" কুন্তীদেবীর শিক্ষা " সুধি ভগবদ্ভক্তগণ কর্তৃক অতি সমাদৃত এই গ্রন্থ

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোক, অনুবাদ এবং বিশদ তাৎপর্যসহ ইংরেজি Teachings of Queen Kunti গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ । অনুবাদক : শ্রীমদ্ সুভগ স্বামী মহারাজ

  • পরা প্রকৃতির সংস্পর্শ

    শ্লোক: ১১
    মন্যে ত্বাং কালমীশানমনাদিনিধনং বিভুম্ ।
    সমং চরন্তং সর্বত্র ভূতানাং যন্মিথঃ কলিঃ ॥ ১১ ॥
  • অনুবাদ : হে ভগবান , আমি মনে করি তুমি হচ্ছ নিত্য কাল স্বরূপ , পরম নিয়ন্তা আদি অন্তহীন ও সর্বব্যাপ্ত । তুমি সকলকে সমভাবে কৃপা বিতরণ কর । সামাজিক অন্তরঙ্গতাই জীবকুলের পরস্পর কলহের কারণ । ( ভাঃ ১/৮/২৮ )
  • তাৎপর্যঃ- কুন্তীদেবী অবগত ছিলেন যে , শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বা পিতৃপক্ষের কোন একজন সাধারণ স্বজন নন । তিনি তত্ত্বত জানতেন যে , শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদি পুরুষ , যিনি সকলের হৃদয়ে অন্তর্যামী পরমাত্মারূপে বাস করেন । ভগবানের পরমাত্মা রূপের অপর একটি নাম কাল । কাল আমাদের ভাল মন্দ সকল কর্মের সাক্ষী এবং এভাবে কাল দ্বারা আমাদের কর্মফলরূপ ভাগ্য রচিত হয় । আমরা সংসার - ক্লেশ ভোগ করছি কেন তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না বলা অর্থহীন । আমরা পূর্বকৃত যে দুষ্কর্মের জন্য আমাদের এখন দুঃখক্লেশ ভোগ হতে পারে , তা আমরা ভুলে যেতে পারি , কিন্তু আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে , পরমাত্মা আমাদের নিত্য সহচর এবং তাই তিনি আমাদের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ —– আমাদের সব কিছুর সাক্ষী । আর যেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমাত্মারূপ আমাদের সকল কর্ম ও কর্মফলের ভাগ্যনিয়ন্তা , তাই তিনি পরম নিয়ামকও । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুমোদন ছাড়া একটি তৃণও কম্পিত হয় না । ভগবান জীবকুলকে তাদের প্রাপ্য স্বতন্ত্রতা প্রদান করেছেন এবং ঐ স্বতন্ত্রতার অপব্যবহারই জীবকুলের দুর্দশার কারণ । ভগবদ্ভক্ত তাদের স্বতন্ত্রতার অসদ্ব্যবহার করেন না , তাই তাঁরা ভগবানের সুসন্তান । স্বতন্ত্রতার অপব্যবহারকারী অন্যদের ভাগ্যনিয়ন্তা কাল তাদের দুঃখ - দুর্বিপাকে নিপাতিত করে । কাল মায়াবদ্ধ জীবদের সুখ ও দুঃখ উভয়ই প্রদান করে । এগুলি সবই পূর্ব থেকে কালের দ্বারা নির্দিষ্ট হয় । যে - রকম আমাদের না চাইতে দুঃখক্লেশ ভোগ করতে হয় , সেই রকম না চহিতে আমাদের সুখভোগ হতে পারে । কারণ , সেগুলি সবই কালের দ্বারা পূর্বেই নির্ধারিত । এই জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কারও শত্রুও নন , বন্ধুও নন । প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করে । সমাজে অন্তরঙ্গ ভাব বিনিময়ের ফলে জীবকুল তাদের ভাগ্য রচনা করে । জড় জগতে সকলেই প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করতে চায় এবং প্রত্যেকেই এভাবে ভগবানের তত্ত্বাবধানে তার নিজের ভাগ্য রচনা করে । ভগবান সর্বব্যাপ্ত এবং তাই তিনি সকলের কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করতে পারেন । যেহেতু ভগবানের আদি নেই , তার অন্তও নেই , তাই তাকে কাল নামেও অভিহিত করা হয় । মহিয়সী ভক্ত কুন্তীদেবী এখানে যা ব্যাখ্যা করেছেন , ভগবদ্‌গীতায় ( ৯/২৯ ) ভগবান স্বয়ং তাই যথার্থভাবে প্রতিপাদন করেছেন । সেখানে ভগবান বলেছেন

    সমোঽহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোঽস্তি ন প্রিয় ।
    যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্ ॥

       “ আমি কারও প্রতি দ্বেষভাবাপন্ন নই এবং কারও প্রতি পক্ষপাতিত্বও করি না । আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন । কিন্তু যে ভক্তি ভরে আমার ভজন করে , সে আমার বন্ধু , সে আমাতে আসক্তচিত্ত এবং আমিও তাকে বন্ধুরূপে বরণ করি । ” ভগবান কখনও পক্ষপাতিত্ব করেন না । সকলেই ভগবানের সন্তান , তাই একজনকে উপেক্ষা করে ভগবান অপর সন্তানকে কিভাবে অনুগ্রহ করবেন ? তা কখনও সম্ভব নয় । কিন্তু মানবকুল বৈষম্যমূলক আচরণ করে । আমরা লিখি , “ আমরা ভগবদ্বিশ্বাসী " কিন্তু ভগবদ্বিশ্বাসী জীবের সমভাবে কৃপালু ও দয়াপরায়ণ হতে হবে । এটিই ভগবদ্ভাবনা । শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন , “ আমার কেউ শত্রু নয় , কেউ মিত্রও নয় । ” নমে দ্বেষ্যঽস্তি ন প্রিয়ঃ । দ্বেষ্য শব্দের অর্থ শত্রু। শত্রুর প্রতি আমরা দ্বেষপরায়ণ এবং মিত্রের প্রতি আমরা বন্ধুভাবাপন্ন । কিন্তু যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণতত্ত্ব , এমন কি যখন তিনি কোন অসুরের প্রতি শত্রুরূপে প্রতীয়মান হন , বস্তুত তিনি তার বন্ধু । অসুর বধের সময় কৃষ্ণ অসুরের আসুরিক কার্যাবলীকে নিধন করেন , এবং অচিরেই সে এক সাধুতে পরিণত হয় এবং সে পরমব্রহ্মের নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতিতে বিলীন হয় । পরমতত্ত্বের তিনটি অবস্থার একটি রূপ হচ্ছে এই ব্রহ্মজ্যোতি ।

    বদন্তি তৎ তত্ত্ববিস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞানমদ্বয়ম্ ।
    ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ( ভাঃ ১/২/১১ )

       অদ্বয়জ্ঞান এক হলেও তা ব্রহ্ম , পরমারা ও ভগবান — এই তিন রূপে অনুভূত হয় । অদ্বয়তত্ত্বের আদি পূর্ণ রূপ হচ্ছেন লীলা পুরুষোত্তম ভগবান এবং তার অংশ প্রকাশ হচ্ছেন পরমাত্মা বা ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু , যিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন ( ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ) । অদ্বয়জ্ঞানের তৃতীয় রূপ হচ্ছে ব্ৰহ্ম বা সর্বব্যাপী নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি ।

