ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • যেখানে নৃসিংহদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন

    অহোবলম

    ধ্রুব দাস

    ৫১ বাকী
    আসার পয়সা জমাতে শুরু করলাম । কিন্তু ভারত দেশটি এত বড় , আমার ঠিক কোথায় যাওয়া উচিত আমি চিন্তা করছিলাম । একদিন আমি মিয়ামি হরেকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে পুরানো ' ব্যাক টু গডহেড ' পত্রিকা ঘাটছিলাম । একটি পত্রিকায় দেখি প্রচ্ছদে পূর্ণাবয়ব নৃসিংহদেবের ছবি । ঐ পত্রিকাটিতেই রয়েছে তরুণ সন্ন্যাসী শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম স্বামী মহারাজের দক্ষিণ ভারতের এক দুর্গম স্থানে নৃসিহংদেবের আবির্ভাবস্থলীরূপে পরিচিত অহোবলম ভ্রমণ বৃত্তান্ত এখানেই একসময় ছিল হিরণ্যকশিপুর প্রাসাদ । এইখানেই প্রাসাদ স্তম্ভ থেকে নৃসিংহদেব আবির্ভূত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেছিলেন । এখন সেই স্থান দুর্গম অরণ্যময় শ্বাপদ সঙ্কুল এক অঞ্চল । কিন্তু শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম স্বামীর সেই অভিযান সম তীর্থযাত্রার কাহিনী পাঠ করে আমি অনুপ্রাণিত হয়ে উঠলাম । ঠিক করলাম , যত কঠিন যাত্রাপথই হোক আমি অহোবলমে যাব ।

        ভারতে পৌঁছে আমি প্রথমে বৃন্দাবনে এলাম । সেখানে ত্রিনয়ন বিশিষ্ট শ্রীনৃসিংহদেবকে দর্শন করে আমি আমার অহোবলম অভিযাত্রা শুরু করলাম । সেখান থেকে দক্ষিণ ভারতের নানা পবিত্র তীর্থস্থান দর্শন করে আমি অবশেষে তিরুপতি এলাম । ইসকন তিরুপতি মন্দিরের ভক্তগণ আমায় জিজ্ঞাসা করলেন আমি এরপর কোথায় যাবো । ' অহোবলম ' এই নামটি উচ্চারণ করতেই তাঁরা সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি একটি পাগল এবং আমাকে সেখানে যেতে নিষেধ করতে লাগলেন । শেষ পর্যন্ত আমার অহোবলমে যাওয়ার দৃঢ় মনোভাব বুঝতে পেরে আমাকে সেখানে একদিনের বেশি না থাকার জন্য সাবধান করে দিলেন । একজন অভিজ্ঞ ভক্ত আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন ওখানকার মানুষেরা আমার সবকিছু ছিনতাই করার এমন কি আমাকে হত্যার চেষ্টাও করতে পারে এবং চারপাশের গভীর জঙ্গলে ভয়ঙ্কর বন্যপ্রাণী যেমন বাঘ , ভালুক , কেউটে সাপ প্রভৃতি রয়েছে । তাঁদের এইসব কথা শুনে মনে মনে কিছুটা ভয় অনুভব করলেও , ভাবলাম তাহলে এই যাত্রাই হোক ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের প্রতি আমার বিশ্বাসের পরীক্ষা ।

        তিরুপতি থেকে দীর্ঘ ১০ ঘন্টা বাস যাত্রা করে আমি আল্লাগাদা স্টেশনে পৌঁছালাম । ওখান থেকেই আমি অহোবলমের বাস ধরব । বাসের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম , ধীরে ধীরে দেখলাম আমাকে ঘিরে স্থানীয় মানুষদের বেশ ভীড় জমে গেল । ওখানে আমিই একমাত্র সোনালী চুল ও সাদা চামড়ার বিদেশী মানুষ । ওরা সবাই আমাকে অবাক চোখে দেখছিল । একজন ইংরেজি জানা মানুষ আমি কোথায় যাচ্ছি তা জিজ্ঞাসা করলেন । আমি যখন উত্তর করলাম যে “ অহোবলম ” তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকালেন । আমার উত্তরটি তিনি স্থানীয় মানুষদের বুঝিয়ে বলতে তারাও প্রত্যেকে যেন বিস্মিত হল ।

