ভক্ত ও ভক্ত সম্বন্ধীয়ঃ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 37
মালী হঞা করে সেই বীজ আরোপণ ।
শ্রবণ-কীর্তণ-জলে করয়ে সেচন ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৫২)
অনুবাদঃ-
সেই বীজ লাভ করার পর, মালী হয়ে সেই বীজটিকে হৃদয়ে রোপণ করতে হয় এবং শ্রবণ, কীর্তণরূপ জল তাতে সিঞ্চন করতে হয়।
(শ্রীল রূপ গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)
শ্লোক: 38
নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম ‘সাধ্য’ কভু নয় ।
শ্রবণাদি-শুদ্ধচিত্তে করয়ে উদয় ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/১০৭)
অনুবাদঃ-
কৃষ্ণপ্রেম নিত্যসিদ্ধ বস্তু, তা কখনও (শুদ্ধ ভক্তি ব্যতীত অন্য কোন অভিধেয়ের) সাধ্য নয়। কেবলমাত্র শ্রবণাদি দ্বারা বিশোধিত চিত্তে তার উদয় সম্ভব।
(শ্রীল সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)
শ্লোক: 39
যন্নামধেয়শ্রবণানুকীর্তনাদ্
যৎপ্রহ্বণাদ্ যৎস্মরণাদপি ক্বচিৎ ।
শ্বাদোহপি সদ্যঃ সবনায় কল্পতে
কুতঃ পুনস্তে ভগবন্নু দর্শনাৎ ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৬)
অনুবাদঃ-
হে ভগবন্ যাঁর নাম শ্রবণ, অনুকীর্তন, প্রণাম ও স্মরণ করা মাত্র চণ্ডাল ও যবন কুলোদ্ভূত ব্যক্তিও তৎক্ষণাৎ বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের যোগ্য হয়ে উঠে, এমন যে প্রভু তুমি, তোমার দর্শনের প্রভাবে কি না হয়?
শ্লোক: 40
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্
যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যা
ব্রহ্মানূচুর্নাম গৃণন্তি যে তে ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৭)
অনুবাদঃ-
হে ভগবান ! যাঁদের জিহ্বায় আপনার নাম বিরাজ করে, তাঁরা যদি অত্যন্ত নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। যাঁরা আপনার নাম কীর্তন করেন, তাঁরা সব রকম তপস্যা করেছেন, সমস্ত যজ্ঞ করেছেন, সর্বতীর্থে স্নান করেছেন এবং সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন, সুতরাং তাঁরা আর্য মধ্যে পরিগণিত।
শ্লোক: 41
নাম চিন্তামণিঃ কৃষ্ণশ্চৈতন্যরসবিগ্রহঃ ।
পূর্ণ শুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নত্বান্নামনামিনোঃ ।।
(পদ্ম পুরাণ)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের নাম চিন্ময় চিন্তামণি বিশেষ, তা চৈতন্যরসের বিগ্রহস্বরূপ। তা পূর্ণ অর্থাৎ মায়িক বস্তুর মতো আবদ্ধ ও খণ্ড নয়; তা শুদ্ধ, অর্থাৎ মায়া-মিশ্য নয়; তা নিত্য মুক্ত অর্থাৎ সর্বদা চিন্ময়, কখনও জড় সম্বন্ধে আবদ্ধ হয় না, যেহেতু নাম ও নামীর স্বরূপে কোন ভেদ নেই।
শ্লোক: 42
শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্ত্যভীক্ষ্নশঃ
স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং
ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৬)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ ! যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন, অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত করতে পারে।
শ্লোক: 43
গোলোকের প্রেমধন, হরিনাম সংকীর্তন,
রতি না জন্মিলে কেনে তায় ।
সংসার-বিষানলে দিবানিশি হিয়ে জ্বলে,
জুড়াইতে না কৈনু উপায় ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর-ইষ্টদেবে বিজ্ঞপ্তি-২, প্রার্থনা থেকে)
অনুবাদঃ- হরিনাম সংকীর্তনরূপে ভগবৎপ্রেম গোলোক বৃন্দাবন থেকে এই জগতে অবতরণ করেছে। কেন আমার তাতে রতি হল না? দিন ও রাত ধরে সংসার বিষের অনলে আমার হৃদয় জ্বলছে। কিন্তু তবুও তাকে প্রশমিত করার কোন উপায় আমি গ্রহণ করছি না।
শ্লোক: 44
জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য নমন্ত এব
জীবন্তি সন্মুখরিতাং ভবদীয়বার্তাম্ ।
স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতিগতাং তনুবাঙ্মনোভি-
র্যে প্রায়শোহজিত জিতোহপ্যসি তৈস্ত্রিলোক্যাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৩)
