" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • শ্রীকৃষ্ণ সান্নিধ্যের সৌন্দর্য

    শ্লোক: ২১
    নেয়ং শোভিষ্যতে তত্র যথেদানীং গদাধর।
    ত্বৎপদৈরঙ্কিতা ভাতি স্বলক্ষণবিলক্ষিতৈঃ ॥ ২২ ॥
  • অনুবাদ : হে গদাধর ( শ্রীকৃষ্ণ ), আমাদের রাজ্য এখন তোমার পদাঙ্ক দ্বারা অঙ্কিত হয়ে সুশোভিত হয়েছে। কিন্তু তুমি আমাদের রাজ্য ছেড়ে চলে গেলে আর তেমন শোভা পাবে না। ( ভাঃ ১/৮/৩৯ )
  • তাৎপর্যঃ- শ্রীভগবানের পায়ের নীচে বিশেষ চিহ্ন আছে, অন্যদের সঙ্গে ভগবানের পার্থক্য নিরূপণ করে। পতাকা, বজ্র, অঙ্কুশ, ছত্র, পদ্ম, চক্রাদি চিহ্নগুলি ভগবানের পায়ের নীচে রয়েছে। ভগবান যেখানে লীলাবিলাস করেন, সেখানে কোমল ধূলায় এই চিহ্নগুলির ছাপ দেখা যায়। ভগবান যখন পাণ্ডবদের সঙ্গে তাদের রাজ্য হস্তিনাপুরে ছিলেন, তখন সেখানে এই চিহ্নগুলি দেখা গিয়েছিল, এভাবে পাণ্ডবদের রাজ্য হস্তিনাপুর ঐ শুভ চিহ্নদ্বারা সজ্জিত হয়েছিল। কুন্তীদেবী এই সব বিশিষ্ট লক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং কৃষ্ণের বিরহে ভাবী দুর্ভাগ্যের জন্য তিনি ভীত। বিখ্যাত নীতিশাস্ত্রবিৎ চাণক্য পণ্ডিতের শ্লোকের মধ্যে এটি এক সুন্দর শ্লোক-

    পৃথিবীভূষণং রাজা নারীণাং ভূষণং পতিঃ।
    শর্বরীভূষণং চন্দ্রো বিদ্যা সর্বস্য ভূষণম্ ॥

       সব কিছুই সুন্দর হয়ে উঠে যখন কেউ এগুলির সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে সম্বন্ধ যুক্ত হয়। যেমন, চন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার ফলে আকাশ সুন্দর হয়ে উঠে। আকাশ সর্বদাই আছে, কিন্তু পূর্ণিমার রাতে, চন্দ্র ও তারকারা যখন উজ্জ্বলভাবে কিরণ দান করে, তখন আকাশকে ভারী সুন্দর দেখায়। সেইরকম, উত্তম রাজা অথবা রাষ্ট্রপতিসহ উত্তম সরকার হলে, রাষ্ট্রকেও সর্বোত্তম মনে হয়। তখন সকলেই সুখী হয়, এবং সব কিছুই ভালভাবে পরিচালিত হয়। আবার, মেয়েদের দেখতে সুন্দর হলেও, পতিসহ নারীদের বিশেষভাবে সুন্দর দেখায়। বিদ্যা সর্বস্য ভূষণম্ – কিন্তু কোন ব্যক্তি কুৎসিত হলেও যদি বিদ্বান হয়, সেটি তাঁর সৌন্দর্য। সেই রকম, কৃষ্ণের উপস্থিতিতে সব কিছুই সৌন্দর্যময় হয়ে উঠে।

