23) ছি ছি, বেহায়া কোথাকার? মেয়ে ছেলের গায়ে হাত-
সেদিন বড় গঞ্জের হাটবার। সকলকে সেই হাটেবাজার করতে যেতে হয়। গোপাল গঞ্জের বাজারে চলেছে গ্রামের কয়েকজন চেনাজানা লোকের সঙ্গে গল্প করতে করতে। যেতে যেতে হঠাৎ গোপালের নজরে পড়ে, সামনে একটি মেয়েও যাচ্ছে বোঝা মাথায় নিয়ে। গোপাল ভালভাবে নজর দিয়ে দেখতে পেলে, মেয়েটি ভারি বোঝার জন্য হোক বা অন্য কোনও কারণে হোক কাঁদতে কাঁদতে আগে আগে চলেছে, আর ঘন ঘন একটা হাত দিয়ে সর্দি মুছছে পাছায় ঘষছে আনমনে। কাঁদলে সকলেরই নাকি সর্দি আসে এমনিতেই। সে একহাতে বোঝার টাল সামলাচ্ছে, আর এক হাত দিয়ে নাকের সর্দি টেনে পাছার মুছছে। আর এ অভ্যাসটাতো অল্প বিস্তর অনেকেরই থাকে, এ আর তাই তেমন নতুন কি?
গোপালের থামায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল, আর মুখে দেখা গেল বাঁকা হাসি। গোপালের মাথায় তো সব সময় কত রকম বুদ্ধি ফিকিরের আসর। সে মনে মনে ভাবলে একটু মজা না করলেই নয়। মেয়েটি গরীব হলেও চলন ও অন্যান্য আদব কায়দা দেখে ভাল ঘরের মনে হোল। আর মেয়েটিরও ছেলে মানুষি মিষ্টি চেহারা। কিলবিল করছিল ফন্দি গুলো গোপালের মাথায়। তারই একটাকে সে ছেড়ে দিলে মেয়েটির কান্না থামাতে আর তার মুখে হাসি টেনে আনতে তার এবং তার মনে ব্যথা ভোলানোর জন্য।
চকিতে গোপাল এগিয়ে যায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ভান করে- নাকের সর্দি জোরে ভেতরে টানার শব্দ করে, যেন কত সর্দি জমে আছে। তারপরই হঠাৎ একদলা সর্দি বের করে মেয়েটির পেছনের কাপড়ে মুছে দিল। মেয়েটি চমকে উঠে। সে ঘুরেই মুখ ঝামটা দিয়ে বললে, একি করলেন মশাই। আপনার সর্দ্দি আমার গায় মুছতে আপনাকে কি কেউ বলেছে? আপনার লজ্জা করল না? ছি ছি, বেহায়া কোথাকার? মেয়ে ছেলের গায়ে হাত দিলেন- ভদ্রলোক হয়েও এই কি উচিত কাজ? আমি এখনই রাজদরবারে নালিশ করব, কেন আপনি আমার পাছায় হাত দিলেন?
গোপাল প্রাণখোলা হাসি হেসে তখন বলল, তা বাছা তুমি রাগ করছ কেন? তোমার সর্দ্দি মোছার বহর দেখে আমি ভাবলাম, এটা বোধ হয় সদ্দি মোছার পাছা। গোপালের সঙ্গীরা হো হো করে হেসে উঠে। মেয়েটির মুখেও হাসির রেখা দেখা দেয়। গোপাল তখনও বললে, দেখ বাছা, তোমার চোখের সামনে, চোখের জল দিয়ে তো তোমার পেছনের কাপড়ের সর্দ্দি ধোওয়া যাবে না? তাই বাজারে পৌছাতে পৌছাতে আমার চোখের জল দিয়ে তোমার পাছার কাপড়ে সর্দ্দির দাগ ধুয়ে দেব। আমি আবার এমন ছোট মেয়ের কান্না সইতে না পেরে কেঁদে ফেলি যে। মেয়েটি ফিক করে হেসে উঠে। তার বাবার মত কথা বলতে শুনে। মেয়েটি তখন সব দুঃখ ভুলে যায়।
24) ঘোড়া মলত্যাগ করেছে, তাতে আমরা আশুচি হবো কেন ?
