" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • পূর্ণ শরণাগতি

    শ্লোক: ২০
    অপাদ্য নস্ত্বং স্বকৃতেহিত প্রভো
    জিহাসসি স্বিৎ সুহৃদোহনুজীবিনঃ।
    যেষাং ন চান্যদ্ভবতঃ পদাম্বুজাৎ
    পরায়ণং রাজসু যোজিতাংহসাম্ ॥ ২০ ॥
  • অনুবাদ : হে ভগবান, তুমি স্বয়ং সকল কর্তব্যই সম্পাদন করেছ। আজ যখন সকল রাজন্যবর্গই আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, তুমি ছাড়া আমাদের রক্ষাকর্তা বলতে কেউই নেই, তোমার কৃপার উপরই যখন আমরা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল, সেই সময়ে তুমি কি আমাদের ত্যাগ করছ ? ( ভাঃ ১/৮/৩৭ )
  • তাৎপর্যঃ- পাণ্ডবরা হচ্ছেন সবচেয়ে ভাগ্যবান, কেননা তাঁদের এমনই সৌভাগ্য যে, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে ভগবৎ-কৃপার উপর নির্ভরশীল। এই ভবসংসারে কারও দয়ার উপর নির্ভরশীল হওয়ার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নেই। কিন্তু ভগবানের সঙ্গে দিব্য সম্পর্কের মাধ্যমে ভগবানের উপর নির্ভর করে জীবন যাপনই সবচেয়ে সৌভাগ্যের লক্ষণ। ভবরোগের কারণই হচ্ছে সব কিছু থেকে স্বাধীন হওয়ার চিন্তা-ভাবনা। কিন্তু নিষ্ঠুর জড়া প্রকৃতি আমাদের স্বাধীন হতে দেয় না। জড়া প্রকৃতির কঠোর অনুশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার মিথ্যা প্রয়াসই হচ্ছে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের জড় প্রগতি নামে পরিচিত। এই জড়া প্রকৃতির কবল থেকে স্বাধীন হওয়ার মিথ্যা প্রয়াস থেকেই সমগ্র জড় জগৎ চলছে। রাবণ সরাসরি স্বর্গারোহণের সিঁড়ি তৈরি করতে চেয়েছিল, সেই রাবণ থেকে আজ পর্যন্ত সকলেই প্রকৃতির নিয়মকে জয় করতে প্রয়াসী। জড়বাদীরা আজ ইলেকট্রনিক যান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে দূরবর্তী গ্রহলোকে যাওয়ার প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু মানব-সভ্যতার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হচ্ছে ভগবৎ-নির্দেশ অনুসারে কঠোর পরিশ্রম করা এবং তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া। সভ্যতার কৃতিত্বের পরাকাষ্ঠা হচ্ছে বীরদর্পে ভগবৎ-সেবা করা এবং সেই সঙ্গে ভগবৎ সদিচ্ছার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হওয়া। এই মানের সভ্যতার আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হচ্ছেন পাণ্ডবরা। নিঃসন্দেহে পাণ্ডবরা ভগবানের সদিচ্ছার উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই নিষ্ক্রিয় বা অলসভাবে ভগবানের