       পরম সত্য সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন , কিন্তু প্রপত্তি অনুযায়ী অদ্বয়জ্ঞান উপলব্ধি হন ( যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে ) । উপলব্ধির ক্ষমতা অনুযায়ী নির্বিশেষ ব্রহ্ম , অন্তর্যামী পরমাত্মা অথবা পরিশেষে ভগবানরূপে পরম সত্য প্রকাশিত হন । একটি উদাহরণ দ্বারা এটি ব্যাখ্যা করা যায় । আমাদের কক্ষের ভিতর থেকে আমরা কিছু পাহাড় দেখতে পারি , হয়ত তাদের স্পষ্ট না - ও দেখতে পারি । লসএঞ্জেলেসে অনেক পাহাড় আছে , কিন্তু দূর থেকে পাহাড়গুলিকে অনেকটা মেঘের মতো দেখায় । কিন্তু ঐ পাহাড়গুলির আরও কাছে গেলে , আমরা স্পষ্ট একটি পাহাড় দেখব । আর পথ দিয়ে সেই পাহাড়েই উপস্থিত হলে , সেখানে আমরা দেখব কর্মরত বহু লোক , বহু বাড়ি , রাস্তা , গাড়ি , আরও কত কি । সেই রকম তুচ্ছ মস্তিষ্ক দ্বারা পরম সত্যকে জানতে ইচ্ছুক হয়ে কেউ যখন মনে করে , “ আমি পরম সত্যের সন্ধানে গবেষণা চালাব " , তখন সে এক অস্পষ্ট , নির্বিশেষ ধারণা লাভ হয় । তারপর আরও উন্নত হয়ে ধ্যান অনুশীলকারী দেখবে যে , ভগবান সকলের হৃদয়ে অবস্থিত । ধ্যানাবস্থিততদ্‌গতেন মনসা পশ্যন্তি যং যোগিনঃ । যথার্থ যোগী ধ্যানযোগে হৃদয়াভ্যন্তরে বিষ্ণুমূর্তি দেখতে পান । ঠিক যেমন আমরা মুখোমুখি মিলিত হই , সাক্ষাৎ করি , তেমনই ভক্তরা প্রত্যক্ষভাবে ভগবৎ - সাক্ষাৎকার করেন । পরমেশ্বর ভগবান আদেশ করেন , “ আমাকে এগুলি যোগান দাও ” এবং ভগবদ্ভক্ত ভগবানের অভিপ্রেত দ্রব্য যোগান দিয়ে সোজাসুজি ভগবৎ - সেবা করেন । এভাবে অদ্বয়জ্ঞানের উপলব্ধি বিভিন্ন প্রকার। ভগবান সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন হলেও, আমাদের ভগবৎ - চেতনার উন্নতি অনুযায়ী ভগবৎ - উপলব্ধি আমাদের উপর নির্ভরশীল । তাই কুন্তীদেবী বলেছেন , সমং চরন্তং সর্বত্র – সকলকে তুমি সমানভাবে কৃপা বিতরণ কর । চরন্তম্ শব্দের অর্থ ' বিচরণশীল ' । অন্তরে ও বাইরে , সর্বত্রই ভগবান বিচরণ করেন । দৃষ্টি স্বচ্ছ করলেই আমরা ভগবৎ - দর্শন লাভ করতে পারি । সেবার মাধ্যমে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি পবিত্র করে আমরা ভগবৎ - উপস্থিতি অনুভব করতে পারি । যারা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন তারা শুধু ভগবানকে অন্তরে দেখার প্রয়াস করে , কিন্তু যাঁরা উন্নত বুদ্ধিসম্পন্ন তারা অন্তর ও বাইরে , উভয় ক্ষেত্রেই ভগবৎ দর্শন করতে সক্ষম ।

       ধ্যানযোগ প্রণালী বস্তুত অল্পবুদ্ধি সম্পন্নদের জন্য । ধ্যানযোগ অনুশীলনকারীর ইন্দ্রিয় সংযম করতে হয় ( যোগ ইন্দ্রিয়সংযমঃ ) । আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি অতিশয় চঞ্চল । বিভিন্ন আসন অভ্যাসদ্বারা মন ও ইন্দ্রিয় সংযম করতে হয় , যাতে হৃদয়াভ্যন্তরে বিষ্ণুর রূপে মনোনিবেশ করা যায় । যারা দেহাত্মবুদ্ধিতে অত্যন্ত আবিষ্টচিত্ত , তাদের জন্য এই যোগপ্রণালী নির্দিষ্ট । কিন্তু ভগবদ্ভক্তরা পরমার্থ চেতনায় আরও উন্নত হওয়ায় পৃথক প্রণালীদ্বারা তাদের ইন্দ্রিয় সংযমের প্রয়োজন নেই । পক্ষান্তরে , ভগবৎ - সেবার মাধ্যমে স্বতই তাদের ইন্দ্রিয় সংযম হয় ।

