" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বরঃ হৃষীকেশ

    শ্লোক: ৬
    যথা হৃষীকেশ খলেন দেবকী
    কংসেন রুদ্ধাতিচিং শুচার্পিতা ।
    বিমোচিতাহঞ্চ সহাত্মজা বিভো
    ত্বয়ৈব নাথেন মুহুর্বিপদৃগণাৎ ॥ ৬ ॥
  • অনুবাদ : হে ইন্দ্রিয়াধিপতি! হে হাষীকেশ! যে বিভু! তুমি, খল কংসরাজ দ্বারা নিপীড়িতা ও দীর্ঘকাল ধরে কারারুদ্ধ তোমার মাতৃদেবী দেবকীকে উদ্ধার করেছিলে এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরও তুমি অবিশ্রান্ত বিপদরাশি থেকে মুক্ত করেছিলে ( ভাঃ ১/৮/২৩ )
  • তাৎপর্যঃ- কৃষ্ণের মাতা দেবকী বা কংসরাজের ভগিনী ও তাঁর পতি বসুসের কারারুদ্ধ হন, কারণ ক্রুর কংস দেবকীর অষ্টম সন্তান কৃষ্ণ দ্বারা নিহত হওয়ার ভয়ে ভীত ছিল । কৃষ্ণের জন্মের পূর্বে জাত দেবকীর সকল পুত্রকেই ক্রুর কংস হত্যা করে, কিন্তু কৃষ্ণ এই নৃশংস শিশুহত্যা থেকে রক্ষা পান , কারণ ভগবান কৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ মহারাজের গৃহে কৃষ্ণ স্থানান্তরিত হয়েছিলেন । পাণ্ডবগণ সহ কুন্তীদেবীও অবিরাম বিপদরাশি থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত হন । কুন্তীদেবী আরও অধিক ভগবৎ কৃপা লাভ করেছেন , কারণ ভগবান কৃষ্ণ দেবকীর অন্যান্য পুত্রদের রক্ষা করেন নি , কিন্তু তিনি কুন্তীপুত্রদের রক্ষা করেছেন । এইরূপ ভগবৎ - কৃপা বিতরণের কারণ হচ্ছে দেবকীপতি বসুদেব জীবিত ছিলেন , অথচ কুন্তী ছিলেন পতিহীনা এবং কৃষ্ণ ছাড়া তাঁর সহায়ক কেউ ছিল না । এই থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে , অধিক বিপন্ন ভক্তকে ভগবান মধুসুদন অধিক কৃপা বিতরণ করেন । কখনও কখনও তিনি শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তকে এই রকম বিপদে নিপতিত করেন; কারণ এই রকম অসহায় অবস্থায় ভক্ত ভগবৎ - চরণে আরও আসক্ত হন । ভগবৎ - পাদপদ্মে আসক্তি যত বেশি উদয় হবে , ভক্তের সিদ্ধিও তত অধিক হবে ।

       কৃষ্ণের মাতা ভক্ত দেবকী সাধারণ রমণী ছিলেন না । তা ছাড়া , কে - ই বা পরমেশ্বর ভগবানের মাতৃ পদের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন ? একমাত্র ভাগবতোত্তম ভক্তের পুত্র হতেই কৃষ্ণ সম্মত হন । পূর্ববর্তী জীবনে দেবকী ও তার পতি কঠোর তপশ্চর্যায় ব্রতী ছিলেন । তাই বর প্রদানের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ তাঁদের সম্মুখে অবতীর্ণ হলে , তারা তাঁর কাছে ভগবানের মতো এক পুত্র কামনা করেন । কিন্তু কোথাও ভগবানের সমান কেউ নেই । তা থাকা সম্ভবও না । ভগবান হচ্ছেন অসমোর্ধ্ব , অর্থাৎ কেউ তার সমকক্ষ অথবা শ্রেয় নয় । ভগবানের সঙ্গে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম নয় । কেউ বলতে পারে না , “ আমি ভগবান , তুমি ভগবান , সে ভগবান , আমরা ভগবান । " না , তা কখনও হয় না । যে এই কথা বলে সে একটি কুকুর , ভগবান নয় , কেন না ভগবান হচ্ছেন মহান এবং তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । কেউ তার সমান নয় ; সকলেই তার অধীন একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য-- কৃষ্ণই একমাত্র প্রভু , অন্যান্যদের তো কথাই নেই , এমন কি ব্রহ্মা , বিষ্ণু ও শিবাদি শ্রেষ্ঠ দেবতা সহ প্রত্যেকেই কৃষ্ণের ভৃত্য মাত্র । শিববিরিঞ্চিনুতম্ । বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে , সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা দেবাদিদেব শিব ও স্রষ্টা ব্রহ্মাও ভগবান কৃষ্ণের সশ্রদ্ধ বন্দনা করেন ।

