কৃষ্ণমহিমার আকর্ষণ
শ্লোক: ২৬
শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণসখ বৃষ্ণ্যৃষভাবনীধ্রুগ্-
রাজন্যবংশদহনানপবগবীর্য।
গোবিন্দ গোদ্বিজসুরার্তিহরাবতার
যোগেশ্বরাখিলগুরো ভগবন্নমস্তে ॥ ২৬ ॥
অনুবাদ :
হে কৃষ্ণ, হে অর্জুনসখা, হে বৃষ্ণি বংশতিলক, এই জগতের উৎপীড়ক রাজন্যবর্গকে তুমি বিনাশ কর। তোমার প্রবল প্রতাপ অক্ষয়, অবিনাশী। তুমি গোলোকপতি এবং ব্রাহ্মণ, গাভী ও ভগবদ্ভক্তদের দুর্গতি নাশের জন্য তুমি অবতরণ কর। তুমি যোগেশ্বর। তুমি অখিল জগতের গুরু এবং তুমি সর্বশক্তিমান ভগবান এবং আমি তোমাকে ভক্তিভরে প্রণাম জানাই। ( ভাঃ ১/৮/৪৩ )
তাৎপর্যঃ-
কুন্তীদেবী এখানে কৃষ্ণের পরম ভগবত্তার এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করেছেন। সর্বশক্তিমান ভগবান গোবিন্দের সনাতন, অপ্রাকৃত ধাম আছে। সেই দিব্যধামে তিনি ' সুরভি ' গাভী রক্ষণাবেক্ষণে নিরত থাকেন। শত সহস্র লক্ষ্মীদের দ্বারা তিনি সেখানে সেবিত হন। জগতের উৎপীড়ক রাজনৈতিক দল ও শাসক রাজন্যকারীবর্গকে বিনাশ ও ভগবদ্ভক্তদের পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি এই জড় জগতে অবতরণ করেন। তাঁর অনন্ত শক্তিদ্বারা তিনি সৃষ্টি, পালন ও নাশ করেন, তবু সর্বদাই তাঁর প্রতাপ পূর্ণই থাকে এবং তাঁর এই শক্তি কখনও হ্রাসপ্রাপ্ত হয় না। গো, ব্রাহ্মণ ও ভগবদ্ভক্তরা ভগবানের বিশেষ অনুকম্পার পাত্র, কারণ জীবসকলের সাধারণ কল্যাণের জন্য তাদের বিশেষ ভূমিকা আছে।
কুন্তীদেবী ভগবান কৃষ্ণকে কৃষ্ণসখা বলে সম্বোধন করেছেন, কেন না তিনি জানতেন যে, অর্জুনও কৃষ্ণ নামে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু পুত্র হওয়ায়, তিনি তাঁর অধীন ছিলেন, এবং কুন্তী অপেক্ষা অর্জুনের সঙ্গে ভগবান কৃষ্ণের সম্পর্ক আরও অন্তরঙ্গ ছিল। দ্রৌপদীরও আর এক নাম ছিল কৃষ্ণা, তাই কৃষ্ণসখা শব্দে দ্রৌপদীর সঙ্গে কৃষ্ণের সম্বন্ধ ব্যক্ত হয়েছে। দুর্যোধন ও কর্ণ দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে প্রয়াসী হলে, সেই লাঞ্ছনা থেকে কৃষ্ণ তাকে রক্ষা করেন। কুন্তীদেবী ভগবান কৃষ্ণকে বৃষ্ণি-ঋষভ, অর্থাৎ বৃষ্ণিকুলন্দন বলেও সম্বোধন করেছেন। চন্দন বৃক্ষ উৎপন্নের জন্য যেমন মলয়পর্বত ও মালেশিয়া বিখ্যাত, ঠিক সেই রকম বৃষ্ণিবংশে কৃষ্ণের আবির্ভাবের জন্যই বৃষ্ণিবংশ যশস্বী।
জগৎ উৎপীড়নকারী রাজন্যবর্গ ও শাসককুলের বিনাশকারীরূপেও ভগবান কৃষ্ণকে কুন্তীদেবী সম্বোধন করেছেন। প্রত্যেক রাজ্যেই বিপুল আড়ম্বর সহ রাজা সম্বর্ধিত হন কেন ? যেহেতু তিনি একজন মানুষ এবং অন্যান্য প্রজারাও মানুষ, তা হলে রাজা এভাবে সম্বর্ধিত হন কেন ? উত্তর এই যে, সদ্গুরুর মতো রাজাকেও ভগবানের প্রতিনিধি রূপে বিবেচনা করা উচিত। বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিপন্ন হয়েছে, আচার্যং মাং বিজানীয়ান্নাবমন্যেত কর্হিচিৎ ( ভাঃ ১১/১৭/২৭ ) –– গুরুদেবকে সাধারণ মনুষ্যরূপে গণ্য করা উচিত নয়। ঠিক সেই রকম, রাজা বা রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করা অকর্তব্য।