আশ্রয়ে থাকতেন না। দৈহিক কার্যাবলী ও ব্যক্তিগত চরিত্রে তাঁরা সমস্ত দিব্য গুণাবলীতে ভূষিত ছিলেন। তবুও তারা সর্বদাই ভগবৎ-কৃপা প্রার্থনা করতেন কেননা তারা জানতেন যে, স্বরূপতভাবে প্রত্যেক জীবই নিয়ন্ত্রাধীন। তাই জড় জগতে মিথ্যা স্বাধীনতাবোধ অপেক্ষা, ভগবানের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল হওয়াই জীবনের পরম সিদ্ধি। যারা ভগবানের কর্তৃত্ব থেকে অলীক স্বাধীনতা লাভে প্রয়াসী হয় তাদের অনাথ বলে, অর্থাৎ তাদের কোন অভিভাবক নেই। আর যারা সম্পূর্ণভাবে ভগবৎ ইচ্ছার অধীন, তাদের সনাথ বলে, অর্থাৎ তাদের কেউ একজন রক্ষাকর্তা রয়েছেন। তাই আমাদের অবশ্যই সনাথ হতে হবে, যাতে আমরা এই ভবসংসারের প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে পারি। বহিরঙ্গা জড়া প্রকৃতির বিমোহিনী শক্তির প্রভাবে আমরা ভুলে যাই যে, এই জড়-জাগতিক সংসার জীবন হচ্ছে সবচেয়ে অবাঞ্ছিত বিড়ম্বনায় পরিপূর্ণ। তাই ভগবদ্গীতা ( ৭/১৯ ) আমাদের নির্দেশ দিচ্ছে যে, বহু বহু জন্মের পর একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি এই সত্য উপলব্ধি করেন যে, বাসুদেব বা কৃষ্ণই হচ্ছেন সর্বেসর্বা এবং কৃষ্ণের চরণকমলে সম্পূর্ণ শরণাগতিই জীবন যাপনের সর্বোত্তম পন্থা। সেটিই মহাত্মার লক্ষণ। গৃহস্থাশ্রমী পাণ্ডব পরিবারের সকলেই ছিলেন মহাত্মা। মহারাজ যুধিষ্ঠির ছিলেন এই মহাত্মাদের মধ্যে প্রধান এবং কুন্তীদেবী ছিলেন তাঁদের স্নেহময়ী মাতা। তাই, ভগবদ্গীতা ও সমস্ত পুরাণ, বিশেষত ভাগবত পুরাণের শিক্ষাদর্শ এই মহান পাণ্ডবদের জীবন ইতিহাসের সঙ্গে অনিবার্যভাবেই সম্বন্ধযুক্ত। তাদের কাছে, ভগবৎ সঙ্গবিরহ ঠিক অনেকটা একটি মাছের জল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মতো। তাই, কুন্তীদেবী বজ্রাহতের মতোই কৃষ্ণবিরহ অনুভব করেছেন। এই জন্য কুন্তীদেবী তাঁর সমগ্র প্রার্থনার মাধ্যমে ভগবান কৃষ্ণকে তাঁদের পরিবারকে সান্নিধ্য দেওয়ার জন্য সকাতরে তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অবসানে, সকল শত্রুভাবাপন্ন রাজন্যবর্গের নিধন হলেও তাঁদের পুত্র-পৌত্ররা পাণ্ডবদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য জীবিত ছিল। এমন নয় যে শুধু পাণ্ডবরাই বহু লোকের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল, আমাদের সকলের অবস্থাও পাণ্ডবদের মতোই, এবং জীবন-যাপনের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে ভগবৎ সদিচ্ছার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে সকল সংসার বিপর্যয়কে অতিক্রম করা।

       কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অবসান হলে পাণ্ডবরা তাঁদের রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। কৃষ্ণ স্বগৃহ দ্বারকায় প্রত্যাবর্তনের আগে পিতৃষ্বসা কুন্তীদেবীর কাছে বিদায় নিতে গিয়ে তাকে প্রণাম জানান। ঠিক এই সময়ই কুন্তীদেবী এই প্রার্থনা করেছিলেন। কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, “ এই কথা কি সত্যি যে, তুমি তোমার কর্তব্য সম্পাদন করে এবং আমাদের সঙ্গহীন রেখে বিদায় নিচ্ছ। " এই হচ্ছে ভগবদ্ভক্তের অবস্থা। কুন্তীদেবী বলেছেন, যেষাং ন চান্যদ্ভবতঃ পদাম্বুজাৎ " তোমার চরণকমল ছাড়া আমাদের অন্য কোন আশ্রয় নেই। " এই হচ্ছে পূর্ণ শরণাগতি।

       শরণাগতির ছয়টি অঙ্গ। প্রথমটি হচ্ছে কৃষ্ণের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হওয়া, এবং পরবর্তীটি হচ্ছে যে, কৃষ্ণসেবার অনুকূল সব কিছুই স্বীকার করা ( আনুকুল্যস্য সঙ্কল্পঃ )। আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা – উত্তম ভক্তি বা ভগবদ্ভজনের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কৃষ্ণসেবার অনুকূল সব কিছু গ্রহণীয়। শরণাগতির অপর একটি অঙ্গ হচ্ছে, প্রাতিকূল্যবিবর্জনম্-- কৃষ্ণানুশীলনের প্রতিকূল সব কিছুই বর্জনীয়। কখনও কখনও সদগুরু ভজনের প্রতিকূল কোন কাজ করতে নিষেধ করে বলেন, “ এই কাজটি কর না। " আবার কখনও কখনও কৃষ্ণভজনের অনুকূল কাজের নির্দেশ দিয়ে বলেন— " এই কাজটি কর। ' হরেকৃষ্ণ ' কীর্তন কর। ” এই জন্য ভগবদ্ভজনের প্রতিকূল বর্জন ও অনুকুল গ্রহণই ( আনুকূল্যস্য সঙ্কল্পঃ প্রাতিকুল্যবিবর্জনম্ ) পূর্ণ কৃষ্ণ-শরণাগতির অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া, সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিত, " কৃষ্ণ আমাকে অবশ্যই রক্ষা করবেন। " এবং কৃষ্ণের দাসদের মধ্যে নিজেকে একজন বিবেচনা করা উচিত। এগুলি হচ্ছে শরণাগতি বা সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের কয়েকটি অঙ্গ।

       এখন কুন্তীদেবী বলছেন, " প্রিয় কৃষ্ণ, এখন আমরা আমাদের রাজ্য ফিরে পেয়েছি বলে যদি তুমি আমাদের সুপ্রতিষ্ঠিত বলে মনে কর এবং এই জন্য যদি তুমি আমাদের কাছে বিদায় নিতে চাও, তা হলে সেটি আদৌ উত্তম প্রস্তাব নয়। আমরা এখনও বিপদমুক্ত নই। আমরা বহু রাজন্যবর্গকে নিধন করায় তাদের স্বজন বন্ধুরা আমাদের সঙ্গে আবার যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হচ্ছে। এইজন্য কখনও মনে করো না যে, আমরা সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ। আমরা বিপদমুক্ত নই। আর তোমার চরণকমল ছাড়া আমাদের আর কোন নিরাপদ আশ্রয় নেই। সেটিই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। " এইভাবে পরোক্ষে কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে অনুরোধ করেছেন, " আমাদের পরিত্যাগ করো না। কখনও মনে করো না যে, এখন আমরা নিরাপদে আছি। তোমার সুরক্ষা ছাড়া, আমরা প্রতিনিয়তই বিপদাপন্ন। ”

       ভগবদ্ভক্তের এই রকম অবস্থা হওয়া উচিত। আমাদের জানা উচিত যে, এই ভব-সংসারে বস্তুত আমরা বিপদাপন্ন। যেই মাত্র একটু অসতর্ক হয়ে ভাবব, " এখন আমার কর্তব্য সুসম্পন্ন করেছি। এখন একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক, " যে কোন মুহূর্তে আমরা মায়ার কবলিত হতে পারি। না, ভগবদ্ভজনে কোন অবসর নেই। আমাদের সর্বদাই সজাগ থাকতে হবে।

       একটি শ্লোকে শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন, অব্যর্থকালত্বম্-- ভগবদ্ভক্তের অত্যন্ত সতর্ক হয়ে দেখা উচিত যে, অপ্রয়োজনে কালক্ষয় হচ্ছে কি না। তাঁর আত্ম জিজ্ঞাসা করা উচিত, “ আমি কি এখন মায়ার সেবা করছি, না কি কৃষ্ণের সেবা করছি ? " এটিই হচ্ছে উন্নত ভগবদ্ভক্তের বৈশিষ্ট্য। নামগানে সদা রুচিঃ — এই রকম কৃষ্ণভক্ত কখনও কীর্তন, গান ও নৃত্যে ক্লান্ত হন না। সদা অর্থে ' সর্বদা ' এবং রুচি ‘ আস্বাদ '। কৃষ্ণভক্ত সর্বদাই ‘হরেকৃষ্ণ’ কীর্তন আস্বাদন করে বলেন— “ ওঃ, এই হরিনাম কীর্তন কী মধুর। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥ " একেই রুচি বলে। অবশ্য, এই রকম রুচির উদয় হওয়া সময় সাপেক্ষ। কিন্তু শ্রীল রূপ গোস্বামী কীর্তনের সময় ভাবছিলেন, " আমার একটি জিহ্বা ও দুটি কান দিয়ে হরিনাম কীর্তন কতটুকুই বা আস্বাদন করতে পারি ? আমার লক্ষ লক্ষ জিহ্বা ও কোটি কোটি কান থাকত, তবেই হয়ত হরিনাম শ্রবণ-কীর্তনে কিছুটা আস্বাদন করতে পারতাম। ” অবশ্য তাকে অনুকরণ করা আমাদের উচিত নয়, কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের ভক্তদের প্রতিদিন তাদের বিধিবদ্ধ কমপক্ষে যোল মালা মহামন্ত্র জপ পূর্ণ করার জন্য সতর্ক হওয়া উচিত। নামগানে সদা রুচিঃ — ' হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র গান-কীর্তনে আমাদের রুচি বৃদ্ধি করতে হবে।