       মানব কুল থেকে শ্রেয় হচ্ছেন দেবতারা । ইতর পশুকুল অপেক্ষা আমরা মানবকুল শ্রেয় , সেই রকম দেবতারা আমাদের থেকে শ্রেয় দেবকুলের শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন স্রষ্টা ব্রহ্মা ও দেবাদিদেব শিব । ব্রহ্মাজী ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা এবং দেবাদিদেব শিব হচ্ছেন সৃষ্টির ধ্বংসকর্তা এবং যিনি কৃষ্ণ স্বয়ং সেই ভগবান বিষ্ণু হচ্ছেন পালনকর্তা । এই সৃষ্টি প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে সত্ত্ব , রজ ও তম — এই তিনটি জড় গুণ রয়েছে । ভগবান বিষ্ণু , স্রষ্টা ব্রহ্মা ও দেবাদিদেব শিব — এই তিনজন এক একটি গুণের অধীশ্বর ভগবান বিষ্ণু সত্ত্বগুণের অধীশ্বর , স্রষ্টা ব্রহ্মা রজোগুণের অধীশ্বর এবং দেবাদিদেব শিব তমোগুণের অধীশ্বর । কিন্তু তাঁরা কেউ এই গুণগুলির প্রভাবাধীন নন । কারাধ্যক্ষ কয়েদি নন কিন্তু তিনি কারাপাল । সেই রকম দেবাদিদেব শিব , ভগবান বিষ্ণু ও স্রষ্টা ব্রহ্মা এঁরা এই তিন গুণের নিয়ন্তা , কিন্তু গুণাধীন নন ।

       কিন্তু সর্বোপরি , পরম নিয়ামক হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ , যিনি হৃষীকেশ নামে পরিচিত । হৃষীক শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়সমূহ ' । আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি ভোগ করলেও , এই ইন্দ্রিয়গুলির পরম নিয়ন্তা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ । উদাহরণ স্বরূপ , আমার হাতের কথাই বিবেচনা করুন । আমি দাবি করি , “ এই আমার হাত , এই হাত দিয়ে আমি ভাল মুষ্টিযুদ্ধ করতে পারি । কিন্তু আমি নিয়ন্তা নই । নিয়ন্তা হচ্ছেন কৃষ্ণ , কারণ ভগবান আমার হাতের কর্মক্ষমতা প্রত্যাহার করলে হাত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে । আমি যদিও বড়াই করে বলি , “ এটি আমার হাত এটিকে আমি ব্যবহার করব । ” কিন্তু হাতটি অসাড় হয়ে গেলে আমি সেই হাত দিয়ে কিছুই করতে পারি না । তাই আমাদের উপলব্ধি করা কর্তব্য যে , কৃপায় আমি এই হাতের অধিকারী হলেও আমি হাতের নিয়ামক নই । এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা ।

