শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 91
নৈবোদ্বিজে পরদুরত্যয়বৈতরণ্যা-
স্ত্বদ্বীর্যগায়নমহামৃতমগ্নচিত্তঃ ।
শোচে ততো বিমুখচেতস ইন্দ্রিয়ার্থ
মায়াসুখায় ভরমুদ্বহতো বিমূঢ়ান্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৩)
অনুবাদঃ- হে পরম পুরষ! আমি জড়-জাগতিক অস্তিত্ব তথা বৈতরণীকে ভয় করি না, কেন না যেখানেই আমি থাকি না কেন, সব সময় আমি আপনার মহিমান্বিত লীলা চিন্তনে মগ্ন আছি। আমি শুধু সেই সব মূর্খদের কথাই ভাবছি, যারা জড়-জাগতিক সুখের জন্য এবং তাদের পরিবার, সমাজ ও দেশের পরিচালনার জন্য বিপুল পরিকল্পনা করে চলেছে। অনুকম্পাবশত আমি শুধু তাদের কথাই ভাবছি।
শ্লোক: 92
মহদ্বিচলনং নৃণাং গৃহিণাং দীনচেতসাম্ ।
(ভাগবত ১০/৮/৪)
অনুবাদঃ- হে প্রভু! আপনার মতো মহৎ ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইতস্তত পর্যটন করেন না, বরং দীনচেতা গৃহীদের উদ্ধারের জন্যই তাদের গৃহে গমন করেন।
(গর্গমুনির প্রতি নন্দ মহারাজ)
শ্লোক: 93
সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৫)
অনুবাদঃ- যিনি ভাগবতোত্তম, তিনি সর্বভূতে আত্মার আত্মাস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই দেখেন এবং আত্মার আত্মাস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণে সমস্ত জীবকে দেখেন।
শ্লোক: 94
ঈশ্বরে তদধীনেষু বালিশেষু দ্বিষৎসু চ ।
প্রেমমৈত্রীকৃপোপেক্ষা যঃ করোতি স মধ্যমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৬)
অনুবাদঃ- যে ভক্ত ঈশ্বরে প্রেম, ভক্তে মৈত্রী, অজ্ঞান ব্যক্তিদের কৃপা এবং বিদ্বেষীদের প্রতি উপেক্ষা করেন, তিনি মধ্যম ভক্ত।
শ্লোক: 95
অর্চায়ামেব হরয়ে পূজাং যঃ শ্রদ্ধয়েহতে ।
ন তদ্ভক্তেষু চান্যেষু স ভক্তঃ প্রাকৃতঃ স্মৃতঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৭)
অনুবাদঃ- যিনি লৌকিক ও পারিবারিক প্রথাক্রমে পরম্পরাগত শ্রদ্ধার সঙ্গে অর্চা মূর্তিতে হরিকে পূজা করেন, অথচ শাস্ত্র অনুশীলনের দ্বারা শুদ্ধ ভক্তিতত্ত্ব অবগত না হওয়ায় হরিভক্তদের পূজা করেন না। তিনি প্রাকৃত ভক্ত, অর্থাৎ ভক্তিপর্ব আরম্ভ করেছেন মাত্র। তাকে ভক্তপ্রায় বা বৈষ্ণবাভাষ বলা হয়।
শ্লোক: 96
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জ্ঞানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ।।
(ভাগবত ৯/৪/৬৮)
অনুবাদঃ- সাধু-মহাত্মারা আমার হৃদয় এবং আমিও তাদের হৃদয়। তারা আমাকে ছাড়া অন্য কিছু জানে না এবং আমিও তাদের ছাড়া অন্য কাউকে আমার বলে জানি না।
শ্লোক: 97
মুক্তানামপি সিদ্ধানাং নারায়ণপরায়ণঃ ।
সুদুর্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটিষ্বপি মহামুনে ।।
(ভাগবত ৬/১৪/৫)
অনুবাদঃ- হে মহর্ষি! কোটি কোটি মুক্ত ও সিদ্ধদের মধ্যে নারায়ণ পরায়ণ প্রশান্তাত্মা পুরুষ অত্যন্ত দুর্লভ।
শ্লোক: 98
ভবদ্বিধা ভাগবতাস্তীর্থভূতাঃ স্বয়ং বিভো ।
তীর্থীকুর্বন্তি তীর্থানি স্বান্তঃস্থেন গদাভৃতা ।।
(ভাগবত ১/১৩/১০)
অনুবাদঃ- আপনার মতো ভাগবতেরা নিজেরাই তীর্থস্বরূপ। তাঁরা স্বীয় অন্তকরণস্থিত গদাধারী ভগবানের পবিত্রতা বলে পাপীগণের পাপ দ্বারা মলিন তীর্থস্থানগুলিকে পবিত্র করেন।
(বিদুরের প্রতি মহারাজ যুধিষ্ঠির)
শ্লোক: 99
যস্যাস্তি ভক্তির্ভগবত্যকিঞ্চনা
সর্বৈর্গুণৈস্তত্র সমাসতে সুরাঃ ।
হরাবভক্তস্য কুতো মহদ্ গুণা
মনোরথেনাসতি ধাবতো বহিঃ ।।
(ভাগবত ৫/১৮/১২)
অনুবাদঃ- যিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনন্য ভক্তিসম্পন্ন, তাঁর মধ্যে দেবতাদের সমস্ত সদ্ গুণগুলি প্রকাশিত হয়। কিন্তু যিনি হরিভক্তি-বিহীন তার মধ্যে কোন সদ্ গুণই নেই, কেন না তিনি মনোরথের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা শক্তি জড় জগতের প্রতি নিরন্তর ধাবিত হচ্ছেন।