       তা ছাড়া, কৃষ্ণের বসতিস্থলে ( প্রীতিদ্বসতিস্থলে ) বসবাসে আমাদের আসক্তি বৃদ্ধিও করতে হবে। উন্নত ভক্তের দৃষ্টিতে কৃষ্ণ সর্বত্রই বিরাজমান, কিন্তু যেহেতু আমরা কৃষ্ণভাবনায় উন্নত নয়, আমাদের জানা উচিত যে, আমাদের জন্য কৃষ্ণ মন্দিরেই রয়েছেন। যেহেতু আমরা কৃষ্ণকে সর্বত্র বিরাজমান দেখি না, তাই কৃষ্ণসন্দর্শনে আমাদের মন্দিরে যাওয়া উচিত। কৃষ্ণ কৃপাবশত দয়া করে মন্দিরে আবির্ভূত হন, এমনভাবে যাতে আমরা তাঁকে দর্শন করতে পারি।

       কৃষ্ণের দেহ সচ্চিদানন্দঘন ( সৎ-চিদ্-আনন্দ-বিগ্রহ ), কিন্তু এই চিন্ময় দেহ দর্শনের যোগ্য দৃষ্টিশক্তি আমাদের নেই। আমরা জড়, স্থূল বস্তু ( জড় ) দর্শন করতে অভ্যস্ত। আমরা পাথর, ধাতু, কাঠাদি অন্যান্য উপাদান দেখতে সক্ষম, কিন্তু কৃষ্ণ সর্বময় হওয়ায়, আমাদের অপূর্ণ দৃষ্টির গোচর হওয়ার জন্য তিনি এই সব উপাদান সমন্বিত একটি রূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হন। এমন নয় কৃষ্ণ পাথর অথবা আমরা পাথরের পূজা করছি। আমরা কৃষ্ণের উপাসনাই করছি, কিন্তু যেহেতু আমরা পাথরাদি জড় উপাদান ছাড়া কিছুই দেখতে সক্ষম নই, তাই কৃপাসিন্ধু কৃষ্ণ এক প্রস্তরময় রূপে আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন। এইজন্য যেখানে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহপূজা হয়, সেই মন্দিরের চারিপার্শ্বে বসবাসে আগ্রহশীল হওয়া উচিত।

       তা ছাড়া, সর্বদাই নিজেকে কৃষ্ণের উপর নির্ভরশীল মনে করা উচিত। এই হচ্ছে কৃষ্ণানুশীলন। আমাদের সর্বদা মনে করা উচিত যে, " কৃষ্ণহীন আমার জীবন নিষ্ফল এবং কৃষ্ণহীন আমার জীবন বিপণ্ন। তাই কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করার সময় কুন্তীদেবী বলেছেন, “ কৃষ্ণ, তুমি এখন আমাদের নিরাপদ মনে করলেও, আমরা নিজেদের বিপদমুক্ত মনে করি না। আমরা সর্বদাই বিপন্ন। তুমিই যদি আমাদের নিরাপদ মনে কর, তা হলে কে আমাদের রক্ষা করবে ? তোমার চরণকমল ছাড়া আমাদের আর কোনই আশ্রয় নেই। নানা শত্রু-দ্বারা আমরা এখন পরিবেষ্টিত, কেন না কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত আমাদের বিপক্ষ দলের সন্তানরা এখন আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।”

       এখন, কৃষ্ণ তাঁর বয়ঃজ্যেষ্ঠা পিতৃষ্বসার পদধূলি গ্রহণে অগ্রসর হলে, কুন্তী কৃষ্ণকে স্নেহের ভাগিনেয় রূপে নয়, ভগবান বা প্রভু রূপে সম্বোধন করেন। কুন্তীদেবী জানেন, “কৃষ্ণ আমার ভ্রাতার সন্তান বা আমার ভাগিনেয়র ভূমিকা গ্রহণ করলেও, তবু সে পরম প্রভু।”