সংস্কৃত ভাষায় রাজাকেও নরদেব বলা হয়, নরদেব অর্থে ‘নররূপী ভগবান’। কৃষ্ণ প্রদর্শিত পন্থাই রাজার ধর্ম। কৃষ্ণ যেমন বিশ্বের পরম চেতন সত্ত্বা এবং অন্যান্য সকল জীবসকলের প্রতিপালক, ঠিক সেই রকম, রাজাও হচ্ছেন রাজ্যের শ্রেষ্ঠ নাগরিক এবং প্রজাকুলের কল্যাণকামী প্রতিপালক।
আমরা সকলেই যেমন চেতন সত্ত্বা, সেই রকম ভগবান কৃষ্ণও একজন চেতন সত্ত্বা। কৃষ্ণ নির্বিশেষ নন। আমরা সকলেই স্বতন্ত্র ব্যক্তি, কিন্তু আমাদের জ্ঞান ও ঐশ্বর্য সীমিত হওয়ায় নির্বিশেষবাদীরা পরব্রহ্ম তথা আদি ও পরম উৎসের এক সবিশেষ ব্যক্তিত্ব ধারণার সমন্বয় সাধন করতে অসমর্থ। আমরা সীমিত এবং ভগবান অসীম হওয়ায়, মায়াবাদী বা নির্বিশেষবাদীরা তাদের জ্ঞানের অল্পতার জন্য ভগবানকে নিশ্চিতভাবে নির্বিশেষ বলে অনুমান করে। একটি জড় উপমা দিয়ে তারা বলে যে, আকাশকে আমরা অসীম বলে অনুমান করি, এবং আকাশ হচ্ছে নির্বিশেষ, ঠিক সেই রকম, ভগবান যদি অসীম হন, তবে তিনিও নিশ্চয় নির্বিশেষ হবেন।
কিন্তু এটি বৈদিক সিদ্ধান্ত নয়। বৈদিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, ভগবান একজন ব্যক্তি। কৃষ্ণ একজন ব্যক্তি এবং আমরাও ব্যক্তি, কিন্তু প্রভেদ এই যে, তিনি উপাস্য আর আমরা উপাসক। রাজা অথবা রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন একজন ব্যক্তি, আর নাগরিকরাও ব্যক্তি, কিন্তু তাদের প্রভেদ এই যে, রাজা বা রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাঁকে সর্বতোভাবে সম্মান প্রদান করা কর্তব্য।
কিন্তু এত লোক একজন ব্যক্তিকে উপাসনা করবে কেন ? কারণ সেই এক ব্যক্তিই সকলকে প্রতিপালন করেন। একো বহুনাং যো বিদধাতি কামান। ভগবান এক, আমরা বহু, কিন্তু তিনি সকলের উপাস্য কারণ তিনি সকলকে প্রতিপালন করেন। ভগবান কৃষ্ণই সকলকে আহার্য ও জীবন যাপনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু সকল প্রদান করেন। আমাদের জলের প্রয়োজন, এবং সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে লবণমিশ্রিত অপরিমেয় সমুদ্রের জল কৃষ্ণ আমাদের প্রদান করেছেন। তারপর, যেহেতু আমাদের পানীয় জলের প্রয়োজন আছে, তাই ভগবৎ-ইচ্ছায় সূর্যালোকের দ্বারা সমুদ্রজল বাষ্পীভূত হয়ে উচ্চাকাশে নীত হয়, তারপর নির্মল, পরিশোধিত জল পরিবেশিত হয়। এভাবে আমরা দেখতে পাই, কিভাবে কৃষ্ণ প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় সব কিছু প্রদান করছেন।
