শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৮ম অধ্যায়:- অক্ষরব্রহ্মযোগ-এর সার সংক্ষেপ:-
লেখক-
শ্রী স্বপন কুমার রায়
মহা ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ব্যাংক৷
সাধারণ সম্পাদক, শ্রী শ্রী গীতাসংঘ, মতিঝিল শাখা, ঢাকা৷
--------------------------------------
গীতার অষ্টম অধ্যায়টি মাত্র ২৮টি শ্লোকবিশিষ্ট অধ্যাত্মতত্ত্বসমৃদ্ধ একটি অধ্যায় যা ‘অক্ষরব্রহ্মযোগ’ নামে পরিচিত। অধ্যায়ের প্রারম্ভেই ভক্ত অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের নিকট কয়েকটি বিষয়ে জানবার জন্য জিজ্ঞেস করেছেন। তিনি জানতে চাইলেন ব্রহ্মকি? অধিযজ্ঞকি? প্রয়াণকালে তিনি কিপ্রকারে তাঁকে জানতে বা স্মরণ করতে পারবেন? অর্জুনের জিজ্ঞাসার উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন অব্যয় ও অক্ষর বস্তুই ব্রহ্ম এবং তাঁর স্বভাবই অধ্যাত্ম। ক্ষর ভাবযুক্ত দেহাদি অধিভূত এবং এই দেহে পরমাত্মারূপে যে পুরুষ অধিষ্ঠিত আছেন তিনিই অধিদৈব। এভাবে বলতে বলতে অন্তিমকালে তাঁকে কিভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সহজ ও সরল ভাষায় অর্জুনকে বললেন যে, মৃত্যুকালে মানুষ যেমনটি চিন্তা করতে করতে দেহত্যাগ করে, মৃত্যুর পর অর্থাৎ পরজন্মে ঠিক সেই চিন্তার অনুরূপ হয়েই জন্মগ্রহণ করে থাকে। অন্তিমকালে কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণকে ভাবনা করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তবে সে পরজন্মে তাঁকেই পাপ্ত হবে। কাজেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন যে তিনি যদি সর্বদা তাঁকে স্মরণ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় তবে তার পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায়, কর্তব্য-অকর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে কোন চিন্তার প্রয়োজন হবে না। তাঁকে স্মরণ করে কর্তব্য প্রতিপালন করে গেলে তার মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। অতপর শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগীপুরুষ কিভাবে দেহান্তে তাঁকে লাভ করতে পারে তার বর্ণনা দিলেন। কোন যোগী দেহের সর্বদ্বার সংযত করতঃ মনকে হৃদয়ে নিরুধ্য করে প্রাণকে যোগবলে ভ্রুযুগলের মধ্যখানে স্থাপনপূর্বক ‘ওম’ এই ব্রহ্মময় এক অক্ষর উচ্চারণ করতে করতে দেহত্যাগ করলে তিনি পরজন্মে পরমগতি লাভ করে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ আরেকটি বিষয় নিশ্চিত করে বললেন যে, ভূ-লোক থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত লাভ করেও সাধককে পুণ্যফল ভোগের পর পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয়, কিন্তু একবার শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা গেলে আর এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয়না। এরপর শ্রীকৃষ্ণ বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করলেন