" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • স্নেহবন্ধন মোচন

    শ্লোক: ২৪
    অথ বিশ্বেশ বিশ্বাত্মন্ বিশ্বমূর্তে স্বকেষু মে।
    স্নেহপাশমিমং ছিন্ধি দৃঢ়ং পাণ্ডুষ বৃষ্ণিষু ॥ ২৪ ॥
  • অনুবাদ : হে জগদীশ, হে বিশ্বাত্মা, হে বিশ্বরূপ, কৃপা করে তুমি আমার আত্মীয় পাণ্ডব ও বৃষ্ণিদের প্রতি আমার স্নেহবন্ধন ছিন্ন কর। ( ভাঃ ১/৮/৪১)
  • তাৎপর্যঃ- শুদ্ধ ভগবদ্ভক্ত ভগবান শ্রীহরির কাছে নিজ স্বার্থে কিছু চাইতে লজ্জাবোধ করেন। পারিবারিক স্নেহপাশে আবদ্ধ হওয়ায় গৃহস্থরা কখনও কখনও ভগবানের কাছে অনুগ্রহ কামনা করতে বাধ্য হয়। কুন্তীদেবী এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তাই তিনি তাঁর স্বজন পাণ্ডব ও বৃষ্ণিদের প্রতি তাঁর স্নেহপাশ ছিন্ন করবার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন। পাণ্ডবরা ছিল তাঁর নিজ সন্তান এবং বৃষ্ণিরা ছিল তাঁর পিতৃ পরিবার। উভয় পরিবারের সঙ্গেই কৃষ্ণের সমভাবে সম্বন্ধ ছিল। উভয় পরিবারই ভগবানের শরণাগত ভক্ত হওয়ায় তাঁরা ভগবৎ-অনুকম্পার প্রার্থী ছিল। শ্রীমতী কুন্তীদেবী ইচ্ছা করেছেন যে, কৃষ্ণ যেন তাঁর সন্তান পাণ্ডবদের সঙ্গে অবস্থান করেন, কিন্তু কৃষ্ণের তা করার ফলে কুন্তীদেবীর পিতৃগৃহ ভগবান মধুসুদনের অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত হবে। এই রকম পক্ষপাতিত্ব কুন্তীদেবীর মনকে চঞ্চল ও আলোড়িত করেছিল এবং তাই তিনি স্নেহপাশ ছিন্ন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

       একজন শুদ্ধ ভগবদ্ভক্ত নিজ পরিবারের সীমিত স্নেহবন্ধন ছিন্ন করে, কৃষ্ণবিস্মৃত জীবাত্মাদের জন্য নিজ ভগবৎ-সেবার প্রসার ঘটায়। মহাপ্রভুর অনুগামী ও পার্ষদ ষড় গোস্বামীরাই হচ্ছেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তারা সকলেই উচ্চ বংশজাত, ধনী, সংস্কৃতি-পরায়ণ বিদ্বান ও পণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু জনসাধারণের নিত্য কল্যাণের উদ্দেশ্যে তাঁরা আরামপ্রদ বিলাসবহুল গৃহ ত্যাগ করে ভিক্ষুর আশ্রম গ্রহণ করেন। সমস্ত পারিবারিক স্নেহবন্ধন ছিন্ন করবার অর্থ হচ্ছে ভগবৎ-সেবার ক্ষেত্র ও পরিধি বিস্তৃত করা। এই কাজ ছাড়া কেউই যোগ্য ব্রাহ্মণ, রাজা, জননেতা অথবা হরিভক্ত হতে পারে না। পুরুষোত্তম ভগবান আদর্শ রাজারূপে দৃষ্টান্ত দ্বারা এটি প্রদর্শন করেছেন। আদর্শ রাজার গুণাবলী প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্র প্রিয়তমা পত্নীর প্রেমবন্ধন ছিন্ন করেন।

       ব্রাহ্মণ, ভগবদ্ভক্ত, রাজা ও জননেতা, এই সমস্ত ব্যক্তিত্বদের নিজ কর্তব্য পালনে অত্যন্ত উদার মনোভাব থাকা প্রয়োজন। কুন্তীদেবী এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং দুর্বলতাবশত তিনি ঐ পারিবারিক স্নেহবন্ধন থেকে মুক্তির প্রার্থনা করেছিলেন। ভগবানকে বিশ্বেশ অথবা বিশ্বাত্মন্ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, এবং তার দ্বারা কঠিন স্বজন স্নেহপাশ ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের সর্বশক্তিমত্তার বিষয় প্রকাশ করা হয়েছে। এই জন্য, কখনও কখনও অনুভব করা যায় যে, ভগবান তার দুর্বল ভক্তের প্রতি বিশেষ কৃপাবশত তাঁর সর্বশক্তিমত্তা সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রভাবে পারিবারিক স্নেহপাশ জোরপূর্বক ছিন্ন করেন। এই কার্য দ্বারা তিনি ভক্তকে তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল করেন এবং এভাবে ঐ ভগবদ্ভক্তের ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তির পথ প্রশস্ত করেন।

