শ্রী শ্রী গীতার জ্ঞান সহজে উপলব্ধির উপায় বা গীতার জ্ঞান বুঝতে হলে যে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

পৃষ্ঠা - ১   ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,   ১০   ,   ১১   ,   ১২   ,   ১৩   ,   ১৪

  • হরেকৃষ্ণ।
    শ্রীল প্রভুপাদ রচিত -

    পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা'র পর -

    নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা চিন্ময় জগৎ লাভ করতে পারি (ভঃ গীঃ ১৫/৫)-

    নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা
    অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ ।
    দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ-
    র্গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ ॥

    সেই পদম্ অব্যয়ম্ বা নিত্য জগতে সে-ই যেতে পারে, যে নির্মাণমোহ অর্থাৎ যে মোহমুক্ত হতে পেরেছে। এর অর্থ কি? এই জড় জগতে সকলেই কিছু না কিছু হতে চায়। কেউ চায় রাজা হতে, কেউ চায় প্রধানমন্ত্রী হতে, কেউ চায় ঐশ্বর্যশালী হতে, এভাবে সকলেই কিছু না কিছু হতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই অভিলাষগুলির প্রতি আসক্ত থাকি, ততক্ষণ আমরা আমাদের দেহকে আমাদের স্বরূপ বলে মনে করি, কারণ দেহকে কেন্দ্র করেই এই সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি জন্ম নেয়। আমরা যে আমাদের দেহ নই, এই উপলব্ধিটাই হচ্ছে অধ্যাত্ম উপলব্ধির প্রথম সোপান। জড় জগতের যে তিনটি গুণের দ্বারা আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়ি, তার থেকে মুক্ত হওয়াটাই হচ্ছে আমাদের প্রথম কর্তব্য এবং তার উপায় হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি। ভক্তির মাধ্যমে ভগবানের সেবা করলে এই বন্ধন আপনা থেকেই খসে পড়ে। কামনা-বাসনার বশবর্তী হবার ফলে আমরা জড়া প্রকৃতির উপরে আধিপত্য করতে চাই এবং তার ফলে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। যতক্ষণ না আমরা আধিপত্য করার এই বাসনাকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে পারছি, ততক্ষণ আমরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের আলয় সনাতন ধামে ফিরে যেতে পারব না। সেই ভগবৎ-ধাম, যা সনাতন, সেখানে কেবল তাঁরাই যেতে পারেন, যাঁরা জড় জগতের ভোগ-বাসনার দ্বারা লালায়িত নন, যাঁরা ভগবানের সেবায় নিজেদের সর্বতোভাবে নিয়োজিত করেছেন। কেউ এভাবে অধিষ্ঠিত হলে তিনি অনায়াসে পরম ধামে উপনীত হন।

    ভগবদ্গীতায় অন্যত্র (৮/২১) বলা হয়েছে-

    অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম্ ।
    যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥


    অব্যক্ত মানে অপ্রকাশিত। এমনকি এই জড় জগতের সবকিছু আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়নি। আমাদের জড় ইন্দ্রিয় এতই সীমিত যে, জড় আকাশে যে সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রাদি আছে, তাও আমাদের গোচরীভূত হয় না। বৈদিক সাহিত্যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য গ্রহ-নক্ষত্রের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা সেই সব বিশ্বাস করতে পারি অথবা বিশ্বাস নাও করতে পারি। বিশেষ করে শ্রীমদ্ভাগবতে এর বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। এই জড় আকাশের ঊর্ধ্বে সে অপ্রাকৃত লোক আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে তাকে অব্যক্ত অর্থাৎ অপ্রকাশিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই যে অপ্রাকৃত লোক যা নিত্য, সনাতন, যেখানে প্রতিনিয়ত দিব্য আনন্দের আস্বাদন পাওয়া যায়, সেই যে দিব্য জগৎ, তাই হচ্ছে মানব-জীবনের পরম লক্ষ্য- মানব জীবনের পরম গন্তব্যস্থল। সেখানে একবার উত্তীর্ণ হলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেই পরম রাজ্যের জন্যই মানুষের বাসনা ও আগ্রহ থাকা উচিত।

    এখানে প্রশ্ন হতে পারে- কিভাবে সেই অপ্রাকৃত জগতে যাওয়া যায় ? ভগবদ্ গীতার অষ্টম অধ্যায়ে এই বিষয়ে তথ্য দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-

    অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্ত্বা কলেবরম্ ।
    যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ॥