       বিবেকী ব্যক্তি চিন্তা করবেন,-- যদি এই হাতের পরম নিয়ন্তা কৃষ্ণ হন তাহলে হাতটি কৃষ্ণের সুখান্বেষণে ব্যবহৃত হওয়া উচিত । এটি হচ্ছে সাধারণ জ্ঞান ও উপলব্ধি । আমরা সর্বদা বড়াই করে বলি , “ এটি আমার হাত , এটি আমার পা , এটি আমার কান " । একটি শিশু পর্যন্ত এভাবে কথা বলে । আমরা যদি শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করি , “ এটি কি ? " সে বলবে , “ এটি আমার হাত । ” কিন্তু যা নিয়েই আমরা বড়াই করি না কেন , বস্তুত এটি আমাদের হাত নয় , এই হাতটি আমাদের দেওয়া হয়েছে । যেহেতু আমি এই হাতটি নানাভাবে ব্যবহার করতে অভিলাষী , তাই কৃষ্ণ আমাকে হাতটি দিয়েছেন ।- “ আচ্ছা , এই নাও হাতটি , আর এটি ব্যবহার কর । ” সুতরাং এই হাতটি হচ্ছে কৃষ্ণের দান এবং বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রই সর্বদা সচেতন হয়ে ভাবে , “ দেহ থেকে শুরু করে ইন্দ্রিয়াদি আমার যা কিছু আছে , বস্তুত ঐ গুলির মালিক আমি নই । ব্যবহারের জন্য এগুলি আমাকে দেওয়া হয়েছে এবং সব কিছুরই অন্তিম মালিক কৃষ্ণ হওয়ায় সর্বস্ব কৃষ্ণ সেবায় নিযুক্ত করি না কেন ? একেই বলে যথার্থ বুদ্ধি এবং এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা ।

       প্রত্যেকেই কৃষ্ণের অংশবিশেষ ( মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ ) তাই প্রত্যেকের ইন্দ্রিয়গুলিও কৃষ্ণের। কৃষ্ণসেবায় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি ব্যবহার করলে , আমরা জীবনে পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত হই । তাই হৃষীকেণ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে-- যখন আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা ( হৃষীকেণ) আমরা প্রকৃত ইন্দ্রিয়াধিপতি হৃষীকেশের সেবা করি , তখন সেই সেবাকে ' ভক্তি ' বলে । ভক্তির এই হচ্ছে খুব সরল সংজ্ঞা । হৃষীকেশসেবনম্ , হৃষীকসেবনম্ নয়- ইন্দ্রিয়ের পরম প্রভুর সেবা , ইন্দ্রিয়ের সেবা নয় । যখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি বিষয়ভোগে নিযুক্ত করি , তখন আমরা মায়াবিষ্ট হই , কিন্তু ইন্দ্রিয়াধিপতির সেবায় ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়োগ করলে , তাকে ভক্তি বলে ।

       এই ভব-সংসারে সাধারণত প্রত্যেকেই ইন্দ্রিয়গুলি বিষয়ভোগে ব্যবহার করছে । সেটিই হচ্ছে মায়া এবং সেটিই হচ্ছে তাদের সংসার বন্ধনের কারণ । কিন্তু কৃষ্ণানুশীলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পবিত্র ও নির্মল হলে , যখন উপলব্ধি হয় যে , ইন্দ্রিয়গুলি বস্তুত কৃষ্ণের সন্তোষ বিধানের জন্য , তখন তারা ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয় ( মুক্ত পুরুষ ) ।

    ঈহা যস্য হরের্দাস্যে কৰ্মনা মনসা গিরা ।
    নিখিলাস্বপ্যবস্থাসু জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে ।।

       “ যিনি নিজের দেহ , মন , বুদ্ধি ও বাক্য কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করেন , ভব-সংসারে থাকা সত্ত্বেও তিনি জীবন্মুক্ত পুরুষ । আমাদের এইরূপ জ্ঞানের উন্মেষ হওয়া উচিত । “ আমার ইন্দ্রিয়গুলির উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয়াধিপতি হাদীকেশের সেবা করার জন্য । " ইন্দ্রিয়াধিপতি সকলের হৃদয়ে অবস্থান করছেন । ভগবদ্‌গীতায় ( ১৫/১৫ ) ভগবান বলেছেন , সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্ট-- “ আমি সকলের হৃদয়ে উপবিষ্ট । " মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ “ আমা থেকেই স্মৃতি , জ্ঞান ও বিস্মৃতির উম্মেষ হয় ।”

