" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • আমাদের জীবনের সার্থকতা কোথায় ?

    শ্লোক: ২১
    কে বয়ং নামরূপাভ্যাং যদুভিঃ সহ পাণ্ডবাঃ।
    ভবতোহদর্শনং যৰ্হি হৃষীকাণামিবেশিতুঃ ৷৷ ২১ ৷৷
  • অনুবাদ : চেতন আত্মার অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিশেষ দেহের নাম ও যশের যেমন অবসান হয়, ঠিক সেই রকম, তোমার কৃপাদৃষ্টির অভাবে পাণ্ডব ও যাদবরা সহ আমাদের সমস্ত যশ ও গৌরবময় কার্যাবলী, সমস্তই মুহূর্তে নিঃশেষ হবে। ( ভাঃ ১/৮/৩৮ )
  • তাৎপর্যঃ- শ্রীকৃষ্ণই যে পাণ্ডবদের অস্তিত্বের একমাত্র কারণ, কুন্তীদেবী এই বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পরিচালনায় এবং নাম ও যশে পাণ্ডবরা নিঃসন্দেহে সুপ্রতিষ্ঠিত। যাদবরাও নিঃসংশয়ে তাঁদের মহান মিত্রপক্ষ, কিন্তু কৃষ্ণের নেতৃত্ব ছাড়া তারা সবাই প্রাণহীন, ঠিক যেমন চেতনার অভাবে দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে। ভগবানের অনুকম্পা ছাড়া কারও মান, ক্ষমতা ও যশের জন্য গর্ব অনুভব করা উচিত নয়। জীব মাত্রই সর্বদা নির্ভরশীল এবং অন্তিম নির্ভরযোগ্য বিষয়বস্তু হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। তাই আমাদের জড় বিদ্যার উন্নতির মাধ্যমে জড় সম্পদ বিরোধী বস্তু উদ্ভাবন করতে পারি, কিন্তু ভগবানের নেতৃত্বের অভাবে সকল উদ্ভাবিত উপকরণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানগুলি যতই কঠোর হোক না।

       একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু হলে, তিনি যত বড়ই বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ বা দার্শনিক হোন না কেন, তার নাম ও রূপের গুরুত্ব লুপ্ত হয়। আমাদের জীবন থাকাকালীন, আমাদের নাম, রূপ ও কার্যাবলীর গুরুত্ব থাকে, কিন্তু আমাদের জীবন নিঃশেষ হওয়া মাত্র আমাদের দেহ এক জড়পিণ্ডে মাত্র পরিণত হয়। জীবিত থাকার সময় কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির অনেক দেহরক্ষী থাকে, যাতে কেউ তাঁর কাছে যেতে বা তাঁকে স্পর্শ করতে না পারে, কিন্তু তাঁর মৃত্যু হলে এবং যখন তাঁর দেহ মেঝেতে শায়িত থাকে, তখন তাঁর মুখে কেউ লাথি মারলেও, কেউ তাতে ভ্রূক্ষেপ করবে না। আত্মা অন্তর্হিত হলে, বিশিষ্ট ব্যক্তির দেহের কোন গুরুত্বই থাকে না। কিন্তু আত্মার স্বরূপ কি ? আত্মা হচ্ছে কৃষ্ণের শক্তি, তাই আত্মা হচ্ছে কৃষ্ণের অংশ-বিশেষ। এই জন্য, কৃষ্ণশক্তি অন্তর্হিত হলে, অর্থাৎ যেখানে কৃষ্ণ অনুপস্থিত, সেখানে দেহের কোনই গুরুত্ব নেই।

       কৃষ্ণশক্তি ও স্বয়ং কৃষ্ণ ভিন্ন নয় ( শক্তিশক্তিমতোরভেদঃ )। যেমন, সূর্য হচ্ছে- শক্তিমান, সূর্যালোক হচ্ছে শক্তি। যতদিন সূর্যালোক আছে, ততদিন সূর্যও আছে এবং সূর্য না থাকলে সূর্যালোকও থাকত না। শক্তি ও শক্তিমান উভয়ই থাকা চাই। মায়াবাদী দার্শনিকরা শক্তিমানকে স্বীকার না করলেও নির্বিশেষ শক্তিকে স্বীকার করে ; শক্তি ও শক্তিমান উভয়কেই আমাদের স্বীকার করতে হবে।