    “মৃত্যুর সময় যিনি আমাকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভাবই প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” (ভঃ গীঃ ৮/৫)

    মৃত্যুকালে শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করতে পারলেই শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপ স্মরণ করতে হবে; এই রূপ স্মরণ করতে করতে যদি কেউ দেহত্যাগ করে, তা হলে সে অবশ্যই দিব্য ধামে চলে যায়। এখানে মদ্ভাবম্ বলতে পরমেশ্বর ভগবানের পরম ভাবের কথা বলা হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সৎ-চিৎ-আনন্দ বিগ্রহ অর্থাৎ তার রূপ নিত্য, জ্ঞানময় ও আনন্দময়। আমাদের এই জড় দেহ সৎ-চিৎ-আনন্দময় নয়। এই দেহ অসৎ, এই দেহের কোন স্থায়িত্ব নেই। এই দেহ বিনাশ হয়ে যাবে। এই দেহ চিৎ বা জ্ঞানময় নয়, পক্ষান্তরে এই দেহ অজ্ঞনতায় পরিপূর্ণ। অপ্রাকৃত জগৎ সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান নেই, এমন কি এই জড় জগৎ সম্বন্ধেও আমাদের যে জ্ঞান আছে, তা ভ্রান্ত ও সীমিত। এই দেহ নিরানন্দ; আনন্দময় হবার পরিবর্তে এই দেহ দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। এই জগতে যত রকমের দুঃখ-দুর্দশা আমরা পেয়ে থাকি, তা সবই এই দেহটির জন্যই। কিন্তু যখন আমরা এই দেহটিকে ত্যাগ করবার সময় পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপটি স্মরণ করি, তখন আমরা জড় জগতের কলুষমুক্ত সৎ-চিৎ-আনন্দময় দিব্য দেহ প্রাপ্ত হই।

    এই জগতে দেহত্যাগ করা এবং অন্য একটি দেহ লাভ করা প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা সুচারুভাবে পরিচালিত হয়। পরবর্তী জীবনে কি রকম দেহ প্রাপ্ত হবে, তা নির্ধারিত হবার পরেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে। জীব নিজে নয়, তার থেকে উচ্চস্তরে যে-সমস্ত নির্ভরযোগ্য অধিকারীরা রয়েছেন, যাঁরা ভগবানের আদেশ অনুসারে এই জড় জগতের পরিচালনা করেন, তাঁরাই জীবের কর্ম অনুসারে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। আমাদের কর্ম অনুসারে আমরা ঊর্ধ্বলোকে উত্তীর্ণ হই অথবা নিম্নলোকে পতিত হই। এভাবেই প্রতিটি জীবন তার পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতির কর্মক্ষেত্র। এই জীবনে যদি আমরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ ধামে উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি, তবে এই দেহত্যাগ করবার পর আমরা অবশ্যই ভগবানের মতো সৎ-চিৎ-আনন্দময় দেহ প্রাপ্ত হয়ে ভগবদৎ-ধামে ফিরে যেতে পারব।

    পূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, বিভিন্ন ধরনের পরমার্থবাদী আছেন- ব্রহ্মবাদী, পরমাত্মবাদী ও ভক্ত। আর এই কথাও বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মজ্যোতিতে বা চিন্ময় আকাশে অগণিত চিন্ময় গ্রহাদি ভাসছে। এই সব গ্রহের সংখ্যা সমস্ত জড় জগতের গ্রহের থেকে অনেক বেশি। এই জড় জগতের আয়তন সৃষ্টির এক চতুর্থাংশের সামান বলে অনুমিত হয়েছে (একাংশেন স্থিতো জগৎ)। এই জড় জগতের অংশে অগণিত সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র সমন্বিত কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সমস্ত জড় সৃষ্টি হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টির এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সৃষ্টির অধিকাংশই রয়েছে চিন্ময় আকাশে। পরমার্থবাদীদের মধ্যে যাঁরা নির্বিশেষবাদী, যাঁরা ভগবানের নিরাকার রূপকে উপলব্ধি করতে চান, তাঁরা ভগবানের দেহনির্গত ব্রহ্মজ্যোতিতে বিলীন হয়ে যান। এভাবে তাঁরা চিদাকাশ প্রাপ্ত হন। কিন্তু ভগবানের ভক্ত ভগবানের দিব্য সান্নিধ্য লাভ করতে চান, তাই তিনি বৈকুণ্ঠলোকে উন্নীত হয়ে ভগবানের নিত্য সাহচর্য লাভ করেন। পরবর্তী পৃষ্ঠা
  • Add_6

    * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।