শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 61
লোকে ব্যবায়ামিষমদ্যসেবা
নিত্যা হি জন্তোর্ন হি তত্র চোদনা ।
ব্যবস্থিতিস্তেষু বিবাহযজ্ঞ
সুরাগ্রহৈরাসু নিবৃত্তিরিষ্টা ।।
(ভাগবত ১১/৫/১১)
অনুবাদঃ- এই জড় জগতে বদ্ধ জীবেরা সর্বদাই কাম উপভোগ, মাংসাহার ও মদ্যপানের প্রবণতা-সম্পন্ন। সুতরাং ধর্মীয় শাস্ত্র কখনও এগুলিকে উৎসাহ দেয় না। যদিও শাস্ত্রে বিবাহ যজ্ঞের মাধ্যমে কামভোগ, পশুযজ্ঞের মাধ্যমে মাংসাহার এবং সুরাগ্রহ যজ্ঞের মাধ্যমে মদ্যপানের নির্দেশ রয়েছে- কিন্তু এই সমস্ত যজ্ঞের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ সমস্ত ভোগ থেকে নিবৃত্তি লাভ করা।
শ্লোক: 62
কর্মণা দৈবনেত্রেণ জন্তুর্দেহোপপত্তয়ে।
স্ত্রীয়াঃ প্রবিষ্ট উদরং পুংসো রেতঃকণাশ্রয়ঃ।।
(ভাগবত ৩/৩১/১)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বরের অধ্যক্ষতায় জীবাত্মা তার পূর্বকৃ্ত কর্মের ফল অনুসারে, বিশেষ প্রকার শরীর ধারণের জন্য, পুরুষের রেতকণা আশ্রয় করে স্ত্রীর গর্ভে প্রবেশ করে।
শ্লোক: 63
নূনং প্রমত্তঃ কুরুতে বিকর্ম
যদিন্দ্রিয়প্রীতয় আপৃণোতি।
ন সাধু মন্যে যত আত্মনোহয়-
মসন্নপি ক্লেশদ আস দেহঃ ।।
(ভাগবত ৫/৫/৪)
অনুবাদঃ- যখন কোন ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকেই জীবনের লক্ষ্য বলে গণ্য করে, সে নিঃসন্দেহে জড়বাদী জীবনধারায় প্রমত্ত হয়ে ওঠে এবং সমস্ত প্রকার পাপকর্মে লিপ্ত হয়। সে জানে না যে, তার অতীত পাপকর্মের ফলে সে ইতিমধ্যেই একটি দেহ পেয়েছে, যা ক্ষণস্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও তার দুঃখের কারণ। আসলে এই জড় গ্রহণ করা জীবের উচিত হয়নি, কিন্তু ইন্দ্রিয়-ভোগের জন্যই জীবকে এই জড় দেহ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এভাবেই পুনরায় ইন্দ্রিয়ভোগে লিপ্ত হয়ে একের পর এক জড় দেহ লাভ করা বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে উপযুক্ত নয়।
শ্লোক: 64
পরাভবস্তাবদবোধজাতো
যাবন্ন জিজ্ঞাসত আত্মতত্ত্বম্ ।
যাবৎ ক্রিয়াস্তাবদিদং মনো বৈ
কর্মাত্মকং যেন শরীরবন্ধঃ ।।
(ভাগবত ৫/৫/৫)
অনুবাদঃ- যতদিন পর্যন্ত জীব আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা না করে, ততদিন পর্যন্তই সে জড় প্রকৃতির প্রভাবে পরাস্ত হয়ে অবিদ্যাজাত দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়। পাপই হোক আর পুণ্যই হোক- কর্ম মাত্রই ফল উৎপাদন করে। কোন না কোন কর্মে রুচি থাকলেই মন কর্মাত্মক হয়, অর্থাৎ সকাম কর্মের দ্বারা তার মন কলুষিত থাকে। মন যতদিন কলুষিত থাকে, চেতনাও ততদিন আচ্ছাদিত থাকে এবং যতদিন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সকাম কর্মে মগ্ন থাকে, ততদিন তাকে জড় দেহ গ্রহণ করতেই হবে।
শ্লোক: 65