       তাই কুন্তীদেবী মনে করেন, " কৃষ্ণ যতক্ষণ আমাদের সঙ্গে আছে, ততক্ষণ আমাদের রাজ্য ও আমাদের রাজধানী হস্তিনাপুর— সবই সুন্দর। কিন্তু কৃষ্ণের অবর্তমানে আমাদের রাজ্যের সমস্ত সৌন্দর্যই লুপ্ত হবে। ” কুন্তীদেবী বলেছেন, “ কৃষ্ণ, তুমি এখন আমাদের রাজ্যে পদচারণ করছ, তোমার পদাঙ্কে সব কিছুই সৌন্দর্যময় হয়ে উঠছে। আমাদের রাজ্যে অফুরন্ত জল ও ফল থাকায় সব কিছুই সুন্দর, কিন্তু তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে এই সৌন্দর্যও অন্তর্হিত হবে।

       এমন নয় যে, যখন কৃষ্ণ উপস্থিত ছিলেন এবং কুন্তীদেবী বলছিলেন, তখনই কেবল এটি প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে, সত্য সর্বদাই একই। আমাদের সভ্যতার অগ্রগতি সত্ত্বেও, যদি আমরা কৃষ্ণ অথবা কৃষ্ণভাবনাকে সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দুতে না আনি, তবে আমাদের সভ্যতা কখনই সৌন্দর্যময় হয়ে উঠবে না। কৃষ্ণানুশীলনের পূর্বে অনুশীলনকারীরা সুশ্রী ছিল, কিন্তু আজ তারা কৃষ্ণভাবনাময় হওয়ায় বিশেষ সুশ্রী হয়ে উঠেছে। এই জন্য দৈনিক পত্রিকাগুলি কৃষ্ণভক্তদের প্রায়ই উজ্জ্বল মুখবর্ণ ' বলে উল্লেখ করে। বিদেশের জনগণ ঐ দেশে কৃষ্ণভক্তদের সম্বন্ধে মন্তব্য করে বলে, " এই ছেলেমেয়েগুলি দেখতে কি আনন্দোজ্জ্বল ও সুন্দর হয়েছে।” বর্তমানে আমেরিকায় যুবসমাজ বিভ্রান্ত ও অসহায়, তাই তাদের বিষণ্ণ ও মলিন দেখায়। কেন ? কারণ তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট, তাদের জীবনে কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু বিষ্ণুজন বা কৃষ্ণভতদের অত্যন্ত সুশ্রী দেখায়, কেন না তাঁরা কৃষ্ণসান্নিধ্যে রয়েছে।

       এই জন্য পাণ্ডবদের রাজত্বকালে, পাঁচ হাজার বছর আগে যা সত্য ছিল, আজও তা সত্য। কৃষ্ণ যেখানে কেন্দ্রবিন্দু সেখানে সব কিছুই সুন্দর। কৃষ্ণকে সব সময়ই কেন্দ্রবিন্দু করা যায়। কৃষ্ণ সর্বদাই রয়েছেন এবং আমাদের শুধু তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে, “ হে ভগবান, আপনি অনুগ্রহ করে আসুন এবং কেন্দ্রে অবস্থান করুন।” ব্যস, তা হলেই সব কিছু ঠিক। পূর্বের মতো আবার সেই দৃষ্টান্ত দিয়ে আমি বলছি যে, শূন্যের কোন মূল্য নেই, কিন্তু আমরা সংখ্যা ১’কে ' o ' শুন্যের পূর্বে স্থাপন করি, তখন শূন্য দশে পরিণত হয়। সুতরাং যে যা-ই করুন, তাতে বিরত হওয়ার দরকার নেই। আমরা কখনও বলি না, " সব রকম জড় কর্ম থেকে বিরত হোন। " সব কিছুতে শুধু কৃষ্ণকে যুক্ত করতে হবে।

