জপ কীর্তন সম্পর্কে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 20
শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্ত্যভীক্ষ্নশঃ
স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং
ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।। (ভাগবত ১/৮/৩৬)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ ! যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন, অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত করতে পারে।
শ্লোক: 21
গোলোকের প্রেমধন, হরিনাম সংকীর্তন,
রতি না জন্মিলে কেনে তায় ।
সংসার-বিষানলে দিবানিশি হিয়ে জ্বলে,
জুড়াইতে না কৈনু উপায় ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর-ইষ্টদেবে বিজ্ঞপ্তি-২, প্রার্থনা থেকে)
অনুবাদঃ- হরিনাম সংকীর্তনরূপে ভগবৎপ্রেম গোলোক বৃন্দাবন থেকে এই জগতে অবতরণ করেছে। কেন আমার তাতে রতি হল না? দিন ও রাত ধরে সংসার বিষের অনলে আমার হৃদয় জ্বলছে। কিন্তু তবুও তাকে প্রশমিত করার কোন উপায় আমি গ্রহণ করছি না।
শ্লোক: 22
জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য নমন্ত এব
জীবন্তি সন্মুখরিতাং ভবদীয়বার্তাম্ ।
স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতিগতাং তনুবাঙ্মনোভি-
র্যে প্রায়শোহজিত জিতোহপ্যসি তৈস্ত্রিলোক্যাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৩)
অনুবাদঃ- যাঁরা তাঁদের সামাজিক পদে স্থিত হয়েও মনোধর্মী জল্পনা-কল্পনামূলক জ্ঞানকে দূরে নিক্ষেপ করেন, দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে আপনার লীলাকথা শ্রবণ করেন এবং আপনি ও আপনার শুদ্ধ ভক্তদের মুখনিঃসৃত হরিকথা শ্রবণ করে জীবন ধারণ করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে আপনাকে জয় ক্রেন্ম, যদিও ত্রিলোকের কোনও ব্যক্তি অন্য কোন উপায়ে আপনাকে জয় করতে পারে না।
শ্লোক: 23
নিবৃত্ততর্ষৈরুপগীয়মানাদ্
ভবৌষধাচ্ছ্রোত্রমনোহভিরামাৎ
ক উত্তমশ্লোকগুণানুবাদাৎ
পুমান্ বিরজ্যেত বিনা পশুঘ্নাৎ ।। (ভাগবত ১০/১/৪)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয় গুরু-পরম্পরার ধারা অনুসারে। এই জড় জগতের ক্ষণস্থায়ী মিথ্যা গুণকীর্তনে যাঁরা আদৌ আগ্রহী নয়, তাঁরাই ভগবানের মহিমা কীর্তনে আনন্দ লাভ করেন। ভগরোগের অধীনে যারা জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই সব দেহবদ্ধ জীবদের পক্ষে ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তন হল যথার্থ ঔষধ। তাই, পশুঘাতক বা আত্মঘাতী ছাড়া ভগবৎ-কথা শ্রবণ-কীর্তনে আর কে-ই বা বিরত হবে?
শ্লোক: 24
শৃণ্বতাং স্বকথা কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎ সতাম্ ।। (ভাগবত ১/২/১৭)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং তিনি হচ্ছেন সাধুদের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ ও কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।
শ্লোক: 25
এতন্নির্বিদ্যমানানামিচ্ছতামকুতভয়ম্ ।
যোগিনাং নৃপ নির্ণীতং হরের্নামানুকীর্তনম্ ।। (ভাগবত ২/১/১১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! মহান আচার্যদের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে নিরন্তর ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা সকলের জন্য সিদ্ধি লাভের নিশ্চিত তথা নির্ভীক মার্গ। এমন কি যাঁরা সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, যাঁরা সব রকম জড়-জাগতিক সুখভোগের প্রতি আসক্ত এবং যাঁরা দিব্যজ্ঞান লাভ করার ফলে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন, তাঁদের সকলের পক্ষে এটিই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
শ্লোক: 26
আপন্নঃ সংসৃতিং ঘোরাং যন্নাম বিবশো গৃণন্ ।
ততঃ সদ্যো বিমুচ্যেত যদ্বিভেতি স্বয়ং ভয়ম্ ।। (ভাগবত ১/১/১৪)
অনুবাদঃ- জন্ম-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর আবর্তে আবদ্ধ মানুষ বিবশ হয়েও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম উচ্চারণ করতে করতে অচিরেই সেই সংসারচক্র থেকে মুক্ত হয়, সেই নামে স্বয়ং মহাকালও ভীত হন।