ঋতেহর্থং যৎ প্রতীয়েত ন প্রতীয়েত চাত্মনি ।
তদ্বিদ্যাদাত্মনো মায়াং যথাভাসো যথা তমঃ ।।
(ভাগবত ২/৯/৩৪)
অনুবাদঃ- আমি ব্যতীত যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, তা হচ্ছে আমার মায়াশক্তি, কেন না আমি ব্যতীত কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এটি ঠিক প্রতীয়মান প্রকৃত আলোকের প্রতিফলনের মতো, কেন না আলোকে ছায়াও নেই, প্রতিবিম্বও নেই।
শ্লোক: 66
ভক্তিযোগেন মনসি সম্যক্ প্রণিহিতেহমলে ।
অপশ্যৎপুরুষং পূর্ণং মায়াং চ তদপাশ্রয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/৭/৪)
অনুবাদঃ- এভাবেই তাঁর মনকে একাগ্র করে জড় কলুষ থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়ে তিনি যখন পূর্ণরূপে ভক্তিযোগে যুক্ত হয়েছিলেন, তখন তিনি পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁর মায়াশক্তি সহ দর্শন করেছিলেন, যে মায়া পূর্ণরূপে তাঁর বশীভূত ছিল।
শ্লোক: 67
যয়া সম্মোহিতো জীব আত্মানং ত্রিগুণাত্মকম্ ।
পরোহপি মনুতেহনর্থং তৎকৃতং চাভিপদ্যতে ।।
(ভাগবত ১/৭/৫)
অনুবাদঃ- এই বহিরঙ্গা শক্তির প্রভাবে জীব প্রকৃতির তিনটি গুণের অতীত হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে জড়া প্রকৃতি সম্ভূত বলে মনে করে এবং তার ফলে জড় জগতের দুঃখ-ভোগ করে।
শ্লোক: 68
তস্যৈব হেতোঃ প্রয়তেত কোবিদো
ন লভ্যতে যদ্ভ্রমতামুপর্যধঃ ।
তল্লভ্যতে দুঃখবদন্যতঃ সুখং
কালেন সর্বত্র গভীররংহসা ।।
(ভাগবত ১/৫/১৮)
অনুবাদঃ- যে সমস্ত মানুষ যথার্থই বুদ্ধিমান এবং পরমার্থ বিষয়ে উৎসাহী, তাদের কর্তব্য হচ্ছে সেই চরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য প্রয়াস করা, যা এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ লোক (ব্রহ্মলোক) থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন লোক (পাতাল লোক) পর্যন্ত ভ্রমণ করেও লাভ করা যায় না । ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ যে জড় সুখ, তা কালের প্রভাবে আপনা থেকেই লাভ হয়, ঠিক যেমন আকাঙ্ক্ষা না করলেও কালক্রমে আমরা দুঃখভোগ করে থাকি।
শ্লোক: 69
কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশসদৃশাত্মকঃ ।
জীবঃ সূক্ষ্মস্বরূপোহয়ং সংখ্যাতীতো হি চিৎকণঃ ।।
(ভাগবত ১০/৮৭/৩১)
অনুবাদঃ- কেশের অগ্রভাগকে শত ভাগ করলে তার শত শতাংশ-সদৃশ স্বরূপই জীবের সূক্ষ্ম স্বরূপ; জীব-চিৎকণ ও সংখ্যাতীত।
শ্লোক: 70
ইদং ভাগবতং নাম পুরাণং ব্রহ্মসম্মিতম্ ।
উত্তমশ্লোকচরিতং চকার ভগবানৃষিঃ ।।
নিঃশ্রেয়সায় লোকস্য ধন্যং স্বস্ত্যয়নং মহৎ ।।
(ভাগবত ১/৩/৪০)
অনুবাদঃ- এই শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বাঙ্ময় বিগ্রহ এবং তা সংকলন করেছেন ভগবানের অবতার শ্রীল ব্যসদেব। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত মানুষের পরম মঙ্গল সাধন করা এবং এটি সর্বতোভাবে সার্থক, পূর্ণ আনন্দময় এবং সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ।