এমন কি আমাদের সাধারণ নাগরিক জীবনে সরকারের তাপ বিভাগ, আলোক বিভাগ, জল-গ্যাস সরবরাহ বিভাগাদি আছে কেন ? কারণ এগুলি আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। কিন্তু এই সকল ব্যবস্থা অন্যের অধীন ; কৃষ্ণের ব্যবস্থাপনাই প্রথম প্রয়োজন। ভগবানই মূলত তাপ, আলোক ও জল দাতা। ভগবানই আমাদের কূপ ও সরোবরগুলি বারিবর্ষণের মাধ্যমে জলপূর্ণ করেন। এভাবে কৃষ্ণই আদি সরবরাহকারী। ভগবান সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি জানেন যে, আমাদের তাপ, আলোক ও জলাদির প্রয়োজন আছে। জল ছাড়া আমরা খাদ্য প্রস্তুত করতে পারি না ; ভগবানের সহায়তা ছাড়া এমন কি মাংসাহারীরাও খাদ্য প্রস্তুত করতে অক্ষম, কেন না কসাইখানায় নিয়ে যাওয়ার আগে পশুদেরও ঘাস প্রদান করা কর্তব্য। এভাবে মূলত কৃষ্ণই খাদ্য প্রদাতা, তবু আমরা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি। ' ধ্রুক্ শব্দে ‘ বিদ্রোহিশুলভ '। ভগবৎ-আদেশ অমান্যকারী, দুর্জন বা মূঢ়রাই হচ্ছে বিদ্রোহী।
রাজার কর্তব্য হচ্ছে কৃষ্ণের প্রতিনিধি রূপে কাজ করা। নয়তো, নাগরিকদের কাছ থেকে এত সম্মান লাভের তার কি অধিকার আছে ? পুরাকালে প্রত্যেক দেশেই রাজতন্ত্র বর্তমান ছিল, কিন্তু যেহেতু রাজন্যবর্গ ভগবানের বিরুদ্ধাচরণ করে ভগবৎ-আদেশ লঙ্ঘন করেছে, যেহেতু তারা ভগবৎ-প্রদত্ত ক্ষমতা আত্মসাৎ করতে প্রয়াসী হয়ে ভগবানের প্রতিনিধিত্ব উপেক্ষা করেছে, তাই বিশ্বের প্রায় সকল রাজকীয় শাসন অন্তর্হিত হয়েছে। রাজারা রাজ্যগুলিকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করত। তারা নিজেদের বিপুল সম্পদ ও বিরাট রাজ্যের অধিকারী মনে করে সর্বময় কর্তা অথবা ভগবান বলে মনে করত। কিন্তু বস্তুত তা সত্য নয়। বাস্তব সত্য হচ্ছে যে, ভগবানই সব কিছুর প্রকৃত মালিক ঈশাবাস্যমিদং সর্বম্। এইজন্য কৃষ্ণের প্রতিনিধির কৃষ্ণের প্রতি ঐকান্তিক আনুগত্য থাকা প্রয়োজন এবং তখনই তার পদ বৈধ হবে।
লোভী, স্বার্থান্বেষী রাজন্যবর্গ, অসদ্গুরুদের সঙ্গে তুলনীয়। অসদ্গুরুরা নিজেদের ভগবান বলে প্রচার করে। এই রকম অসদ্গুরুবর্গ ভগবৎ-বিদ্বেষী হওয়ায়, তাদের পদাধিকার নেই। যথার্থ সত্গুরু কখনও ভগবানের ভূমিকা গ্রহণ করেন না, পক্ষান্তরে ভগবৎ-ভাবনামৃত বা কৃষ্ণভাবনামৃত পরিবেশন করে ; ভগবানের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সেবকরূপে কাজ করেন। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর গুরুদেবের বন্দনা করে বলেছেন, সাক্ষাদ্ধরিত্বেন সমস্ত শাস্ত্রৈরুক্তঃ— সকল বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, সদ্গুরুকে পরমেশ্বর ভগবানের মতো সম্মান জ্ঞাপন করা উচিত। এভাবে গুরুদেবকে ভগবানতুল্য বিবেচনা করা অর্থহীন মুঢ়তা নয়। এটি শাস্ত্র বাক্য, তাই ভগবৎ-অনুশীলনে উন্নত ভক্ত এই দিব্য বাণী গ্রহণ করেন। ( উক্তস্তথা ভাব্যত এব সদ্ভিঃ)। তা হলে গুরুদেব কি সাক্ষাৎ ভগবান সম? কিন্তু প্রভোর্যঃ প্রিয় এব তস্য- গুরুদেব ভগবান নন, কিন্তু তিনি ভগবানের অন্তরঙ্গ প্রতিনিধি। উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এই – সেব্য ভগবান ( উপাস্য ) এবং সেবক ভগবান ( উপাসক )। গুরুদেব ভগবান এবং কৃষ্ণ ভগবান, কিন্তু কৃষ্ণ হচ্ছেন উপাস্য ভগবান এবং সদ্গুরু হচ্ছেন উপাসক ভগবান।
মায়াবাদীরা এই তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। তাদের মনোভাব হচ্ছে, “ যেহেতু গুরুদেবকে ভগবানরূপে স্বীকার করতে হবে এবং যেহেতু আমি গুরুদেব হয়েছি, তাই আমি ভগবানে পরিণত হয়ে গেছি। " এটি ভগবৎ-বিদ্বেষী মনোভাব। ভগবান যাদের একটি পদ দান করেছেন, কিন্তু যারা বলপূর্বক ভগবানের ক্ষমতা আত্মসাৎ করতে চায়, কিন্তু বস্তুত যা তারা করতে পারে না, তারাই হচ্ছে মূঢ়, ভগবৎ-বিদ্বেষী ও দুরাচারী এবং তারাই দণ্ডনীয়। তাই কুন্তীদেবী বলেছেন অবনিধ্রুগ্-রাজন্যবংশদহনঃ " যে সব মূঢ় বা দুরাচারী বিদ্বেষপূর্ণভাবে তোমার পদ দাবি করে, তাদের নিধনের উদ্দেশ্যে তুমি ধরায় অবতরণ কর। " সম্রাটের অধীনস্থ বিভিন্ন রাজা ও ভূম্যাধিকারীরা কখনও কখনও সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করে কর দানে অস্বীকৃত হয়। সেই রকম, কৃষ্ণের ভগবত্তা উপেক্ষাকারী ভগবৎ-বিদ্বেষী ব্যক্তিরা নিজেদের ভগবান বলে জাহির করে এবং কৃষ্ণের কাজই হচ্ছে তাদের বধ করা।
অপবর্গ শব্দে কৃষ্ণের অক্ষুণ্ণ শক্তি বা বীর্যকে প্রকাশ করে। অথবর্গ শব্দটি পবর্গের বিপরীত শব্দ। পবর্গ বলতে সংসার যাতনাকে উল্লেখ করে। সংস্কৃত ভাষাবিদ্যা অনুযায়ী প বর্গ শব্দে সংস্কৃত শব্দাবলী — ' প ', ফ ', ' ব ', ' ভ ' ও ' ম ' কে বুঝায়। এইভাবে প-বর্গ শব্দে যখন ভবযন্ত্রণাকে বুঝিয়ে থাকে, তখন তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা যায় পাঁচটি শব্দের মাধ্যমে, যেগুলি পাঁচটি বর্ণ দিয়ে শুরু হয়েছে।
' প ' অক্ষর ' পরিশ্রম ' অর্থ-জ্ঞাপক। এই ভবসংসারে সকলকেই জীবন ধারণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ভগবদ্গীতায় ( ৩/৮ ) প্রতিপন্ন হয়েছে-- শরীরযাত্রাপি চ তেন ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণঃ– " কাজ না করলে, কেউই এমন কি নিজ দেহকেও প্রতিপালন করতে পারে না। " কৃষ্ণ কখনও অর্জুনকে বলেননি যে, " আমি তোমার বন্ধু, এবং আমিই সব কিছু করব। তুমি শুধু বসে থেকে গাঁজা পান কর। " কৃষ্ণই সব কিছু করছিলেন, কিন্তু তবুও তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন, " তোমাকে অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে। অর্জুন বলেননি যে, “ তুমি আমার