        “ আপনি ওখানে কেন যেতে চাইছেন ? ” সেই ভদ্রলোক আমাকে আবার প্রশ্ন করলেন । “ এটি বড় ভয়ানক জায়গা । " বললেন তিনি ।

        “ আমি ভগবান নৃসিংহদেবের দর্শনে যাচ্ছি । ” আমি উত্তর দিলাম । “ তিনি যেন আপনাকে রক্ষা করেন । ” শান্তভাবে এই কথা বলে সেই লোক চলে গেলেন ।

        ইতিমধ্যে বাস এসে গেলে আমি বাসে উঠে পড়লাম । বাস অহোবলমের যত নিকটবর্তী হচ্ছিল আমি অনুভব করছিলাম , উত্তেজনায় আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন কাঁপছে এবং আমার হৃদস্পন্দন যেন দ্রুততর হচ্ছে । জানি না সম্মুখে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে , কিন্তু আমি আমার প্রভুকে তাঁর আবির্ভাবস্থলীতে দর্শন করতে চলেছি ।

        এক ঘন্টা বাস যাত্রার পর আমি নিম্ন অহোবলমের একটি ছোট্ট গ্রামে এসে পৌঁছলাম । সারা অহোবলম এলাকা জুড়ে ভগবান নৃসিংহদেবের নয়টি ভিন্ন ভিন্ন রূপের মন্দির ছড়িয়ে আছে । এখানে লক্ষ্মী - নরসিংহ রূপের মন্দির । আমি তা দর্শন করলাম । ওখানে কোথাও থাকবার জারগা নেই । তবু কোনমতে থাকবার | একটি ঘর জোগাড় করলাম । আমি যখন স্নান করছিলাম তখন | কে যেন “ হ্যালো , হরেকৃষ্ণ ” বলে দরজা ধাক্কাতে লাগলো । যেহেতু আমাকে সবাই চোর ডাকাত সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিল আমি তাই সাবধানে দরজা খুলতেই দেখি দুজন ভারতীয় দাঁড়িয়ে আছে । তাদের একজন দেখতে সাধু প্রকৃতির এবং লম্বা চেহারার তিনি নিজেকে বিজয়ওয়াড়া থেকে আগত মধু বলে পরিচয় দিলেন । কয়েক বৎসর আগে তিনি ইসকনে ছিলেন । এখন রামানুজ সম্প্রদায়ে দীক্ষিত । তিনি আমাকে বললেন “ আমি শুনেছি তুমি নাকি ভগবান নৃসিংহদেবের নটি রূপের সমস্ত বিগ্রহই দর্শন করতে চাও ?

        আমি বললাম , “ হ্যাঁ ” আর মনে মনে ভাবলাম এখানে খবর কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ।

        তিনি বললেন , “ আমিও কাল সকালে দর্শনে চলেছি । আর তাহলে আম একসাথেই দর্শন করতে যেতে পারি । আমি এর আগে অনেকবার নয়টি মন্দির | দর্শন করেছি । আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নয়টি মন্দিরে নিয়ে যেতে পারব । ”

        ওর কথা শুনে আমার মনে হল এ যেন সবকিছু নৃসিংহদেবেরই অয়োজন । আমি তাই সহজেই সম্মত হলাম আর মধুকে জিজ্ঞাসা করলাম , এর জন্য সে কত নেবে । মধু বিনীতভাবে উত্তর দিল " আমি একজন ভক্তের সেবা করতে পারলেই খুশী হব।” কথায় কথায় মধু আমাকে জানিয়ে রাখল যে নৃসিংহদেবের নয়টি রূপকে একদিনে দর্শন করতে হলে আমাদের দুর্গম জঙ্গলের ভিতর রাত্রিবাস করতে হবে ।

