" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • ভূভার হরণ

    শ্লোক: ১৭
    ভারাবতারণায়ান্যে ভুবো নাব ইবোদধৌ ।
    সীদন্ত্যা ভূরিভারেণ জাতো হ্যাত্মভূবার্থিতঃ ॥ ১৭ ॥
  • অনুবাদ : অন্যেরা বলেন যে , সাগরে অর্ণবযানের মতো এই পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়ে পীড়িত হলে , তখন তোমার পুত্র ব্রহ্মার প্রার্থনায় জগতের দুঃখক্লেশভার লাঘবের জন্য তুমি আবির্ভূত হয়েছ । ( ভাঃ ১/৮/৩৪ )
  • তাৎপর্যঃ- ব্রহ্মা হচ্ছেন পরম পুরুষ বা পরম পিতার সাক্ষাৎ পুত্র । পরম পিতা , পরমব্রহ্মের সন্তান হচ্ছেন ব্রহ্মা । মাতৃগর্ভ থেকে তাঁর জন্ম হয়নি । তাই তাঁর নাম হচ্ছে আত্মভূ । এই ব্রহ্মা সর্বশক্তিমানের শক্তিদ্বারা গৌণভাবে প্রতিফলিত ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য সৃষ্টির অধিকর্তা । এই ব্রহ্মাণ্ডের জ্যোতিশ্চক্রের ভিতরে শ্বেতদ্বীপ নামে এক অপ্রাকৃত ধাম আছে , এবং সেটি হচ্ছে ভগবানের পরমাত্মামূর্তি ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর দিব্যধাম । এই ব্রহ্মাণ্ডের শাসকবর্গ দেবতাদের সমাধানের অসাধ্য কোন বিপর্যয় উপস্থিত হলে , তাঁরা সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন , এবং এমন কি ব্রহ্মাজীও সেই সমস্যা সমাধানে অসমর্থ হলে , তিনি ঐ বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য জগতে ভগবানের আবির্ভাবের উদ্দেশ্যে ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেন । কংসাদি অন্যান্য অসুরদের পৃথিবী শাসনকালে এই রকম সমস্যার উদয় হয় এবং এই সব অসুরের নির্যাতনে পৃথিবী অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে । অন্যান্য দেবতাসহ ব্রহ্মা তখন সেই ক্ষীর সমুদ্রের তীরে গিয়ে প্রার্থনা করেন এবং তখন বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে ভগবানের আবির্ভাবের কথা তাঁদের জানানো হয় । এই জন্য কেউ কেউ বলেন যে , ব্রহ্মার প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে ভগবান আবির্ভূত হন ।

       ভগবানের আবির্ভাবের কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন বিবৃতি কুন্তীদেবী এখানে বর্ণনা করছেন । কেউ কেউ বলেন , বসুদেব ও দেবকীর প্রার্থনায় ভগবান আবির্ভূত হন, আবার কেউ কেউ বলেন যে , ব্রহ্মার প্রার্থনায় তিনি অবতরণ করেন । ভারাবতারণায়ান্যে ভুবো নাব ইবোদধৌ- কেউ কেউ বলেন যে , সমুদ্রে ভারাক্রান্ত অর্ণবযানের মতো ভূভার লাঘবের উদ্দেশ্যে তিনি আবির্ভূত হন। জগৎ ভারাক্রান্ত হলে সেখানে যুদ্ধ , মড়ক , দুর্ভিক্ষ , মহামারী ইত্যাদি হয় । এগুলি প্রকৃতির নিয়ম ।

       নানা পর্বতমালা ও বিশাল সমুদ্র সমন্বিত, লক্ষ-লক্ষ গ্রহের মধ্যে পৃথিবীও মহাশূন্যে ভাসমান । গ্রহগুলি ভাসে কারণ কৃষ্ণ সেগুলোর মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছেন । ভগবদ্গীতায় গামাবিশ্য বলা হয়েছে , ঠিক যেমন তিনি প্রতিটি পরমাণুতে প্রবেশ করেন । পৃথিবী নিশ্চয় ভারহীন নয় , পক্ষান্তরে , পৃথিবী অত্যন্ত ভারী । কিন্তু পরমাত্মা অন্তরে প্রবেশ করায় , পৃথিবী ভাসমান অবস্থায় আছে ।

