" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • অনন্যা ভক্তি

    শ্লোক: ২৫
    ত্বয়ি মেহনন্যবিষয়া মতির্মধুপতেহসকৃৎ।
    রতিমুদ্বহতাদদ্ধা গঙ্গেবৌঘমুদন্বতি ॥ ২৫ ॥
  • অনুবাদ : হে মাধব, গঙ্গাদেবী যেমন সকল বাধা তুচ্ছ করে সাগরাভিমুখে চিরন্তন প্রবাহিত হয়, তোমার প্রতি আমার আকর্ষণও সেই রকম অপ্রতিহতভাবে নিরন্তর ধারায় প্রবাহিত হোক। ( ভাঃ ১/৮/৪২ )
  • তাৎপর্যঃ- সমস্ত মনোযোগ অপ্রাকৃত ভগবদ্ভজনে চালিত করলে শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তিতে সিদ্ধি লাভ করা যায়। অন্য সকল স্নেহের পাশ ছিন্ন করার অর্থ এই নয় যে, অন্যের প্রতি আসক্তি ভালবাসাদি হৃদয়ের সূক্ষ্ম ভাবগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বিনাশ করা। তা বস্তুত সম্ভবও নয়। জীব মাত্রেরই এই অন্যের প্রতি আসক্তিভাব থাকবেই। কেন না এটি জীবনের একটি লক্ষণ। কামনা, ক্রোধ, আকাঙ্ক্ষা, আকর্ষণের অনুভূতি এই সব জীবনের লক্ষণগুলিকে ধ্বংস করা যায় না। শুধু লক্ষ্যবস্তুকে পরিবর্তন করতে হবে। কামনাকে অবহেলা করা যায় না, কিন্তু ভগবদ্ভজনে এই কামনার পরিবর্তন ঘটানো যায়। ইন্দ্রিয়ভোগ কামনার পরিবর্তে ভগবৎ-সেবার জন্য কামনা করা যায়। তথাকথিত পরিবার, সমাজ ও দেশাদির প্রতি আসক্তিগুলি ইন্দ্রিয়- ভোগময় জীবনের বিভিন্ন স্তর মাত্র। যখন এই কামনা ভগবান শ্রীহরির সন্তোষ বিধানে রূপান্তরিত হয়, তাকে ভগবদ্ভজন বলে।

       ভগবদ্‌গীতায় আমরা দেখি যে, ব্যক্তিগত অভিলাষ চরিতার্থতার জন্য অর্জুন তাঁর ভ্রাতা ও স্বজনদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হন। কিন্তু ভগবান কৃষ্ণের মুখঃনিসৃত ভগবদ্গীতার বাণী শ্রবণ করে, তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং ভগবানের সেবা করেন। এভাবে ভগবৎ-আনুগত্যে কাজ করায়, তিনি একজন বিখ্যাত ভগবদ্ভক্তে পরিণত হন, কেন না সকল শাস্ত্রে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সখ্যরসে ভগবৎ-সেবার মাধ্যমে অর্জুন পারমার্থিক সাফল্য অর্জন করেছেন। যুদ্ধ হয়েছিল, বন্ধুত্বও হয়েছিল, অর্জুন ও কৃষ্ণ দুজনেই সেখানে ছিলেন, কিন্তু ভগবৎ সেবার ফলে অর্জুন ভিন্ন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন। এই জন্য কুন্তীদেবীর প্রার্থনার কাজেও একই শ্রেণীর রূপান্তর অভিব্যক্ত হয়। কুন্তীদেবী অনন্যাভাবে ভগবৎ সেবা করতে ইচ্ছা করেছিলেন এবং তাঁর প্রার্থনায় সেই ভাবই ব্যক্ত হয়েছিল। এই বিশুদ্ধ ভক্তিই জীবনের অন্তিম লক্ষ্য, এবং জীবনের পরম উদ্দেশ্য। সচরাচর আমাদের মনোযোগ ভগবানের অনভিপ্রেত বা ভগবৎ-সম্বন্ধহীন কোন কিছুর সেবায় চালিত হয়। যখন সেই কার্যক্রম ভগবৎ-সেবায় পরিবর্তিত হয়, অর্থাৎ ভগবৎ সেবায় ইন্দ্রিয়গুলি নির্মল ও পবিত্র হয়, তাকে অনন্যা বা বিশুদ্ধ ভক্তি বলে। কুন্তীদেবী সেই পরম সিদ্ধি কামনা করেছিলেন এবং ভগবানের কাছে তা প্রার্থনা করেছিলেন।