       কুন্তীদেবী ছিলেন বৃষ্ণিবংশের রাজকন্যা এবং পাণ্ডব পরিবারের বধূ ও মাতা। সাধারণত নারীরা তার পিতৃ পরিবার ও পতির পরিবার উভয়ের প্রতি আসক্ত থাকে। তাই কুন্তীদেবী কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করে বলেছেন, “ আমি একজন নারী এবং নারীরা সাধারণত তাদের পরিবারে আসক্ত হয়। সুতরাং কৃপা পরবশ হয়ে আমার এই স্নেহপাশ ছিন্ন কর, যাতে আমি সম্পূর্ণভাবে তোমার চরণারবিন্দে আসক্ত হই। তুমি ছাড়া, উভয় পরিবারই জীবনশূন্য। আমি এই উভয় পরিবারের প্রতি মিথ্যা মোহে আসক্ত, কিন্তু আমার জীবনের যথার্থ লক্ষ্য হচ্ছে, তোমার শ্রীচরণে আসক্ত হওয়া। ” এই রকম মনোভাবই কৃষ্ণভক্তি। ভগবদ্ভক্তির অর্থ হচ্ছে এই ভবসংসারের আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে ভগবান শ্রীহরির চরণারবিন্দে আসক্ত হওয়া। কেউ অনাসক্ত হতে পারে না, কেন না প্রত্যেকেই কোন কিছুর প্রতি অবশ্যই আসক্ত। কিন্তু ভগবৎ-সেবায় প্রবেশের জন্য অথবা কৃষ্ণে আসক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে জড় বস্তু থেকে অবশ্যই অনাসক্ত হতে হবে। সাধারণত জনসাধারণ তাদের সংসার আসক্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়। তারা প্রার্থনা করে বলে, " হে ভগবান, আমাদের প্রতিদিনের আহার্য দান করুন। " তাদের এই জড় জগতের প্রতি আসক্তি রয়েছে, এই ভবসংসারে জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে তারা জড়-জাগতিক দ্রব্যসম্ভার যোগানের জন্য প্রার্থনা করে, যাতে তারা তাদের প্রতিষ্ঠা বা পদমর্যাদা রক্ষা করতে পারে। একেই জাগতিক বা বিষয় আসক্ত বলে। যদিও এক অর্থে, নিঃসন্দেহে এটি ভালই যে, জনসাধারণ জড়-জাগতিক পদমর্যাদা রক্ষার্থে ভগবানের শরণাপন্ন হচ্ছে, কিন্তু বস্তুত তা বাঞ্ছনীয় নয়। জড় জগতে ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করার জন্য ভগবৎ-অর্চন করার চেয়ে বরং বিষয় আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। অতএব ভক্তিযোগ অনুশীলনের জন্য আমাদের বিষয়ে অনাসক্ত হওয়া উচিত।

       আসক্তিই আমাদের সকল দুঃখের কারণ। এই সংসারে আসক্তির জন্যই আমরা নানা জড়-জাগতিক দ্রব্য কামনা করি এবং এই জন্য কৃষ্ণ আমাদের অভীষ্ট জড়-জাগতিক সুবিধা ভোগের সুযোগ দান করেন। নিঃসন্দেহে এই সব সুবিধা ভোগের জন্য আমাদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। প্রথমে যোগ্যতা অর্জন, তারপর কামনা করা যেতে পারে। ধরা যাক, আমি একজন রাজা হতে চাই। অতীতে আমার পুণ্যকর্ম করা চাই যাতে আমি রাজত্ব লাভ করতে পারি।