       আত্মার উপস্থিতির জন্য সব কিছুই হালকা হয় । যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ জীবিত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার দেহটি ভাসবে , কিন্তু আত্মা দেহত্যাগ করা মাত্রই দেহটি জলে নিমজ্জিত হয় । একটি জীবিত শিশুকে আমরা এক হাতে তুলতে পারি , কিন্তু মৃত শিশু ভারী হয়ে পড়ে । অতএব এখন আমরা ভারী কিন্তু পারমার্থিক উন্নতি করে আমরা বিপদভার থেকে মুক্ত হব । এখন আমরা আকাশে উড়তে পারি না , কিন্তু চিন্ময় আত্মা এতই লঘু যে , জড় দেহ মুক্ত হওয়া মাত্রই মুহূর্তে সে চিৎ - জগৎ বৈকুণ্ঠলোকে যেতে পারে ( ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি ) ।

       তা হলে এই জগৎ ভারাক্রান্ত হয় কেন ? ভগবদ্ভক্তি বিদ্বেষী অসুরদের উপস্থিতিতেই তা হয় । যখন মাতা বসুন্ধরা ভূভার অনুভব করেন , তখন কৃষ্ণ ঐ ভূভার লাঘবের জন্য অবতরণ করেন । যেমন সমুদ্রে জাহাজ গুরুভাবে ভারাক্রান্ত হলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় , কারণ যে কোন মুহূর্তে জাহাজটি নিমজ্জিত হতে পারে । তাই অসুরদের উৎপীড়ন ভারে ( সীদন্তা ভুরিভারেণ ) মাতা বসুমতী অস্বস্তি অনুভব করলে , তিনি ব্রহ্মাণ্ডের প্রধান জীব ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন । প্রয়োজনের সময় বিশ্বের প্রধানরা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন , ব্রহ্মা ভগবান বিষ্ণুকে ভূভার লাঘবের উদ্দেশ্যে অনুরোধ করেন । তখন কৃষ্ণ অথবা বিষ্ণু জগতে অবতরণ করেন । ভগবদ্গীতায় ( ৪/৭ ) বর্ণিত হয়েছে—

    যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
    অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্

    অর্থাৎ ," হে ভারত , যখন ধর্মসাধনে অবনতি হয় এবং অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয় , তখন আমি স্বয়ং এই জগতে অবতরণ করি । "

       যখন তাইন শৃঙ্খলার অত্যন্ত অভাব দেখা যায় এবং অপরাধী ও দুর্বৃত্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় , তখন দেশ উৎপীড়ন ও বিপর্যয়ে ভারাক্রান্ত ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হয়ে উঠে এবং রাজ্যের শাসকগণ তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে । সেই রকম , অসুর ও নাস্তিকদের দ্বারা বিধ্বস্ত হলে তারা বিশ্বে যে গুরুভার সৃষ্টি করে , তখন বিশ্বের পুণ্যবান শাসক দেবতারা হতবুদ্ধি হন । লোকেরা দেশের আইন মান্য করলে , রাজ্যশাসন সহজ হয় , কিন্তু জনসাধারণ দুর্বৃত্ত হলে তারা শাসকগণকে ভারাক্রান্ত করে তোলে । ঠিক সেইরকম অবস্থায় নিখিল সৃষ্টির কার্যকলাপের ভারসাম্য কখনও কখনও ওলটপালট করে দেয় । অসুর ও দেবতা উভয়েই সর্বদা বর্তমান , কিন্তু আসুরিক শক্তি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে জগৎ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে । ঠিক সেই সময়ই সাহায্যের উদ্দেশ্যে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন । ব্রহ্মা হচ্ছেন দ্বাদশ মহাজনের ( স্বয়ম্ভূর্নারদঃ শম্ভুঃ কুমারঃ কপিলো মনুঃ / প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মো বলির্বৈয়াসকির্বয়ম্ , ভাঃ ৬/৩/২০ ) অন্যতম । দিব্যজ্ঞান লাভ করতে হলে আমাদের মহাজনদের অনুগমন করতে হবে । বৈদিক নির্দেশ হচ্ছে , তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ - কেউ যদি সর্ববিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে চায় , তাকে সদগুরুর শরণাপন্ন হতে হবে । আদি শুরু হচ্ছেন কৃষ্ণ । কৃষ্ণ যেমন অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছেন , তিনি ব্রহ্মাকেও সেই রকম শিক্ষা দিয়েছেন । শ্রীমদ্ভাগবতে ( তেনে ব্রহ্ম্য হৃদা য আদিকবয়ে ) তা লিপিবদ্ধ আছে ।