       শক্তি যখন ক্রিয়াবতী, তখন শক্তিমান দূরে থাকে, যেমন সূর্য যখন দূরে থাকে তখন সূর্যালোক সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়। সেই রকম, বিশ্বচরাচর ব্যাপী শক্তি ক্রিয়াশীল। নিখিল সৃষ্টি, মাটি, জল, বায়ু আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার দিয়ে তৈরি। এই আটটি জড় উপাদান হচ্ছে বিভিন্ন জড়াশক্তি ( মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ) এবং আমরা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারি যে, এই শক্তিগুলির অন্তরালে এক শক্তিমান উৎস নিশ্চয় রয়েছে। যেমন, আমরা বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করছি, কিন্তু এই শক্তির অন্তরালে শক্তিকক্ষ ( Power House ) এবং ইঞ্জিনিয়ার আছে। মূর্খরা তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। তারা শুধু নিখিল সৃষ্টির শক্তিকে দর্শন করে, কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারে না যে, এই শক্তির অন্তরালে শক্তির উৎস শক্তিমান আছেন। এই জন্যই কৃষ্ণ অবতরণ করেন এবং বলেন, “ আমিই শক্তিমান। আমিই সকল শক্তির উৎস। " কৃষ্ণ স্বয়ং ব্যক্তিগতভাবে অবতরণ করেন, কারণ কৃষ্ণকে দর্শন করার মতো আমাদের দৃষ্টিশক্তি নেই এবং আমরা কৃষ্ণকে উপলব্ধিও করতে অক্ষম। ভগবানের রূপের ধ্যান করার সময়, আমরা মনে করি যে, যেহেতু ভগবান কোটি কোটি বছর আগে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি অবশ্যই একজন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তি হবেন। তাই ভগবান ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সম্মুখীন হন, যাতে আমরা তাঁকে দেখতে পারি। এটিই ভগবানের কৃপা। ভগবদ্‌গীতায় ( ৪/৭ ) ভগবান বলেছেন—

    যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
    অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥

       “ হে ভারত, যখনই ও যেখানেই ধর্মের গ্লানি হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, সেই সময় আমি জগতে অবতরণ করি। "

       ভগবান ব্যক্তিগতভাবে ইহলোকে আগমন করেন, তিনি ভগবদ্‌গীতাদি উপদেশ দান করে যান, এবং তিনি তাঁর ভক্তদেরও রেখে যান যাতে তারা এই জগতে ভগবৎ-তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারেন, কিন্তু তবুও আমরা এমনই জেদী যে, ভগবানকে স্বীকার করি না। এখানেই আমাদের নির্বুদ্ধিতা। যারা ভগবানকে অস্বীকার করে, ভগবদ্‌গীতায় তাদের মূঢ়াঃ অর্থাৎ নির্বোধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