       আমাদের অভীষ্ট সবই, এমন কি মুক্তিও কৃষ্ণ দিতে পারেন, কিন্তু ভক্তি একটি বিশেষ বিবেচনার বস্তু, কারণ যখন কৃষ্ণ কাউকে ভক্তি প্রদান করেন, তখন কৃষ্ণ তার কাছে বিক্রীত হয়ে যান এবং ভক্তের হাতের যন্ত্ররূপে পরিণত হন, এমন কি কৃষ্ণ পরম শক্তিমান হলেও উজ্জ্বলতম ভক্তির প্রতীক রাধারাণী এমন বলশালিনী যে, কৃষ্ণ সম্পূর্ণভাবে তাঁর অধীন। এই জন্য বৈষ্ণবরা রাধারাণীর চরণকমলে শরণাগত হন, কেন না তিনি যদি কৃষ্ণকে অনুরোধ করে বলেন, “ কৃষ্ণ, এ তোমার একজন উত্তম ভক্ত। " কৃষ্ণ তখন নিশ্চয় তাঁকে গ্রহণ করবেন।

       ভগবদ্ভক্তি প্রাপ্তির জন্য সকল বিষয় আসক্তি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া উচিত। এই যোগ্যতাকে বলা হয় বৈরাগ্য। মহাপ্রভুর অনুগামী হয়ে, সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রভুর বন্দনা করে একশটি স্তব রচনা করেন। তাদের মধ্যে দু'টি শ্লোক চৈতন্য চরিতামৃতে উল্লেখ করা আছে, এবং তার একটি স্তব হচ্ছে –

    বৈরাগ্য-বিদ্যা-নিজভক্তিযোগ-
    শিক্ষার্থমেকঃ পুরুষঃ পুরাণঃ।
    শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যশরীরধারী
    কৃপাম্বুধির্যস্তমহং প্রপদ্যে

       " আমি পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দে শরণাপন্ন হই। তিনি আমাদের প্রতি তাঁর ভক্তিযোগ ও বৈরাগ্যবিদ্যা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ভগবান শ্রীচৈতন্য

       মহাপ্রভুরূপে অবতরণ করেছেন। তিনি কৃপা-পারাবার, তাই জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন। আমি তাঁর চরণকমলে শরণাগত হই। " ( চৈঃ চঃ মধ্য ৬/২৫৪ )। জনসাধারণকে জ্ঞান ও বৈরাগ্যবিদ্যা শিক্ষাদান ও শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তি প্রদানের জন্য যে পরমেশ্বর ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভুরূপে আবির্ভূত হন, সার্বভৌম ভট্টাচার্য তাঁকে এভাবে কদনা করেছেন।

       শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বয়স যখন চব্বিশ অথবা পঁচিশ বৎসর, তখন তাঁর এক প্রিয়তমা সুন্দরী পত্নী ও ভক্তিমতী স্নেহময়ী মাতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সব কিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাস-আশ্রম গ্রহণ করেন। গৃহস্থ আশ্রমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এমন সম্মান-সমাদর ছিল যে, তিনি নির্দেশ দেওয়া মাত্র আইন অমান্য আন্দোলনে হাজার হাজার লোক তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন। তাঁর বাসস্থান নদীয়া শহরে, তাঁর যেমন সম্মান ছিল, তেমনই দেখতেও ছিলেন অতীব সুন্দর কান্তি। তবু তিনি তাঁর যুবতী সতী পত্নী, তাঁর স্নেহশীলা মাতা, তাঁর প্রতিষ্ঠা ও আর সব কিছুই পরিত্যাগ করেন। একেই বৈরাগ্য বলা হয়।

       যার কিছুই নেই, সেই রকম কোন নিঃস্ব ব্যক্তি যদি বলে যে, সে সব কিছুই ত্যাগ করেছে, তার বৈরাগ্যের কি অর্থ ? কিন্তু যার কিছু আছে, এবং সে যখন তা পরিত্যাগ করে, তার বৈরাগ্যই অর্থপূর্ণ। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বৈরাগ্য হচ্ছে অপূর্ব। কেউ এই রকম সুখময় গৃহ, এমন সম্মান এবং মাতা, পত্নী, বন্ধু ও অনুগামীদের স্নেহ-প্রীতি ত্যাগ করতে পারত না। এমন কি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পিতৃতুল্য অদ্বৈত প্রভু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে সম্মান প্রদর্শন করতেন। তবু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সব কিছুই ত্যাগ করেন। কেন ? আমাদের শিক্ষাদান করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ( আপনি আচরি ' প্রভু জীবেরে শিখায় )। কিভাবে সংসার-পাশ ছিন্ন করে কৃষাভক্ত হতে হবে, তাই তিনি স্বয়ং সমগ্র জগৎকে শিক্ষা দান করেছেন। তাই রূপ গোস্বামী যখন সরকারী মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে প্রয়াগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তিনি তখন তাঁর পদতলে লুটিয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করেন এবং এইভাবে মহাপ্রভুর বন্দনা করেছিলেন—

    নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেমপ্রদায় তে।
    কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যনাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ ॥

       তিনি বন্দনা করে বলেন, " আপনি হচ্ছেন মহাবদান্য কারণ আপনি কৃষ্ণপ্রেম প্রদান করেছেন।”

       কৃষ্ণপ্রেম দুর্লভ, কেন না এই প্রেমদ্বারা কৃষ্ণকে ক্রয় করা যায়। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই কৃষ্ণপ্রেম সকলকেই, এমন কি মদ্যপ দুই ভাই জগাই-মাধাইকেও দান করেছেন। তাই শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর গান গেয়েছেন—

    দীনহীন যত ছিল,       হরিনামে উদ্ধারিল, তা’র সাক্ষী জগাই-মাধাই।

       “ মহাবদান্য অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সবরকম পাপীকে শুধু 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তনের মাধ্যমে উদ্ধার করেছেন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জগাই ও মাধাই। সেই সময় অবশ্য জগাই ও মাধাই শুধু দুজনই ছিল, কিন্তু আজ মহাপ্রভুর কৃপা ও তাঁর শিক্ষার প্রভাবে কত জগাই-মাধাই উদ্ধার প্রাপ্ত হচ্ছে। মহাপ্রভু তুষ্ট হলে, যোগ্যতা নির্বিশেষে তিনি যে কোন ব্যক্তিকে কৃষ্ণপ্রেম দিতে পারেন। মহাবদান্য ব্যক্তি যে কেউকে তার দানের পাত্ররূপে নির্বাচন করতে পারেন।

       মহাপ্রভুর কৃপাশীর্বাদ ছাড়া কৃষ্ণোপলব্ধি অতীব দুর্লভ। মনুষ্যাণাং সহস্ৰেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে ( গীতা ৭/৩ ) — " লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে কচিৎ কেউ জীবনের পারমার্থিক সিদ্ধি লাভে প্রয়াসী হয়। " মানব জীবনকে সফল করার উপায় সম্বন্ধে অজ্ঞতাবশত জনসাধারণ কেবল পশুর মতো কঠোর পরিশ্রম করে। কৃষ্ণোপলব্ধি হলে মানব-জীবন সফল হয় ; নয়তো সে পশুতুল্যই থাকে। যে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করে না, যার কৃষ্ণের স্বরূপ জ্ঞান নেই, সে একটি পশু থেকে কোন অংশেই শ্রেয় নয়। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই যুগের পতিত জীবসকলকে এই বিশেষ সুবিধা দান করেছেন-- " শুধু ' হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীৰ্ত্তন কর, তা হলেই তুমি উদ্ধার প্রাপ্ত হবে। " এটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিশেষ দান- কীর্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গঃ পরং ব্রজেৎ ( ভাঃ ১২/৩/৫১ )।

       কিন্তু কুন্তীদেবী একজন সাধারণ কৃষ্ণভক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন কৃষ্ণের একজন আত্মীয়া এবং এই জন্য কৃষ্ণ তাঁকে যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন। কিন্তু তবু কুন্তীদেবী প্রার্থনা করে বলেছেন, “ কৃষ্ণ, আমি আমার পিতৃ পরিবার ও পতির পরিবার, এই দুই পরিবারে আসক্ত হয়ে পড়েছি। কৃপা পরবশ হয়ে এই আসক্তি খন্ডন করতে আমাকে সাহায্য কর। " এইভাবে কুন্তীদেবী সমাজ, বন্ধুর ও প্রীতির বন্ধন নিশ্চিতভাবে ছিন্ন করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, নতুবা সেগুলিই আমাদেরকে আবদ্ধ করবে। যতদিন আমি নিজেকে কোন বিশেষ পরিবার, জাতি, ধর্ম, বর্ণাদির অন্তর্ভুক্ত মনে করব, ততদিন কৃষ্ণভাবনাময় হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজেকে ভারতীয়, আফ্রিকান অথবা আমেরিকান বলে মনে করে, কিংবা কোন বিশেষ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মনে করে অথবা সে নিজেকে কোন ব্যক্তির পিতা, মাতা, স্বামী অথবা স্ত্রী মনে করছে, ততক্ষণ সে জড়-জাগতিক উপাধিতে আসক্ত রয়েছে। আমি চিন্ময় আত্মা, এবং এই আসক্তিগুলি দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু আমি এই জড় শরীর নই। এইটি হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধির সার কথা। আমি যখন এই জড় শরীরই নই, তখন আমি কার পিতা অথবা কার মাতা ? আমাদের পরম পিতামাতা হচ্ছেন কৃষ্ণ। আমরা ঠিক যেন নাটকের মঞ্চে পিতা, মাতা, ভগ্নী ও ভ্রাতার ভূমিকায় শুধু অভিনয় করছি। জড়া প্রকৃতি বা মায়া আমাদের কোন বিশেষ পরিবার ও জাতির একজন বলে আমাদের মোহিত করে নাচাচ্ছে। এভাবে আমরা বানরের মতো নৃত্য করছি। ভগবদ্‌গীতায় ( ৩/২৭ ) বলা হয়েছে—