       শ্রীকৃষ্ণ এমনই করুণাময় যে, আমরা যদি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে কোন বিশেষভাবে প্রয়োগ করতে অভিলাষী হই , তা হলে তিনি সেই কাজে আমাদের সুযোগ দান করেন । আমরা ইন্দ্রিয়গুলির মালিক নই । কৃষ্ণই এগুলির মালিক । কিন্তু আমাদের ইচ্ছানুযায়ী সেগুলি ব্যবহার করতে কৃষ্ণই আমাদের সুযোগ দেন । যেমন , আমাদের প্রত্যেকের একটি জিহ্বা আছে । মনে করুন আমরা বিষ্ঠা আহারে ইচ্ছুক । আমরা বলতে পারি , " কৃষ্ণ , আমি বিষ্ঠা আহার করব । ” কৃষ্ণ বলবেন , “ হ্যাঁ , তাই হবে , এই শুকর দেহ গ্রহণ কর , আর বিষ্ঠা আহার কর । ” কৃষ্ণ হচ্ছেন প্রভু , তিনি উপস্থিতি । তিনি আমাদের যথোপযুক্ত দেহ প্রদান করবেন আর স্মরণ করিয়ে দিবেন " হে জীব , তুমি বিষ্ঠা ভোজন করতে চেয়েছিলে তাই এখন সেই কাজে তুমি উপযুক্ত দেহ প্রাপ্ত হয়েছ । সেই রকম কেউ দেবতার শরীর হতে ইচ্ছুক হলে , কৃষ্ণ তাকে সেই সুযোগ দান করেন । ৮৪,০০,০০০ রকম জীব দেহ আছে , এবং এক বিশেষ প্রকার দেহে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়োগে অভিলাষীকে শ্রীকৃষ্ণ সেই সুযোগও প্রদান করেন– “ এস , এই তোমার বাঞ্ছিত দেহ এবং গ্রহণ কর । ” কিন্তু পরিশেষে ইন্দ্রিয়গুলি প্রয়োগের ফলে সে উত্ত্যক্ত হয়ে বুদ্ধিহীন হয়ে পড়বে । " তাই কৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন , সবর্ধমান পরিতাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ " এই রকম কাজ করো না । তোমার ইন্দ্রিয়গুলি আমার সেবার জন্য। তুমি ইন্দ্রিয়গুলির অপব্যবহার করছ এবং তাই নানা রকম দেহে আবদ্ধ হয়ে পড়ছ । সুতরাং , এই রকম বারবার এক দেহ ত্যাগ ও অপর দেহ গ্রহণ— এই ক্লান্তিকর ভবসংসার থেকে উদ্ধারের জন্য ইন্দ্রিয়ভোগের পন্থা পরিত্যাগ করে আমার শরণাগত হও । তুমি রক্ষা পাবে । ” একেই বলে কৃষ্ণভাবনা ।

       এই মুহূর্তে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি কলুষিত । আমি ভাবছি , “ আমি আমেরিকান , তাই আমার ইন্দ্রিয়গুলি আমার জাতি , সমাজ ও দেশের জন্য ব্যবহার হওয়া উচিত " বা অন্যভাবে আমি চিন্তা করছি , " আমি ভারতীয় , এবং আমার ইন্দ্রিয়গুলি ভারতীয় ইন্দ্রিয়, তাই এগুলি ভারতের জন্য ব্যবহৃত হওয়া উচিত । অজ্ঞানাচ্ছন্ন ব্যক্তিরা জানে না যে , ইন্দ্রিয়গুলির মালিক হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পক্ষান্তরে , তারা আমেরিকান ইন্দ্রিয় , ভারতীয় ইন্দ্রিয় অথবা আফ্রিকান ইন্দ্রিয় বলে ভাবছে । একেই মায়া বলে । সংসারাবদ্ধ জীবনে ইন্দ্রিয়গুলি ' আমেরিকান ' , ' ভারতীয় ' , ' আফ্রিকান ' আদি উপাধি দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে । যখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিতে এই সব উপাধির কলুষতা থাকে না ( সর্বোপাধিবিনির্মুক্তম্ ) , তখন ভক্তির উদয় হয় ।