       ভগবান রয়েছেন এবং ভগবানের শক্তিও রয়েছে। তাই, আমরা ভগবানকে দেখতে না পেলেও, অন্তত তাঁর শক্তিকে দেখতে পারি। আমরা হয়তো উৎপাদন শক্তির মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন কক্ষ ও বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্নকারী ইঞ্জিনিয়ারকে নাও দেখতে পারি, কিন্তু আমরা বৈদ্যুতিক শক্তি নানা কাজে ব্যবহার করে থাকি। এই জন্য বৈদ্যুতিক শক্তির উৎস সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধিৎসু হওয়া উচিত। এখানেই আমাদের বুদ্ধিমত্তা। এভাবে অনুসন্ধানে আগ্রহী হলে একদিন বৈদ্যুতিক উৎপাদন কক্ষের ( Power House ) সন্ধান পাওয়া যাবে। সেই রকম, কেউ যদি আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করে কে বৈদ্যুতিক উৎপাদন কক্ষের ( Power House ) পরিচালক, তখন সে একজন ব্যক্তিকে খুঁজে পাবে। বৈদ্যুতিক শক্তি যদি নির্বিশেষ হয়, এমন কি বৈদ্যুতিক শক্তির উৎপাদন কক্ষ নির্বিশেষ হলেও, এই সবের অন্তরালে রয়েছেন একজন ব্যক্তি। ঠিক সেই রকম, পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন একজন ব্যক্তি। এটি একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত। ভগবান কিভাবে নির্বিশেষ হবেন ? নির্বিশেষ তত্ত্ব বুদ্ধিমত্তাহীন। আমরা অদ্ভুত অদ্ভুত নানা যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন করেছি, কিন্তু যন্ত্রগুলির বুদ্ধি নেই। যন্ত্রচালকের বুদ্ধি থাকে। তাই কৃষ্ণ বলেছেন, ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সুয়তে সচরাচরম্— " নিখিল বিশ্বচরাচরে যে অদ্ভুত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায় প্রদর্শিত যে শক্তি তুমি দেখছ, কিন্তু এই বলে মনে করো না তারা স্বতন্ত্রভাবে ক্রিয়াশীল। না, তাদের পশ্চাতে রয়েছি আমি। ” কৃষ্ণ আরও বলেছেন--

    ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা।
    মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ॥

    “ আমি আমার অব্যক্ত মূর্তিতে সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্ত। নিখিল জীব আমাতে অবস্থিত হলেও, আমি তাদের মধ্যে অবস্থিত নই। ” ( গীঃ ৯/৪ ) যা অব্যক্ত, তারও মূর্তি আছে। যেমন, আকাশ অব্যক্ত হলেও ব্রহ্মাণ্ডের মতো গোলাকার আকৃতি আছে। সমুদ্রের কাছে গেলেও বৃহৎ বৃত্তাকার এক আকৃতি আমরা দেখতে পাব। রূপ ছাড়া কিছুই নেই। সব কিছুর আকৃতি আছে, এমন কি নির্বিশেষ বলে যা কিছু অনুমান করা হয়, তাও সাকার। তাই সব কিছুই শূন্য বা নির্বিশেষ, এই ধারণা মূর্খতারই নামান্তর। তথাকথিত শূন্য বা নির্বিশেষ রূপের অন্তরালে রয়েছেন পরম রূপ-কৃষ্ণ। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ। ঈশ্বর শব্দের অর্থ হচ্ছে নিয়ন্তা। প্রকৃতি আত্মনিয়ন্তা নয়; যথার্থ নিয়ন্তা হচ্ছেন কৃষ্ণ। ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা। ব্রহ্মসংহিতায় ( ৫/88 ) বলা হয়েছে যে, জড়া প্রকৃতির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গাদেবী কৃষ্ণ বা গোবিন্দের নির্দেশে কর্ম করছেন। তিনি কাজ করছেন কিভাবে ? ঠিক ছায়ার মতো। আমাদের হাতের নীচেই হাতের ছায়া, এবং আমাদের হাত নড়লে, ছায়াও নড়ে। নিখিল প্রকাশের অন্তরালে গতি রয়েছে। আমি কখনও কখনও রেলের কামরা সরানোর দৃষ্টান্ত দিয়েছি। ইঞ্জিন গতিদান করে একটি বগিকে ধাক্কা দেয় ; সেই বগিটি আবার তার পরবর্তী বগিটিকে ধাক্কা দেয়, সেই বগিটি আবার তার পরবর্তী বগিটিকে ধাক্কা দেয়। এভাবে চলে। সেই রকম বিশ্বচরাচরে কে গতি দান করল ? সেই মূল গতি দানকারী হচ্ছেন কৃষ্ণ।