       একজন যথার্থ কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তির লক্ষণ হচ্ছে, তিনি জানেন যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন পরম প্রভু, কৃষ্ণহীন তিনি সর্বদাই নিজেকে বিপন্ন বোধ করেন। কৃষ্ণের চরণকমলে তিনি সর্বদাই নিরাপদ বোধ করেন। কৃষ্ণ বলেছেন, কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি— " অর্জুন, তুমি জগতে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্তের বিনাশ নেই। ( গীঃ ৯/৩১ ) কেউ কৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হলে, তাঁর কোন বিপদের প্রশ্নই উঠে না অবশ্য, কৃষ্ণ সকলেরই রক্ষাকর্তা, কারণ তিনি রক্ষা না করলে কারও পক্ষে এক মুহূর্তও জীবিত থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু কারও এই রকম ভাবা উচিত নয় যে, " কৃষ্ণ যখন সকলকে রক্ষা করবেন তখন তাঁর ভক্ত হওয়ার কি প্রয়োজন। ” রাজা তাঁর সকল প্রজারই রক্ষাকর্তা, কেন না সেটি তার কর্তব্য, কিন্তু তিনি বিশেষভাবে তার পরিকর-পার্ষদদের রক্ষা করেন। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কেউ যদি সরাসরি রাষ্ট্রপতির সেবক হয়, সে সামান্য বিপন্ন হলেও বিশেষভাবে তাকে রক্ষা করা হয়। রাষ্ট্রপতি সকল নাগরিকেরই রক্ষক, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত পার্যদেরা বিশেষভাবে বিবেচনার পাত্র। এই কাজ বস্তুত পক্ষপাতিত্ব নয়। পক্ষান্তরে, সেটিই স্বাভাবিক। একজন ভদ্রলোক ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ভালবাসে, কিন্তু তিনি নিজের সন্তানদের বিশেষভাবে স্নেহ করেন, কেউ বলবে না, “ ওঃ, আপনি অন্যদের চেয়ে নিজের সন্তানদের বেশি ভালবাসেন কেন ? " না, সেটিই স্বাভাবিক। সেই রকম, কৃষ্ণ ভগবদ্‌গীতায় বলেছেন, সমোহহং সর্বভূতেষু — “ আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন "। ভগবান হওয়ায় কৃষ্ণ সকলের প্রতি প্রীতিসম্পন্ন কেন না সকলেই তাঁর অংশ বিশেষ। তবু, কৃষ্ণ বিশেষভাবে ভক্তবৎসল। তাই কৃষ্ণ বলেছেন, কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি-" আমার ভক্তের কখনও বিনাশ হয় না। ”

       কৃষ্ণ তাঁর ভক্তের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সর্বদাই লক্ষ্য রাখেন। কৃষ্ণ সন্তুষ্ট কি না তা দেখার জন্য ভক্তরা সর্বদাই ব্যস্ত। কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণের শৃঙ্গার করে, তাকে ভোগ নিবেদন করে এবং প্রতিনিয়তই প্রীতিময় কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত থাকে, এবং সেই রকম, কৃষ্ণ সর্বদাই ভক্তের সুখান্বেষণ লক্ষ্য করেন। এভাবে কৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তের মধ্যে এক অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ রয়েছে। প্রত্যেক জীবাত্মারই কৃষ্ণের সঙ্গে এক সম্বন্ধ রয়েছে, কিন্তু কেউ কৃষ্ণভক্ত হলে, তাঁর কৃষ্ণসম্বন্ধ আরও নিবিড় অন্তরঙ্গ হয়ে উঠে। তাই কুন্তীদেবী কৃষ্ণের কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করেছেন, “ কিভাবে তুমি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছ ? আমরা তোমার অন্তরঙ্গ জন। তোমার সুরক্ষা ও তোমার কৃপাতেই এখনও আমরা জীবন যাপন করছি। কখনই মনে করো না যে, আমরা এখন নিরাপদ, তাই তুমি আমাদের পরিত্যাগ করতে পার না কারণ তোমার কৃপাই আমাদের জীবন, তোমার চরণকমল ছাড়া আমাদের অন্য আশ্রয় নেই। কৃপাপরবশ হয়ে আমাদের পরিত্যাগ করো না। " এই হচ্ছে কুন্তীদেবীর প্রার্থনা। সেই রকম, নরোত্তম ঠাকুর প্রার্থনা করেছেন—

