শ্রী শ্রী গীতার জ্ঞান সহজে উপলব্ধির উপায় বা গীতার জ্ঞান বুঝতে হলে যে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

পৃষ্ঠা - ১   ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,     ,   ১০   ,   ১১   ,   ১২   ,   ১৩   ,   ১৪

  • হরেকৃষ্ণ।
    শ্রীল প্রভুপাদ রচিত -

    পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা'র পর -
    ত্রুটিহীন, অভ্রান্ত জ্ঞান আমাদের ভগবদগীতা থেকে গ্রহণ করতে হবে, যার উৎস হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান এবং যা গুরু-শিষ্য পরম্পরাক্রমে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। অর্জুন যখন শিষ্যরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে গীতার জ্ঞান আহরণ করেন, তখন তিনি কোনো রকম বাদানুবাদ না করে, ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীকে পরম সত্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। ভগবদগীতাকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা চলে না। আমরা বলতে পারি না যে, ভগবদগীতার একটি অংশ আমরা গ্রহণ করব, আর বাকিটা গ্রহণ করব না। ভগবদগীতার বাণী সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতভাবে খেয়ালখুশি মতো বাদ না দিয়ে কিংবা মনগড়া ব্যাখ্যা না করেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যেভাবে তা বলেছিলেন, ঠিক সেভাবেই ভগবদ্গীতার যথাযথ নির্দেশ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, গীতা হচ্ছে বৈদিক জ্ঞানের পূর্ণ প্রকাশ। বৈদিক জ্ঞান এই জড় জগতের জ্ঞান নয়, এর প্রবর্তক হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান, তাই বেদের জ্ঞান হচ্ছে দিব্যজ্ঞান। অপ্রাকৃত উৎস থেকে বৈদিক জ্ঞান গ্রহণ করতে হয় এবং এর প্রথম বাণী নিঃসৃত হয়েছিল স্বয়ং ভগবানের কাছ থেকেই। ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীকে বলা হয় অপৌরুষেয়, অর্থাৎ ভগবানের কথা সাধারণ মানুষের কথার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, সাধারণ মানুষ চারটি ত্রুটির দ্বারা কলুষিত—১) ভ্রম, ২) প্রমাদ, ৩) বিপ্রলিপ্সা, ৪) করণাপাটব। ভ্রম- সাধারণ মানুষ অবধারিতভাবে ভুল করে; প্রমাদ- সে মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন; বিপ্রলিপ্সা- সে অন্যকে প্রতারণা করতে চেষ্টা করে এবং করণাপাটব- সে তার ত্রুটিপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সীমিত। এই সমস্ত ত্রুটি থাকার ফলে মানুষ সর্বপরিব্যাপ্ত পরম জ্ঞান গ্রহণ করতে ও প্রধান করতে অক্ষম।

    বৈদিক জ্ঞান এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ জীবদের দ্বারা প্রদত্ত হয়নি। প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মার হৃদয়ে ভগবান সর্বপ্রথমে এই জ্ঞান প্রদান করেন, তারপর ব্রহ্মা যেভাবে পরমেশ্বরের কাছ থেকে সেই জ্ঞান পেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই তাঁর সন্তান ও শিষ্যদের মধ্যে তা বিতরণ করেন। ভগবান হচ্ছেন পূর্ণ, জড়া প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা তাঁর কখনই প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই যাঁরা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন তাঁরা বুঝতে পারেন, ভগবানই হচ্ছেন আদি স্রষ্টা—ব্রহ্মাকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই হচ্ছেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুর ভোক্তা। ভগবদ্ গীতার একাদশ অধ্যায়ে ভগবানকে প্রপিতামহ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ তিনি পিতামহ ব্রহ্মারও পিতা। এভাবে সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই যে, ভগবানই হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা। তাই আমাদের কখনই মনে করা উচিত নয়, আমরা কোন কিছুর মালিক। মালিক কেবল তিনিই, যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। জীবন ধারণ করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন এবং ভগবান আমাদের জন্য যতটুকু নির্ধারিত করে রেখেছেন, ঠিক ততটুকুই আমাদের গ্রহণ করা উচিত।