       যেমন , শ্রীবিগ্রহের অর্চন , মন্দির - মার্জন , শ্রীবিগ্রহের শৃঙ্গার , ভোগরন্ধন আদির দ্বারা কেউ যখন নিযুক্ত হয় , তখন পরমব্রহ্মোর সেবায় তার ইন্দ্রিয়গুলি আগে থেকেই নিয়োজিত হওয়ায় , তার ইন্দ্রিয়গুলি বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা কোথায় ? হাষীকেণ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে — ভক্তি বা ভগবৎ - সেবার সরল অর্থ হচ্ছে , আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে ( হৃষীক ) ইন্দ্রিয়াধিপতির ( হৃষীকেশ ) সেবার নিয়োগ করা । এখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়তর্পণে নিযুক্ত । আমি ভাবছি যে , যেহেতু আমি এই জড় দেহ , তাই এই ইন্দ্রিয়গুলিকে আমার তৃপ্ত করা চাই । বস্তুতপক্ষে এটি কলুষিত জীবনের স্তর। আত্মা জড় দেহ নয় , সে ভগবানের অংশ বিশেষ চিন্ময় আত্মা — এই উপলব্ধি হওয়া মাত্রই সে জানতে পারে যে , তার এই চিন্ময় ইন্দ্রিয়গুলি পরম চিন্ময় সত্তার সেবায় নিয়োজিত হওয়া উচিত । এইভাবে মুক্তিলাভ হয় ।

       দেহাত্মবুদ্ধিরূপ জড় অহঙ্কার ত্যাগ করে পুনরায় ভগবৎ - সেবায় নিযুক্ত হয়ে , স্ব স্বরূপে অবস্থিত হওয়া মাত্রই জীব মুক্তিলাভ করে ( মুক্তির্হিত্বান্যথা রূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ ভাঃ ২/১০/৬ ) । মায়া কবলিত অবস্থায় আমরা নিজ স্বরূপ বর্জন করি । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এটিকে জীবের নিত্য ভগবৎ - সেবা বলে বর্ণনা করেছেন ( জীবের ‘ স্বরূপ ' হয় কৃষ্ণের ‘ নিত্যদাস ' ) । ভগবৎ - সেবায় আত্মনিয়োগ করা মাত্র আমরা মুক্তিলাভ করি । ভগবৎ - সেবায় ইন্দ্রিয়গুলিকে নিযুক্ত করার এই কাজটি হচ্ছে মুক্তি লাভের প্রমাণ ।

       এই মুক্তি সকলেই লাভ করতে পারে (সমং চরন্তম্) । ভগবদ্‌গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেননি , “ একমাত্র তুমিই মুক্ত হতে পার । " না , ভগবান সকলেরই লভ্য । যখন তিনি বলেন , সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ– “ অন্যান্য সকল কর্তব্য বর্জন করে একমাত্র আমার শরণাপন্ন হও , " এই কথা তিনি শুধু অর্জুনকে লক্ষ্য করেই বলেননি , সকলের উদ্দেশ্যেই বলেছেন । অর্জুন ছিলেন মূল লক্ষ্য , কিন্তু বস্তুত ভগবদ্‌গীতা সকলের উদ্দেশ্যে , সমগ্র মানবকুলের উদ্দেশ্যে বর্ণিত হয়েছে । তাই এই সুবর্ণ সুযোগ , অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে ।

       সূর্যের মতোই শ্রীকৃষ্ণ নিরপেক্ষ। সূর্য কখনও বিবেচনা করেন না , “ এই লোকটি দরিদ্র, এ নিম্নশ্রেণীর লোক, এবং এটি একটি শূকর। আমি এদের সূর্যালোক বিতরণ করব না । " না , সূর্য সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন । আমাদের এই সূর্যালোক গ্রহণের সুযোগ নিতে হবে । সূর্যালোক সুলভ , কিন্তু আমরা গৃহদ্বার বন্ধ করে অন্ধকারে থাকতে চাইলে , সেটি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা । সেই রকম , শ্রীকৃষ্ণ সর্বত্র বিরাজমান ; তিনি সকলের জন্য । শরণাপন্ন হলেই আমাদের গ্রহণের জন্য শ্রীকৃষ্ণ উন্মুখ হয়ে আছেন । সমং চরন্তং। কোন প্রতিবন্ধক নেই । লোকেরা নিম্নশ্রেণী ও উচ্চ শ্রেণীকে পৃথক করতে পারে , কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন , মাং হি পার্থ বাপাশ্রিত্য যোঽপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ ” ( গীতা ৯/৩২ ) – “ কেউ নীচ জাতিরূপে বিবেচিত হলেও তাতে কিছু যায় আসে না । আমার শরণাপন্ন হলে সে-ও ভগবদ্ধাম প্রাপ্তির যোগ্য হয় । "