       এখন কুন্তীদেবী বলছেন, “ আমাদের এখন অনেক খ্যাতি, এবং জনসাধারণ আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। কেন ? কারণ তুমি হচ্ছ আমাদের সুহৃৎ। "-কৃষ্ণ পাণ্ডবদের, বিশেষত অর্জুনের সখা ছিলেন, তাই অর্জুন ছিলেন এক মহান দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। কিন্তু কুন্তীদেবী জানতেন, " লোকেরা বলে, ওঃ, পাণ্ডবরা কত মহান যোদ্ধা ও বীর ’, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার পুত্র পাণ্ডবদের মূল্য কতটুকু ? ঠিক সেই রকম, কৃষ্ণ যদুবংশে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তো যদুবংশ এত যশস্বী। কিন্তু কুন্তীদেবী বলেছেন, কে বয়ন্, " আমরা কে ? আমাদের মূল্য কতটুকু? কে বয়ং নামরূপাভ্যাম্ " আমাদের নাম আছে, আমাদের আকার রয়েছে, কিন্তু তুমি ছাড়া এই সবই অর্থহীন। এই সবের কোন মূল্য নেই। ”

       জনসাধারণ এই কথা উপলব্ধি করতে অক্ষম। জনসাধারণ তাদের সুন্দর দেহ, তাদের সুন্দর নাম নিয়েই গর্ব অনুভব করে। তাদের মনোভাব হচ্ছে, আমি আমেরিকান, " " আমি ভারতীয় ", " আমি জার্মান ", ইত্যাদি। কিন্তু এই সব মনোভাবের মূল্য কতটুকু ? এগুলি সবই অর্থহীন আজেবাজে নাম ও আকার ছাড়া আর কিছুই নয়।

       আমরা যদি কৃষ্ণকে বাদ দিই, তা হলে সব কিছুই শুন্যে পরিণত হয়। এটি বাস্তব সত্য, কিন্তু জনসাধারণ এমনই নির্বোধ যে, তারা এই সত্য কথাটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। কিন্তু কে-ই বা তা অস্বীকার করতে পারে ? আমেরিকান দেহই হোক, আর ভারতীয় দেহই হোক, সুন্দর নাম থাকলেও চেতনার অভাবে তার মূল্য কতটুকু ? তার কোন মূল্যই নেই। তাই শাস্ত্রে উল্লেখ আছে-

    ভগবভক্তিহীনস্য জাতিঃ শাস্ত্রং জপস্তপঃ।
    অপ্রাণস্যেব দেহস্য মণ্ডনং লোকরঞ্জনম্॥

       “ ভগবভক্তিহীন ব্যক্তির উচ্চবংশ বা জাতিতে জন্ম, তার শাস্ত্রজ্ঞান, তার জপ, তপ ও মন্ত্রোচ্চারণ, সবই মৃতদেহের অলঙ্কার মাত্র। তা শুধু জনগণের তথাকথিত আনন্দ দান করে মাত্র। " ( হরিভক্তি-সুধোদয় ৩/১১ )।

       আমাদের চেতনা আছে, কিন্তু এই চেতনার প্রকৃতি কি ? আমাদের এই চেতনা হচ্ছে কৃষ্ণচেতনা। আমরা কৃষ্ণকে বিস্মৃত হয়েছি, তাই আমরা শুধু বলি ' চেতনা ', কিন্তু যথার্থ ' চেতনার অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণচেতনা, কেন না কৃষ্ণ ছাড়া আমাদের চেতনা থাকতে পারে না। সূর্য ছাড়া সূর্যালোকের অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব ? তাই আমরা ' সূর্যালোক ' বলি, শুধু ' আলোক ' বলি না। সেই রকম, ' চেতনার ' অর্থ কৃষ্ণচেতনা। এটি হৃদয়ঙ্গমের জন্য একটু বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন, কিন্তু কুন্তীদেবীর মতো মহীয়সী ভগবদ্ভক্তের সেই বুদ্ধি ও জ্ঞান রয়েছে। তাই কুন্তীদেবী বলেছেন, " পাণ্ডব ও যাদবরা সত্যি মহান, কিন্তু বস্তুত আমাদের মূল্য কতটুকু ? "