       

    যাত্রা শুরু হলো

    ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি মধুর সঙ্গে দেখা করলাম । এরপর আমরা দুজনে একসঙ্গে ভগবান নৃসিংহদেবের কাছে আমাদের যাত্রাকে সুরক্ষিত করার প্রার্থনার জন্য নিকটস্থ লক্ষ্মী নৃসিংহ মন্দিরে গেলাম । আমি আগেই জানিয়েছি যে এই লক্ষ্মী - নৃসিংহ মন্দিরটি হচ্ছে অহোবলমের নয়টি নৃসিংহ মন্দিরের প্রথম মন্দির । এখান থেকেই আমাদের পূর্ণ অহোবলমের তীর্থ যাত্রা শুরু হলো ।

        ভগবান নৃসিংহদেবের নয়টি রূপের দ্বিতীয় রূপের মন্দির ভার্গব নরসিংহ মন্দিরের উদ্দেশ্যে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম । হাঁটতে হাঁটতে পাথুরে জমি ছাড়িয়ে জঙ্গল শুরু হল । শুরুতে জঙ্গল তেমন ঘন নয় । জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বিভিন্ন দিকে পায়ে চলা সরু সরু পথ চলে গেছে । চলতে চলতে মধু আমায় জানাল , ' তুমি কতবার এখানে এসেছ এটা কোন ব্যাপার নয় । এখানে যে কোন সময় যে কেউই পথ হারাতে পারে । সবকিছুই এখানে ভগবান নৃসিংহদেবের কৃপার উপর নির্ভরশীল । ”

        আর সত্যি সত্যিই নির্জন জঙ্গল পথে আমরা পথ ভুল করলাম । আমি শঙ্কিত বোধ করছিলাম । কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাস্তা খুঁজে পেয়ে অপূর্ব সেই ভার্গব নরসিংহ মন্দিরে পৌঁছে গেলাম আমরা । সেখানে বসে কিছুক্ষণ আমরা মহামন্ত্র জপ করলাম । অতীতে বহু মহাত্মা এই মন্দিরের বিগ্রহের আরাধনা করেছেন । মধু জানালেন এই বিগ্রহ ভগবানের যোদ্ধা অবতার পরশুরামের নামে নামাঙ্কিত । পরশুরাম ভার্গব নামেও পরিচিত । ভগবান পরশুরাম অহোবলমের নিকটবর্তী এক স্থানে ( বর্তমানে যা রামতীর্থ নামে পরিচিত ) | কঠোর তপস্যা করেছিলেন ।

        এরপর আমরা নৃসিংহদেবের তৃতীয় রূপ চত্রবাড় নরসিংহ মন্দির দর্শনে রওনা হলাম । মধু বলছিলেন আমরা যদি ভাগ্যবান হই তাহলে নয়টি রূপের সকল বিগ্রহকেই আমরা আজকের এই পবিত্র দিনে দর্শন করতে সমর্থ হব । চত্রবাড় নরসিংহ বিগ্রহ দেখে আমি অভিভূত হলাম । এখানে নৃসিংহদেব হাস্যময় বিগ্রহ জ্যোর্তিময় রূপে উদ্ভাসিত । চত্রবাড় নরসিংহ বিগ্রহের পাদপরে আমরা আমাদের মস্তক স্পর্শ করলাম । মন্দিরের পুরোহিত সেটি অনুমোদন করেছিলেন । এই চত্রবাড় নরসিংহের কাছেই রয়েছে , নৃসিংহদেবের চতুর্থরূপ যোগানন্দ নরসিংহ মন্দির । নিম্ন অহোবলম অঞ্চলে ভগবান নৃসিংহদেবের নয়টি রূপের এটিই শেষ মন্দির । এখানে নৃসিংহদেবের ঐশ্বর্যমণ্ডিত এক মহাশক্তিময় রূপ । বলা হয়ে থাকে যে নয়টি নৃসিংহদেবের বিগ্রহের মধ্যে এই যোগানন্দ নরসিংহই সবচেয়ে কৃপালু ।

