শ্রী শ্রী গীতার জ্ঞান সহজে উপলব্ধির উপায় বা গীতার জ্ঞান বুঝতে হলে যে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

পৃষ্ঠা - ১   ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,   ১০   ,   ১১   ,   ১২   ,   ১৩   ,   ১৪

  • হরেকৃষ্ণ।
    শ্রীল প্রভুপাদ রচিত -

    পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা'র পর -
    তাই অর্জুনের গুনে গুণান্বিত মানুষেরাই কেবল ভগবদ্ গীতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে। ভক্তির মাধ্যমে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের যে প্রেম-মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারই আলোকে ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়, তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ভক্ত ভগবানের সঙ্গে নিম্নলিখিত পাঁচটি সম্পর্কের যে কোন একটির দ্বারা যুক্ত থাকেন-

    (১) নিষ্ক্রিয় ভাবে ভক্ত হতে পারেন (শান্ত)
    (২) সক্রিয়ভাবে ভক্ত হতে পারেন (দাস্য)
    (৩) বন্ধুভাবে ভক্ত হতে পারেন (সখ্য)
    (৪) অভিভাবক রূপে ভক্ত হতে পারেন (বাৎসল্য)
    (৫) দাম্পত্য প্রেমিকরূপে ভক্ত হতে পারেন (মাধুর্য)

    অর্জুনের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্কের রূপ ছিল সখ্য। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তার সঙ্গে পার্থিব জগতের বন্ধুত্বের বিস্তর তফাৎ। এই সম্পর্ক হচ্ছে অপ্রাকৃত এবং জড় অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিচার করা কখনোই সম্ভব নয়। যে কোন লোকের পক্ষে এই বন্ধুত্বের আস্বাদন লাভ করা সম্ভব নয়, তবুও প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত এবং এই সম্পর্কের প্রকাশ হয় ভক্তিযোগের পূর্ণতার মাধ্যমে। তবে আমাদের বর্তমান অবস্থায়, আমরা কেবল ভগবানকেই ভুলে যাইনি, সেই সঙ্গে ভুলে গেছি তাঁর সঙ্গে আমাদের চিরন্তন সম্পর্কের কথা। লক্ষ কোটি জীবের মধ্যে প্রতিটি জীবেরই ভগবানের সঙ্গে কোনো না কোনো রকমের শাশ্বত সম্পর্ক রয়েছে, এবং সেই সম্পর্ক হচ্ছে জীবের স্বরূপ। ভক্তিযোগের মাধ্যমে এই স্বরূপের প্রকাশ হয় এবং তাকে বলা হয় জীবের স্বরূপসিদ্ধি। অর্জুন ছিলেন ভগবানের ভক্ত এবং তাঁর সাথে ভগবানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

    ভগবদ্ গীতার মর্মোপলব্ধি করতে হলে প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে অর্জুন কিভাবে তা গ্রহণ করেছিলেন। ভগবদ্ গীতার দশম অধ্যায়ে (১০/১২-১৪) তা বর্ণনা করা হয়েছে-

    অর্জুন উবাচ পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।
    পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥
    আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
    অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥
    সর্বমেতদ্ ঋতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব ।
    ন হি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিদুর্দেবা ন দানবাঃ ॥

    “অর্জুন বললেন- তুমিই পরম পুরুষোত্তম ভগবান, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরব্রহ্ম। তুমিই শাশ্বত, দিব্য, আদি পুরুষ, অজ ও বীভু। নারদ, অসি্ দেবল, ব্যাস আদি সমস্ত মহান ঋষিরাই তোমার এই তত্ত্ব প্রতিপন্ন করে গেছেন, আর এখন তুমি নিজেও তা আমার কাছে ব্যক্ত করছ। হে শ্রীকৃষ্ণ, তুমি আমাকে যা বলেছ তা আমি সম্পূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ করেছি। হে ভগবান! দেব অথবা দানব কেউই তোমার তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারে না।”

    পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে ভগবদ্ গীতা শোনার পর অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরং ব্রহ্ম অর্থাৎ পরব্রহ্ম। প্রতিটি জীবই ব্রহ্ম, কিন্তু পরম জীব অথবা পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন পরব্রহ্ম। পরং ধাম কথাটির অর্থ হচ্ছে তিনি সব কিছুর পরম আশ্রয় অথবা পরম ধাম। পবিত্রম্ মানে তিনি হচ্ছেন বিশুদ্ধ অর্থাৎ জড় জগতের কোন রকম কলুষ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। পুরুষ কথাটির অর্থ হচ্ছে, তিনি পরম ভোক্তা; শাশ্বতম্ অর্থ সনাতন; দিব্যম্ অর্থ অপ্রাকৃত; আদিদেবম্ অর্থ পরম পুরুষ ভগবান; অজম্ অর্থ জন্মরহিত এবং বিভুম্ শব্দটির অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ।