কোন্ তিথি ও ক্ষণে মৃত্যুবরণ করলে মানুষের পুনঃজন্ম হয় এবং কখন মৃত্যু হলে মানুষ মোক্ষলাভ করে থাকে। তিনি জানালেন ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ এবং দক্ষিণায়ন এর সময় মৃত্যুহলে মানুষের পুনঃজন্ম হয়। কিন্তু অগ্নি, জ্যোতি, দিবাকাল, শুক্লপক্ষ এবং উত্তরায়নের কালে প্রাণত্যাগ করলে যোগী মোক্ষধাম প্রাপ্ত হন। জগতে শুক্ল অর্থাৎ প্রকাশময় এবং কৃষ্ণ অর্থাৎ অন্ধকারময়-এই দু’টি পথ অনাদি বলে প্রসিদ্ধ। একটি দ্বারা মোক্ষলাভ হয় এবং অপরটি দ্বারা পুনর্জন্ম হয়। এই মার্গদ্বয় সম্পর্কে অবগত হয়ে যোগীপুরুষ কখনও মোহগ্রস্ত হয়না। অতএব, অর্জুনকে যোগযুক্ত হবার জন্য পরামর্শ দিলেন শ্রীকৃষ্ণ। প্রসংগত একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে এ অধ্যায়ে শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ, উত্তরায়ন, দক্ষিণায়ন শব্দগুলো ব্যবহার করা হলেও ভক্ত ও জ্ঞানী পাঠক গণকে এশব্দগুলোর শুধু বাহ্যিক অর্থ বিবেচনা করলে সঠিক বিবেচনা করা হবেনা। এগুলোকে বুঝতে হবে অধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক অর্থে। কারণ বাহ্যিক অর্থে এগুলোর সত্যতা অনুধাবন করতে গেলে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীত ঘটনা পরিদৃষ্ট হবে।
এঅধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, শুক্লপক্ষে ও উত্তরায়নের সময় কেহ দেহত্যাগ করলে তার মোক্ষলাভ হবে, কিন্তু কৃষ্ণপক্ষে ও দক্ষিণায়নের সময় দেহত্যাগ হলে
পুনর্জন্ম হবে।
জাগতিকভাবে এর সত্যতা খুজতে গেলে দেখা যাবে অনেক মহাযোগীপুরুষ, এমনকি অবতার বলে স্বীকৃত পুরুষও দক্ষিণায়নের সময় দেহত্যাগ করেছেন। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেবে যে তাঁরা কি তাহলে মোক্ষলাভ করবেন না? তাদেরকি সাধারণ মানুষের ন্যায় আবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে? এহেন প্রশ্নের বা সন্দেহের উত্তর পাওয়া যাবে এশব্দগুলোর আধ্যাত্মিক বা তাত্ত্বিক অর্থের বিশ্লেষণে। ভূ-গোল পঠনে জানা যায় যে, প্রতি পনের দিনে একপক্ষ। অমাবস্যার পরেরদিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে পরের পূর্ণিমা পর্যন্ত যে পনের দিন তাকে বলে শুক্লপক্ষ এবং পূর্ণিমার পরের দিন থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পনের দিন কৃষ্ণপক্ষ। আবার আষাঢ় পূর্ণিমা থেকে পৌষ পূর্ণিমার আগপর্যন্ত যে ছয় মাস তাকে বলে দক্ষিণায়ন। পক্ষান্তরে পৌষপূর্ণিমা থেকে আষাঢ়পূর্ণিমার আগ পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ন। শাস্ত্রবলে, যা আছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে তা আছে দেহভান্ডে। সে অনুযায়ী বাহ্যিক জগতের কৃষ্ণপক্ষ, শুক্লপক্ষ, দক্ষিণায়ন ও উত্তারয়ণ এ দেহের মধ্যেও কল্পনীয়। প্রথমে দেখা যাক কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষ হচ্ছে অন্ধকারময় সময়। এই পক্ষে প্রতিদিন চন্দ্রের ক্ষয় হতে হতে