       শ্রীমদ্ভাগবতে সৃষ্টির আদি উৎসের বর্ণনা রয়েছে । এই সৃষ্টিতত্ত্বই আমাদের গবেষণার যথার্থ বিষয় হওয়া উচিত । সৃষ্টির আদি উৎস কি ? জন্মাদাস্য যতঃ --সব কিছুর মূল আধার হচ্ছে জন্ম , স্থিতি ও প্রলয়ের উৎস । এক বিশেষ সময়ে আমাদের এই দেহের জন্ম হয়েছে , তখন দশ , ঝুড়ি , পঞ্চাশ অথবা দেহ অনুযায়ী যাই হোক একটা সময় পর্যন্ত এই দেহ স্থায়ী হবে , তারপর শরীরটি বিনাশ প্রাপ্ত হবে । এই দেহের উৎস কোথায় এবং দেহাবসানে তার গতি কি হবে ? শক্তির সংরক্ষণ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বিধি রয়েছে । সেই শক্তির উৎস কি ? উৎস একটি আছে ( যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে ) , এবং শ্রীমদ্ভাগবতে সেই উৎসটি নির্ণীত হয়েছে ।

       সেই পরম উৎসটি শূন্য নয় । মূঢ়দের অনুমান হচ্ছে সব কিছুই শূন্য থেকে এসেছে । শূন্য থেকে কোন কিছু কিভাবে আসতে পারে । এই রকম ঘটনার কোন প্রমাণ নেই , কিন্তু মূর্খরা দাবি করে যে , তা হতে পারে , তাই তারা বিচারবুদ্ধিহীন । যাঁর থেকে সব কিছু প্রকাশিত হয়েছে । যার মধ্যে সব কিছু বিরাজমান এবং যাঁর মধ্যে সব কিছু প্রবেশ করবে , সেই আদি উৎসের স্বরূপ কি ? ভাগবত ( ১/১/১ ) বলা হয়েছে জন্মাদাস্য যতোহন্বয়াদিতরশ্চার্থেষ্বভিজ্ঞঃ । " অভিজ্ঞ শব্দটি ইঙ্গিত করছে যে , সব কিছুর মূল উৎস হচ্ছেন পূর্ণ জ্ঞানময় ।

       জ্ঞ শব্দে ' জ্ঞান ' এবং অভি শব্দে বিশেষ বুঝায় । কোথা থেকে আমরা এসেছি এবং মৃত্যুর পর কোথায় আমরা যাব , সেই সম্বন্ধে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই , এবং তাই আমরা অভিজ্ঞ বা পরম চেতন নই । কিন্তু পরম উৎস হচ্ছেন অভিজ্ঞ । তিনি পাথর নন অথবা শূন্য নন । তিনি কি হতে পারেন ? নিখিল সৃষ্টি হচ্ছে পরম চেতনের প্রমাণ । প্রত্যেকেই জড় প্রকাশকে উপলব্ধি করতে পারে এবং কি সুন্দর উপায়ে এই নিখিল সৃষ্টি ক্রিয়াশীল । সূর্য - চন্দ্রের উদয় হচ্ছে ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে , এমন কি মুহুর্তের অনুভ্যাংশ সময় তার ব্যতিক্রম নেই । সেই রকম যথাসময়ে ঋতু পরিবর্তন হয় , এবং ফুল - ফলাদির আগমন ঘটে । এইভাবে নিখিল বিশ্ব চরাচর খুবই সুশৃঙ্খল ও বিধিবদ্ধভাবে চলছে । সুতরাং সর্বজ্ঞ অর্থাৎ কোনও অতীব বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞ কেউ না থাকলে , এই নিখিল সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব ? কেউ কেউ বলে যে , শূন্যই এই নিখিল সৃষ্টির উৎস ? এটি কি রকম অর্থহীন ? শূন্য থেকে এই রকম সৃষ্টি কি হতে পারে ? এই রকম ধারণা কি খুবই যুক্তিসঙ্গত ? ভাগবত এই রকম ধারণাকে অযৌক্তিক বলে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছে ।