    প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ।
    অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে ॥

       এই শ্লোকটি নির্দেশ করছে যে, জীবাত্মা প্রকৃতির কোন এক বিশেষ গুণের সঙ্গ করায়, প্রকৃতি সেই গুণ অনুসারে জীবাত্মাকে মোহিত করে নাচাচ্ছে এবং এভাবে জীবাত্মা নিজের নানা স্বরূপ কল্পনা করছে। গীতা প্রদত্ত এই জ্ঞান হচ্ছে আত্মোপলব্ধির মূলতত্ত্ব। এই উপলব্ধিই মুক্তি প্রদান করে।

       সব শিক্ষার সারাৎসার হচ্ছে যে, জ্ঞান আমাদের দেহাত্মবুদ্ধি থেকে মুক্ত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিৎ ও অন্যান্য তথাকথিত নেতারা এমনভাবে জনসাধারণকে বিপদগামী করছে যে, তারা দেহের প্রতি আরও আসক্ত হয়ে পড়ছে। একমাত্র এই মানব-জীবনেই কৃষ্ণভাবনাময় হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু এই মূঢ়, দুর্জনেরা জনসাধারণকে দৈহিক উপাধিদ্বারা আকৃষ্ট করে এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণে বাধা প্রদান করছে, এবং এই জন্য তারা মানব সভ্যতার চরম শত্রু।

       ৮৪ লক্ষ প্রজাতির মধ্যে জলচর থেকে লতাগুল্ম এবং তারপর গাছ, কীট, পাখি, পশু ইত্যাদিতে বিবর্তিত হয়ে মানবদেহ লাভ হয়। এখন, বিবর্তনের পরবর্তী সোপান সম্পর্কে জনসাধারণ অজ্ঞ, কিন্তু ভগবদ্‌গীতায় ( ৯/২৫ ) তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যান্তি দেবব্রতা দেবান্। বিবর্তনের পরবর্তী সোপান হচ্ছে, ইচ্ছা করলে একজন ব্যক্তি ঊর্ধ্বলোক প্রাপ্ত হতে পারে। প্রতি রাত্রে জনসাধারণ বহু গ্রহ ও নক্ষত্র দেখলেও, ঊর্ধ্বলোকের স্বরূপ সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞান নেই। কিন্তু বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, এই ঊর্ধ্বলোকের জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য আমাদের এই পৃথিবীর চেয়ে বহু বহু গুণে শ্রেয়। আমাদের এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হলে আমরা একশ বছর বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু ঊর্ধ্বলোকে জীবের জীবনকাল আমাদের গণনারও অতীত। যেমন, সর্বোচ্চ লোকে বসবাসকারী ব্রহ্মার জীবনকাল ভগবদ্গীতায় ( ৮/১৭ ) উল্লেখ করা হয়েছে সহস্ৰযুগপর্যন্তমহর্যদ্ ব্রহ্মণো বিদুঃ। আমাদের গাণিতিক সংখ্যার মাধ্যমে আমরা এমন কি ব্রহ্মার ১২ ঘণ্টাও হিসাব করতে পারি না, কিন্তু ব্রহ্মাকেও একদিন মরতে হয়। সুদীর্ঘ জীবন কালের অধিকারী হলেও কেউ শাশ্বতকাল এই ভবসংসারে বেঁচে থাকতে পারে না। তবুও কেউ প্রস্তুত হলে ঊর্ধ্বলোক যেতে পারে অথবা একইভাবে কেউ পিতৃলোকে গতি লাভ করতে পারে। সেখানে কেউ যাবার যোগ্যতাসম্পন্ন হলে, তবে সে সেখানে পিতৃপুরুষদের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে। সেই রকম, কেউ ইচ্ছা করলে, সে এই পৃথিবীতেও থাকতে পারে। অথবা যান্তি মদযাজিনোহপি মাম্‌ — কেউ কৃষ্ণভজন করলে সে কৃষ্ণকে প্রাপ্ত হবে। ইচ্ছা অনুযায়ী একজন নরকগামী হতে পারে, স্বর্গ লাভ করতে পারে অথবা নিজ আলয় ভগবদ্ধামে গমন করতে পারে। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির চিন্তা করা কর্তব্য, " যদি পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতই হতে হয়, তা হলে নিজালয় ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার জন্যই বা কেন প্রস্তুত হব না ? " বর্তমান জড় দেহের অবসান হলে, অন্য একটি দেহ ধারণ করতে হবে। কি রকম দেহ প্রাপ্তি হবে তা ভগবদ্‌গীতায় ( ১৪/১৮ ) বলা হয়েছে। ঊর্ধ্বং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থাঃ — যারা সত্ত্বগুণসম্পন্ন এবং পাপময় জীবনের চারটি নীতি বর্জন করেছে, তারা পরবর্তী জীবনে ঊর্ধ্বলোকে গতি প্রাপ্ত হবেন। এমন কি কেউ যদি ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত নাও হন, পাপময় জীবন বর্জনের উদ্দেশ্যে বিধি-নিষেধ পালন করেন, তবে তিনি সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে এই সুযোগ লাভ করবেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই মানব-জীবন। কিন্তু যদি আমরা আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও আত্মরক্ষায় কুকুর-বিড়ালের মতো জীবন ধারণ করে দুর্লভ মানব-জীবনের অপচয় করি, তবে আমরা এই সুবর্ণ সুযোগ হারাব।