       সেই একই শ্রীকৃষ্ণকে কুন্তীদেবী ' কাল ' বর্ণনা করেছেন । সবকিছুই কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ , কিন্তু আমাদের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের পরিমাপ আপেক্ষিক । একটি কীটের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের পরিমাপ আমাদের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের পরিমাণ থেকে ভিন্ন । সেই রকম এই ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ জীব স্রষ্টা ব্রহ্মার অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের মাপ আমাদের কালের পরিমাপ থেকে ভিন্ন । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের বর্তমান , অতীত ও ভবিষ্যৎ নেই । তাই তিনি সনাতন । আমাদের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আছে , কেন না আমরা দেহান্তরিত হই । আমাদের যে দেহ আছে তা কালনির্দিষ্ট। এক বিশেষ তারিখে পিতা - মাতা থেকে আমার জন্ম হয় , এখন এই দেহ কিছুকাল স্থায়ী হবে । এই দেহের বৃদ্ধি হবে । দেহটি থেকে কিছু উৎপন্ন হবে , এবং তারপর দেহটি বৃদ্ধ হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে । অবশেষে অন্তর্হিত হবে । তারপর আমাকে পুনরায় অন্য এক দেহ ধারণ করতে হবে । বর্তমান দেহের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের অবসান হলে , আমি অন্য দেহ গ্রহণ করব , আবার আমার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শুরু হবে । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের অতীত , বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ নেই , কারণ শ্রীকৃষ্ণের দেহান্তর ঘটে না । এখানেই শ্রীকৃষ্ণ ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য ।

       শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অবস্থান ভগবদ্‌গীতায় প্রকাশিত হয়েছে । যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন , “ কোটি কোটি বছর পূর্বে আমি এই গীতাতত্ত্ব সূর্যদেবকে প্রদান করেছিলাম । " অর্জুন এই কথা বিশ্বাস করেন না বলে প্রতীয়মান হয় । অবশ্য , অর্জুন সবই অবগত ছিলেন , কিন্তু আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন , “ কৃষ্ণ আমরা উভয়ই সমকালীন , দুজনই কার্যত একই সময়ে জন্মগ্রহণ করায় , এতকাল পুর্বে এই তত্ত্বজ্ঞান সুর্যদেবকে শিক্ষা দেওয়ার কথা আমি কিভাবে বিশ্বাস করি ? ” তখন শ্রীকৃষ্ণ উত্তর দেন , “ প্রিয় অর্জুন , তখন তুমিও ছিলে , কিন্তু তুমি তা বিস্মৃত হয়েছ , অথচ আমি বিস্মৃত হইনি এখানেই তোমার ও আমাতে পার্থক্য । ” যে বিস্মৃত হয় তার ক্ষেত্রেই অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কাল প্রযোজ্য , কিন্তু যিনি বিস্তৃত হন না , যাঁর জীবন শাশ্বত , তার অতীত , বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ নেই ।

       এইজন্যে কুন্তীদেবী শ্রীকৃষ্ণকে কাল বলে সম্ভাষণ করেছেন ( মন্যে ত্বাং কালম্ ) । এবং কাল হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণই পরম নিয়ন্তা ( ঈশানম্ ) । শ্রীকৃষ্ণের অসাধারণ কার্যাবলীর মাধ্যমে কুন্তীদেবী উপলব্ধি করেছেন যে , শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন কাল এবং শ্রীকৃষ্ণই পরম নিয়ামক । তাঁর আদি নেই ; এবং অন্ত নেই ( অনাদিনিধন্ ), এবং তাই তিনি বিভু, পরমতত্ত্ব বা মহত্তম ।

       আমরা অণু , আমরা ক্ষুদ্রতম এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বিভু বা মহত্তম । আমরা শ্রীকৃষ্ণের অংশ বিশেষ , অতএব শ্রীকৃষ্ণ ক্ষুদ্রতম ও বৃহত্তম উভয়ই , অথচ আমরা কেবল ক্ষুদ্রতম । বিভু অর্থাৎ বৃহত্তমে সব কিছুই অনুস্যূত । একটি বড় ঝোলাতে অনেক কিছু ভর্তি করা যায় , অথচ ছোট ব্যাগে তা সম্ভব নয় । যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ বিভু অর্থাৎ বৃহত্তম , সবই তাঁর মধ্যে অনুস্যূত , এমন কি অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালও , এবং শ্রীকৃষ্ণ সর্বব্যাপ্ত অর্থাৎ সর্বত্র বিরাজমান ।

       শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া জড়ের বিকাশ হতে পারে না । নাস্তিক বিজ্ঞানীরা বলে যে , জড় থেকে জীবনের উদ্ভব , কিন্তু সেটি বাজে কথা । জড় হচ্ছে কৃষ্ণের একটি শক্তি এবং চেতন অন্য এক শক্তি । চেতন হচ্ছে উৎকৃষ্ট শক্তি এবং জড় হচ্ছে নিকৃষ্ট শক্তি । উৎকৃষ্ট শক্তির উপস্থিতিতে জড়ের বিকাশ হয় । যেমন , দুই - তিন শ বছর পূর্বে আমেরিকা উন্নত ছিল না , কিন্তু কিছু উৎকৃষ্ট জীবাত্মা ইউরোপ থেকে সেখানে যাওয়ায় আমেরিকা আজ এত অধিক উন্নত । অতএব উন্নতির কারণ হচ্ছে উৎকৃষ্ট শক্তি । আফ্রিকা , অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য বহু স্থানে এখনও বহু অনুন্নত খালি ভূভাগ পড়ে আছে । এই স্থানগুলি অনুন্নত কেন ? কেন না উন্নত জীবাত্মার উৎকৃষ্ট শক্তি এই স্থানগুলি স্পর্শ করেনি । উৎকৃষ্ট শক্তি স্পর্শ করা মাত্র সেই ভূভাগ কত কারখানা , বাড়ি , গাড়ি , রাস্তা শহর আদির মাধ্যমে উন্নত হবে ।

       এই উদাহরণটিতে শিক্ষণীয় হচ্ছে যে , জড় স্বয়ং উন্নতি লাভ করতে পারে না । তা সম্ভব নয় । উৎকৃষ্ট শক্তির স্পর্শ চাই , তখন জড় সক্রিয় হয়ে উঠে । আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় । যন্ত্র হচ্ছে জড় , তা নিকৃষ্ট শক্তি এবং তাই যন্ত্র চালকের স্পর্শ ছাড়া যন্ত্রটি সক্রিয় হবে না । যত মূল্যবান গাড়িই হোক না , চালকের সাহায্য ছাড়া কোটি বছরেও গাড়িটি কখনও কোথাও যেতে পারবে না ।

       এভাবে সাধারণ বুদ্ধিতেই হৃদয়ঙ্গম করা যায় যে , জড় স্বয়ং কাজ করতে অক্ষম । উৎকৃষ্ট শক্তি জীবাত্মার স্পর্শ ছাড়া জড় পদার্থ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে না । এতএব জড় পদার্থ থেকে জীবন বা চেতনার বিকাশের সিদ্ধান্ত কিভাবে করা যায় ? মুঢ় , দুরাচার বিজ্ঞানীরা এই কথা বলতে পারে , কিন্তু তাদের যথেষ্ট জ্ঞান নেই ।

       শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতির জন্য নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের বিকাশ সাধন সম্ভব হয়েছে , যা ব্রহ্মসংহিতায় উল্লেখ আছে ( অণ্ডান্তরস্থপরমাণুচয়ান্তরস্থম্ ) । বিজ্ঞানীরা এখন অণু পরীক্ষা করে ইলেক্টন , প্রোটনাদির নানা রকম কার্যাবলী খুঁজে পাচ্ছে । এগুলি সক্রিয় কেন ? কারণ এগুলিতে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত রয়েছেন । এটিই হচ্ছে যথার্থ বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি ।

       বিজ্ঞানসম্মতভাবে শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা উচিত । কৃষ্ণের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেই । তিনি হচ্ছেন কাল । শ্রীকৃষ্ণের আদি নেই , অন্ত নেই এবং তিনি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন । শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন ও উপলব্ধির জন্য আমাদের শুধু প্রস্তুত হতে হবে । এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের উদ্দেশ্য ।

  • এখন দেখতে পারেন => " কুন্তীদেবীর শিক্ষা " গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ১২ ) কৃষ্ণলীলার বিভ্রম –
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।