       ভাগবত আমাদের বলছে যে , সব কিছুই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন অভিজ্ঞ পুরুষের কাছ থেকে আসছে । সেই আদি পরম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন পুরুষ , প্রথম সৃষ্ট জীব আদি কবি ব্রহ্মাকে ( তেনে ব্রহ্ম হৃদা য আদিকবয়ে ) দিব্যজ্ঞান প্রদান করেন । প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মার এক আদি উৎস রয়েছে , এবং ব্রহ্মা সেই উৎসের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত । আমরা জানি যে , আমরা অন্য এক ব্যক্তি থেকে জ্ঞান আহরণ করি যার মুখোমুখি হতে হয় । কিন্তু ব্রহ্মার জন্মের সময় তিনি একাকী ছিলেন । তাই কিভাবে তিনি জ্ঞান আহরণ করেছিলেন ? সেটি ভাগবতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তেনে ব্রহ্মা হৃদা । হৃদা শব্দের অর্থ হচ্ছে ' হৃদয়ের মাধ্যমে । পরম পুরুষ পরমাত্মা ব্রহ্মাসহ সকলের হৃদয়ের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন । তাই একাকী হলেও , ব্রহ্মা ভগবানের নির্দেশে জ্ঞান প্রাপ্ত হন । ব্রহ্ম শব্দ বৈদিক জ্ঞানকে বোঝায় । এভাবে বৈদিক জ্ঞান প্রথম ব্রহ্মাকে প্রদান করা হয় ।

       সকলকেই বৈদিক জ্ঞান দেওয়া হয়েছে , কেন না সকলের হৃদয়েই ( সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ ) শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন । কিন্তু সেই জ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করা চাই । শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মারূপে ( চৈত্যগুরু ) অন্তর থেকে এবং বাইরে শুরুদেবরূপে জ্ঞান দান করে আমাদের সাহায্য করেন । কৃষ্ণ থেকে দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মা সেই বৈদিক জ্ঞান বিতরণ করেন । তাই তিনি একজন অধিকারী । চারটি সম্প্রদায় অথবা গুরু শিষ্য পরম্পরাক্রমে এই বৈদিক জ্ঞান বিতরিত হয় । এই চারটি সম্প্রদায় আসছে ব্রহ্মা , লক্ষ্মীদেবী , দেবাদিদেব শিব ও চারজন কুমার থেকে । কৃষ্ণ থেকে প্রবাহিত এই চারটি সম্প্রদায়ের যে কোন একজন অধিকার প্রাপ্ত প্রতিনিধির শরণাগত হতে হবে , তা হলে আমরা দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হব । এইভাবে মূর্তিমতী পৃথিবী ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে , ব্রহ্মা পরমেশ্বর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন , " এখন আসুরিক নির্যাতনে জগৎ ভারাক্রান্ত , তাই আপনাকে বিশ্বে অবতরণ করতে আবেদন করছি । " এই জন্য কেউ কেউ বলেন যে , ভূভার লাঘবের জন্য ব্রহ্মার অনুরোধে শ্রীভগবান জগতে অবতরণ করেন ।