       মূঢ়, দুর্জনরা কিন্তু এই সব বিষয়ে অজ্ঞ। তারা পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী নয়। রাশিয়ায় অধ্যাপক কটভস্কি আমাকে বলেছিল, “ স্বামীজি, এই দেহের অবসানে সব কিছুই নিঃশেষ হয়। " তার মতো একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এই রকম কথা বলেছিল। এই সব লোক নিজেদের বিজ্ঞানী, দার্শনিক বলে জাহির করলেও, বস্তুত তারা অজ্ঞ, তারা শুধু জনসাধারণকে বিপথে চালিত করে। এটি হচ্ছে আমাদের দুঃখের সবচেয়ে বড় কারণ। অতএব, যারা সমগ্র মানব সমাজকে বিপথগামী করছে, সেই সব দুর্জন, মূঢ়দের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানিয়ে তাদের পরাস্ত করবার জন্য আমি কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের সদস্যদের অনুরোধ করছি। জনসাধারণের ভাবা উচিত নয় যে, কৃষ্ণভক্তরা শুধু ভাবপ্রবণ। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্তরা হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।

       কৃষ্ণের দুটি কাজ-- পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্-- সাধু ভগবদ্ভক্তদের রক্ষা করা এবং অসুরদের নিধন করা। কৃষ্ণ পাণ্ডব ও বৃষ্ণিদের রক্ষা করেছিলেন, কেন না তাঁরা ছিলেন কৃষ্ণভক্ত ও তিনি কংস, অঘাসুর ও বকাসুরাদিকে বধ করেছেন। এই দুটি কাজের মধ্যে অসুর নিধন ছিল তাঁর প্রধান কাজ। যদি আমরা পরীক্ষা করি, কত সময় তিনি অসুর বধে এবং কত সময় তিনি ভক্ত রক্ষাকার্যে অতিবাহিত করেছেন, তখন আমরা দেখব অসুর নিধনেই তিনি অধিক সময় নিয়োগ করেছেন। সেই রকম, যাঁরা কৃষ্ণভক্ত তাঁরাও অস্ত্রদ্বারা নয়, তবে শাস্ত্রযুক্তি, বিচার ও শিক্ষার মাধ্যমে আসুরিক ভাবকে ধ্বংস করেন। কেউ যদি অসুর হয়, তখন আমরা শাস্ত্রযুক্তি বিচারের মাধ্যমে তার আসুরিক প্রবৃত্তিকে বিনাশ করে তাকে ভগবদ্ভক্ত বা সাধুতে পরিণত করতে পারি। বিশেষভাবে এই কলিযুগে জনসাধারণ ইতিমধ্যেই দারিদ্র-নিপীড়িত এবং দৈহিকভাবে তাদের হত্যা করাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যুক্তি-বিচার ও পারমার্থিক তত্ত্ববিজ্ঞানের মাধ্যমে তাদের নিধন করা উচিত।

       কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে বিশ্বেশ বা জগদীশ বলে সম্বোধন করেছেন। বিশ্ব মানে " জগৎ ', এবং ঈশ মানে ' পতি ' অথবা নিয়ন্তা। নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যোদয়, ঋতু পরিবর্তন ও ঋতু অনুযায়ী ফল, ফুলাদি প্রকাশের মাধ্যমে জগতের কাজ সুষ্ঠুভাবে চলছে। এভাবে জগৎ পরিচালনায় কোন বিশৃঙ্খলা নেই। কোন নিয়ন্তা না থাকলে, কিভাবে সব কিছু এই রকম সুষ্ঠুভাবে চলছে ? কোন প্রতিষ্ঠানকে খুব সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে দেখলে, আমরা তৎক্ষণাৎ হৃদয়ঙ্গম করি যে, প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ, পরিচালক অথবা নিয়ামকরা দক্ষ। ঠিক সেই রকম জগতের কার্য সুষ্ঠুভাবে চলতে দেখলে আমাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, এই সবের অন্তরালে একজন নিপুণ পরিচালক বা নিয়ন্তা আছেন। আর কে এই নিয়ন্তা? সেই নিয়ন্তা হচ্ছেন কৃষ্ণ। ভগবদ্‌গীতায় তা প্রমাণিত হয়েছে ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্। তাই কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে বিশ্বেশ বা ব্রহ্মাণ্ডের পরম নিয়ন্তা বলে সম্বোধন করেছেন। জনগণ শ্রীরাধা-কৃষ্ণের আলিঙ্গনবদ্ধ চিত্রেই বিশেষ আগ্রহী। আপাতদৃষ্টিতে তা সাধারণ কিশোর-কিশোরীর জড়-জাগতিক সম্পর্কের মতো মনে হয়। তারা কৃষ্ণতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানহীন। এই রকম আপত্তিকর চিত্রদর্শন বর্জনীয়। কৃষ্ণ হচ্ছেন পরম নিয়ন্তা। বরং, নিখিল বিশ্বের পরম নিয়ন্তারূপে কৃষ্ণলীলার উপর চিত্রাঙ্কন হোক। এই রকম চিত্রই বাঞ্ছনীয়, অন্য রকম সস্তা চিত্র নয়।

       প্রাণশক্তির অবর্তমানে দেহ চলচ্ছক্তিহীন ও নিষ্ক্রিয়। সেই রকম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রাণশক্তি-স্বরূপ কৃষ্ণ ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু অথবা পরমাত্মারূপে বর্তমান। তাই কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে বিশ্বাত্মা বলে সম্বোধন করেছেন। এই বিশ্বের গতি ও ক্রিয়া সম্বন্ধে দুর্জন বা মূঢ়রা কিছুই জানে না। তাই, শ্রীমদ্ভাগবত থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য।

       শ্রীকুন্তীদেবী কৃষ্ণকে বিশ্বমূর্তি বলে সম্বোধন করেছেন। অর্জুন যখন কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করতে ইচ্ছা করেন, কৃষ্ণ অচিরেই তা প্রকাশ করেন। এটি কৃষ্ণের অন্য একটি বিভূতি। ভগবানের আদিরূপ হচ্ছে দ্বিভূজ মুরলীধর কৃষ্ণ। অর্জুন ছিল কৃষ্ণভক্ত এবং তিনি কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখতে চান, তাই কৃষ্ণ তাঁকে সেই রূপ প্রদর্শন করেন, কিন্তু সেটি কৃষ্ণের প্রকৃত রূপ নয়। কোন ব্যক্তি রাজবেশ পরিধান করতে পারে, কিন্তু স্বগৃহেই তার যথার্থ স্বাভাবিক রূপ দেখা যায়। সেই রকম, কৃষ্ণের স্বয়ংরূপ তাঁর নিজালয় বৃন্দাবনেই দেখা যায় এবং অন্য সব রূপ হচ্ছে তাঁর অংশ-প্রকাশের কলা। যেমন ব্রহ্মসংহিতায় প্রতিপন্ন হয়, অদ্বৈতম্-চ্যুতমনাদিমনন্তরূপম্ — তিনি স্বয়ং অনন্ত রূপে ( অনন্তরূপম্ ) বিস্তার লাভ করেন, কিন্তু তিনি এক ( অদ্বৈত ) ও অচ্যুত। কিন্তু তাঁর যথার্থ রূপ হচ্ছে দ্বিভূজ মুরলীধর কৃষ্ণ। তাই কুন্তীদেবী বলেছেন যে, কৃষ্ণের এক বিশ্বরূপ আছে কিন্তু কুন্তীদেবীর সম্মুখে দাঁড়ানো রূপই কৃষ্ণের স্বয়ংরূপ।