       পাণ্ডব ও বৃষ্ণিদের প্রতি কুন্তীদেবীর আসক্তি ভগবদ্ভজনের বহির্ভূত নয়, কেন না ভগবৎ-সেবা ও ভক্তসেবা অভিন্ন। কখনও কখনও, ভক্তসেবা ভগবৎ-সেবার চেয়েও অধিক মূল্যবান। কিন্তু এখানে পাণ্ডব ও বৃষ্ণিদের প্রতি কুন্তীদেবীর আকর্ষণ পারিবারিক সম্বন্ধজাত। জড়-জাগতিক সম্বন্ধ অনুযায়ী এই স্নেহবন্ধন হচ্ছে মায়িক সম্বন্ধ, কারণ দৈহিক ও মানসিক সব সম্বন্ধই হচ্ছে জড় মায়ার প্রভাবজাত। পরমাত্মার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কই হচ্ছে বাস্তব সম্বন্ধ। কুন্তীদেবী যখন পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তার সকল দৈহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ইচ্ছাই প্রকাশ করেছেন। দৈহিক সম্পর্কই সংসার বন্ধনের কারণ, কিন্তু আত্মিক সম্বন্ধ হচ্ছে মুক্তির পথ। পরমাত্মার সম্পর্কের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়। অন্ধকারে দেখা প্রকৃত দেখা নয়। সূর্যালোকের মাধ্যমে দর্শন করার অর্থ সূর্যদর্শন এবং অন্ধকারে যা দর্শন করা যায় না, তাও দর্শন। এই হচ্ছে ভগবজনের পথ।

       কুন্তীদেবী তাঁর স্বজন- পাণ্ডব ও বৃষ্ণি পরিবারের প্রতি আসক্তি ছিন্ন করবার জন্য, কৃপাময় ভগবান মধুসূদনের কাছে পূর্ববর্তী শ্লোকে প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু জড় বস্তুর প্রতি আসক্তি বর্জনই যথেষ্ট নয়। মায়াবাদী দার্শনিকরা বলে,- ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা— " এই ভবসংসার মিথ্যা এবং ব্রহ্মই ( আত্মা ) সত্য।” আমরা এই কথা স্বীকার করি, কিন্তু তাতে বৈশিষ্ট্যাদি যুক্ত করি। জীবাত্মা হওয়ায়, আমরা ভোগ কামনা করি। ভোগের অর্থই তা বৈচিত্র্যে পূর্ণ। বৈচিত্র্যহীন কিছুই ভোগ্য নয়। ভগবান নানা রঙ, নানা রূপ সৃষ্টি করেছেন কেন ? বৈচিত্র্য থেকে আনন্দ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, কারণ বৈশিষ্ট্য বা বৈচিত্র্যই আনন্দ উপভোগের উৎস।

       মায়াবাদী দার্শনিকরা বা নির্বিশেষবাদীরা বৈশিষ্ট্যকে বিনষ্ট করতে চায়, কিন্তু পরিণামে কি ঘটে ? যেহেতু তারা কৃষ্ণ ভজনে ব্রর্তী হয় না, তাই তারা তপস্যা, ও কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা কঠোর পরিশ্রম করে, অথচ কোন নিত্যফল প্রাপ্ত হয় না। ভাগবতে ( ১০/২/৩২ ) একটি প্রার্থনার মাধ্যমে তা প্রতিপন্ন হয়েছে—

    যেহন্যেহরবিন্দাক্ষ বিমুক্তমানিন-
    স্ত্বয্যস্তভাবাদবিশুবুদ্ধয়ঃ ।
    আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ
    পতন্ত্যধোহনাদৃতযুষ্মদঙ্ঘ্রয়ঃ॥

       " হে অরবিন্দাক্ষ, যারা নিজেদের বিমুক্ত অভিমান করে আপনার ভজনে অনাদর করে, তাদের বুদ্ধি অবিশুদ্ধ। কৃচ্ছসাধন ও কঠোর তপশ্চর্যার মাধ্যমে তারা নির্বিশেষ ব্রহ্মানুভূতি স্তরে উন্নীত হলেও, আপনার চরণারবিন্দের উপেক্ষা করায় আবার সংসার-কূপে পতিত হয়। "