       শ্রীকৃষ্ণ বিদায় জানাতে এলে কুন্তীদেবী ব্যথিত চিত্তে বলেন, “ তুমি চলে গেলে তোমাকে আমরা দেখতে পাব না। " তখন তোমাকে ছাড়া আমাদের নাম ও যশের মূল্য কতটুকু ? ভবতোহদর্শনং যর্হি হৃষীকাণামিবেশিতুঃ। কুন্তীদেবী উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, কৃষ্ণের বিরহে তাঁরা নিষ্প্রাণ ইন্দ্রিয়ের মতো হবেন। এই ভবসংসারে আমরা সকলেই ইন্দ্রিয়ভোগ কামনা করি, কিন্তু কৃষ্ণবিহীন অথবা কৃষ্ণভাবনা ব্যতীত ইন্দ্রিয়ভোগ সম্ভব নয়। হাত, পা সবল হলেও যখন চেতনা নেই, যখন কৃষ্ণচেতনা নেই, তখন আমরা সেগুলি ব্যবহার করতে পারি না। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানেন যে, কৃষ্ণসম্বন্ধহীন তার ইন্দ্রিয়ের কোনই মূল্য নেই। তাই, তিনি কৃষ্ণভক্তে পরিণত হন। কৃষ্ণভক্ত সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত করেন যে, কৃষ্ণ ও ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকায় যতক্ষণ ইন্দ্রিয়গুলি সক্রিয়, তখন কর্তব্য হচ্ছে সেগুলিকে কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করা। একেই ভক্তি বলে।

       আমি প্রায়ই একটি উদাহরণ দিয়ে থাকি। ধরা যাক, কোন জনসমাবেশে অন্যের পকেট থেকে পড়া একটি একশ টাকার নোট কেউ কুড়িয়ে পেল। সে টাকার নোটটি তুলে নিজের পকেটে রেখে দিলে সে চোর, কারণ টাকার মালিক সে নয়। একে ভোগ বা মিথ্যা উপভোগ বলে। তারপর অন্য কেউ ভাবতে পারে, " ওঃ টাকার নোটটি আমি স্পর্শ করব কেন ? এটি অন্যের টাকা। এটি ওখানে পড়ে থাক। আমার সঙ্গে ঐ টাকার কোন সম্পর্ক নেই। " একে ত্যাগ বলে। উভয় ক্ষেত্রেই নোটটা একশ টাকার, কিন্তু একজন তা ভোগ করার চেষ্টা করছে, পক্ষান্তরে অপরজন তা ত্যাগ করার প্রয়াসী। কিন্তু ভোগী ত্যাগী উভয়ই মূঢ়। ভোগীরা হচ্ছে কর্মী। তারা প্রকৃতির সম্পদকে আত্মসাৎ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। যেমন, বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির সম্পদকে আরও আত্মসাতের জন্য গবেষণা করছে। বস্তুত তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অপহরণ করা। পক্ষান্তরে, যারা অপহরণ কাজে অসমর্থ, সেই ত্যাগীদের জীবনদর্শন হচ্ছে — আঙ্গুর ফলগুলি টক ’ — “ ওঃ, এই জিনিসগুলি অর্থহীন। এগুলির কোনই প্রয়োজন নেই। " অধিকাংশ লোকই অবশ্য ভোগী, এর অর্থ হচ্ছে যে, তারা সব কিছুই ইন্দ্রিয়ভোগের জন্য ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু তবু এমন অনেকে আছে যারা ইন্দ্রিয়তর্পণে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন তারা বলে, " না, না, আমরা এগুলি চাই না। "