    কেউ মনে করতে পারেন যে, অর্জুন যেহেতু শ্রীকৃষ্ণের বন্ধু ছিলেন, তাই তিনি ভাবোচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন করছেন। কিন্তু ভগবদ্ গীতার পাঠকের মন থেকে সেই সন্দেহ দূর করার জন্য অর্জুন পরবর্তী শ্লোকে বলেছেন যে, নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাসাদি ভগবৎ-তত্ত্ববিদ্ মহাজনেরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে স্বীকার করেছেন। বৈদিক জ্ঞান যথাযথভাবে বিতরণকারী এই সমস্ত মহাপুরুষদের আচার্যেরা স্বীকার করেছেন। তাই অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন যে, তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথাকেই তিনি সম্পূর্ণ নির্ভূল বলে গ্রহণ করেন। সর্বমেতদ্ ঋতং মন্যে- “তোমার প্রতিটি কথাই আমি পরম সত্য বলে গ্রহণ করি।” অর্জুন আরও বলেছেন যে, ভগবানের ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করা খুবই দুষ্কর এবং দেবতারাও তাঁর প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারেন না। এর অর্থ হচ্ছে যে, মানুষের চেয়ে উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিত যে দেবতা, তাঁরাও ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে অক্ষম। তাই সাধারণ মানুষ ভগবানের ভক্ত না হলে কিভাবে তাঁকে উপলব্ধি করবে?

    ভগবদ্ গীতাকে তাই ভক্তির মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণকে কখনই আমাদের সমকক্ষ বলে মনে করা উচিত নয়। শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ ব্যক্তি বলে মনে করা উচিত নয়, এমন কি তাঁকে একজন মহাপুরুষ বলেও মনে করা উচিত নয়। ভগবদ্ গীতার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হলে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে স্বীকার করে নিতেই হবে। সুতরাং ভগবদ্ গীতার বিবৃতি অনুসারে কিংবা অর্জুনের অভিব্যক্তি অনুসরণে যিনি ভগবদ্ গীতা বুঝতে চেষ্টা করছেন, তাঁকে শ্রীকৃষ্ণ যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তা অন্তত তত্ত্বগতভাবে মেনে নিতে হবে এবং সেই রকম বিনম্র মনোভাব নিয়ে ভগবদ্ গীতা উপলব্ধি করা সম্ভব। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবদ্গীতা না পড়লে, তা বুঝতে পারা খুবই কঠিন, কারণ এই শাস্ত্রটি চিরকালই বিপুল রহস্যাবৃত।

    ভগবদ্ গীতা আসলে কি? ভগবদ্ গীতার উদ্দেশ্য হচ্ছে অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। প্রতিটি মানুষই নানাভাবে দুঃখ কষ্ট পাচ্ছে, যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অর্জুনও এক মহা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অর্জুন ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এবং তার ফলে তখন ভগবান তাঁকে গীতার তত্ত্বজ্ঞান দান করে মোহমুক্ত করলেন। এই জড় জগতে কেবল অর্জুনই নন, আমরা প্রত্যেকেই সর্বদাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জর্জরিত। এই জড় জগতের অনিত্য পরিবেশে আমাদের অস্তিত্ব, তা অস্তিত্বহীনের মতো। এই জড় অস্তিত্বের অনিত্যতা আমাদের ভীতি প্রদর্শন করে, কিন্তু তাতে ভীতো হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের অস্তিত্ব হচ্ছে নিত্য। কিন্তু যে-কোনো কারণবশত আমরা অসৎ সত্তায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। অসৎ বলতে বোঝায় যার অস্তিত্ব নেই।

    এই অনিত্য অস্তিত্বের ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত দুঃখ কষ্ট ভোগ করছে। কিন্তু সে এতই মোহাচ্ছন্ন যে, তার দুঃখকষ্ট সম্পর্কে সে মোটেই অবগত নয়। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কেবল দুই-একজন তাদের ক্লেশ-জর্জরিত অনিত্য অবস্থাকে উপলব্ধি করতে পেরে অনুসন্ধান করতে শুরু করে, “আমি কে?” “আমি কোথা থেকে এলাম?” “কেন আমি এই জটিল অবস্থায় পতিত হয়েছি?” পরবর্তী পৃষ্ঠা
  • Add_6

    * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।