        এবার আমরা উচ্চ অহোবলম অঞ্চলে যাবার জন্য বাসে উঠে পড়লাম । এক ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কুল পথে এই যাত্রা । কিছুদূর বাস চলার পর এক জায়গায় এসে বাস থেমে গেল এবং ড্রাইভার আমাদের নেমে যেতে বললো । বাস থেকে নেমে চারদিকে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না । কিন্তু বাসটি চলে যেতেই করঞ্জ নরসিংহ মন্দির আমার দৃষ্টিগোচর হল । মন্দিরের নিকটবর্তী একটি করঞ্জ ফলগাছের নামানুসারে তাঁর এখানে এই নাম হয়েছে । এই মন্দিরটি নিয়ে আমাদের ভগবান নৃসিংহদেবের প্রথম পাঁচটি রূপের দর্শন করা হল । এবার আমরা পরবর্তী ষষ্ঠ বিগ্রহ উগ্র - নরসিংহ মূর্তি দর্শনের জন্য যাত্রা করলাম । দুটি পাহাড়ের সংযোগস্থলের এক সুপ্রাচীন গুহায় এই বিগ্রহটি রয়েছে ।

        উগ্র - নরসিংহ বিগ্রহ দর্শনে যাবার পথটি বেশ গা ছমছমের । ঘন জঙ্গলাকীর্ণ উঁচু নীচু পাহাড়ী পথটি বন্য জীবজন্ততে পূর্ণ । প্রতি মুহূর্তে বিপদের ভয় । কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কোন বন্য জন্তুর মুখোমুখি হতে হয় নি । দ্রুত পা চালিয়ে আমরা অতি শীঘ্রই সেই গুহায় পৌঁছে গেলাম যেখানে ভগবান নৃসিংহদেব উগ্র - নরসিংহ রূপে অধিষ্ঠিত রয়েছেন । নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এখানে তাঁর উগ্র অর্থাৎ ভয়ঙ্কর মূর্তি । আমরা সেখানে ভগবানের কাছে আমাদের পরবর্তী যাত্রাপথের সুরক্ষা প্রার্থনা করলাম । এরপর আমরা যাবো উগ্র - স্তম্ভ দর্শনে । হিরণ্যকশিপুর প্রাসাদের যে স্তম্ভটি থেকে স্বয়ং ভগবান নৃসিংহরূপে আবির্ভূত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেছিলেন । উগ্র স্তম্ভ দর্শন করার পথেই আমরা নৃসিংহদেবের সপ্তম মূর্তি ' জ্বালা নরসিংহ ' দর্শন করলাম । আমাদের পথ খুবই বিপজ্জনক । বেশ কিছুটা পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে উঠতে হবে । পার হতে হয়েছে বেশ কিছু পাহাড়ী জলস্রোত । একটু অসতর্ক হলেই মৃত্যু অবধারিত । পথে যেতে যেতে আমার সঙ্গী ভক্ত মধু পথের ধারে পড়ে থাকা কিছু বড় বড় কাঠের বাক্স দেখাল । মধু বলছিল , পাহাড়ে আরোহণ করতে গিয়ে যাদের মৃত্যু হয় এগুলো তাদের জন্য ব্যবহৃত হয় । আমি আর সেসব শুনতে চাই নি ।