       আমাদের ভগবৎ-সম্বন্ধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ও সেই সম্বন্ধ অনুযায়ী ভগবদ্ভজন অনুশীলন করাই এই দুর্লভ মানব-জীবনের উদ্দেশ্য। এমন কি সাধারণ আচরণেও, অন্যের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয়ে ইচ্ছুক ব্যবসায়ী, প্রথমেই ঐ ব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করে, তারপর লেন-দেন, বিনিময়াদি সম্ভব হয়। সেই রকম, বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন তারা একত্রে জীবন যাপন করে। সেই রকম, ভগবৎ-সম্পর্ক পুনস্থাপন করাই মানব-জীবনের উদ্দেশ্য। জড় জগতের অর্থ এই সম্পর্কের বিস্মৃতি। এই জড় জগতে কৃষ্ণভাবনার অমৃত নেই, কারণ কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন মাত্রই, কৃষ্ণকেন্দ্রিক সেবা শুরু হওয়া মাত্রই, এই স্থান আর জড় জগৎ থাকবে না, চিন্ময় ধাম বৈকুণ্ঠলোকে পরিণত হবে।

       স্ত্রীলোক হওয়ায় দুটি পরিবারের সঙ্গে কুন্তীদেবীর সম্বন্ধ ছিল। ঐটিই ছিল তাঁর আসক্তি। তাই কুন্তীদেবী ঐ সম্বন্ধ ছিন্ন করে তাঁকে উদ্ধার করার জন্য কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু সংসার বন্ধন মুক্ত হয়ে তারপর তিনি কি করবেন ? সেটিই হচ্ছে প্রশ্ন ? এইটি জিজ্ঞাসা ? কেউ কোন কাজে নিযুক্ত হতে পারে এবং অসুবিধা অনুভব করে ঐ কাজ পরিত্যাগ করতে পারে। পদত্যাগ করে হয়ত যথার্থ কাজ করেছে, কিন্তু পদত্যাগের ফলে সে যদি কর্মহীন হয়, তার যদি কোন কর্ম না থাকে, তা হলে এই পদত্যাগের মূল্য কতটুকু ?

       জীবনে বিভ্রান্ত ও ব্যর্থ ব্যক্তিরাই এই জড় জগৎকে অস্বীকার করতে চায়। তাদের অনভিপ্রেত বস্তু সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান আছে, কিন্তু তাদের অভিপ্রেত বস্তু সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। জনসাধারণ সর্বদাই বলছে, “ আমি এটি চাই না। কিন্তু তাদের অভিপ্রেত বস্তু কি ? সেই সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ।

      ভ আমাদের বাস্তবিক অভিষ্ট বস্তু কি হওয়া উচিত তা কুন্তীদেবী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “ আমার পারিবারিক সম্বন্ধের অবসান হোক কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দৃঢ়বদ্ধ হোক। " পক্ষান্তরে বলা যায়, তিনি কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কিছুতেই আসক্ত হতে ইচ্ছা করেন না। এখানেই পরম সিদ্ধি এবং এটিই বস্তুত অভিপ্রেত।

       অনন্যবিষয়া শব্দের অর্থ অনন্যা ভক্তি, অর্থাৎ অপ্রতিহতা ভগবদ্ভজন। আমাদের দিনে চব্বিশ ঘণ্টা অনন্যভাবে শুধু কৃষ্ণে আসক্ত হতে হবে। এভাবে আমানের সংসার বৈরাগ্য সফল হবে। আমরা যদি মনে করি যে, সংসার বিষয়ে ও কৃষ্ণে একই সঙ্গে আমরা আসক্ত হতে পারি, তা হলে আমরা ভ্রান্ত। আমরা একই সময় আগুন জ্বালাতে ও তাতে জল সিঞ্চন করতে পারি না। যদি তা করি, তা হলে আগুন জ্বালানো সম্ভব হবে না।

       মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা এই ভবসংসার ত্যাগ করে ( ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা )। সংসার বৈরাগ্য প্রচার উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু পাশাপাশি আমাদের কোন কিছুতে আসক্তি থাকতে হবে, নয়তো আমাদের এই বৈরাগ্য স্থায়ী হবে না। আমাদের দেখা বহু মায়াবাদী সন্ন্যাসীকে ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা বলতে শুনেছি, কিন্তু সন্ন্যাস-আশ্রম গ্রহণ করে তারা জড় জগতে হাসপাতাল খুলতে ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হতে ফিরে যায়। কেন ? তারা যখন জড় জগৎকে মিথ্যা বা অলীক বিবেচনায় ত্যাগ করেছে, তখন রাজনীতি, জনকল্যাণ ও সমাজনীতি গ্রহণ করতে তারা আবার প্রত্যাবর্তন করে কেন ? বস্তুত এই রকম ঘটনা অবশ্যম্ভাবী কেন না আমরা জীবাত্মা ও ক্রিয়াশীল। যদি ব্যর্থ ও নিরাশ হয়ে আমরা নিষ্ক্রিয় হওয়ার প্রয়াস করি, তবে এই প্রচেষ্টায় আমরা অকৃতকার্য হব। আমাদের অবশ্যই ক্রিয়াশীল হতে হবে।