    হা হা প্রভু নন্দসুত, বৃষভানুসুভাযুত,
    করুণা করহ এইবার।

       " নন্দসুত কৃষ্ণ, আপনি বৃষভানুসুতা শ্রীমতী রাধারাণী সহ উপস্থিত। আজ আমি সম্পূর্ণভাবে আপনাদের শরণাগত। কৃপাপরবশ হয়ে আমার উপর আপনাদের করুণা বর্ষণ করুন। "

       যার কৃষ্ণভক্তি নেই তার মনোভাব হচ্ছে, “ আমি নিজেকে রক্ষা করব, অথবা আমার সমাজ, সম্প্রদায় অথবা রাষ্ট্র আমাকে রক্ষা করবে। আমার অনেক রক্ষক আছে। আমি ভগবানকে মানব কেন ? আমি কৃষ্ণের কাছে যাব কেন ? যে মুঢ়দের কোন রক্ষাকর্তা নেই, তারা কৃষ্ণের শরণাপন্ন হোক। ” কিন্তু বাস্তব সত্য পূর্ণ শরণাগতি হচ্ছে যে, কৃষ্ণ রক্ষা না করলে, কেউই রক্ষা পেতে পারে না। শ্রীমদ্ভাগবতে ( ৭/৯/১৯ ) বর্ণিত হয়েছে বালস্য নেহ শরণং পিতরৌ নৃসিংহ। প্রহ্লাদ মহারাজ নৃসিংহরূপী কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনার সময় বলেন, “ হে ভগবান, শিশুর পিতা-মাতা থাকলেই সে নিরাপদে আছে বলে কারও ভাবা উচিত নয়। " কৃষ্ণ যদি রক্ষা না করেন, তা হলে হাজার হাজার পিতা-মাতা থাকা সত্ত্বেও কোন শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রহ্লাদ মহারাজ আরো বলেছেন, নার্তস্য চাগদমুদন্বতি মজ্জতো নৌঃ— এমন নয় যে, উত্তম চিকিৎসক বা ওষুধ থাকলেই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। " যেমন কোন ধনী ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হয়ে উত্তম চিকিৎসক ও ওষুধের ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থায় কি ধনী ব্যক্তির জীবনরক্ষা নিশ্চিত হবে ? নিশ্চয়ই নয়। কৃষ্ণ তাকে রক্ষা না করলে, উত্তম চিকিৎসা ও ওষুধ সত্ত্বেও তাঁর জীবন নাশ হবে। প্রহ্লাদ মহারাজ বলে চলেন যে, “ সেই রকম, উত্তম অর্ণবযান সত্ত্বেও সমুদ্রে নিমজ্জিত না হওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আপনি তাকে রক্ষা না করলে, যে কোন মুহূর্তে সে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হতে পারে। " জড়া প্রকৃতি কত বিপর্যয় সৃষ্টি করে, এবং জীবন-সংগ্রামে এই সব বিপর্যয়কে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীরা নানা উপায় উদ্ভাবন করলেও, ভগবান কৃষ্ণ রক্ষা না করলে, এই সব উদ্ভাবিত উপায় সবই নিষ্ফল ও ব্যর্থ হবে।

       কুন্তীদেবী এই কথা জানেন, তাই তিনি মহান বীর অর্জুন ও ভীমের মাতা হওয়া সত্ত্বেও তবু তিনি মনে করেন, “ আমার সন্তানরা মহান বীর হওয়া সত্ত্বেও, তারা আমাদের নিরাপত্তায় যথেষ্ট নয়। তোমার চরণযুগল ছাড়া অন্য কিছুই আমাদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। " এই শ্লোকটি ভগবানের চরণাশ্রয় অন্বেষণকারী একজন শরণাগত ভক্তের লক্ষণ প্রকাশক। কৃষ্ণই আমাদের একমাত্র রক্ষাকর্তা এবং কৃষ্ণসেবাই আমাদের একমাত্র ধর্ম, আমরা এই মনোভাব সর্বদা পোষণ করলে, তখন আমাদের জীবন সফল হবে।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ২১ ) আমাদের জীবনের সার্থকতা কোথায় ?
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।