মহান বন্ধু। বরং তুমি যুদ্ধ কর আমি বসে গাঁজা খাই। " সেটি কৃষ্ণভক্তি নয়। একজন ভগবদ্ভক্ত কখনও বলেন না, “ হে ভগবান, আপনি অনুগ্রহ করে আমার জন্য সব কিছু করুন আর আমাকে গাঁজা খেতে দিন। " পক্ষান্তরে ভগবদ্ভাবনাময় ব্যক্তির ভগবানের জন্য অবশ্যই কাজ করতে হবে। কিন্তু এমন কি ভগবানের সেবার জন্য কাজ না করলেও, কাজ অবশ্যই করতে হবে, কেন না কাজ না করে কেউই নিজের দেহ ভরণপোষণ করতে পারে না। তাই এই ভবসংসার হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম করার জন্য।
এমন কি পশুরাজ হলেও, শিকার অন্বেষণে সিংহকেও জঙ্গলে বের হতে হয়। প্রবাদ আছে-নহি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশন্তি মুখে মৃগাঃ। সিংহ কখনও মনে করে না, " যেহেতু আমি বনের রাজা, তাই আমি ঘুমাই, আর সমস্ত পশুরাই খাদ্যরূপে আমার মুখের মধ্যে প্রবেশ করবে। " তা সম্ভবও নয়। " না, মহাশয়, সিংহ হলেও আপনাকে খাদ্যান্বেষণ করতে হবে। এইভাবে, এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সিংহকে খাদ্যের জন্য একটি পশুর খোঁজে সুকঠিন প্রয়াস করতে হবে। সেই রকম, এই জড় জগতে জীবন রক্ষার জন্য, সকলকেই বহু কষ্ট সহ্য করে পরিশ্রম করতে হবে।
' প ' অক্ষর ' পরিশ্রম ' অর্থ-জ্ঞাপক, এবং ' ফ ' শব্দে ফেনিল, হচ্ছে ' ফেনা '। কঠোর পরিশ্রমরত ঘোড়ার মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। সেই রকম, মানব সমাজকেও এভাবে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এই রকম কঠোর পরিশ্রম কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়, এবং ' ব ' এই অর্থই ব্যক্ত হয়েছে। আর ' ভ ' অক্ষরে ' ভয় ' অর্থ জ্ঞাপন করে। এত কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও, সর্বদাই একরকম ভীতি রয়েছে কারণ অভিলাষ অনুযায়ী কাজটি যদি সম্পন্ন না হয়। জীবদেহের প্রকৃতি হচ্ছে আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন ( আহারনিদ্রাভয়মৈথুনং চ )। কেউ পরিপূর্ণভাবে আহার করলেও, অতিরিক্ত আহার হয়েছে কি না তা বিবেচনা করতে হয়, যাতে সে রোগাক্রান্ত না হয়ে পড়ে। এভাবে আহার্য গ্রহণেও ভয়ের প্রশ্ন আছে। আহার্য গ্রহণের সময় একটি পাখিও আক্রমণকারী শত্রুর ভয়ে ভীত হয়ে চতুর্দিকে লক্ষ্য করে। আর মৃত্যুতেই জীবকূলের সব কিছুর অন্তিম অবসান ঘটে, এবং ' ম ' অক্ষরের দ্বারা এই অর্থই প্রকাশিত হয়।
