-স্বরূপ এবং তার ফলেই জীবের দেহ, গৃহ, সম্পত্তি, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও ধন-সম্পদ আদিতে “আমি ও আমার” বুদ্ধিরূপ মোহ উৎপন্ন হয়।
শ্লোক: 57
যন্মৈথুনাদি গৃহমেধিসুখং হি তুচ্ছং
কণ্ডূয়নেন করয়োরিব দুঃখদুঃখম্ ।
তৃপ্যন্তি নেহ কৃপণা বহুদুঃখভাজঃ
কণ্ডূতিবন্মনসিজং বিষহতে ধীরঃ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৫)
অনুবাদঃ- চুলকানি কমানোর উদ্দেশ্যে দুহাতের ঘর্ষণের সঙ্গে যৌনজীবনের তুলনা করা হয়। গৃহমেধি বা তথাকথিত গৃহস্থদের কোন পারমার্থিক জ্ঞান নেই। তাই তারা মনে করে যে, এই চুলকানিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখের স্তর, যদিও বাস্তবে তা শুধু দুঃখেরই উৎস। ব্রাহ্মণদের বিপরীতধর্মী কৃপণগণ পুনঃ পুনঃ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করেও কখনও তৃপ্ত হয় না। কিন্তু যাঁরা ধীর এবং যাঁরা এই চুলকানি সহ্য করেন, তাঁদেরকে কখনও গণ্ডমূর্খদের প্রাপ্য দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় না।
শ্লোক: 58
তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শমেন চ দমেন চ ।
ত্যাগেন সত্যশৌচাভ্যাং যমেন নিয়মেন বা ।।
(ভাগবত ৬/১১/১৩)
অনুবাদঃ- মনকে সংযত করতে হলে অবশ্যই ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে এবং পতিত হওয়া চলবে না। স্বেচ্ছায় ইন্দ্রিয়ভোগ ত্যাগরূপ তপস্যা বরণ করতে হবে। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়কে অবশ্যই সংযত করতে হবে । দান করতে হবে, সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন এবং জপ করতে হবে।
শ্লোক: 59
প্রায়েণ দেব মুনয়ঃ স্ববিমুক্তিকামা
মৌনং চরন্তি বিজনে ন পরার্থনিষ্ঠাঃ ।
নৈতান্ বিহায় কৃপণান্ বিমুমুক্ষ একো
নান্যং ত্বদস্য শরণং ভ্রমতোহনুপশ্যে ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৪)
অনুবাদঃ- হে নৃসিংহদেব! বাস্তবিকই আমি কতো মুনি-ঋষিদের দেখি, যাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের মুক্তির ব্যাপারেই আগ্রহী। বড় বড় শহর ও নগরের কথা বিবেচনা না করে, তাঁরা হিমালয়ে কিংবা নির্জন বনে মৌনব্রত অবলম্বন করে ধ্যান করে থাকেন। অন্যদের মুক্ত করার ব্যাপারে তাঁদের কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি এই সমস্ত কৃপণদের পরিত্যাগ করে একা মুক্তি পেতে চাই না। আমি জানি কৃষ্ণভাবনামৃত ছাড়া, আপনার চরণ-কমলের আশ্রয় গ্রহণ না করে কেউ সুখী হতে পারে না। তাই তাদেরকেও আপনার চরণ-কমলের আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমি পোষণ করি।
(ভগবান নৃসিংহদেবের প্রতি প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 60
নৈবোদ্বিজে পরদুরত্যয়বৈতরণ্যা-
স্ত্বদ্বীর্যগায়নমহামৃতমগ্নচিত্তঃ ।
শোচে ততো বিমুখচেতস ইন্দ্রিয়ার্থ
মায়াসুখায় ভরমুদ্বহতো বিমূঢ়ান্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৩)
অনুবাদঃ- হে পরম পুরষ! আমি জড়-জাগতিক অস্তিত্ব তথা বৈতরণীকে ভয় করি না, কেন না যেখানেই আমি থাকি না কেন, সব সময় আমি আপনার মহিমান্বিত লীলা চিন্তনে মগ্ন আছি। আমি শুধু সেই সব মূর্খদের কথাই ভাবছি, যারা জড়-জাগতিক সুখের জন্য এবং তাদের পরিবার, সমাজ ও দেশের পরিচালনার জন্য বিপুল পরিকল্পনা করে চলেছে। অনুকম্পাবশত আমি শুধু তাদের কথাই ভাবছি।
শ্লোক: 61
মহদ্বিচলনং নৃণাং গৃহিণাং দীনচেতসাম্ ।
(ভাগবত ১০/৮/৪)
অনুবাদঃ- হে প্রভু! আপনার মতো মহৎ ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইতস্তত পর্যটন করেন না, বরং দীনচেতা গৃহীদের উদ্ধারের জন্যই তাদের গৃহে গমন করেন।