       কেউ মনে করতে পারে , “ আমি একজন আমেরিকান । কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করে , আমি হিন্দু দেবতার উপাসনা করব কেন ? " এই রকম চিন্তাধারা হচ্ছে নির্বুদ্ধিতা । যদি কেউ মনে করে , “ আমি মুসলমান " , " আমি খ্রিস্টান " , আমি হিন্দু " – তা হলে সে মায়াচ্ছন্ন । আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে পবিত্র ও নির্মল করতে হবে , যাতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে , “ আমি চিন্ময় আত্মা এবং কৃষ্ণ হচ্ছেন পরমাত্মা । আমি কৃষ্ণের অংশ বিশেষ , তাই কৃষ্ণের সেবা করাই আমার একান্ত কর্তব্য । ” এই রকম চিন্তা করে , অচিরেই মুক্ত হওয়া যায় । সেই সময় তিনি আমেরিকান নন , ভারতীয় , আফ্রিকান বা অন্য কিছুই নন । তখন তিনি কৃষ্ণময় বা কৃষ্ণভাবনাময় হন । এটি বাঞ্ছনীয় । তাই কুন্তীদেবী বলেছেন , “ হে কৃষ্ণ হে হৃষীকেশ ! তুমিই হচ্ছ ইন্দ্রিয়াধিপতি । "

       ইন্দ্রিয়ভোগের জন্যই আমরা এই ভববন্ধনে পতিত হয়েছি এবং বিভিন্ন জীবদেহ প্রাপ্ত হয়ে ক্লেশভোগ করছি । যেহেতু এটি ভবসংসার, তাই এমন কি কৃষ্ণের মাতাও দুঃখভোগ করেন । দেবকী এতই উন্নত ভক্ত ছিলেন যে , তিনি কৃষ্ণের মাতৃত্ব লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন , তবু তিনি নিজ ভ্রাতা ক্রুর কংস দ্বারা নির্যাতিত ও উৎপীড়িত হন । ভবসংসারের এই হচ্ছে প্রকৃতি । এই জড় জগতে জীবকুল এতই মৎসরতাপূর্ণ যে ব্যক্তিগত স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে অচিরেই অন্যদের , এমন কি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে পর্যন্ত বিপন্ন করতে উদ্যোগী হয় ।

       খল শব্দের অর্থ ' ঈর্ষাপরায়ণ ' এই ভবসংসার মৎসরতা ও ঈর্ষায় পরিপূর্ণ । আমি তোমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এবং তুমি আমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ । কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় আন্দোলন হচ্ছে নির্মৎসর ও ঈর্ষাহীনদের জন্য । নির্মৎসর ও ঈর্ষাহীন হলে আমরা সিদ্ধপুরুষ হতে পারি । ধর্মঃ প্রোজ্ঝিতকৈতবোঽত্র পরমো নির্মৎসরাণাং সতাম্ ( ভাঃ ১/১/২ ) । মাৎসর্য ও ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিরাই সংসার ভোগ করে , এবং নির্মৎসর , ঈর্ষাহীন ব্যক্তিরা বৈকুণ্ঠে বাস করেন । অতএব , আমরা নিজেদের পরীক্ষা করতে পারি । আমরা আমাদের বন্ধু ও সঙ্গীদের প্রতি মৎসরতাপুর্ণ হলে , আমরা ভবসংসারে আছি, আর আমরা তাদের প্রতি ঈর্ষাহীন হলে বৈকুণ্ঠে বসবাস করছি । আমরা পারমার্থিকভাবে উন্নত কি না এই বিষয়ে সংশয়ের প্রয়োজন নেই । আমরা নিজেদের পরীক্ষা করতে পারি। ভক্তিঃ পরেশানুভবো বিরক্তিরন্যত্র চ (ভাঃ ১১/২/৪২ ) । আহারের সময়, আমাদের ক্ষুধার তৃপ্তি হয়েছে কি না , তা আমরা অনুভব করতে পারি; এ ব্যাপারে অন্যের সমর্থন জ্ঞাপক বিবৃতি সংগ্রহের প্রয়োজন নেই । সেই রকম আমরা জড় জগতে না চিৎ - জগতে আছি , আমরা নিজেরাই তা পরীক্ষা করতে সক্ষম । আমরা ঈর্ষাপরায়ণ ও মৎসরতাপূর্ণ হলে জড় জগতে বসবাস করছি , আর তা না হলে আমরা চিন্ময় জগতে বসবাস করছি ।