        পর্বতের দুরারোহ খাড়াইয়ের এক ধারেই এই ' জ্বালা - নরসিংহ ' মন্দির । কথিত আছে ঠিক এই মন্দিরের জায়গাটিতেই ভগবান নৃসিংহদেব দানব হিরণ্যকশিপুকে বধ করেছিলেন । মন্দিরের ঠিক গা দিয়ে একটি বেশ বড় পাহাড়ী ঝর্ণা বয়ে চলেছে । বলা হয়ে থাকে হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর নৃসিংহদেব এই ঝর্ণার জলে তাঁর হাত ধুয়েছিলেন । আর আশ্চর্য এই ঝর্ণার জলের রঙ কিন্তু আজও রক্ত মেশানো জলের মতো লাল । এখান থেকে আর একটু উঁচুতে সেই উগ্র স্তম্ভ । যে স্তম্ভের ভিতর থেকে নৃসিংহদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন ।

        এরপর আমরা আরও অনেকটা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে নৃসিংহদেবের অষ্টম বিগ্রহ মন্দির ‘মোহলোহা নরসিংহ’ মন্দিরে পৌঁছলাম । এটি একটি পাহাড়ের একেবারে কিনারে অবস্থিত । মধু জানালেন ভগবানকে বিবাহের উদ্দেশ্যে লক্ষ্মীদেবী এই স্থানে তপস্যা করেছিলেন । এই মন্দিরের কাছেই রয়েছে ভক্ত প্রহ্লাদের বিদ্যাচর্চার স্থান । আমরা সেটিও দর্শন করলাম । পাহাড়ের আরও একটু উচ্চতায় আরও একটি গুহা । সেখানে রয়েছেন নৃসিংহদেবের অপূর্ব যোগ নৃসিংহ বিগ্রহ । যদিও এই বিগ্রহ নৃসিংহদেবের নটি রূপের অন্তর্গত নয় । নৃসিংহদেবের নবম বিগ্রহ হচ্ছে ' ভাবন নরসিংহ বিগ্রহ ' , যেটি এখান থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত ।

        এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । হঠাৎই পথের মাঝে আমার সামনে এক বিষধর কেউটে সাপ দেখে আমি আঁতকে উঠলাম । প্রায় দশ ফুট লম্বা সাপটা । তরতর করে সে পাহাড়ের খাঁজে ঢুকে গেল । যদিও সে আমাকে কিছুই করে নি । কিন্তু আমি প্রায় লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেলাম । মধু আমাকে টেনে ধরল । আমাকে সে সাপ দেখলে ওরকম লাফাতে না করল । এতে বিপদ আরও বাড়তে পারে । বরং শান্তভাবে দাঁড়িয়ে যাবার পরামর্শ দিল । মধু আমাকে আগে আগে না যেতে নিষেধ করলে পর আমি তাকে আগে যেতে দিয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম ।

        এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আরও প্রায় মাইলখানেক হাঁটতে হবে । নিকটবর্তী গ্রামের লোকেদের সঙ্গে দেখা হলে তারা ক্রুদ্ধভাবে আমাদেরকে জঙ্গলে আর ঢুকতে না করল । কিন্তু মধু ক্রমাগত হেঁটে যাচ্ছিল । সে ছিল অকুতভয় এবং পরম ভক্ত । কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমার বেশ ভয় করছিল । যদিও তখনও পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়নি । আধো আলো আধো অন্ধকার ভাব । সেই মলিন আলোতেই পথে যেতে যেতে পথের মাঝখানে দেখলাম একটি সাপ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে । মধু আমাকে অভয় দিয়ে জানাল এটি একটি মরা সাপ । মৃত সাপ দর্শন খুব একটা শুভ লক্ষণ নয় জানতাম । আমার মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল । ক্রমশ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । অথচ এরই মধ্যে আমরা দুর্গম পথে এগিয়ে চলেছি । অজানা আশঙ্কায় বুক দুরু দুরু করছিল । কিন্তু পরক্ষণেই এই ভয়ের ভাবনাটাই পালটে গেল । আমি না নৃসিংহদেবের ভক্ত । তাহলে আমার আবার ভয় কি ? যা ঘটছে তা স্বয়ং নৃসিংহদেবের ইচ্ছাতেই ঘটছে । তিনি আমাদের রক্ষা করবেন । আর তাছাড়া মধু আমার কাছে ছিল যেন স্বয়ং নৃসিংহদেব প্রেরিত এক পথ প্রদর্শক ।