       ঐ উদাহরণ প্রসঙ্গে বলা যায় যে ব্যক্তি টাকার নোটটি দেখে, তা তুলে নিয়ে বলে, “ কেউ টাকাটি হারিয়ে ফেলেছে, তাকে খুঁজে বের করব " —তার কাজই যথাযথ ও শাস্ত্রসম্মত। টাকার নোটটি প্রকৃত মালিককে ফেরত দিয়ে সে যথার্থ সেবা করে। যে নিজের জন্য টাকাটি নেয় এবং যে সেই জায়গায় নোটটি ফেলে রেখে আসে, তারা দুজন কেউই সেবক নয়। সেই রকম, ভোগী ও ত্যাগী কেউই সেবক নয়। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত জানেন যে, কৃষ্ণই হচ্ছেন প্রকৃত মালিক, তাই সব কিছুই কৃষ্ণকে অর্পণ করা কর্তবা। এই হচ্ছে যথার্থ সেবা। সব কিছুরই মালিক হচ্ছেন কৃষ্ণ। আমাদের দেহের স্বরূপ কি ? এই দেহটি হচ্ছে মাটি, জল, আগুন, বায়ু এবং সূক্ষ্ম মনোবিদ্যাগত উপাদান — মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কারের সমন্বয়। কৃষ্ণ ঘোষণা করেছেন, " এই আটটি উপাদানই আমার ভিন্না শক্তি। তা হলে এই জড় দেহ ও মন আমাদের হচ্ছে কিভাবে ? এই জড় দেহকে আমার বলে দাবি করা সত্ত্বেও, এই দেহ কিভাবে কাজ করছে তা জানি না। একজন ভাড়াটে ঘরের ভাড়া দিয়ে ঘর অধিকার করে তা ভোগ করলেও, সে ঘরের তাপব্যবস্থা ও কলের জলের ব্যবস্থা সম্বন্ধে নাও জানতে পারে। সেই রকম, আমরা দেহের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না জানলেও, এই দেহ ব্যবহার করছি। বস্তুত এই দেহের মালিক আমরা নই, মালিক হচ্ছেন কৃষ্ণ। এই কথাটি হচ্ছে বাস্তব সত্য। এই দেহটি মন ও ইন্দ্রিয় দিয়ে তৈরি, এবং তাই মন ও ইন্দ্রিয়ের প্রকৃত মালিকও কৃষ্ণ।

       আমি হচ্ছি চিন্ময় আত্মা, কিন্তু আমাকে এক বিশেষ জড় দেহ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু আমি ইচ্ছা করেছিলাম, তাই কৃষ্ণ কৃপা করে আমাকে তা দান করেছেন। যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। আমি রাজার শরীর কামনা করলে, কৃষ্ণ তাই প্রদান করবেন, কেউ নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি অনুসরণ করলে, সে রাজার শরীর প্রাপ্ত হবে। কেউ বিষ্ঠা ভোজনের উদ্দেশ্যে শুকর দেহ কামনা করে, কৃষ্ণ তাকেও সেই রকম দেহই প্রদান করবেন। কিন্তু এখন, আমাদের এই মানব-জীবনে আমাদের হৃদয়ঙ্গম করা কর্তব্য, “ কৃষ্ণই সব কিছুর মালিক, তা হলে আমার এই দেহটিকে ভোগ করার জন্য কেন আমি এত ব্যাকুল হচ্ছি ? পক্ষান্তরে, এই মানবদেহ প্রাপ্ত হয়েছি, তা ভগবান শ্রীহরির সেবায় নিযুক্ত করি। একেই বলে বুদ্ধি, এবং এই হচ্ছে ভক্তি।

       হৃষীকেণ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে— ভক্তি'র অর্থ হচ্ছে হৃষীক বা ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়ের অধিপতি হৃষীকেশ বা কৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত করা ( ত্বয়া হৃষীকেশেন হৃদি স্থিতস্য যথা করোমি )। বস্তুত কৃষ্ণই সর্বময় মালিক, তা বিস্মৃত হয়ে ইন্দ্রিয়ভোগে ইচ্ছুক হওয়ায়, আমি এই দেহটি প্রাপ্ত হয়েছি। এই দেহটি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ভোগের একটি উপকরণ। কিন্তু কৃষ্ণসম্বন্ধহীন ইন্দ্রিয়গুলির কোনই মূল্য নেই। তাই স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, কৃষ্ণই হচ্ছেন ইন্দ্রিয়ের মালিক। তাই, ইন্দ্রিয়গুলি আমার হেফাজতে থাকায়, তা কৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানে ব্যবহার করি না কেন ? এই হচ্ছে ভক্তি।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ২২ ) শ্রীকৃষ্ণ সান্নিধ্যের সৌন্দর্য
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।