       অবতরণের সময় শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের রক্ষা করেন এবং অসুরদের হনন করেন । এই জন্য কৃষ্ণের নারায়ণ বিগ্রহ চতুর্ভুজ । অসুর নিধনের জন্য তিনি দুই হাতে চক্র ও গদা ধারণ করেন । নিজ ভক্তকে রক্ষা ও কৃপা করার জন্য তিনি অপর দুই হাতে শঙ্খ ও পদ্ম ধারণ করেন । ভগবান বলেছেন — কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি । এভাবে শ্রীকৃষ্ণ পবিত্র শঙ্খ ধ্বনি করে ঘোষণা করেন , " আমার ভক্তের কখনও বিনাশ হবে না । ” আর পদ্মফুল দিয়ে তিনি তাঁর আশীর্বাদ বিস্তার করেন । লক্ষ্মীদেবীর হাতে কখনও কখনও যে পদ্ম দেখা যায় , তা - ও আশীর্বাদের প্রতীক ।

       কেউ কেউ বলতে পারে যে , কৃষ্ণ এই উদ্দেশ্যে অথবা ঐ উদ্দেশ্যে আবির্ভূত হন , কিন্তু যথার্থ সিদ্ধান্ত হচ্ছে কৃষ্ণ তাঁর নিজের আনন্দের জন্য আবির্ভূত হন , এই নয় যে তিনি অন্য কোন কারণের দ্বারা বাধ্য । আমরা কর্মবন্ধনে আবদ্ধ তাই আমরা জন্মগ্রহণ করি , কিন্তু কৃষ্ণ হচ্ছেন পরম স্বতন্ত্র পুরুষ , তাই তিনি অন্যের অনুরোধে অথবা কর্মের বন্ধনের ফলে অবতরণ করেন না । পক্ষান্তরে , স্বেচ্ছায় ( আত্মমায়য়া ) অবতরণ করেন । কৃষ্ণের বহিরঙ্গা জড় মায়ার প্রভাবে আমরা জন্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হই , কিন্তু কৃষ্ণ মায়া অথবা অন্য কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন । তাই তিনি ঐভাবে জন্মগ্রহণ করেন না । অবিদ্যা শক্তি মায়া হচ্ছে কৃষ্ণের নিয়ন্ত্রণাধীন । তাই মায়া কি করে কৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ? কৃষ্ণকে যে আমাদের মতো মায়াধীন বলে মনে করে , তাকে ভগবদ্‌গীতায় মূঢ় বা মূর্খ ( অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ ) বলা হয়েছে ।

       কৃষ্ণই হচ্ছেন নিখিল চরাচর সৃষ্টির আদি উৎস , মূল নারায়ণ । সৃষ্টির পরই যে প্রথম জীবের জন্ম হয় , সেই ব্রহ্মা হচ্ছেন নারায়ণের সাক্ষাৎ পুত্র । এই নারায়ণ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে প্রথম জড় ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করেন । চিন্ময় সান্নিধ্য ছাড়া জড় পদার্থ সৃষ্টি কার্যে অক্ষম । জড় সৃষ্টির মূল কারণ অন্বেষণকারীদের জানা উচিত যে , চিন্ময় আত্মার উপস্থিতিতেই সৃষ্টি প্রকাশ হয় । চেতন আত্মার মাধ্যমেই জড় পদার্থ সক্রিয় হয়ে ওঠে । এমন নয় জড়ের দ্বারা চেতন আত্মার সৃষ্টি হয় ।

       বৌদ্ধ মতবাদ অনুযায়ী জীবশক্তি আমরা সকলেই জড়াবস্থায় সৃষ্টি হয়েছি । আজ সারা বিশ্বই এই বৌদ্ধ মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত । কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে , জীবশক্তির উপস্থিতির জনাই জড়ের বিকাশ ঘটে । আমরা সহজেই তা অনুভব করতে পারি । শিশুর জন্মের পর বুদ্ধিপ্রাপ্ত হয় , তার দেহের বিকাশ হয় , কিন্তু চেতন আত্মা দেহে উপস্থিত না থাকার ফলে মৃত শিশুর জন্ম হলে , ঐ দেহের বিকাশ হবে না । তাই আত্মাই হচ্ছে জড় পদার্থের বিকাশের ভিত্তি , এবং তার উল্টোটি নয় ।। মৃত শিশুর বিকাশ হয় না কেন ? কারণ শিশুর দেহে আত্মা নেই । যতদিন জীবন থাকে , ততদিন বৃক্ষটি বেড়ে উঠে । ভাল মাটিতে বট বৃক্ষের ক্ষুদ্র বীজ বপন করলে এবং সেখানে অনুকূলভাবে জল সেচন করলে অঙ্কুর হবে , গাছটি বেড়ে উঠবে , কেননা সেখানে চেতন আত্মা রয়েছে । কিন্তু অগ্নিদগ্ধ বা ভাজা বীজ বপন করলে তার অঙ্কুরোদগম হবে না , তখন গাছও হবে না , কেন না চেতন আত্মা সেখানে নেই ।