       পরম কর্ম বা ব্রহ্মকর্ম হচ্ছে ভগবদ্ভজন। দুর্ভাগ্যবশত মায়াবাদীরা এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তারা চিন্ময় জগৎকে শূন্য বলে অনুমান করে। কিন্তু ঐ চিন্ময় জগৎ ঠিক জড় জগতেরই মতো এবং ঐ চিন্ময় ধাম বৈচিত্র্যময়। ঐ চিৎ-জগতে গৃহ, বৃক্ষ, সড়ক, রথ-সব কিছুই রয়েছে, কিন্তু সেখানে জড় হেয়তা নেই। ব্রহ্মসংহিতায় ( ৫/২৯ ) তা প্রতিপন্ন হয়েছে-

    চিন্তামণিপ্রকরসদ্মসু কল্পবৃক্ষ-
    লক্ষাবৃতেষু সুরভীরভিপালয়ন্তম্।
    লক্ষ্মীসহস্রশতসম্ভ্রমসেব্যমানং
    গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

       " কল্পবৃক্ষে পরিপূর্ণ চিন্তামণিময় ভগবদ্ধামে শত সহস্র লক্ষ্মী বা গোপীদ্বারা সম্ভ্রমে সেবিত এবং সুরভী গাভী চারণে নিযুক্ত সেই আদি পুরুষ ভগবান শ্রীগোবিন্দকে আমি ভজনা করি। "

       চিৎ-জগতে কল্পবৃক্ষ আছে এবং আমরা যে ফল চাইব কল্পবৃক্ষ তাই প্রদান করবে। জড় জগতে আম গাছে আঙ্গুর হয় না, আবার আঙ্গুর গাছেও আম হয় না। কিন্তু চিন্ময় জগতে আমরা কোন গাছ থেকে একটি আম পেড়ে, তারপর সেই গাছ থেকেই যদি আঙ্গুর আশা করি, তা হলে সেই গাছ থেকে আঙ্গুর পাওয়া যাবে। একে বলা হয় ' কল্পবৃক্ষ '। এগুলি হচ্ছে চিন্ময় জগতের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য।

       এই জড় জগতে সূর্যালোক ও চন্দ্রালোক উভয়েরই প্রয়োজন আমরা অনুভব করি। কিন্তু চিন্ময়লোকে সেই আলোকের কোন প্রয়োজন নেই, কেন না সেখানে সকলেই এবং সব কিছুই জ্যোতির্ময়। কৃষ্ণলীলায় কৃষ্ণ মাখন চুরি করত, এবং মা যশোদার প্রতিবেশিনী সখীরা অভিযোগ করতেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অভিযোগ করতেন না, বরং কৃষ্ণের কৌতুক উপভোগ করতেন এবং তাঁর শ্রীঅঙ্গ-মাধুর্য পান করতেন। তাঁরা মা যশোদাকে বলতেন, “ তোমার পুত্র আমাদের গৃহে গিয়ে মাখন চুরি করে। সে যাতে দেখতে না পায়, সেই জন্য আমরা অন্ধকারে মাখনাদি লুকিয়ে রাখি, তবুও সে কোন উপায়ে তা খুঁজে বের করে। তুমি তার অলঙ্কারগুলি খুলে রেখে দিও, কেন না আমাদের মনে হয় ঐসব অলঙ্কারের আলোই মাখনের পাত্র খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। " মা যশোদা উত্তরে বলেন, " আচ্ছা, আমি কৃষ্ণের সব অলঙ্কারই খুলে রেখে দেব। ” কিন্তু প্রতিবেশীনীরা আবার বলতেন, “ না না, ওসব করেও কিছু হবে না। এই ছেলেটির দেহ থেকেই এক রকম জ্যোতি বের হয়। এমন কি অলঙ্কার ছাড়াই সে মাখনের পাত্রগুলি দেখতে পায়। ” দিব্য দেহ এমনই জ্যোতির্ময়।

       শ্রীকৃষ্ণের দিব্য দেহের জ্যোতিই আলোর অস্তিত্বের কারণ। আমরা যে আলোই দেখি না কেন, তা মূলত শ্রীকৃষ্ণেরই শ্রীঅঙ্গনিঃসৃত ব্রহ্ম-জ্যোতির থেকেই ধার করা। ব্রহ্ম-সংহিতায় ( ৫/৪০ ) তা উল্লেখ করা হয়েছে—

    যস্য প্রভা প্রভবতো জগদণ্ডকোটি-
    কোটিষ্বশেষবসুধাদিবিভূতিভিন্নম্।
    তদ্ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমশেষভূতং
    গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি

       “ কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে অসংখ্য গ্রহ রয়েছে, এই গ্রহমণ্ডলের সংগঠন বৈচিত্র্যময়। ব্রহ্মজ্যোতি নামে চিন্ময় আলোকে এই সব গ্রহগুলি অবস্থিত। পরমেশ্বর ভগবানের দেহনিঃসৃত আলোকই এই ব্রহ্মজ্যোতি। সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি। "

       কৃষ্ণদেহের দিব্য জ্যোতি থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হচ্ছে। এই সৌরমণ্ডলে সূর্য অনেক গ্রহ সৃষ্টি করে। সূর্যালোকের ফলে গ্রহগুলি উত্তপ্ত হয়। এবং ঋতুও পরিবর্তিত হয়। সূর্য আছে বলেই বৃক্ষ, গাছপালার সবুজ শোভা, ফুল ও ফলের সমারোহ আছে। সেই রকম, সৃষ্টিতে যা কিছু আমরা দেখি, সব কিছুরই মূল উৎস কৃষ্ণের দেহের দিব্য জ্যোতি।

       মায়াবাদীরা শুধু জ্যোতি দর্শন করে, এবং এই জ্যোতি নিরাকার। তারা এই জ্যোতির অতীত কিছুই দর্শন করতে পারে না। আমরা আকাশে একটি বিমানকে উড়তে দেখতে পারি, কিন্তু একটু পরে তীব্র উজ্জ্বল সূর্যালোকে বিমানটি আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। বিমানটি সেখানে রয়েছে, কিন্তু আমরা সেটিকে দেখতে পাই না। সেই রকম, আমরা যদি শুধু তাঁর উজ্জ্বল ব্রহ্মজ্যোতিই দর্শন করতে চেষ্টা করি, তা হলে জ্যোতির অভ্যন্তরের বস্তু দেখতে আমরা অসমর্থ হব। এই জন্য ঈশোপনিষদের একটি মন্ত্রে, যথাযথ ভগবৎ-দর্শনের জন্য তাঁর উজ্জ্বল ব্রহ্মজ্যোতিকে সংবরণের জন্য ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানানো হয়েছে।

       মায়াবাদী দার্শনিকরা কৃষ্ণের ব্যক্তিগত কার্যকলাপ দর্শন করতে পারে না, আবার কৃষ্ণলীলাময় ভগবদ্ধামও তারা দর্শনে অক্ষম। ভাগবতে প্রতিপন্ন হয়েছে, আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ পতন্ত্যধোহনাদৃতযুষ্মদঙ্ঘ্রয়ঃ- কৃষ্ণের চরণারবিন্দ দর্শনে উপেক্ষা করায়, কৃচ্ছ্রসাধন ও কঠোর তপশ্চর্যা সত্ত্বেও তাদের আবার ভবসংসারে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। এভাবে কেবল বৈরাগ্যই আমাদের সাহায্যের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কৃত্রিমভাবে আমরা ভব সংসার ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু পুনরায় আমরা তথাকথিত ভোগীতে পরিণত হব। এই রকম ভোগ ও ত্যাগ ঘড়ির দোলকের মতো দোদুল্যমান। একদিকে আমরা বৈরাগ্যের ছলনা করি, অপরদিকে কৃত্রিম উপায়ে ভোগের চেষ্টা করি। কিন্তু উপায় আছে। বাস্তবিক যদি আমরা ভব-সংসার অনাসক্ত হতে চাই, তা হলে কৃষ্ণভক্তিতে আমাদের আসক্তি অবশ্য বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু বিষয়-বৈরাগ্যই আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করবে না। এই জন্য কুন্তীদেবী কৃষ্ণের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করেছেন – ত্বয়ি মেহনন্যবিষয়া। তিনি প্রার্থনা করেছেন যে, অনন্যভাবে কৃষ্ণের শ্রীচরণে তাঁর ভক্তি নিরন্তর প্রবাহিত হোক। এটিই হচ্ছে ভক্তি, এটিই হচ্ছে বিশুদ্ধ ভগবদ্ভজন। এইজন্য রূপ গোস্বামী বিশুদ্ধ ( অন্যাভিলাষিতাশূন্য জ্ঞানকর্মাসনাবৃত্তম্ ) হওয়া উচিত বলে উপদেশ দিয়েছেন।