প-বর্গ এবং তার গঠনকারী প, ফ, ব, ভ, ম শব্দগুলি কঠোর পরিশ্রম, ফেনিল মুখ, ব্যর্থতা, ভয় ও মৃত্যুকে ব্যক্ত করে। এই হচ্ছে প-বর্গ বা সংসার ক্লেশের পথ। কিন্তু অপবর্গ শব্দ ঠিক তার বিপরীত চিন্ময় জগৎকে প্রকাশ করে। সেই জগতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না, ফলে মুখে ফেনাও বের হয় না, সেখানে অভিলাষও ব্যর্থ হয় না, সেখানে ভয় নেই এবং মৃত্যু নেই। এভাবে কৃষ্ণকে অপবর্গ-বীর্য বলা হয়, কারণ তিনি এই চিন্ময় ধামের পথ প্রদর্শন করেন। জীবকুলের এই পঞ্চক্লেশ ভোগের কারণ কি ? জড় দেহই তার কারণ। জড় দেহ ধারণ করা মাত্রই— সেই দেহ রাষ্ট্রপতি, সাধারণ নাগরিক, দেবতা, মানুষ, কীট বা ব্রহ্মারই হোক না কেন সকলকেই এই ভবযন্ত্রণা, ভোগ করতে হবে। একেই ভবসংসার বলে। তাই অপবর্গের পথ, অর্থাৎ ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ জগতে অবতরণ করেন। কৃষ্ণ যখন এই পথ প্রদর্শন করেন তখন আমাদের এই পথ গ্রহণ করা উচিত। কৃষ্ণ স্পষ্টভাবে আদেশ করেছেন, আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে অপবর্গ প্রদান করব। অহং তাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি— “ আমি তোমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করব। " আর নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ক্ষমতা কৃষ্ণের আছে।
কুন্তীদেবী কৃষ্ণকে গোবিন্দ বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ কৃষ্ণ ইন্দ্রিয় ও গাভী উভয়কে আনন্দ দান করেন। গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি। গোবিন্দ বা কৃষ্ণই হচ্ছেন আদিপুরুষ বা মূল ব্যক্তি। অহমাদিৰ্হি দেবানাম্ ( গীঃ ১০/২ ) এমন কি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবাদি দেবতাদেরও তিনি মূল কারণ। জনসাধারণের মনে করা উচিত নয় যে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা শিবই সব কিছুর মূল উৎস। না। কারণ কৃষ্ণই প্রতিপন্ন করেছেন, অহমাদিৰ্হি দেবানাম্ -এমন কি এই সব দেবতাদেরও আমিই মূল উৎস। ' এইজন্য আমরা বারবার দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করি যে, আদি পুরুষ ছাড়া অন্য কাউকে আমরা আরাধনা করি না ( গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি )।
কুন্তীদেবী প্রার্থনা করে বলেছেন — গোদ্বিজসুরার্তিহরাবতার অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত করছেন যে, গোবিন্দ বা কৃষ্ণ গাভী, ব্রাহ্মণ ও হরিভক্তদের রক্ষার উদ্দেশ্যে, এই জড় জগতে অবতরণ করেন। জগতের অসুররা গাভীদের চরম শত্রু, কারণ তারা শত সহস্র কসাইখানা চালু রাখে। নিরীহ গাভীগুলি আমাদের সর্বোত্তম আহার্য দুধ প্রদান করা সত্ত্বেও এবং মৃত্যুর পর আমাদের পাদুকার জন্য চামড়া প্রদান করলেও, জনসাধারণ এমনই মূঢ় বা দুরাচারী যে, তারা গোহত্যা করে, কিন্তু তবুও তারা এই জগতে সুখী হতে চায়। তারা এমনই পাপী।