    আমাদের জন্য ভগবান যতটুকু নির্ধারিত করে রেখেছেন, তা কিভাবে সদ্ব্যবহার করতে হবে তার অনেক সুন্দর সুন্দর উদাহরণ আছে। ভগবদ্গীতাতেও এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন ঠিক করেন তিনি যুদ্ধ করবেন না। এটি ছিল তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত। অর্জুন পরমেশ্বর ভগবানকে বলেন যে, সেই যুদ্ধে নিজের আত্মীয়-পরিজনদের হত্যা করে রাজ্য ভোগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দেহাত্মবুদ্ধির ফলে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে তাঁর দেহ, এবং তাঁর দেহজাত আত্মীয়-পরিজন, ভাই, ভাইপো, ভগ্নীপতি, পিতামহ প্রভৃতিকে তিনি তাঁর আপনজন বলে মনে করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর দেহের দাবিগুলি মেটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ঐ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্যই ভগবান ভগবদ্গীতার দিব্যজ্ঞান তাঁকে দান করেন। এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তাঁর প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারার ফলেই অর্জুন ভগবানের পরিচালনায় যুদ্ধ করতে ব্রতী হন। তখন তিনি বলেন, করিষ্যে বচনং তব- “তুমি যা বলবে আমি তাই করবো ।”

    এই পৃথিবীতে মানুষ কুকুর-বেড়ালের মত ঝগড়া করে দিন কাটাবার জন্য আসেনি। তাকে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানব-জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে এবং একটি পশুর মতো জীবন যাপন করা বর্জন করতে হবে। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র মানব-জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছে, এবং সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারাংশ ব্যক্ত হয়েছে ভগবদ্ গীতাতে। বৈদিক সাহিত্য মানুষের জন্য, পশুদের জন্য নয়। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য হচ্ছে বৈদিক জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে মানবজীবন সার্থক করে তোলা। কোন পশু যখন অন্য পশুকে হত্যা করে, তাতে তার পাপ হয় না, কিন্তু মানুষ যদি তার বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের জন্য কোন পশুকে হত্যা করে, তখন সে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে অপরাধী হয়। ভগবদ্ গীতাতে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, প্রকৃতির বিভিন্ন গুণ অনুসারে তিন রকমের কর্ম সাধিত হয়, যথা- সত্ত্বগুণের প্রভাবে কর্ম, রজোগুণের প্রভাবে কর্ম এবং তমোগুণের প্রভাবে কর্ম। তেমনই আহার্য বস্তুও আছে তিন ধরনের- সত্ত্বগুণের, রজোগুণের আহার, আর তমোগুণের আহার। এই সবই পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা আছে এবং যদি আমরা ভগবদ্গীতার এই সব নির্দেশ যথার্থভাবে কাজে লাগাই, তা হলে আমাদের সারা জীবন পবিত্র হয়ে উঠবে এবং পরিণামে আমরা এই জড় জগতের আকাশের ঊর্ধ্বে আমাদের পরম লক্ষ্যে উপনীত হতে পারব (যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম )।

    এই পরম গন্তব্যস্থলের নাম ‘সনাতন ধাম’। সেই নিত্য শাশ্বত অপ্রাকৃত জগৎই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত আলয়। এই জড় জগতে আমরা দেখতে পাই সবকিছু অস্থায়ী। তাদের প্রকাশ হয়, কিছুকালের জন্য তারা অবস্থান করে, কিছু ফল প্রসব করে, ক্ষয় প্রাপ্ত হয় এবং তারপর এক সময় তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। এটিই হচ্ছে এই জড় জগতের ধর্ম, আমাদের এই দেহ, অথবা এক টুকরো ফল অথবা অন্য যে-কোনো কিছুরই দৃষ্টান্ত আমরা দিই না কেন। কিন্তু এই অস্থায়ী জগতের অতীত আর একটি জগৎ আছে, যার কথা আমরা জানতে পারি বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে। সেই জগৎ শাশ্বত, সনাতন। বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি জীবও শাশ্বত, সনাতন। ভগবদ্ গীতার একাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ভগবান সনাতন এবং সনাতন ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবার ফলে জীবাত্মাও সনাতন। ভগবানের সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে, এবং যেহেতু গুণগতভাবে সনাতন ধাম, সনাতন ভগবান ও সনাতন জীব- সবই এক, তাই ভাগবদ্ গীতার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের সনাতন বৃত্তি অথবা আমাদের সনাতন ধর্মকে পুনর্জাগরিত করা। অস্থায়ীভাবে আমরা নানা ধরনের কর্মে নিয়োজিত রয়েছি, কিন্তু এই সমস্ত কর্ম পবিত্রতা অর্জন করতে পারে, যদি আমরা এই সমস্ত অস্থায়ী কর্ম বর্জন করি আর পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ মতো কর্মভার গ্রহণ করি। এরই নাম পবিত্র জীবন। পরবর্তী পৃষ্ঠা
  • Add_6

    * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।