(গর্গমুনির প্রতি নন্দ মহারাজ)
শ্লোক: 62
চৈঃ চঃ
আপনি করিমু ভক্তভাব অঙ্গীকারে ।
আপনি আচরি’ ভক্তি শিখাইমু সবারে ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৩/২০)
অনুবাদঃ- আপনি নিজে ভক্তভাব অঙ্গীকার করে এবং ভক্তির আরচরণ করে সকলকে শিক্ষা দেব।
(শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)
শ্লোক: 63
ভারত-ভূমিতে হৈল মনুষ্য-জন্ম যার ।
জন্ম সার্থক করি’ কর পর-উপকার ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৯/৪১)
অনুবাদঃ- ভারতবর্ষে যিনি মনুষ্য দেহ পেয়েছেন, তিনি যেন নিজের জীবন সার্থক করে পরোপকার করেন।
শ্লোক: 64
যারে দেখ, তারে কহ ‘কৃষ্ণ’-উপদেশ ।
আমার আজ্ঞায় গুরু হঞা তার’ এই দেশ ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ৭/১২৮)
অনুবাদঃ- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও ভাগবতে যেমনটি রয়েছে, অবিকৃতভাবে কৃষ্ণের সেই সব আদেশ সকলকে পালন করতে উপদেশ দাও। এভাবেই গুরু হয়ে আমার আজ্ঞায় এই দেশের প্রত্যেককে ত্রাণ কর।
শ্লোক: 65
এইমত ভক্তভাব করি’ অঙ্গীকার ।
আপনি আচরি’ ভক্তি করিল প্রচার ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৪/৪১)
অনুবাদঃ- এইমত ভক্তভাব অঙ্গীকার করে, নিজে আচরণ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগতে ভক্তি প্রচার করলেন।
শ্লোক: 66
কলিকালের ধর্ম—কৃষ্ণনাম-সঙ্কীর্তন ।
কৃষ্ণ-শক্তি বিনা নহে তার প্রবর্তন ।।
(চৈঃ চঃ অন্ত্য ৭/১১)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের নাম-সঙ্কীর্তনই কলিকালের মূল ধর্ম, শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা শক্ত্যাবিষ্ট না হলে এই সংকীর্তন আন্দোলন প্রচার করা যায় না।
শ্লোক: 67
সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৫)
অনুবাদঃ- যিনি ভাগবতোত্তম, তিনি সর্বভূতে আত্মার আত্মাস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই দেখেন এবং আত্মার আত্মাস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণে সমস্ত জীবকে দেখেন।
শ্লোক: 68
ঈশ্বরে তদধীনেষু বালিশেষু দ্বিষৎসু চ ।
প্রেমমৈত্রীকৃপোপেক্ষা যঃ করোতি স মধ্যমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৬)
অনুবাদঃ- যে ভক্ত ঈশ্বরে প্রেম, ভক্তে মৈত্রী, অজ্ঞান ব্যক্তিদের কৃপা এবং বিদ্বেষীদের প্রতি উপেক্ষা করেন, তিনি মধ্যম ভক্ত।
শ্লোক: 69
অর্চায়ামেব হরয়ে পূজাং যঃ শ্রদ্ধয়েহতে ।
ন তদ্ভক্তেষু চান্যেষু স ভক্তঃ প্রাকৃতঃ স্মৃতঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৭)
অনুবাদঃ- যিনি লৌকিক ও পারিবারিক প্রথাক্রমে পরম্পরাগত শ্রদ্ধার সঙ্গে অর্চা মূর্তিতে হরিকে পূজা করেন, অথচ শাস্ত্র অনুশীলনের দ্বারা শুদ্ধ ভক্তিতত্ত্ব অবগত না হওয়ায় হরিভক্তদের পূজা করেন না। তিনি প্রাকৃত ভক্ত, অর্থাৎ ভক্তিপর্ব আরম্ভ করেছেন মাত্র। তাকে ভক্তপ্রায় বা বৈষ্ণবাভাষ বলা হয়।
শ্লোক: 70
শ্রুতিমপরে স্মৃতিমিতরে ভারতমন্যে ভজন্তু ভবভীতাঃ ।
অহমিহ নন্দং বন্দে যস্যালিন্দে পরং ব্রহ্ম ।।
(পদ্যাবলী ১২৬)
অনুবাদঃ- সংসার ভয়ে ভীত মানুষেরা কেউ শ্রুতিকে, কেউ স্মৃতিকে, কেউ বা মহাভারতকে ভজনা করুন; আমি কিন্তু কেবল শ্রীনন্দেরই বন্দনা করি – যাঁর অলিন্দে শ্রীকৃষ্ণ খেলা করেন। (রঘুপতি উপাধ্যায়/ রূপ গোস্বামী)
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
ভক্ত ও ভক্ত সম্বন্ধীয়ঃ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক :-
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।