গোরক্ষাকে এমনভাবে সমর্থন করা হয় কেন ? কারণ গাভী হচ্ছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পশু। এই রকম কোন শাস্ত্র নির্দেশ নেই যে, বাঘ বা ঐরকম পশুর মাংসাহারই নিষিদ্ধ। বৈদিক শাস্ত্রে মাংসাহারীদের জন্য, ছাগল, কুকুর, শূকর অথবা অন্যান্য পশুমাংস আহারের নির্দেশ আছে, কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পশু গরুর মাংস নিষিদ্ধ। জীবিত অবস্থায় গরু দুধ প্রদান করে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবা করে। মৃত্যুর পরও নানা কাজে ব্যবহারের জন্য চামড়া, ক্ষুর ও শিং প্রদান করে গাভী আমাদের সেবা করে। তবু বর্তমান মানব-সমাজ এমনই অকৃতজ্ঞ যে, তারা অপ্রয়োজনে এই সব নিরীহ গাভীদের বধ করে। এই জন্য এই অসুরদের শাস্তি বিধানের উদ্দেশ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জড় জগতে অবতরণ করেন। নীচের এই প্রার্থনা দ্বারা কৃষ্ণ উপাসিত হন—
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ ॥
“ হে ভগবান, আপনি গাভী ও ব্রাহ্মণদের পরম কল্যাণকামী এবং আপনি অখিল জগৎ ও মানবকুলেরও পরম মঙ্গলকামী। " আদর্শ মানব-সমাজে গোদ্বিজ, অর্থাৎ গাভী ও ব্রাহ্মণদের অবশ্য রক্ষা করা কর্তব্য। দ্বিজ শব্দে ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করা হয়েছে, অথবা যিনি ব্রহ্মজ্ঞ তিনিই ব্রাহ্মণ। যখন অসুরকুল ব্রাহ্মণ ও গাভীদের উপর নির্যাতন করে, তখন ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ জগতে অবতরণ করেন। তাই ভগবদ্গীতায় ( ৪/৭ ) কৃষ্ণ ঘোষণা করেছেন—
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥
“ হে ভারত, যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের উত্থান দেখা যায়, সেই সময় আমি স্বয়ং জগতে অবতীর্ণ হই। ” বর্তমান, কলিযুগে জনসাধারণ অত্যন্ত পাপী এবং এই কারণে তারা ভীষণ দুঃখক্লেশ ভোগ করছে। এই জন্য ' মহামন্ত্রে ' নামাবতার রূপে কৃষ্ণ অবতরণ করেছেন—
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে
কুন্তীদেবী ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তিনি যেন তার সামান্য গুণমহিমা বর্ণনা করতে সক্ষম হন। কুন্তীদেবী কৃর্তক উত্তম শ্লোকরচিত ভগবৎ-মহিমা শ্রবণ করে, কৃষ্ণ স্মিতহাস্যে তা অনুমোদন করেন। কৃষ্ণের এই হাসি তাঁর যোগৈশ্বর্যের মতোই ভুবনমোহিনী। জড় জগতের উপর কর্তৃত্বে প্রয়াসী, মায়াবদ্ধ জীবকুলও ভগবানের যৌগিক শক্তি দ্বারা মোহিত। কিন্তু কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণমহিমার দ্বারা ভিন্ন পন্থায় মুগ্ধ হন। এইভাবে সকল ভগবদ্ভক্তই উত্তম শ্লোকের দ্বারা ভগবৎ-উপাসনা করেন। অনন্ত উত্তম শ্লোকেও ভগবৎ মহিমা বর্ণনা করতে যথেষ্ট নয়, তবু পিতা যেমন শিশুর আধো আধো কথায় পরিতুষ্ট হয়, ভগবানও সেই রকম ভক্তের ভগবৎ-মহিমা বর্ণনায় সন্তুষ্ট হন। এভাবে ভগবান কৃষ্ণ হেসে কুন্তীদেবীর প্রার্থনা গ্রহণ করেছিলেন।
হরেকৃষ্ণ।