একদিন এক পূজারী বামুন শালগ্রাম শিলা কাঁধে নিয়ে যজমান বাড়ি যাচ্ছেন, এমন সময়ে পথের মাঝে তাঁর ভয়ানক মলত্যাগের বেগ হল। অগত্যা সেই শালগ্রাম তিনি পাশে গাছের কাছে রেখেই অন্য এক গাছের আড়ালে বসে পড়লেন। সেই পূজারী বামুন রাজবাড়িতেও পুজো করতেন। ব্রাক্ষ্মণের ভাগ্য মন্দ ঠিক সেই সময়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যাচ্ছিলেন সেই পথে। রাজা দেখলেন পূজারী ঠাকুর নারায়ন রেখে গাছেন পিছনে বসে মলত্যাগ করছেন। রাজা পূজারী ঠাকুরকে চিনতে পেরেই চলে গেলেন রাজবাড়িতে। সেই সময় সেই দিয়ে এক প্রতিবেশীও যাচ্ছিল। সে বামুনের কথা রাজাকে বলতে পরদিন পূজারী যখন রাজবাড়িতে পূজা করতে এসেছেন, তখন রাজার আদেশ শুনে তিনি হতবাক। পূজারী শালগ্রাম অপবিত্র করেছেন, এ পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত তিনি যতদিন না করবেন, ততদিন আর রাজবাড়ির বিগ্রহের পূজা করতে তিনি পারবেন না। এমন কি, পূর্বের মত অন্য যজমানদের বড়ি পূজা অচ্চনা করেছেন তিনি- এমন কথা যদি রাজা জানতে পারেন, তাহলে কঠোর দন্ড দেওয়া হবে পূজারীকে। পূজারী বামুন পূজা না করেই কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেলেন। শালগ্রাম কলুষিত করার প্রায়শ্চিত্ত একট ব্যায় সাধ্যব্যাপার। গরীব বামুন কোথায় পাবেন অত টাকা? টাকা না হলে কি করে হবে। ব্রাক্ষ্মণকে কাঁদতে দেখে সকলেরই দয়া হল তার উপরে, কিন্তু রাজার কাছে তার হয়ে দুকথা বলবার সাহস কারও হলও না। সকলে গোপালের কাছে যেতে বলল, একটা উপায় গোপাল বের করবেই। শেষে ব্রাক্ষ্মণ কেঁদে কেটে ধরলেন গোপালকে। রাজার একান্ত প্রিয়পাত্র ওই গোপাল, রাজাকে যদি কিছু বলতে হয়, তবে গোপালকে দিয়ে বলানোই ভাল। গোপাল ছাড়া বামুনের আর কোনও উপায় নাই। গোপাল বললে, দুচারদিন ধৈর্য্য ধরে থাকুন ঠাকুর মশাই, সুযোগ না এলে কথা কয়ে লাভ হবে না। আমি এর একটা বিহিত করতে পারব আশা করছি। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যান। আপনার কথা আমার মনে থাকবে। সময় সুযোগ না হলে রাজাকে বলে কিছুই লাভ হবে না। এই বলে গোপাল বামুন ঠাকুরকে বিদায় দিল তখনকার মত। দুই একদিন পরেই রাজা একদিন ঘোড়ার গাড়িতে বেড়াতে বেরিয়েছেন। গোপালও সঙ্গে আছে। শীতের অপরাহ্ন খানিকটা বৃষ্টিও হয়েছে, গরম শালে সর্বাঙ্গ ঢেকেও তবু রাজ মাঝে মাঝে শীতে কাঁপছেন। এমন সময়ে হঠাৎ গাড়ির ঘোড়াটা মলত্যাগ করলে। অমনি গোপাল হতাশভাবে বলে ফেললে, কি সর্বনাশ। রাজা অবাক হয়ে বললেন, কি সর্বনাশ। গোপাল বললে, সর্বনাশ নয়? এই শীতের সন্ধ্যায় এখন স্মান করে মরতে হবে মহারাজাকেও আমাকেও। গরম মলত্যাগ করে আমাদের অশুচি করে দিলে। এখন কি করা যায় ভেবে দেখুন, মহারাজ। মহারাজ সবিষ্ময়ে বললেন, ঘোড়া মলত্যাগ করেছে, তাতে আমরা আশুচি হবো কেন, আমি ত কিছু বুঝতে পারছি না। গোপাল তখনই উত্তর দিলে, তাহলে ব্রাক্ষ্মণ মলত্যাগ করাতে নারায়ন অশুচি হলেন কেন? ঘোড়াও যেমন বাহন মাত্র, ব্রাক্ষ্মণও তেমনি দেবতার বাহন ছিল মাত্র। তার কি অপরাধ হল বলুন। রাজা বুদ্ধিমান ব্যক্তি তিনি এভাবে বিচার করে দেখেননি। গোপালের কথা শুনে তিনি অনেক চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, তুমি যা বললে, সেটা ন্যায়শাস্ত্রের হিসাবে সঙ্গত বটে, কিন্তু হিন্দুর ধর্ম সংষ্কার অনুযায়ী সঙ্গত নয়। মানুষে আর পশুতে সব বিষয়েরই পার্থক্য আছে। যাই হোক ব্রাক্ষ্মণ যে বাধ্য হয়েই এ রকম অবস্থায় মলত্যাগ করেছিল, তা আমি বুঝতে পারছি। প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হবেই, তবে তার ব্যয় আমি দেবো। তুমি তাকে কালই প্রায়শ্চিত্ত করে আবার যথারীতি পূজা করতে বল। তোমাকে বুদ্ধিতে হারাতে পারব না, তবে নিশ্চয় বামুন ঠাকুর তোমাকে এরজন্য ঘুষ দিয়েছে আমার মনে হচ্ছে। গোপাল কানে হাত দিয়ে বলে, রাম রাম। এ কথা বলবেন না মহারাজ। ঘুষ কেবল মহারাজের কাছে নিই, তাই বলে গরীব মানুষের কাছে ঘুষ নেব সে মতি যেন কোনদিন না হয় হুজুর। এই বামুন ঠাকুর খুব গরিব কিনা। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।