       কৃপাপরবশ হয়ে স্বজনের প্রতি স্নেহপাশ ছিন্ন করার জন্য কুন্তীদেবী প্রার্থনা করেন। আমরা ভাবি, “ এটি আমার নিজের, ওটি আমার নিজের, " কিন্তু এই মনোভাব হচ্ছে মোহ ( জনস্য মোহোহয়মহং মমেতি )। এই মোহের উৎপত্তি হচ্ছে কিভাবে ? এই মোহের সৃষ্টি হয় নর-নারীর পরস্পর আকর্ষণে। একজন পুরুষ নারীর অন্বেষণ করে, আর এক নারী পুরুষের অন্বেষণ করে। এই সত্য শুধু মানব সমাজেই প্রযোজ্য নয়, পশু-পাখি আদি সকল সমাজেই এই সত্য প্রযোজ্য। এভাবে জড় আসক্তির সূচনা হয়। একটি পুরুষ যখন কোন এক নারীর সাক্ষাৎ লাভ করে, তখন তারা মিলিত হয়, তার ফলে এই আসক্তি এমন কি আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ( তয়োর্মিথো হৃদয়গ্রন্থিমাহুঃ )। এইবার এই আসক্তি কিয়ৎ পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে, তাঁরা একসঙ্গে বসবাসের জন্য গৃহের অন্বেষণ করে এবং তারপর অবশ্যই ব্যক্তিটির অর্থোপার্জন করা প্রয়োজন। তাদের সংসার সুপ্রতিষ্ঠিত হলে, তাদের সন্তান চাই এবং তাদের সুন্দর গৃহ ও সন্তানদের প্রশংসার কথা শোনাবার জন্য বন্ধুবান্ধবেরও প্রয়োজন, এবং তারা বলবে, " বাঃ, তোমার তো চমৎকার বাড়িঘর ও সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়ে রয়েছে। " এভাবে সংসার আসক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

       অতএব, ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে ছাত্রদের শিক্ষার সূচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্রহ্মচর্যের অর্থ হচ্ছে স্ত্রীসঙ্গের আকর্ষণ থেকে মুক্তি। সামর্থ্য থাকলে, এই সব অর্থহীন আকর্ষণ বর্জনে প্রয়াসী হওয়া উচিত। কিন্তু এই কাজে অসমর্থ হলে, বিবাহ করে কিছুকাল পরে বানপ্রস্থ-আশ্রম গ্রহণীয়। এই বানপ্রস্থের মনোভাব হচ্ছে, “ এতকাল তো আমি এই আকর্ষণ যথেষ্ট উপভোগ করেছি, এখন গৃহত্যাগী হই। ” তখন সে বৈরাগ্য লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন তীর্থে পর্যটন করে, এবং সহায়করূপে পত্নী তার অনুগামী হয়। তার সন্তানরা সুষ্ঠুভাবে সংসার প্রতিপালন করছে কি না তা দেখতে সে দুই-তিন মাস পরে গৃহে ফিরে আসে এবং আবার পর্যটনে বের হয়। এই হচ্ছে বৈরাগ্যের সূচনা। বৈরাগ্য সম্পূর্ণ হলে, লোকটি তখন স্ত্রীকে সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করতে নির্দেশ দেয়, এবং স্বয়ং সন্ন্যাস গ্রহণের কথা স্ত্রীকে জানায়। এই হচ্ছে চরম বৈরাগ্য। সমগ্র বৈদিক জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে বৈরাগ্যে। এইজন্য কুন্তীদেবী এই সংসার আসক্তি থেকে কৃপা করে মুক্ত করার জন্য প্রার্থনা করেছেন। এটিই হচ্ছে কুন্তীদেবীর উপদেশ।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ২৫ ) অনন্যা ভক্তি
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।