       অবশ্যই, কৃষ্ণানুশীলন বিরোধী সব কিছুই ত্যাগ করতে হবে। এমন নয় যে, যেহেতু আমরা জড় কর্ম ত্যাগ করিনি, তাই আমাদের আমিষাহার বর্জন করা উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই বর্জন করতে হবে, কেন না তা কৃষ্ণানুশীলনে উন্নতির প্রতিরোধক। পাপকর্ম অনুষ্ঠান করে, একই সময়ে কৃষ্ণভাবনায় অগ্রগতি সম্ভব নয়। কিন্তু কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, অহং তাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি আমার শরণাপন্ন হও, তা হলে সব পাপের কর্মফল থেকে মুক্ত করে, আমি তোমাদের উদ্ধার করব। ” জন্ম-জন্মান্তর থেকে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে আমরা প্রত্যেকেই পাপকর্ম করে চলেছি। আমি জেনেশুনে একটি পশু হত্যা করতে পারি, এবং নিঃসন্দেহে সেটি পাপকর্ম, কিন্তু অজ্ঞাতভাবে এই কাজ করলেও সেটি পাপকর্ম। রাস্তায় হাঁটার সময় অজ্ঞাতভাবে আমরা কত পিঁপড়েকে হত্যা করি, এবং আমাদের অন্যান্য কাজের মাধ্যমে রান্নার কাজে, জলপানের সময়, শীল-নোড়ায় মশলা পেষণের সময় আমরা কত জীব হত্যা করি। আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে ঐকান্তিকভাবে কৃষ্ণানুশীলন না করলে, অজ্ঞাতভাবে পাপকর্মের ফল আমাদের ভোগ করতে হবে।

       অজ্ঞাতবশত একটি শিশু আগুনে হাত দিলে, তার অর্থ এই নয় যে আগুন তাকে ক্ষমা করবে, তাকে পুড়বে না। না। প্রকৃতির নিয়ম খুব কঠিন, তা এমনই কঠোর যে, ক্ষমার কোন প্রশ্নই উঠে না। এমন কি সাধারণ আইনেও অজ্ঞতার ক্ষমা নেই। আমি যদি বিচারালয়ে গিয়ে বলি যে, “ আমি জানতাম না যে এই কাজটি অপরাধজনক। " এই অজুহাত দেখালেই যে আমরা ক্ষমা পাব, তা নয়। সেই রকম প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করার জন্য অজ্ঞতার ক্ষমা নেই। এই জন্য, আমরা যদি বাস্তবিক পাপময় জীবনের কর্মফল থেকে উদ্ধারলাভ করতে ইচ্ছা করি, তা হলে আমাদের অবশ্যই কৃষ্ণভাবনাময় হতে হবে, কেন না তখন কৃষ্ণ আমাদের পাপের কর্মফল থেকে মুক্ত করবেন। তাই শাস্ত্রনির্দেশ হচ্ছে, কীৰ্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ-- আমাদের সর্বদাই হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ৷ কীর্তন করা উচিত। তা হলে কৃষ্ণ আমাদের উদ্ধার করবেন।

       কৃষ্ণকে সর্বদাই আমাদের মনের মধ্যে রাখতে হবে, কেন না শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সূর্যের মতো। এই হচ্ছে আমাদের ভগবৎ-দর্শন পত্রিকার আদর্শবাণী

    কৃষ্ণ – সূর্যসম ; মায়া হয় অন্ধকার।
    যাঁহা কৃষ্ণ, তাহা নাহি মায়ার অধিকার
    ( চৈঃচঃ মধ্য ২২/৩১ )

       শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছে জ্যোতির্ময় সূর্যের মতো, আর মায়া বা অজ্ঞান হচ্ছে ঠিক অন্ধকারের মতো। সূর্যের উপস্থিতিতে অন্ধকার থাকতে পারে না। এই জন্য সব সময় কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করলে, আমরা অজ্ঞান অন্ধকার দ্বারা প্রভাবিত হব না; পক্ষান্তরে, আমরা উজ্জ্বল কৃষ্ণালোকে খুব নিরাপদে সর্বদা চলাফেরা করতে পারব। তাই কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে সর্বদাই তাঁর সঙ্গে ও পাণ্ডবদের সঙ্গে থাকার জন্য প্রার্থনা করছেন।