শ্লোক: 27
এবংব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্ নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ।। (ভাগবত ১১/২/৪০)
অনুবাদঃ-
কেউ যখন ভক্তিমার্গে যথার্থ উন্নতি সাধন করে এবং তার অতি প্রিয় ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করে আনন্দমগ্ন হন, তখন তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম কীর্তন করেন। তিনি কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন এবং কখনও উন্মাদের মতো নৃত্য করেন। বাইরের লোকেরা কে কি বলে সেই সম্বন্ধে তাঁর কোন জ্ঞান থাকে না।
শ্লোক: 28
যদি বৈষ্ণব-অপরাধ উঠে হাতী মাতা ।
উপাড়ে বা ছিণ্ডে, তার শুখি যায় পাতা ।।
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্ত যদি এই জড় জগতে ভক্তিলতার সেবা করার সময় কোন বৈষ্ণবের চরণে অপরাধ করেন, তা হলে ভক্তিলতার পাতা শুকিয়ে যায়। এই প্রকার বৈষ্ণব অপরাধকে মত্ত হস্তীর আচরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
শ্লোক: 29
সতাং নিন্দা নাম্নঃ পরমমপরাধং বিতনুতে ।
যতঃ খ্যাতিং যাতং কথমু সহতে তদ্বিগর্হাম্ ।।
শিবস্য শ্রীবিষ্ণোর্য ইহ গুণনামাদি-সকলম্ ।
ধিয়া ভিন্নং পশ্যেৎ স খলু হরিনামাহিতকরঃ ।। (দশ নাম-অপরাধ, পদ্ম পুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড ২৫/১৫-১৮)
দশ নামাপরাধ
১) যিনি হরিনামের মহিমা প্রচারে তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সেই ধরনের মহান বৈষ্ণবের নিন্দা করা শ্রীনাম প্রভুর চরণে সবচেয়ে বড় অপরাধ। এমন কি কোন মহান ভক্তও যদি এই রকম অপরাধ করেন, নাম প্রভু কখনও তা সহ্য করেন না। ২) এই জড় জগতে শ্রীবিষ্ণুর নাম পরম কল্যাণময়। বিষ্ণুর নাম, রূপ, গুণ ও লীলা সবই চিন্ময়, পরম জ্ঞানময়। তাই কেউ যদি ভগবানের নাম, গুণ ও লীলাদিকে ভগবান থেকে ভিন্ন বলে মনে করেন, তা হলে তা অপরাধমূলক। আবার শিব আদি দেবতাদের নামকে শ্রীবিষ্ণুর নামের সাথে অভিন্ন বলে মনে করাও অপরাধ।
শ্লোক: 30
গুরোরবজ্ঞা শ্রুতিশাস্ত্রনিন্দনং
তথার্থবাদো হরিনাম্নি কল্পনম্ ।
নাম্নো বলাদ্ যস্য হি পাপবুদ্ধি-
র্ন বিদ্যতে তস্য যমৈর্হি শুদ্ধি ।।
অনুবাদঃ- ৩) গুরুদেবকে সাধারণ জড় মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা। ৪) শ্রুতি-শাস্ত্রের নিন্দা করা। ৫) হরিনামে কাল্পনিক অর্থ আরোপ করা এবং ৬) হরিনামের মহিমাকে কাল্পনিক বা অতিস্তুতি বলে মনে করা- এগুলি নামের চরণে অপরাধ। ৭) যারা মনে করে, হরে কৃষ্ণ মন্ত্র জপ বা কীর্তন করলে যেহেতু সমস্ত পাপ খণ্ডন হয়, তা হলে সমস্ত প্রকার পাপকর্ম করে নামের বলেই তা খণ্ডন করব, তারা কোনও তপস্যা করেও, সমস্ত প্রকার যমযন্ত্রণা ভোগ করেও- কোন উপায়েই শুদ্ধ হতে পারবে না। নামবলে এই পাপবুদ্ধিই হরিনামের চরণে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
শ্লোক: 31
ধর্ম-ব্রত-ত্যাগহুতাদি-সর্বশুভক্রিয়া-সাম্যমপি প্রমাদঃ ।
অশ্রদ্দধানে বিমুখেহপ্যশৃণ্বতি যশ্চোপদেশঃ শিবনামাপরাধঃ ।।
অনুবাদঃ- ৮) হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনকে ধর্ম, ব্রত, ত্যাগ, তপস্যা ও অগ্নিহোত্রাদি কর্মকাণ্ডীয় শুভ ক্রিয়ার সঙ্গে সমান বা অভিন্ন বলে মনে করা এক ভয়ঙ্কর নামাপরাধ। ৯) শ্রবণে অনিচ্ছুক, নাস্তিক এবং হরিনামে শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিদের কাছে নামের মাহাত্ম্য প্রচার করাও একটি অপরাধ।
শ্লোক: 32
শ্রুত্বাপি নামমাহাত্ম্যং যঃ প্রীতিরহিতোহধমঃ ।
অহংমমাদিপরমো নাম্নি সোহপ্যপরাধকৃৎ ।।
অনুবাদঃ- ১০) দিব্য হরিনামের মাহাত্ম্য শ্রবণ করেও যে ব্যক্তি মনে করে—এই দেহই আমি এবং দেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব কিছুই আমার এবং এভাবেই জড়-জাগতিক আসক্তি বজায় রাখে, নামের প্রতি প্রীতি রহিত সেই নরাধম নামের চরণে অপরাধী। ১১) হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার সময়ে অমনোযোগী হওয়া একটি নামাপরাধ।
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
আচার-আচরণ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।