       এই জড়গে জ্ঞানী ও কর্মী আছে। কর্মীরা হচ্ছে মূঢ় তারা অর্থহীন কঠোর পরিশ্রম করে, আর তার থেকে একটু উন্নত জ্ঞানীরা মনে করে, “ এত কঠিন কাজ করছে কেন ? এত জিনিসের কোন আবশ্যক নেই। এ অর্থ, আহার্য ও জড় প্রতিষ্ঠা সংগ্রহের কি প্রয়োজন ? " জ্ঞানীর মনোভাব এই রকম। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত জ্ঞানী ও কর্মীর ঊর্ধ্বে। কর্মীর অসংখ্য কামনা-বাসনা থাকে, এবং জ্ঞানী বাসনাহীন হওয়ার প্রয়াসী হয়। কিন্তু একমাত্র কৃষ্ণসেবা কামনার মাধ্যমেই কামনাহীন হওয়া সম্ভব। নয়তো কামনা ত্যাগ করা অসম্ভব। জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্। কৃষ্ণভক্তরূপে আমাদের জ্ঞান ও কর্মে অভিলাষী হওয়া উচিত নয়। জড় বিষয়ে আমাদের আসক্তিহীন হওয়া উচিত, কিন্তু কৃষ্ণের প্রতি আমাদের আসক্তি থাকা উচিত। এইভাবে আমাদের বিষয় বৈরাগ্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

       অনুকূলভাবে আমাদের কৃষ্ণভাবনার অমৃত অনুশীলন করতে হবে ( আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনম্ )। এর অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণতুষ্টির উপায় চিন্তা করা। ব্রজগোপীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সর্বদাই আমাদের কৃষ্ণচিন্তা করা উচিত। গোপিকাদের কৃষ্ণভাবনা পূর্ণ হয়েছিল, কেন না কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করা ছাড়া তাদের অন্য কোন বাসনাই ছিল না। এইখানেই কৃষ্ণানুশীলনের সাফল্য। এখানেই কৃষ্ণভাবনার সার্থকতা॥ তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, রম্যা কাচিদুপাসনা ব্রজবধূবর্গেণ যা কল্পিতা — ব্রজাঙ্গনা কল্পিত কৃষ্ণোপাসনার চেয়ে শ্রেয় ভগবদ্ভজনের অন্য কোন পন্থা নেই। "

       শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করা ছাড়া ব্রজগোপিকাদের অন্য কোন অভিলাষই ছিল না। বয়োজ্যেষ্ঠা গোপী, যশোদা ও তাঁর বান্ধবীসহ সকল গোপীই গোপালকে পরিতুষ্ট করতে চেষ্টা করেছিল। বয়োজ্যেষ্ঠ গোপ, নন্দ মহারাজ ও তাঁর বন্ধুরাও নন্দনন্দনের সন্তোষ বিধানে প্রয়াসী হয়েছিল। কৃষ্ণের সমবয়স্ক ব্রজের বালক বালিকারাও তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিল। এমন কি বৃন্দাবনের জল, ফল, ফুল, গাভী সকলেই কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিল। কারণ বৃন্দাবনে সব কিছুই চিন্ময়, সেখানে কিছুই জড় নয়।

       চিন্ময় ও জড়ের পার্থক্য আমাদের হৃদয়ঙ্গম করা উচিত। জড় পদার্থে জীবনের লক্ষণ নেই, আর চিন্ময় পদার্থে জীবনের সকল লক্ষণ রয়েছে। চিন্ময় জগতের গাছ ও জড় জগতের গাছ উভয়ই জীবাত্মা, কিন্তু জড়জগতের গাছে জীবনের লক্ষণ নেই। মানুষ হচ্ছে জীব আর চিৎ-জগতে কৃষ্ণভক্তরাও জীব। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাহীন মানুষদের মধ্যে চেতনের বাস্তব লক্ষণ অনুপস্থিত।

       বস্তুত কৃষ্ণচেতনা ছাড়া অন্য কোন চেতনা নেই। আর এই চেতনাই হচ্ছে চিন্ময়। এইভাবে, এমন কি এই জড় জগতে থাকাকালীন, শুধু আমাদের কৃষ্ণভক্তি বৃদ্ধি করলেই আমরা ভগবদ্ধামে বাস করতে পারব। আমরা কৃষ্ণমন্দিরে বাস করলে, আমাদের ভগবদ্ধামে বাস হবে। কারণ, কৃষ্ণমন্দিরে কৃষ্ণভজনা ছাড়া অন্য কাজ নেই। কত রকম কৃষ্ণসেবা রয়েছে। যারা কঠোরভাবে নিয়মনিষ্ঠ হয়ে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করেন তারা জড় জগতে বাস করেন না, তারা বৈকুণ্ঠজগতে আছেন। আমরা মনে করতে পারি যে, আমরা দিল্লী, বোম্বে, কলকাতায় অথবা অন্য কোথাও রয়েছি, কিন্তু বস্তুত আমরা বৈকুণ্ঠলোকে আছি।