       বস্তুত কৃষ্ণ যেমন কখনও বৃন্দাবন ত্যাগ করেন না, ঠিক তেমনই তিনি পাণ্ডবদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন না। বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে,-- বৃন্দাবনং পরিতাজ্য ন পদমেকং গচ্ছতি। --শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন পরিত্যাগ করে কখনও এক পদক্ষেপও বাইরে যান না। তিনি বৃন্দাবনের প্রতি এতই আসক্ত। তা হলে, আমরা তো দেখি যে, কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে বহু দূর হস্তিনাপুরে গিয়ে বহু বছর প্রত্যাবর্তন করেননি। কিভাবে তা সম্ভব ? বস্তুত, কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করেন নি, কেন না, কৃষ্ণ চলে গেলে, সমস্ত ব্রজবাসীরা কৃষ্ণের কথা সর্বদাই ভাবছিল আর ক্রন্দন করছিল। মা যশোদা, নন্দ মহারাজ, রাধারাণী, সকল গোপীরা, গাভী, গোবৎস, এবং গোপবালকদের একমাত্র কাজ কৃষ্ণের চিন্তা করা ও ক্রন্দন করা। এইভাবে তারা সকলে কৃষ্ণের উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন, কারণ কৃষ্ণবিরহে তাঁর উপস্থিতি আরও গভীরভাবে অনুভব করা যায়। এটিই হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা – বিপ্রলম্ভে কৃষ্ণকে ভালবাসা। শূন্যায়িং জগৎ সর্বং গোবিন্দবিরহেণ মে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অনুভব করতেন, “ গোবিন্দ বিরহে, কৃষ্ণবিরহে জগৎ শূন্য। " সব কিছুই ছিল শূন্য, শুধু কৃষ্ণভাবনামৃত অস্তিত্বশীল।

       যখন সবকিছুই শূন্যবোধ করে, কৃষ্ণভাবনাকে একমাত্র বলে হৃদয়ঙ্গম করব, তখন আমরা পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত হব। এই জন্যই গোপীরা কৃষ্ণভাবনায় এত উন্নত। এই পরম সিদ্ধি প্রাপ্তির ফলে, তাঁরা এক মুহুর্তের জন্যও কৃষ্ণকে ভুলতে পারেননি। কৃষ্ণ যখন তাঁর গাভী ও গোবৎসদের নিয়ে বনে গোচারণে যেতেন, তখন ব্রজগোপিকাদের মন চঞ্চল হয়ে উঠত, “ ওঃ, কৃষ্ণ নগ্নপদে গোচারণ করছে। পথে কত কঠিন পাথর ও কাঁটা রয়েছে এবং সেগুলি নিশ্চয়ই কৃষ্ণের চরণকমলে বিঁধবে। কৃষ্ণের চরণকমল এতই কোমল যে, যখন তা আমাদের বক্ষে স্থাপন করি, তখন আমরা আমাদের বক্ষকেও কঠিন বলে মনে করি। " এভাবে এই রকম কৃষ্ণভাবনায় আবিষ্টচিত হয়ে গোপীরা ক্রন্দন করতেন। সন্ধ্যায় গাভী ও গোবৎসদের নিয়ে ঘরে ফেরার সময় কৃষ্ণকে দর্শনের জন্য গোপীরা এতই ব্যাকুল হয়ে উঠতো যে তাঁরা তাঁকে দেখার জন্য প্রত্যাবর্তনের পথে সকলে কৃষ্ণের জন্য অধীরভাবে প্রতীক্ষা করতেন। এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার অমৃত। ভক্ত যখন আকুলভাবে কৃষ্ণভাবনায় নিবিষ্টচিত্ত, তখন কৃষ্ণভক্তের কাছ থেকে কৃষ্ণ দূরে থাকতে পারেন না। কৃষ্ণের অনুপস্থিতির কথা ভেবে কুন্তীদেবী খুবই উৎকণ্ঠিত, কিন্তু কৃষ্ণের দৈহিক অনুপস্থিতির বাস্তব ফল হচ্ছে এই যে, তিনি আরও নিবিড়ভাবে ভক্তের মনে আবির্ভূত হন। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর জীবনলীলা দ্বারা বিপ্রলম্ভ-সেবা বা বিরহে কৃষ্ণসেবার শিক্ষা দেন। বর্ষার ধারার মতো মহাপ্রভুর চোখ থেকে অবিশ্রান্তভাবে অশ্রুধারা প্রবাহিত হত, কেন না কৃষ্ণবিরহে তিনি সব কিছুই শূন্য বোধ করতেন।