       ঈর্ষাশূন্য ও মৎসরতাহীন ব্যক্তি উত্তমভাবে কৃষ্ণসেবা করতে সক্ষম । কারণ কৃষ্ণের প্রতি মৎসরতা ও ঈর্ষা থেকেই এই ঈর্ষা ও মৎসরতার সূচনা হয় । যেমন কোন কোন দার্শনিক মনে করে , “ কৃষ্ণ কেন ভগবান হবেন ? আমিও ভগবান হব । ” কৃষ্ণের প্রতি মৎসর ভাবাপন্ন ও ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া থেকেই সংসার জীবন শুরু । তারা মনে করে , " কৃষ্ণ ভোক্তা হবে কেন ? আমিও ভোক্তা হব । কৃষ্ণ গোপীসঙ্গ ভোগ করবে কেন ? আমিও কৃষ্ণ হব এবং গোপীসমাজ গঠন করে তাদের সঙ্গ ভোগ করব । " একে বলে মায়া। কৃষ্ণ ছাড়া কেউই ভোক্তা হতে পারে না । তাই কৃষ্ণ ভগবদ্‌গীতায় বলেছেন- " আমিই একমাত্র ভোক্তা । " আমরা যদি কৃষ্ণের সুখের জন্য ভোগ্য বস্তুর যোগান দিই তা হলে, আমরা জীবনে সিদ্ধি প্রাপ্ত হই । কিন্তু যদি আমরা কৃষ্ণকে অনুকরণ করতে চাই এবং মনে করি , আমি ভগবান হয়ে ভগবানের মতো ভোগ করব , তা হলে আমরা মায়াচ্ছন্ন । আমাদের স্বরূপ হচ্ছে কৃষ্ণের ভোগের উপকণ যোগানো । যেমন চিন্ময় জগতে কৃষ্ণ ভোগ করেন এবং অপ্রাকৃত ব্রজগোপিকারা কৃষ্ণের ভোগের উপকরণ যোগান দেন। একেই ভক্তি বলে।

       ভক্তি হচ্ছে প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্ক । ভৃত্যের কর্তব্য হচ্ছে প্রভুর সেবা করা এবং প্রভু ভৃত্যের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু যোগান দেন ।

    নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্ ।
    একো বহুনাং যো বিদধাতি কামান্ ( কঠোপনিষদ ২/২/১৩ )

       বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে , কৃষ্ণ আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় সবই যোগান দিতে সক্ষম । তাই কোন অভাব নেই , কোন আর্থিক সমস্যা নেই । শুধু কৃষ্ণসেবায় ব্রতী হতে হবে এবং তা হলে সবই পূর্ণ হবে। কৃষ্ণের ইচ্ছায় পর্যাপ্ত যোগান হবে । যেমন , আমেরিকায় প্রয়োজনীয় সব কিছুরই পর্যাপ্ত যোগান আছে , কিন্তু অন্য দেশে সেই রকম অবস্থা নেই । যেমন ,আমি সুইজারল্যান্ডে গিয়ে দেখি সেখানে সবই অন্য দেশ থেকে আমদানি করে । একমাত্র তুষারই ঐ দেশে স্থানীয় যোগানদ্রব্য । এ সবই কৃষ্ণের নিয়ন্ত্রণাধীন। কৃষ্ণভক্ত হলে পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য যোগান হবে , আর কৃষ্ণভক্ত না হলে সেই দেশ শুধু তুষারাবৃত থাকবে। কৃষ্ণই সব কিছুর পরম নিয়ামক , তাই কোন কিছুরই অভাব নেই । অভাব শুধু কৃষ্ণভক্তির।