       এটি হচ্ছে চেতনার প্রশ্ন। ছারপোকা ও সদ্গুরু একই আসনে উপবেশন করলেও, সদ্গুরু হচ্ছেন কৃষ্ণভাবনাময় আর ছারপোকার ভাবনা পৃথক, তাই তারা বিভিন্ন। উভয়েই একই স্থানে উপবেশন করলেও ছারপোকা ছারপোকাই থাকে এবং গুরুদেব গুরুদেবই থাকেন। জড় জগতে অথবা চিৎ-জগতে যেমন আমরা অবস্থান করি অন্তরিক্ষে অবস্থান এক হতে পারে, কিন্তু আমাদের কৃষ্ণভক্তি বলবতী হলে, আমরা আর জড় জগতে নই।

       এইভাবে শুধু বৈরাগ্য বা কেবল জড় বিষয় ত্যাগই যথেষ্ট নয়। বিষয় বৈরাগ্য যথেষ্ট নয়। বিষয়-বৈরাগ্য এক সহায়ক পন্থা হলেও, তা পূর্ণ সাহায্যকারী নয়। কৃষ্ণে আসক্তি বৃদ্ধি করলে, আমাদের বিষয়-বৈরাগ্য পূর্ণ হবে। কৃষ্ণের প্রতি আমাদের আসক্তি যতই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে, এই জড় জগতের প্রতি আসক্তি আপনা থেকেই ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। কৃষ্ণে আসক্তি ও সংসার আসক্তি এক সঙ্গে চলতে পারে। না। একজন নারী, তার স্বামী ও উপপতি, উভয় পুরুষের প্রতি আসক্ত হলে, তার পক্ষে উভয়ের প্রতি আসক্তি রক্ষা করা সম্ভব নয়। উপপতির প্রতি তার আসক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। স্বামীর গৃহে সে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে গৃহকর্ম করলেও, উপপতির প্রতি তার মন নিবিষ্ট থাকবে, তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠবে, রাতে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। ঠিক সেই রকমভাবে, কৃষ্ণের প্রতি আমাদের আসক্তি বৃদ্ধি হলে, বৈরাগ্য বা সংসার ত্যাগ আপনা থেকেই আসবে ( ভক্তিঃ পরেশানুভবো বিরক্তিরন্যত্র চ, ( ভাঃ ১১/২/৪২ )।

       এভাবে কৃষ্ণের কৃপাশীর্বাদে কৃষ্ণের চরণারবিন্দে আসক্তি লাভের জন্য কুন্তীদেবী কৃষ্ণের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করেছেন। কৃষ্ণকৃপা ছাড়া আমরা কৃষ্ণের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি করতে পারি না। কৃষ্ণের অনুকম্পা প্রাপ্ত না হলে, আমরা কৃষ্ণভক্ত হতে পারি না। তাই আমাদের প্রয়োজন শুধু কৃষ্ণসেবা করা, কেন না প্রীতিপূর্ণ ঐকান্তিক সেবার মাধ্যমেই কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হন।

       কারও সেবা কৃষ্ণের প্রয়োজন নেই, কেন না কৃষ্ণ স্বয়ং পূর্ণতত্ত্ব। কিন্তু সর্বান্তকরণে ও ঐকান্তিকভাবে তাঁর সেবা করলে, তখন তাঁর অনুকম্পাবশত আমরা ভগবদ্ভক্তি পথে উন্নতি করব। সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়মেব স্ফুরত্যদঃ। কৃষ্ণ স্বয়ং আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করবেন। জড় চোখে আমরা ভগবানকে দর্শন করতে পারি না। তা হলে, তাকে দর্শনের উপায় কি ? প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তি- বিলোচনেন সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি ( ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৮ ) আমাদের চোখকে কৃষ্ণপ্রেমের অঞ্জন দ্বারা রঞ্চিত করতে হবে। তখন কৃষ্ণ আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করবেন।