       কৃষ্ণ-সান্নিধ্যের দুটি সোপান। কৃষ্ণের সঙ্গে স্বয়ং উপস্থিত থাকা, কৃষ্ণের সঙ্গে স্বয়ং মিলিত হওয়া, কৃষ্ণের সঙ্গে স্বয়ং কথা বলা, এবং ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করাকে সম্ভোগ বলে। অন্য পন্থায়ও কৃষ্ণসান্নিধ্য হয় সেটি হচ্ছে কৃষ্ণবিরহে এবং এই পন্থাকে বিপ্রলম্ভ বলে। উভয় পন্থায় ভগবদ্ভক্ত কৃষ্ণ-সান্নিধ্যের কৃপা লাভ করতে পারেন।

       এখন আমরা ভবসংসারে আবদ্ধ রয়েছি, তাই আমরা প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণকে দেখতে পাই না। তবু, পরোক্ষভাবে আমরা কৃষ্ণের দর্শন লাভ করতে পারি। যেমন, কৃষ্ণভাবনায় উন্নত ভক্ত প্রশান্ত মহাসাগর দেখামাত্র কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারেন। একে বলা হয় ধ্যান। কেউ ভাবতে পারে, " এই প্রশান্ত মহাসাগর হচ্ছে এক বিশাল জলরাশি, তাতে বিরাট বিরাট অসংখ্য ঢেউ রয়েছে, কিন্তু জল থেকে আমি সামান্য দূরে থাকলেও আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। মহাসাগরের ক্ষমতা যতই হোক এবং তার ঢেউ যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, আমি নিশ্চিত যে, মহাসাগর কখনও তার সীমা অতিক্রম করবে না। কিভাবে এটি হচ্ছে। কৃষ্ণের আদেশে হচ্ছে। মহাসাগরের প্রতি কৃষ্ণের আদেশ, তুমি অতি বিশাল ও ক্ষমতাবন হতে পার, কিন্তু তুমি এই সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। এইভাবে অচিরেই কৃষ্ণস্মরণ অথবা ভগবৎ-স্মরণ করা যায়। ভগবান এতই প্রতাপশালী যে, এমন কি প্রশান্ত মহাসাগরও তাঁর আদেশ পালন করে। এভাবে কৃষ্ণচিন্তা করা যায়। এবং সেটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা।

       সেই রকম, সূর্যোদয় দর্শন করে তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণস্মরণ করা যায়, কেন না ভগবদ্গীতায় ( ৭/৮ ) বলেছেন, প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ— " আমি সূর্য ও চন্দ্রের প্রভা। " কেউ যদি কৃষ্ণকে দেখতে চায়, তবে সে সূর্যালোকে তাঁকে দেখতে পারে। আমাদের বিজ্ঞানীরা সূর্য সৃষ্টি করেনি; তারা বাক্‌চাতুর্য প্রকাশ করে বলতে পারে, সূর্যের বাস্তব পরিচয় জানা তাদের ক্ষমতার অতীত। কিন্তু বেদান্ত সূত্রে ( ১/১/৩ ) বলা হয়েছে, শাস্ত্রযোনিত্বাৎ বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে সব কিছু সম্বন্ধে জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়। যেমন, বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সূর্যের স্বরূপ জানা যায়, কেন না সূর্যের বিষয় ব্রহ্মসংহিতায় ( ৫/৫২ ) বর্ণনা করা হয়েছে—

