অসংখ্য বৈকুণ্ঠলোকে ভগবান তাঁর অংশ-প্রকাশ—চতুর্ভুজ বিষ্ণু এবং প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ, গোবিন্দ আদি রূপে তাঁর ভক্তদের সঙ্গদান করেন। তাই জীবনের শেষে পরমার্থবাদীরা ব্রহ্মজ্যোতি, পরমাত্মা কিংবা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করে থাকেন। সকলের ক্ষেত্রেই তাঁরা চিদাকাশে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেবল ভগবানের ভক্তেরাই বৈকুণ্ঠলোকে অথবা গোলক বৃন্দাবনে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভগবান এই বিষয়ে বলেছেন, “এতে কোনও সন্দেহ নেই।” এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেই হবে। আমাদের কল্পনার অতীত বলে এই কথা অবিশ্বাস করা উচিত নয়। আমাদের মনোভাব অর্জুনের মতো হওয়া উচিত—“তুমি যা বলেছ তা আমি সমস্তই বিশ্বাস করি।” তাই ভগবান যখন বলেছেন যে, মৃত্যুর সময় ব্রহ্ম, পরমাত্মা কিংবা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপের ধ্যান করলেই তাঁর আলয় অপ্রাকৃত জগতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, এই কথা ধ্রুব সত্য বলে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ২৫
মৃত্যুর সময় ভগবানের রূপের চিন্তা করে চিন্ময় জগতে প্রবেশ করা যে সম্ভব, তা ভগবদ্গীতায় (৮/৬) বর্ণিত হয়েছে—
“যে যেভাবে ভাবিত হয়ে শরীর ত্যাগ করে, সে নিঃসন্দেহে সেই রকম ভাবযুক্ত শরীর প্রাপ্ত হয়।” এখন, আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, জড়া প্রকৃতি হচ্ছে ভগবানের বহু শক্তির মধ্যে একটি শক্তির প্রকাশ। বিষ্ণুপুরাণে (৬/৭/৬১) ভগবানের শক্তির বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে—
বিষ্ণুশক্তিঃ পরা প্রোক্তা ক্ষেত্রজ্ঞাখ্যা তথাপরা ।
অবিদ্যা কর্মসংজ্ঞান্যা তৃতীয়া শক্তিরিষ্যতে ।।
ভগবানের শক্তি বিচিত্র ও অনন্তরূপে প্রকাশিত। আমাদের সীমতি অনুভূতি দিয়ে তাঁর সেই শক্তি আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু মহাজ্ঞানী মুনি-ঋষিরা, যাঁরা মুক্ত পুরুষ, যাঁরা সত্যদ্রষ্টা, তাঁরা ভগবানের শক্তিকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং শক্তিকে তাঁরা তিনটি ভাগে বিভক্ত করে তার বিশ্লেষণ করেছেন। এই সমস্ত শক্তিই হচ্ছে বিষ্ণুশক্তির প্রকাশ, অর্থাৎ তাঁরা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বিভিন্ন শক্তি। সেই প্রথম শক্তিকে বলা হয় পরাশক্তি বা চিৎ-শক্তি। জীবও এই উৎকৃষ্ট শক্তি থেকে উদ্ভূত, সেই কথা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। ভগবানের এই অন্তরঙ্গা শক্তি ব্যতীত আর যে সমস্ত শক্তি, তাকে বলা হয় জড়া শক্তি। এই সমস্ত শক্তি নিম্নতর শক্তি এবং সেগুলি তামসিক গুণের দ্বারা প্রভাবিত। মৃত্যুর সময় আমরা এই জড় জগতের তামসিক গুণের দ্বারা আচ্ছাদিত নিম্নতর শক্তিতে থাকতে পারি অথবা চিন্ময় জগতের চিৎ-শক্তিতে উত্তীর্ণ হতে পারি। তাই ভগবদ্গীতায় (৮/৬) বলা হয়েছে—
“যে যেভাবে ভাবিত হয়ে শরীর ত্যাগ করে, সে নিঃসন্দেহে সেই রকম ভাবযুক্ত শরীর প্রাপ্ত হয়।”
আমাদের জীবনে আমরা হয় জড়া শক্তি নতুবা চিৎ-শক্তির সম্বন্ধে ভাবতে অভ্যস্ত। এখন, আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে জড়া শক্তি থেকে চিৎ-শক্তিতে কিভাবে রূপান্তরিত করতে পারি ? খবরের কাগজ, উপন্যাস আদি নানা রকম বই আমাদের মনকে জড়া শক্তির ভাবনার যোগান দেয়। আমাদের চিন্তাধারা এই ধরনের সাহিত্যের দ্বারা আবিষ্ট হয়ে আছে বলেই আমরা উচ্চতর চিৎ-শক্তিকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে পড়েছি। আমরা যদি এই চিৎ-শক্তিকে জানতে চাই, বা ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে চাই, তবে আমাদের বৈদিক সাহিত্যের স্মরণ নিতে হবে। মানুষকে অপ্রাকৃত জগতের সন্ধান দেবার জন্যই ভারতের মুনি-ঋষিদের মাধ্যমে ভগবান বেদ, পুরাণ আদি বৈদিক শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়েছেন। এই সমস্ত সাহিত্য মানুষের কল্পনাপ্রসূত নয়; এগুলি হচ্ছে সত্য দর্শনের বিশদ ঐতিহাসিক বিবরণ। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (মধ্য ২০/১২২) বলা হয়েছে—
মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বতঃ কৃষ্ণজ্ঞান।
জীবেরে কৃপায় কৈলা কৃষ্ণ বেদ-পুরাণ।।
স্মৃতিভ্রষ্ট জীবরা ভগবানের সঙ্গে তাদের শাশ্বত সম্পর্কের কথা ভুলে গেছে এবং তাই তারা জড়-জাগতিক কার্যকলাপে মগ্ন হয়ে আছে। তাদের চিন্তাধারাকে অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বহু বৈদিক শাস্ত্র প্রদান করেছেন। প্রথমে তিনি বেদকে চার ভাগে ভাগ করেন। তারপর পুরাণে তিনি তাদের ব্যাখ্যা করেন এবং অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের জন্য তিনি মহাভারত রচনা করেন। এই মহাভারতে তিনি ভগবদ্গীতার বাণী প্রদান করেন। তারপর সমস্ত বৈদিক সাহিত্যের সংক্ষিপ্তসার বেদান্তসূত্র প্রণয়ন করেন। বেদান্তসূত্রকে সহজবোধ্য করে তিনি তার ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করেন। মনোনিবেশ সহকারে এই সমস্ত বৈদিক সাহিত্য অধ্যায়ন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। জড় জগতে আবদ্ধ সাংসারিক লোকেরা যেমন খবরের কাগজ, নানা রকমের পত্রিকা, নাটক, নভেল আদি পড়ে থাকে এবং তার ফলে জড় জগতের প্রতি তাদের মোহমুগ্ধ অনুরাগ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে, তেমনই যারা ভগবানের স্বরূপশক্তি উপলব্ধি করে ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে চায়, তাদের কর্তব্য হচ্ছে মহামুনি ব্যসদেবের রচিত বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন করা। বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন করার ফলে আমরা জানতে পারি-- ভগবান কে, তাঁর স্বরূপ কি, আমাদের সঙ্গে তাঁর কি সম্পর্ক। এই সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করার ফলে মন ভগবান্মুখী হয়ে ওঠে এবং তার ফলে অন্তকালে ভগবানের সচ্চিদানন্দময় রূপের ধ্যান করতে করতে আমরা দেহত্যাগ করতে পারি। ভগবদ্গীতাতে ভগবান বারবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এটিই হচ্ছে তাঁর কাছে ফিরে যাবার একমাত্র পথ এবং তিনি বলেছেন যে, “এতে কোন সন্দেহ নেই।”
“।অতএব অর্জুন ! সর্বক্ষণ আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাব বিহিত যুদ্ধ করা উচিত। তোমার মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পণ করে কার্য করলে নিঃসন্দেহে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে।” (ভঃ গীঃ ৮/৭) ২৭
তিনি অর্জুনকে তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হয়ে তাঁর ধ্যান করতে আদেশ দেননি। ভগবান কোন অবাস্তব পরামর্শ দেন না। পক্ষান্তরে, তখন তিনি বলেছেন, “আমাকে স্মরণ করে তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম করে যাও।” এই জড় জগতে দেহ ধারণ করতে হলে কাজ করতেই হবে। কর্ম অনুসারে মানব-সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-- এই চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এতে ব্রাহ্মণেরা বা সমাজের বুদ্ধিমান লোকেরা এক ধরনের কাজ করছে, ক্ষত্রিয়েরা বা পরিচালক সম্প্রদায় অন্য ধরনের কাজ করছে এবং ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সম্প্রদায় তাদের বিশেষ ধরনের কাজ করছে। মানব-সমাজে প্রত্যেকেই সে শ্রমিকই হোক, ব্যবসায়ী হোক, যোদ্ধা হোক, চাষী হোক অথবা এমনকি সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, বৈজ্ঞানিক কিংবা ধর্মতত্ত্ববিদই হোন না কেন, এদের সকলকেই জীবন ধারণ করবার জন্য তাদের নির্ধারিত কর্ম করতেই হয়। তাই ভগবান অর্জুনকে তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন।
পরবর্তী পৃষ্ঠা