অমাবস্যায় চন্দ্র একেবারেই অদৃশ্য হয়। মানবদেহের মধ্যেও চন্দ্র রয়েছে যা ব্রহ্ম বা কৃষ্ণচন্দ্র নামে পরিচিত। জীব যখন কাম, কামনায় আসক্ত হয়ে ক্রমশঃ কৃষ্ণচন্দ্রকে ভুলে যায় অর্থাৎ দেহের ব্রহ্ম তথা কৃষ্ণজ্ঞান হারিয়ে ফেলে তখনই জীবদেহে কৃষ্ণপক্ষ। এহেন সময়ে বা অবস্থায় যদি কোন মানুষের মৃত্যু হয় তবে তার মুক্তি হয়না, বরং পুনর্জন্ম লাভ করে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। পক্ষান্তরে শুক্লপক্ষ প্রকাশময় অর্থাৎ এইপক্ষে চন্দ্রের কলা ক্রমশঃ বৃদ্ধিপায়। জীব যখন সাধনার দ্বারা বা কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে তার ব্রহ্মজ্ঞান বা কৃষ্ণজ্ঞানকে সুদৃঢ়করে অর্থাৎ দেহমনপ্রাণ কৃষ্ণচেতনায় উদ্ভাসিত হয় তখন জীব দেহের শুক্লপক্ষ। এমন অবস্থায় বা কালে জীব দেহত্যাগ করলে তিনি অবশ্যই পরমগতি লাভ করেন। এবার উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। মানব দেহের মধ্যে ছয়টি চক্র রয়েছে যাকে ষটচক্র বলা হয়। যেমন (সর্বনিম্ন থেকে উর্ধদিকে) 1. মূলাধারচক্র 2. স্বাধিষ্ঠানচক্র 3. মনিপুরচক্র 4. অনাহুতচক্র 5. বিশুদ্ধচক্র 6. আজ্ঞাচক্র। এই ছয়টি চক্রের মধ্যে অনাহুত চক্রটি বক্ষস্থলে অবস্থিত এবং ইহাকে মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত চক্র বলে ধরা হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, চক্রগুলো এই দেহের অভ্যন্তরস্থ 3টি নাড়ী (ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষন্মা) এর মধ্যমা নাড়ী সুষন্মা নাড়ীতে স্তরে স্তরে অবস্থিত। অনাহুত চক্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখান থেকে নিম্নদিকে মূলাধার চক্র পর্যন্ত বায়ুর গতি নিম্নগামী। অধোগামী এই বায়ুর সাথে জড়িত আছে কাম ও কামনা। কামে আসক্ত হয়েই জীব ব্রহ্মসত্ত্বাকে নষ্ট করে, অজ্ঞানতার পথে ধাবিত হয় যার ফলে কৃষ্ণচন্দ্র ক্রমশঃ ক্ষীণহয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। ইহাই দেহের দক্ষিণায়ন। অতএব, এই সময়ে দেহত্যাগ হলে জীবের যে পুনর্জন্ম হবে তাতে আর সন্দেহ কি? পক্ষান্তরে অনাহুত চক্র থেকে আজ্ঞাচক্রের দিকে বায়ুর গতি উর্ধমুখী। এই বায়ুর প্রভাবে জীবের ব্রহ্মবস্তু উর্ধগামী হয়ে সহস্রায় অধিষ্ঠিত হয়। তখন জীব দ্বিদল পদ্মে ঈশ্বরকে দর্শন করে। যোগী পুরুষেরা যোগসাধন বলে (রেচক পুরক ও কুম্ভক সাধনের মাধ্যমে) নিম্নগামী বায়ুকে উর্ধমুখী করার চেষ্টা করেন। এতে ব্রহ্মশক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় বা কৃষ্ণচন্দ্রের কলা ক্রমশঃ বৃ্দ্ধি পায়। ইহাই দেহের শুক্লপক্ষ এবং এই অবস্থায় কেহ মৃত্যুবরণ করলে তিনি মোক্ষগতি লাভ করেন। এভাবে অক্ষরব্রহ্মযোগের নিগুঢ়তত্ত্বের কথাগুলো সাধক ভক্ত অনুধাবন করে তা অনুশীলনের মাধ্যমে মুক্তিলাভ করতে পারেন।
জয় শ্রীকৃষ্ণ ।।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৯ম অধ্যায়: রাজবিদ্যারাজগুহ্যযোগ- এর সার সংক্ষেপ দেখুন