    যচ্চক্ষুরেষ সবিতা সকলগ্রহাণাং
    রাজা সমস্তসুরমূর্তিরশেষতেজাঃ ।
    যস্যাজ্ঞয়া ভ্রমতি সংভৃতকালচক্রো
    গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥

       এই শ্লোকে সূর্যকে সকল গ্রহের চক্ষু বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বিষয়ে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে এই কথাটি সত্য বলে হৃদয়ঙ্গম করা যায়, কেন না সূর্যোদয়ের আগে, রাত্রে কেউই দেখতে পায় না। সূর্যকে ভগবানের চক্ষু বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্য হচ্ছে ভগবানের একটি চোখ আর তাঁর অপর চোখটি হচ্ছে চন্দ্র। তাই, উপনিষদে বলা হয়েছে যে, যখন কৃষ্ণ কেবল দেখেন, তখনই আমরা দেখতে পারি। সূর্যকে অশেষতেজাঃ অর্থাৎ, অসীম তেজসম্পন্ন বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। আর সূর্যের কাজ কি ? যস্যাজ্ঞয়া ভ্রমতি সংভৃতকালচক্রঃ। সূর্যের কক্ষপথ রয়েছে। ভগবান সুর্যকে আদেশ করেছেন, " তুমি শুধু এই কক্ষপথেই পরিভ্রমণ কর, অন্য কোথাও ভ্রমণ করো না। বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে যে সূর্য একপাশে সামান্যতম হেলে পড়লে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে উঠবে, আর অন্য দিকে সূর্য সামান্যতম হেলে পড়লে সমগ্র বিশ্ব হিমায়িত হবে। কিন্তু কৃষ্ণের আদেশে সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথ থেকে সামান্যতমও হেলে পড়ে নি। সূর্য সর্বদাই নির্ভুল সময়ে উদিত হয়। কিন্তু কেন ? নিশ্চয় কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে, কোন আনুগত্য আছে, কোন আদেশ আছে। তাই ব্রহ্ম-সংহিতায় বলা হয়েছে, যস্যাজ্ঞয়া ভ্রমতি সংভৃতকালচক্রো গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥ " যাঁর আদেশে সূর্য তার নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে, সেই আদি পুরুষকে আমি ভজনা করি। তিনিই সমুদ্র, চন্দ্র এবং সূর্যকেও আদেশ দেন। সব কিছুই তাঁর আদেশে চলে। ” তাই ভগবৎ-উপলব্ধি কঠিন কোথায় ? ভগবানকে অনুভব করা আদৌ কঠিন নয়। যাঁর মস্তিষ্ক বিষ্ঠাপূর্ণ নয়, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, প্রতি পদক্ষেপে তিনি ভগবানকে অনুভব করতে পারেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—

    বসোহহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ
    প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু ॥