(প্রহ্লাদ মহারাজ ও হরিবর্ষবাসীরা)
শ্লোক: 100
ইত্থং সতাং ব্রহ্মসুখানুভূত্যা
দাস্যং গতানাং পরদৈবতেন ।
মায়াশ্রিতানাং নরদারকেণ
সাকং বিজহ্রুঃ কৃতপুণ্যপুঞ্জাঃ ।।
(ভাগবত ১০/১২/১১)
অনুবাদঃ- নির্বিশেষবাদীরা জ্ঞানীরা যাঁকে ব্রহ্মসুখরূপে উপলব্ধি করেন, দাস্য রসের ভক্তরা যাঁকে পর-দেবতারূপে দর্শন করেন এবং মায়াশ্রিত সাধারণ মানুষেরা যাঁকে একটি মানব-শিশুরূপে দর্শন করেন, সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের গোপ-বালকেরা জন্ম-জন্মান্তরের পুঞ্জীভূত পুণ্যকর্মের ফলে, সখারূপে খেলা করছেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 101
সত্ত্বং বিশুদ্ধং বসুদেবশব্দিতং
যদিয়তে তত্র পুমানপাবৃতঃ ।
সত্ত্বে চ তস্মিন্ ভগবান্ বাসুদেবো ।
হ্যধোক্ষজো মে মনসা বিধীয়তে ।।
(ভাগবত ৪/৩/২৩)
অনুবাদঃ- যে শুদ্ধ সত্ত্বে পরমেশ্বর ভগবান অনাবৃতভাবে বিরাজ করেন, তাকে বলা হয় বসুদেব স্তর। সেই শুদ্ধ সত্ত্বে অবস্থিত জড় ইন্দ্রিয়ানুভূতির অতীত পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেব নামে পরিচিত। আমার মনের দ্বারা আমি তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি ।
(সতীর প্রতি শিব)
শ্লোক: 102
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞানমদ্বয়ম্ ।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ।।
(ভাগবত ১/২/১১)
অনুবাদঃ- যা অদ্বয় জ্ঞান, অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাকেই পরমার্থ বলেন, এই তত্ত্ববস্তু ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান—এই তিন নামে অভিহিত হন । (সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 103
ভক্ত্যাহমেকয়া গ্রাহ্যঃ শ্রদ্ধয়াত্মা প্রিয়ঃ সতাম্ ।
ভক্তিঃ পুনাতি মন্নিষ্ঠা শ্বপাকানপি সম্ভবাৎ ।।
(ভাগবত ১১/১৪/২১)
অনুবাদঃ- সাধু এবং ভক্তদের অত্যন্ত প্রিয় আমি, ঐকান্তিক শ্রদ্ধাজনিত ভক্তির দ্বারাই আমি প্রাপ্ত হই। আমার প্রতি জীবের নিষ্ঠা বর্ধনকারী ভক্তি নীচ কুলোদ্ভূত মানুষদেরও জন্ম আদি দোষ থেকে পরিত্রাণ করে। অর্থাৎ, ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে প্রত্যেকেই চিন্ময় স্তরে উন্নীত হতে পারে। (উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
শ্লোক: 104
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি দৃষ্ট এবাত্মনীশ্বরে ।।
(ভাগবত ১/২/২১)
অনুবাদঃ- আত্মার আত্মা পরমাত্মা ভগবানকে দর্শন হলে হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়, সমস্ত সংশয় দূর হয় এবং সমস্ত কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
শ্লোক: 105
কেচিৎ কেবলয়া ভক্ত্যা বাসুদেবপরায়ণাঃ ।
অঘং ধুন্বন্তি কার্ৎস্ন্যেন নিহারমিব ভাস্করঃ ।।
(ভাগবত ৬/১/১৫)
অনুবাদঃ- সেই সব বিরল শুদ্ধ ভক্তরা যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অহৈতুকী ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, কেবল তাঁরাই তাঁদের সমস্ত পাপ- বাসনাকে এমনভাবে নির্মূল করতে সক্ষম যে, তাদের আর পুনর্জাগরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। শুধুমাত্র ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের মাধ্যমেই তিনি তা করতে পারেন, ঠিক যেমন সূর্য তার রশ্মিচ্ছটায় তৎক্ষণাৎ কুয়াশাকে দূর করতে পারে।
(শুকদেব গোস্বামী)
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
শ্রীমদ্ভাগবতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।