       ধ্রুব মহারাজ যখন কৃচ্ছ্রসাধন ও কঠোর তপস্যা করে হৃদয়ে বিষ্ণুর শ্রীমূর্তির ধ্যান করছিলেন, তখন বিষ্ণুবিগ্রহ হঠাৎ অন্তর্হিত হন, তখন ধ্রুব মহারাজের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যায়। চোখ খুলে ধ্রুব মহারাজ তৎক্ষণাৎ ভগবান বিষ্ণুকে তাঁর সম্মুখে দর্শন করেন। ধ্রুব মহারাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, আমাদের নিরন্তর কৃষ্ণচিন্তা করা কর্তব্য, এবং আমরা সিদ্ধি অর্জন করলে, আমাদের সম্মুখে আমরা কৃষ্ণকে দর্শন করতে পারব। এই হচ্ছে ভগবৎ-দর্শনের পন্থা। আমাদের অতি দ্রুতগতি সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভগবদ্ভজনের পরিপক্ক অবস্থার জন্য আমাদের প্রতীক্ষা করা উচিত। অবশ্যই কৃষ্ণ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হওয়া উত্তম, কিন্তু অচিরেই কৃষ্ণ-দর্শন না হলে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। কোন নারী বিবাহ করে অচিরেই সন্তান কামনা করলে, নৈরাশ্য বোধ করবে। তৎক্ষণাৎ সন্তান লাভ করা সম্ভব নয়। তাকে অবশ্যই প্রতীক্ষা করতে হবে। সেই রকম, আমরা কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করছি বলে, আমরা কৃষ্ণের দর্শন লাভ অচিরেই কামনা করতে পারি না। কৃষ্ণের সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমাদের শ্রদ্ধাবান হতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকা চাই। যেহেতু আমরা কৃষ্ণানুশীলনে ব্রতী হয়েছি, তখন নিশ্চয় আমরা কৃষ্ণের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার প্রাপ্ত হব। আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। আমাদের শুধু কৃষ্ণসেবা করে যেতে হবে, এবং যখন সময় আসবে, তখন আমরা কৃষ্ণের সাক্ষাৎকার লাভ করব, ঠিক কুন্তীদেবী যেমন তার সম্মুখে সশরীরে কৃষ্ণকে দর্শন করেছিলেন। এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

       ভগবদ্‌গীতায় প্রতিপন্ন হয়েছে যে, ঐকান্তিকভাবে যিনি কৃষ্ণভজনে ব্রতী তাঁকে কখনও কখনও সামান্য দুরাচারী হতে দেখা গেলেও তিনি সাধু বলে বিবেচিত হবেন। ভারতীয় অনুশীলনের মতো আমেরিকান ও ইউরোপীয় ভক্তদের কৃষ্ণার্চন যথাযথ না হলে, অথবা ভুল করলে, অনেক সময় তাদের সমালোচনা করা হয়। কিন্তু ভগবদ্‌গীতা অনুযায়ী তাদের সাধু রূপেই বিবেচনা করতে হবে। ঐকান্তিকভাবে ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে কৃষ্ণভজনে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে, তখন সামান্য ভুল হলেও, কৃষ্ণ আমাদের ক্ষমা করবেন। রূপ গোস্বামী বলেছেন তস্মাৎ কেনাপ্যুপায়েন মনঃ কৃষ্ণে নিবেশয়েৎ— প্রথমেই আমাদের মনকে কৃষ্ণের দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে, তখন কৃষ্ণভজনের অন্যান্য বিধিগুলি পালন আপনা থেকেই অনুসৃত হবে। ভগবৎ সেবার সূচনায় কৃষ্ণের চরণারবিন্দে মনোনিবেশের জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করা কর্তব্য, তখন অন্যান্য সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই অভ্রান্ত হবে।

       কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে মধুপতি বলে সম্বোধন করেছেন। কৃষ্ণের হাজার হাজার অপ্রাকৃত নাম রয়েছে। মধুপতি নাম দ্বারা কৃষ্ণ কর্তৃক মধু দানব বধের কথা প্রকাশ করা হচ্ছে। কৃষ্ণভক্তি একটি নদীর সঙ্গে তুলনীয়, কিন্তু সেটি একটি সাধারণ নদী নয়। কৃষ্ণভক্তি গঙ্গা নদীর সঙ্গে তুলনীয় ; গঙ্গা অতি পবিত্র নদী এবং তা কৃষ্ণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। কুন্তীদেবী কৃষ্ণের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করেছেন যে, গঙ্গা যেমন সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহমানা, কৃষ্ণের চরণারবিন্দে তাঁর আসক্তিও সেই রকম চিরন্তন অবিরাম ধারায় প্রবাহিত হোক। একেই অনন্যা ভক্তি বা শুদ্ধ ভক্তি বলে। এইভাবে কুন্তীদেবী প্রার্থনা করেছেন যে, কৃষ্ণের প্রতি তাঁর আসক্তি যেন অব্যাহতভাবে নিরন্তর প্রবাহিত হয়।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ২৬ ) কৃষ্ণমহিমার আকর্ষণ
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।