       “ হে কৌন্তেয় ( অর্জুন ), আমিই জলের স্বাদ, সূর্য ও চন্দ্রের আলো এবং বৈদিক, মন্ত্রের ওঁ অক্ষর, আমি আকাশের শব্দ এবং মানুষের ক্ষমতা। " ( গীতা ৭/৮ ) তা হলে জনসাধারণ বলে কেন, “ আমি ভগবানকে দেখিনি ? " ভগবৎ-নির্দেশ অনুযায়ী তারা ভগবৎ-দর্শন করে না কেন ? তারা মনগড়া পন্থা তৈরি করে কেন ? নিজস্ব পন্থায়, কেউ ভগবানকে দর্শন করতে পারে না। তা সম্ভব নয়। কেউ ওভাবে চেষ্টা করলে, সে সর্বদাই অন্ধ হয়েই থাকবে। আজকাল তথাকথিত বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা তাদের নিজস্ব পন্থায় ভগবৎ-দর্শনের প্রয়াস করছে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। ভগবৎ নির্দিষ্ট পন্থায় ভগবৎ-দর্শন করতে হবে। তখন ভগবানকে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। ভারতের রাষ্ট্রপতির দর্শন লাভের ইচ্ছা করলে, নিজ পন্থায় আমি কি তার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারব ? যদি তা সম্ভব না হয়, তা হলে আমার নিজস্ব পন্থায় ভগবৎ-দর্শন কিভাবে আশা করা সম্ভব ? এই রকম মনোভাব চরম নির্বুদ্ধিতা নয় কি ? এমন কি এক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত একজন সাধারণ ব্যক্তিকেই আমি নিজস্ব পন্থায় সাক্ষাৎ করতে অক্ষম ; তাঁর সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে উপযুক্ত অন্যান্য আয়োজন করতে হয়। কিন্তু সাধারণ ব্যক্তিদের চেয়ে ভগবান অনেক মহান হলেও, মূর্খরা এই মতবাদ সমর্থন করে যে, নিজ নিজ পন্থায় সকলেই ভগবৎ-দর্শন করতে পারে। তাদের মতবাদ হচ্ছে “ যত মতই আপনি উদ্ধার করুন। না কেন, সবই ঠিক। ” এখানেই মুর্খতা। এখানেই অজ্ঞতা। জগৎটাই মূর্খ ও নির্বোধে পরিপূর্ণ, তাই ভগবৎ-চেতনা বা কৃষ্ণভাবনা এক অস্পষ্ট ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে। নয়তো, কুন্তীদেবীর অভীষ্ট কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভের জন্য কেউ যদি ভগবৎ-দর্শন কামনা করে, কেউ যদি ভগবৎ-সঙ্গ ইচ্ছা করে, তিনি নিরন্তরই ভগবান শ্রীহরিকে হৃদয়সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে পারেন।

       মহারাজ অম্বরীষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত করতে হবে। স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োর্বচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে ( ভাঃ ৯/৪/১৮ )। মন সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কর্মের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায়, প্রথমেই আমাদের মনকে কৃষ্ণের পদারবিন্দে নিবিষ্ট করা কর্তব্য। মন অন্যমনস্ক হওয়ার ফলে, চোখ থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখতে অক্ষম, কান থাকা সত্ত্বেও আমরা শুনতে পারি না। তাই মনকে একাদশ ইন্দ্রিয় বলে গণ্য করা হয়। দশটি ইন্দ্রিয় আছে পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, এবং এই ইন্দ্রিয়গুলির কেন্দ্র হচ্ছে মন। ভগবদ্গীতায় ( ৩/৪২ ) বলা হয়েছে—

    ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
    মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ ॥

       এই শ্লোকে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন যে, আমরা ইন্দ্রিয়গুলির বিশেষ প্রাধান্য বিবেচনা করলেও ইন্দ্রিয়গুলির চেয়ে শ্রেয় হচ্ছে মন, মন অপেক্ষা শ্রেয় হচ্ছে বুদ্ধি আর বুদ্ধির চেয়েও শ্রেয় হচ্ছে আত্মা।

       আমরা মানসিক গতিকেই যদি হৃদয়ঙ্গম করতে অসমর্থ হই, তাহলে আত্মার অস্তিত্ব উপলব্ধি করব কিভাবে ? মনের অতীত হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা এবং নিরস জ্ঞানালোচনা পন্থায় চরম বুদ্ধি স্তরে উপনীত হওয়া যায়। কিন্তু আত্মোপলব্ধি ও ভগবৎ-উপলব্ধির জন্য বুদ্ধির স্তরকে অতিক্রম করতে হবে। সব কিছুই জানা সম্ভব, কিন্তু নির্ভুল বৈধ পন্থায় আমাদের জ্ঞানলাভ করতে হবে। তাই বৈদিক নির্দেশ হচ্ছে-

    তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ ৷
    সমিৎপাণিঃ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্॥

       বস্তুত ঐকান্তিকভাবে পরব্রহ্ম জ্ঞানলাভে অভিলাষীকে অবশ্যই সদ্গুরুর চরণাশ্রয় করতে হবে ( মুণ্ডক উপঃ ১ / ২ / ১২ )।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ২৩ ) প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।