       নিঃসন্দেহে , এই জড় জগৎ বিপদে পরিপূর্ণ । কিন্তু কুন্তীদেবী বলেছেন , “ যেহেতু দেবকী তোমার ভক্ত , তাই তার নিষ্ঠুর ভ্রাতার উৎপীড়ন থেকে দেবকীকে তুমি রক্ষা করেছিলে। যে মুহূর্তে কংস শুনতে পায় যে দেবকীর অষ্টম পুত্র তাকে হত্যা করবে , তৎক্ষণাৎ ক্রুর কংস দেবকী নিধনে উদ্যোগী হয়েছিল । কিন্তু বসুদেব কংসকে শান্ত করে । পতির কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীকে রক্ষা করা । তাই বসুদেব বলেন , " প্রিয় কংস , তোমার প্রিয় ভগ্নীর প্রতি নৃশংস হচ্ছ কেন ? যাই হোক , তোমার ভগ্নী তোমায় বধ করবে না । তার পুত্র তোমায় বধ করবে । এখানেই সমস্যা । তাই আমি তোমাকে সকল সন্তানই দান করব , তখন তুমি তাদেরকে নিয়ে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো । এই নির্দোষ , নববিবাহিতা নারীকে কেন তুমি হত্যা করবে ? সে তোমার কনিষ্ঠা ভগিনী , তোমার কন্যার মতো তাকে তোমার রক্ষা করা কর্তব্য । তুমি তাকে বধ করতে উদ্যোগী হচ্ছ কেন ? ” এইভাবে বসুদেব কংসকে শান্ত করেন । কংস বসুদেবের কথা বিশ্বাস করেছিল ইচ্ছা করলে কংস যাতে বসুদেব তনয়দের নিধন করতে পারে এবং সেই উদ্দেশ্যে বসুদেব তার সব সন্তানদেরই কংসের কাছে নিয়ে আসবে । বসুদেব ভাবল , “ উপস্থিত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাক যাই হোক , পরে কংস ভাগনেয়কে পেয়ে এই ঈর্ষাভাব ভুলে যাবে । ” কিন্তু কংস কখনও তা ভুলে যায়নি । পক্ষান্তরে , কংস দেবকী ও বসুদেবকে দীর্ঘকাল ( অতিচিরম্ ) কারারুদ্ধ করে রাখে এবং তাদের সব পুত্রদেরই সে হত্যা করেছিল । পরিশেষে , কৃষ্ণ আবির্ভূত হয়ে বসুদেব ও দেবকীকে উদ্ধার করেন ।

       তাই , দেবকী ও কুন্তীদেবীর পাদপদ্ম অনুসরণ করে আমাদের অবশ্যই কৃষ্ণের শরণাপন্ন হওয়া উচিত । কুন্তী পতিহীনা বিধবা হওয়ার পর , ঈর্ষাপরায়ণ ধৃতরাষ্ট্র পঞ্চপাণ্ডবদের হত্যা করার জন্য সর্বদা নানা পরিকল্পনা করছিল । ধৃতরাষ্ট্র মনে করছিল , “ আকস্মিকভাবে আমি জন্মান্ধ হওয়ায় আমি উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসন প্রাপ্ত হইনি , পক্ষান্তরে আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা তা প্রাপ্ত হয়েছে । এখন কনিষ্ঠ ভ্রাতা মৃত , অন্তত আমার পুত্ররা সিংহাসন লাভ করতে পারে । এটি ঘোর বিষয়ীর চিন্তাধারা। বিষয়ী মনে করে , “ আমি সুখী হব । আমার পুত্ররা সুখী হবে । আমার সম্প্রদায় সুখী হবে । আমার দেশ সুখী হবে । ” এই চিন্তাধারা হচ্ছে বর্ধিত আকারের স্বার্থপরতা । কৃষ্ণের সুখ , কৃষ্ণের কথা কেউ ভাবছে না । পক্ষান্তরে , সকলেই নিজ সুখের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করছে , “ আমি কিসে সুখী হব ? আমার সন্তানরা কিসে সুখী হবে ? আমার সম্প্রদায় , আমার সমাজ , আমার দেশ বা জাতি কিসে সুখী হবে ? ” সব জায়গায় আমরা এই রকম চিন্তাধারা দেখি । প্রত্যেকেই কঠোর জীবন সংগ্রাম করছে । কৃষ্ণের সুখান্বেষণ কেউ করছে না । কৃষ্ণভাবনা দিব্য মহিমাময় । ভগবদ্‌গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত থেকে এই কৃষ্ণভাবনা উপলব্ধি করে , আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়াধিপতির সেবায় নিযুক্ত করতে প্রয়াসী হওয়া বাঞ্ছনীয় ( হৃষীকেণ হৃষীকেশসেবনম্ ) । তখনই আমরা বস্তুত সুখী হব ।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ৭ ) বিপদের সম্মুখে —
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।