       চেতন আমার উপস্থিতির জন্যই জড়ের বিকাশ ও উন্নতি হয় । সৃষ্টির সূচনা থেকেই এই নীতি অনুসৃত হয়ে চলেছে । সৃষ্টির প্রারম্ভে পরম চেতন ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করেন এবং বিষ্ণুর দিবা নাভিজাত কমল থেকে প্রথম জীব ব্রহ্মার প্রকাশ হয় । যে পদ্মে ব্রহ্মার জন্ম হয়েছে তাকে জড় পদার্থে বিবেচনা করে , আমাদের হৃদয়ঙ্গম করা উচিত যে , ঐ কমলও চেতন থেকে প্রকাশিত । তাই চেতনই হচ্ছে । সৃষ্টির ভিত্তি ।

       যে পরে ব্রহ্মার জন্ম হয়েছে তা বিষ্ণুর নাভিজাত হওয়ায় , ভগবান বিষ্ণু পদ্মনাভ নামে পরিচিত । ব্রহ্মাকে আত্মভূ বলা হয় , কারণ মাতা লক্ষ্মীদেবীর সান্নিধ্য । ছাড়া পিতা বিষ্ণু বা নারায়ণ দ্বারা তাঁর সৃষ্টি হয় । ভগবৎ - সেবায় নিয়োজিত লক্ষ্মীদেবী নারায়ণের পাশেই ছিলেন , তবু লক্ষ্মীদেবীর সান্নিধ্য ছাড়াই নারায়ণ ব্রহ্মাকে জন্মদান করেন । এখানেই ভগবানের সর্বশক্তিমত্তা । যখন আমরা সন্তান চাই , তখন আমাদের পত্নীর সহায়তা প্রয়োজন , কারণ আমরা একাকী তা লাভ করতে পারি না । কিন্তু কৃষ্ণ বা ভগবান বিষ্ণু পত্নী লক্ষ্মীদেবীর উপস্থিতিতে তাঁর সাহায্য ছাড়াই ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেন , কারণ তিনি কারও ওপর নির্ভরশীল নন । যারা মূর্খের মতো ভগবান নারায়ণে মনুষাবুদ্ধি করে , তাদের এই কাহিনী থেকে শিক্ষালাভ করা উচিত ।

       বৈদিক শাস্ত্রে জীবকে ভগবান নারায়ণের সমান বিবেচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে--

    যস্তু নারায়ণং দেবং ব্রহ্মরুদ্রাদি দৈবতৈঃ।
    সমত্বেনৈব বীক্ষেত স পাষণ্ডী ভবেদ্ধ্রুবম্ ॥

       কোন একজন লোক দরিদ্র নারায়ণ কথাটি আবিষ্কার করেছে । সে লোককে দেখাতে চাইছে যে , নারায়ণ দরিদ্র হয়েছেন এবং যে ভিক্ষুক আমাদের দরজায় ভিক্ষা করতে আসে সেও নারায়ণ । বৈদিক শাস্ত্রে এই রকম কথা অনুমোদিত নয় । নারায়ণ হচ্ছেন লক্ষ্মীপতি , একমাত্র মূর্খরাই মনে করে যে , ভগবান যে কোন ভাবেই হোক দারিদ্র্যা প্রপীড়িত হয়েছেন । মূঢ় , দুর্জনরাই বলে যে , নারায়ণ , ব্রহ্মা , শিব , দেবতারা তুমি , আমি ও অন্যান্য সকলেই সমশ্রেণীভুক্ত । এই রকম মনোভাবই হচ্ছে মূর্খতা । নারায়ণ হচ্ছেন অসমো । অর্থাৎ কেউ তাঁর সমকক্ষ নয় , কেউ তাঁর চেয়ে শ্রেয় নয় । তাই আদি নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবদ্‌গীতায় বলেছেন , মত্তঃ পরতরং নান্যৎ " আমার থেকে শ্রেয় কেউ নেই । " তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই । অসম শব্দের অর্থ হচ্ছে যে , কেউ তাঁর সমকক্ষ নয় । অনুর্ধ্ব শব্দের অর্থ কেউ নারায়ণ অপেক্ষা শ্রেয় নয় । এই হচ্ছে ভগবানের স্বরূপ ।