অনুবাদঃ- যাঁরা তাঁদের সামাজিক পদে স্থিত হয়েও মনোধর্মী জল্পনা-কল্পনামূলক জ্ঞানকে দূরে নিক্ষেপ করেন, দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে আপনার লীলাকথা শ্রবণ করেন এবং আপনি ও আপনার শুদ্ধ ভক্তদের মুখনিঃসৃত হরিকথা শ্রবণ করে জীবন ধারণ করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে আপনাকে জয় ক্রেন্ম, যদিও ত্রিলোকের কোনও ব্যক্তি অন্য কোন উপায়ে আপনাকে জয় করতে পারে না।
শ্লোক: 45
নিবৃত্ততর্ষৈরুপগীয়মানাদ্
ভবৌষধাচ্ছ্রোত্রমনোহভিরামাৎ
ক উত্তমশ্লোকগুণানুবাদাৎ
পুমান্ বিরজ্যেত বিনা পশুঘ্নাৎ ।।
(ভাগবত ১০/১/৪)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয় গুরু-পরম্পরার ধারা অনুসারে। এই জড় জগতের ক্ষণস্থায়ী মিথ্যা গুণকীর্তনে যাঁরা আদৌ আগ্রহী নয়, তাঁরাই ভগবানের মহিমা কীর্তনে আনন্দ লাভ করেন। ভগরোগের অধীনে যারা জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই সব দেহবদ্ধ জীবদের পক্ষে ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তন হল যথার্থ ঔষধ। তাই, পশুঘাতক বা আত্মঘাতী ছাড়া ভগবৎ-কথা শ্রবণ-কীর্তনে আর কে-ই বা বিরত হবে?
শ্লোক: 46
শৃণ্বতাং স্বকথা কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎ সতাম্ ।।
(ভাগবত ১/২/১৭)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং তিনি হচ্ছেন সাধুদের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ ও কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।
শ্লোক: 47
এতন্নির্বিদ্যমানানামিচ্ছতামকুতভয়ম্ ।
যোগিনাং নৃপ নির্ণীতং হরের্নামানুকীর্তনম্ ।।
(ভাগবত ২/১/১১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! মহান আচার্যদের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে নিরন্তর ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা সকলের জন্য সিদ্ধি লাভের নিশ্চিত তথা নির্ভীক মার্গ। এমন কি যাঁরা সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, যাঁরা সব রকম জড়-জাগতিক সুখভোগের প্রতি আসক্ত এবং যাঁরা দিব্যজ্ঞান লাভ করার ফলে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন, তাঁদের সকলের পক্ষে এটিই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
শ্লোক: 48
আপন্নঃ সংসৃতিং ঘোরাং যন্নাম বিবশো গৃণন্ ।
ততঃ সদ্যো বিমুচ্যেত যদ্বিভেতি স্বয়ং ভয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/১/১৪)
অনুবাদঃ- জন্ম-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর আবর্তে আবদ্ধ মানুষ বিবশ হয়েও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম উচ্চারণ করতে করতে অচিরেই সেই সংসারচক্র থেকে মুক্ত হয়, সেই নামে স্বয়ং মহাকালও ভীত হন।
শ্লোক: 49
এবংব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্ নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ।।
(ভাগবত ১১/২/৪০)
অনুবাদঃ- কেউ যখন ভক্তিমার্গে যথার্থ উন্নতি সাধন করে এবং তার অতি প্রিয় ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করে আনন্দমগ্ন হন, তখন তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম কীর্তন করেন। তিনি কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন এবং কখনও উন্মাদের মতো নৃত্য করেন। বাইরের লোকেরা কে কি বলে সেই সম্বন্ধে তাঁর কোন জ্ঞান থাকে না।
শ্লোক: 50
যদি বৈষ্ণব-অপরাধ উঠে হাতী মাতা ।
উপাড়ে বা ছিণ্ডে, তার শুখি যায় পাতা ।।
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্ত যদি এই জড় জগতে ভক্তিলতার সেবা করার সময় কোন বৈষ্ণবের চরণে অপরাধ করেন, তা হলে ভক্তিলতার পাতা শুকিয়ে যায়। এই প্রকার বৈষ্ণব অপরাধকে মত্ত হস্তীর আচরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
(সূত্রঃ- বৈষ্ণব শ্লোকাবলী) এরপর দেখুন=
ভক্ত ও ভক্ত সম্বন্ধীয়ঃ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক :-
আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে পারেন। মানসম্মত লেখা নামসহ সাইটে স্থায়ীভাবে পাবলিশ করা হয়।