        অবশেষে সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যেই আমরা পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে আমাদের যাত্রা শেষ করলাম । মধু জানালো গ্রামবাসীরা তাকে বলছিল যে যারা অন্ধকারে কখনও জঙ্গলে ঢুকেছে তারা কখনও আর ফেরেনি । এই জঙ্গল হিংস্র বন্য জন্তুতে পূর্ণ । তারা আরও বলছিল যে কারোরই ভাবন মন্দিরে রাত্রিতে যাওয়া উচিত নয় কেননা ঐসময় দেবতারা নৃসিংহদেবের আরাধনা করতে ওখানে আসেন । এসব কথা শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম এবং ভগবান নৃসিংহদেবের কাছে সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা জানাতে লাগলাম । রাত্রিতে যখন মন্দির চত্বরে কাটাচ্ছিলাম তখন একসময় ঝড় শুরু হল । আমি ভাবলাম ভগবান নিশ্চয়ই রাত্রিতে এখানে আসার জন্য রাগ করেছেন । কিন্তু মধু আমাকে প্রায় টানতে টানতে মন্দিরের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল । আমি এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে এরপর আমার কিছু মনে নেই । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।

        পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেখলাম আমি নৃসিংহদেবের পাদপদ্মের নীচে শুয়ে রয়েছি । ' ভাবন নরসিংহ মন্দিরের অপূর্ব বিগ্রহ দর্শন করার পর আমি ভেবেছিলাম বুঝি আমাদের তীর্থ সমাপ্ত হল । কেননা এটিই ছিল নৃসিংহদেবের নবম ও শেষ রূপ । কিন্তু মধু জানালো এখনও ' গিরিধারী ' ও ' জ্যোতি ' নামে আরও দুটি মন্দির দর্শন বাকী রয়েছে । সে দুটি মন্দিরও এখান থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেকটা দূরের হাঁটা পথ । হাঁটতে হাঁটতে মধু কেন আমাকে গত রাতে ওভাবে জোর করে টেনে নিয়ে মন্দিরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সে রহস্য উন্মোচন করল । আমি তো ভেবেছিলাম যে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে সে ওরকম করেছিল । কিন্তু আসলে তা নয় । ঐ রাতে পাহাড় চূড়োর মন্দির চত্বরে আমি যখন শুয়ে পড়েছিলাম , মধুর তিক্ষ্ম চোখ দেখেছিল যে , দু তিনটি ভালুক পাহাড় বেয়ে আমাদের চূড়ার দিকে দ্রুত উঠে আসছে । উঠে এসেও ছিল । কিন্তু ততক্ষণে আমরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ।

        আমার দর্শন করা সমস্ত নৃসিংহ বিগ্রহের মধ্যে জ্যোতি বিগ্রহ হচ্ছে অত্যন্ত অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর । তাঁর ক্রোধের উত্তাপে জঙ্গল পুড়ে যায় বলে তাঁর এই ' জ্যোতি ' নামকরণ । সবশেষে এই জ্যোতি মন্দির দর্শন করার পর আমরা আবার নিম্ন অহোবলমের যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই লক্ষ্মী - নৃসিংহ মন্দিরে ফিরে এলাম । সেদিন সন্ধ্যাবেলা গ্রামের লোকের আমাদের ঘিরে ধরল । মধু জানালো রাত্রে জঙ্গলে প্রবেশ করেও আমরা বেঁচে ফিরে এসেছি দেখে তারা অবাক হচ্ছে । আমি মনে মনে বললাম ' আসলে তো সবই নৃসিংহদেবের কৃপা । জয় ভক্তের সুরক্ষা প্রদানকারী ভগবান নৃসিংহদেব কি জয় !

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ৯ ) হাম্‌পি
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।