শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১১শ অধ্যায়: বিশ্বরূপদর্শনযোগ-এর সার সংক্ষেপ:-
লেখক-
শ্রী স্বপন কুমার রায়
মহা ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ব্যাংক৷
সাধারণ সম্পাদক, শ্রী শ্রী গীতাসংঘ, মতিঝিল শাখা, ঢাকা৷
--------------------------------------
এ অধ্যায়ে প্রিয় শিষ্য অর্জুনের প্রার্থনার প্রেক্ষিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন বলে এঅধ্যায়কে বিশ্বরূপ দর্শনযোগ বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বরূপ হচ্ছে ভগবানের এমন এক রূপ বা মূরতী যার মধ্যে এ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকলকিছুই দৃশ্যত৷ বিভূতিযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে অর্জুন তাঁর অনন্ত বিভূতির কথা শ্রবণ করেছিলেন। তখন স্বভাবতই তার মনে আকাঙ্খা জেগেছিল যে তিনি যা কানে শুনলেন তা যদি প্রত্যক্ষভাবে নয়নে দর্শন করতে পারতেন তবে আরও ভাল হতো। অর্জুনের মনের সেই বাসনার কথা তাই তিনি ব্যক্ত করলেন এ অধ্যায়ের প্রথমভাগে (চতুর্থশ্লোকে)। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শ্রীকৃষ্ণ সমীপে বললেন, হেপ্রভু! যদি আপনি মনে করেন যে আমার দ্বারা আপনার সেরূপ দেখা সম্ভব, তাহলে হে যোগেশ্বর! আমাকে আপনার সেই অক্ষয় রূপ দর্শন করান। অর্জুনের এই আকুল প্রার্থনায় শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন দানের উদ্দেশ্যে অর্জুনকে দিব্যচক্ষু দান করলেন, কারণ সাধারণ চর্মচক্ষু দিয়ে ভগবানের দিব্যরূপ দর্শন করা যায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত হয়ে অর্জুন দেখলেন যে, এ নিখিল সংসারে এক সূ্র্য নয়, বরং সহস্রসূর্যের তেজবিশিষ্ট এক বিরাট মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। সেই বিরাট মূর্তির মধ্যে তিনি স্বর্গ হতে মর্ত্য পর্যন্ত সমুদয় সৃষ্টি একসংগে দেখতে পেলেন। এই বিশ্বরূপ দর্শনের পূর্বপর্যন্ত অর্জুনের মনের মধ্যে ক্ষীণতম যে সন্দেহ ছিল তা এই রূপ দর্শনে বিদূরিত হলো। তার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল এবং তিনি অবনত মস্তকে সেই বিরাট মূর্তিকে প্রণাম করে করজোড়ে বলতে লাগলেন হে কেশব! হেপুরুষোত্তম! আমি তোমার দেহের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি দেববৃন্দ, যক্ষ, রক্ষ, ঋষি, মানব,
পশুপক্ষী, সমস্তই বিদ্যমান।
অর্জুন দেখতে পেলেন ভগবানের এক দেহের মধ্যেই
অসংখ্য বাহু ও চরণ, উদর ও নেত্র। তাঁর বিরাট মুখগহ্বরের মধ্যে থেকে জলন্ত বহ্নিশিখার মত শত শত শিখা বহির্গত হচ্ছে। পৃথিবীর সকল নদ নদী যেমন সাগরের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি কুরুক্ষেত্রের সকল বীর ও যোদ্ধা সেই জলন্ত শিখার দিকে ছুটে যাচ্ছে। পতঙ্গ যেমন মৃত্যুর জন্য অগ্নিতে ঝাপিয়ে পড়ে, তদ্রুপ তাঁর মুখের জলন্ত অগ্নিতে লোক সকল পতঙ্গের ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ছে। তার উগ্র তেজে সমুদয় সৃষ্টি জ্বলে যাচ্ছে। এসব দেখে ভয়ে অর্জুনের সর্বাঙ্গ কম্পিত হতে লাগল। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এই ভয়ঙ্কর মূর্তিতে আমি সৃষ্টি ধ্বংস করি, অর্থাৎ ইহা আমার লোকসমূহ বিনাশকারী মহাকালরূপ। এখন আমি লোকসমূহ ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়েছি। কাজেই তুমি যুদ্ধ না করলেও তোমার প্রতিপক্ষের যোদ্ধা গণের ধ্বংস অনিবার্য। অর্জুন, তুমি এখানে নিমিত্ত মাত্র কারণ হবে। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে হৃদয় দৌব্যল্য পরিত্যাগ করতঃ কর্তব্য সম্পাদনে ব্রতী হতে বললেন। ভগবানের কথায় অর্জুনের সকল ভ্রান্তির অপনোদন হলো। তিনি তখন ভাবলেন এতদিন যাকে শুধু বন্ধু ও মানব বলে জানতেন, আসলে তিনিই ভগবান, পরমব্রহ্ম সনাতন। তিনি কৃপাকরে তাদের সহায় হয়েছেন। এইবার অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ সমীপে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলতে লাগলেন, হে দীনবন্ধু! হে প্রভু! বন্ধুজ্ঞানে, সখাজ্ঞানে ভ্রমবশতঃ তোমাকে কতইনা অন্যায় বাক্য প্রয়োগ করেছি। এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আপনি আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন। বন্ধু যেমন বন্ধুর অপরাধ ক্ষমা করে, পিতা যেমন পুত্রের অপরাধ ক্ষমা করেন, তদ্রুপ ভগবান যেন তার সকল অপরাধ মার্জনা করেন। অতপর অর্জুন ভগবানের এই উগ্রমূর্তির স্থলে তাঁর শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী মধুর মূরতি ধারণ করার জন্য প্রার্থনা জানালেন। ভগবান ও তার ইচ্ছানুসারে পুনঃরায় শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী মধুর সৌম্যমূরতি ধারণ করলেন৷ তখন অর্জুনের মনের সকল ভয়, সংশয়, দুশ্চিন্তা দূরীভূত হলো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তখন উপদেশ দিলেন যে, যারা তাঁকে ভালবেসে মনেপ্রাণে আত্মসমর্পণ করে, তিনি তাদেরকে এই মধুর রূপে দেখা দিয়ে থাকেন।
জয় শ্রীকৃষ্ণ ।।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১২শ অধ্যায়: ভক্তিযোগ - এর সার সংক্ষেপ দেখুন