শ্লোক: 71
অনর্থোপশমং সাক্ষাদ্ভক্তিযোগমধোক্ষজে ।
লোকস্যাজানতো বিদ্বাংশ্চক্রে সাত্বতসংহিতাম্ ।।
(ভাগবত ১/৭/৬)
অনুবাদঃ- জীবের জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা, যা হচ্ছে তার কাছে অনর্থ, ভক্তিযোগের মাধ্যমে অচিরেই তার উপশম হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা জানে না এবং তাই মহাজ্ঞানী ব্যাসদেব পরমতত্ত্ব সমন্বিত এই সাত্বত সংহিতা সংকলন করেছেন।
শ্লোক: 72
ধর্মঃ স্বনুষ্ঠিতঃ পুংসাং বিষ্বকসেনকথাসু যঃ ।
নোৎপাদয়েদযদি রতিং শ্রম এব হি কেবলম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৮)
অনুবাদঃ- মানুষের উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত বর্ণাশ্রম-ধর্ম যদি কৃষ্ণকথায় রতি উৎপাদন না করে, তা হলে সেই ধর্মও শ্রম মাত্র।
শ্লোক: 73
নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং
শুকমুখাদমৃতদ্রবসংযুতম্ ।
পিবত ভাগবতং রসমালয়ং
মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ ।।
(ভাগবত ১/১/৩)
অনুবাদঃ- হে বিচক্ষণ এবং চিন্তাশীল মানুষ, কল্পবৃক্ষরূপী বৈদিক শাস্ত্রের অত্যন্ত সুপক্ব ফল শ্রীমদ্ভাগবত আস্বাদন করুন। তা শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। তাই ফলটি আরও অধিক উপাদেয় হয়েছে, যদিও এই অমৃতময় রস মুক্ত পুরুষেরা পর্যন্ত আস্বাদন করে থাকেন।
শ্লোক: 74
নষ্টপ্রায়েষ্বভদ্রেষু নিত্যং ভাগবতসেবয়া ।
ভগবত্যুত্তমশ্লোকে ভক্তির্ভবতি নৈষ্ঠিকী ।।
(ভাগবত ১/২/১৮)
অনুবাদঃ- নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করলে এবং ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সেবা করলে হৃদয়ের সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয় এবং তখন উত্তমশ্লোকের দ্বারা বন্দিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমময়ী ভক্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্লোক:75
যং ব্রহ্মাবরুণেন্দ্ররুদ্রমরুতঃ স্তুন্বন্তি দিব্যৈইঃ স্তবৈ-
র্বেদ্যৈইঃ সাঙ্গপদক্রমোপনিষদৈর্গায়ন্তি যং সামগাঃ
ধ্যানাবস্থিত-তদ্ গতেন মনসা পশ্যন্তি যং যোগিনো
যস্যান্তং ন বিদুঃ সুরগণা দেবায় তস্মৈ নমঃ ॥
(ভাগবত ১২/১৩/১)
অনুবাদঃ- ব্রহ্মা, বরুণ, ইন্দ্র, রুদ্র, ও মরুৎগণ দিব্য স্তবদ্বারা যাঁকে স্তুতি করেন, সামবেদগায়কগণ অঙ্গ, পদক্রম ও উপনিষদসহ সমগ্র বেদদ্বারা যাঁর স্তুতিগান করেন, যোগিগণ ধ্যানাবস্থিত তদ্ গতচিত্তে যাঁকে দর্শন করেন, দেবতা ও অসুরগণ যাঁর শেষ জানেন না, সেই দেবতাকে নমস্কার ॥৯॥
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।