       নারায়ণ একজন সাধারণ জীব নন । তিনি হচ্ছেন স্বয়ং পুরুষোত্তম ভগবান । তাঁর দিব্য দেহের প্রতিটি অংশ প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে সক্ষম । এক সাধারণ জীব স্ত্রীসঙ্গের মাধ্যমে একটি সন্তান লাভ করে এবং এই নির্দিষ্ট পন্থা ছাড়া সন্তান প্রাপ্তির অন্য উপায় নেই । কিন্তু নারায়ণ সর্বশক্তিমান , তাই তিনি তার নাভিপদ্ম থেকে একটি সন্তান সৃষ্টি করতে পারেন । তাঁর দিব্য দেহের শ্রীঅঙ্গগুলি সর্বশক্তি সম্পন্ন , যেমন ব্রহ্মসংহিতায় ( ৫/৩২ ) ব্যাখ্যা করা হয়েছে- অঙ্গানি যস্য সকলেন্দ্রিয়বৃত্তিমন্তি । দৃষ্টান্তস্বরূপ , আমি চোখ দিয়ে শুধু দেখতে পারি , কিন্তু কৃষ্ণ তাঁর চোখ দিয়ে আহারও করতে পারেন । মূঢ় , দুর্জনরা বলবে , " তুমি কৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন করছ , কিন্তু কৃষ্ণ আহার্য গ্রহণ করেছে ? এখনও তো ভোগ পড়ে আছে । সে তো কিছুই গ্রহণ করেনি । ” এই ধরনের লোকগুলি জানে না যে , কৃষ্ণ শুধু দর্শন দ্বারাই আহার্য গ্রহণ করতে পারেন , কারণ তাঁর দিব্য দেহের শ্রীঅঙ্গগুলি যে কোন কাজ করতে সক্ষম । মথুরায় কোন রজক কৃষ্ণকে পোশাক দিতে অস্বীকার করায় কৃষ্ণ তাঁর হাত দিয়ে রজকের শিরচ্ছেদ করে তাঁর দিব্য শক্তি প্রদর্শন করেন । এই কাজ কিভাবে সম্ভব ? ভগবান কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান , তাই তার পক্ষে এই কাজ সম্ভব ।

       ভগবান হচ্ছেন পূর্ণ ও স্বাধীন , এবং তাঁর বিবিধ শক্তির দ্বারা যে কোন কাজ করতে তিনি সক্ষম । অভিজ্ঞঃ স্বরাট্ কথাটির মাধ্যমে এই সত্য শ্রীমদ্ভাগবতের সূচনায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে । স্বরাট্ শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে , তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ , কারও উপর নির্ভরশীল নন । এই হচ্ছে ভগবানের বৈশিষ্ট্য । আজকাল কত লোক নিজেকে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করছে , কিন্তু তাদের দাঁতের বেদনা হওয়া মাত্র , তারা চিকিৎসকের সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করে উঠে । তুমি / যদি ভগবানই হও , তা হলে নিজেকে রক্ষা কর । চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে কেন ? এই লোকগুলি বাস্তবিকই দুর্জন , দুরাচার এবং কৃষ্ণভাবনামৃত শিক্ষা প্রচারে এরা সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক । সারা বিশ্ব আজ এই সব অসুর দানবে ভারাক্রান্ত , তাই ভগবৎ - নির্দেশে আণবিক বোমার করাল অভিশাপ তাদের ভাগ্যাকাশে প্রতীক্ষা করছে ।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ১৮ ) অবিদ্যা ও যাতনা থেকে মুক্তি
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।