ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • যেখানের অধিবাসীগণ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশসমূহ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন

    কূর্মক্ষেত্র ( চিকাকোল )

    শ্রীমৎ জগৎগুরু স্বামী মহারাজ

    এপ্রিল মাসটি কলকাতায় দারুণ গরমের মাস। আর সেই এপ্রিল মাসেই আমি ও আমার তিন সঙ্গী মিলে মোট চারজন আমেরিকা থেকে কলকাতা বিমান বন্দরে এসে নামলাম। আমাদের গন্তব্যস্থল ভারতের দক্ষিণ - পূর্ব উপকূলের এক প্রত্যন্ত পবিত্র স্থান — কূর্মক্ষেত্র। ভারতের মানুষদের কাছে , বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের ভক্তমনোভাবাপন্ন মানুষদের কাছে এই কূর্মক্ষেত্র একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান , কেননা এখানেই পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণুর কূর্মরূপধারী বিগ্রহের চমৎকার এক মন্দির রয়েছে। শুধু তাই ই নয় , এটিই পৃথিবীর একমাত্র , ভগবানের কূর্মরূপধারীর মন্দির।

       কূর্ম মানে কচ্ছপ। কূর্ম - অবতার হচ্ছেন ভগবানের দশাবতারের একটি রূপ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যেমন ভগবান বর্ণনা করেছেন যে সাধুদের উদ্ধারের জন্য এবং দুষ্কৃতিদের বিনাশ সাধনের জন্য ভগবানের অবতার এই জগতে আবির্ভূত হন , কূর্মাবতারও সেই উদ্দেশ্যেই অবতরণ করেছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে কিভাবে ভগবান কূর্ম রূপ ধারণ করে ক্ষীর সমুদ্র মন্থনে অমৃত উৎপাদনের জন্য দেবতা ও দানবদের সহায়তা করেছিলেন। ভগবান কূর্মরূপ ধারণ করে সাগরে প্রবেশ করেছিলেন এবং এক লক্ষ যোজন বিস্তৃত একটি বিশাল দ্বীপের মতো তাঁর পৃষ্ঠে তিনি মহন দন্ড - রূপে ব্যবহৃত বিরাট মন্দর পর্বতকে ধারণ করেছিলেন। ভগবানের আয়োজনেই উৎপাদিত অমৃত কেবলমাত্র দেবতাদের মধ্যে বিতরিত হয়েছিল।

       ভারতের পারমার্থিক ইতিহাসে কুর্মাবতারের লীলা কাহিনী বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় চিত্রে , ভাস্কর্যে সাহিত্যে , সঙ্গীতে ও নাটকে কূর্মক্ষেত্রে শ্রীকূর্মদেবের মন্দিরের মহিমা বন্দিত হয়েছে , যা অনবদ্যভাবে মানুষকে আকর্ষণ করে। আমাদেরও করেছিল। তাই আমাদের এই কূর্মক্ষেত্র যাত্রা। তাছাড়া আমাদের আকর্ষণের আরেকটি কারণ হল , যা আমি আগেও বলেছি , —সারা পৃথিবীতে এই একটিই ভগবান কূর্মদেবের মন্দির রয়েছে।

       আমাদের এই তীর্থযাত্রার আরেকটি কারণও রয়েছে। সেটি হল আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বর্ণনা করা হয়েছে আজ থেকে ৫০০ বৎসর আগে তাঁর দক্ষিণ ভারত পর্যটনের সময় মহাপ্রভু এই কূর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করেছিলেন। ভারতের সর্বত্র মহাপ্রভু যা করেছিলেন এই কূর্মক্ষেত্রে এসেও নৃত্য ও কীর্তনের মাধ্যমে মহাপ্রভু তা - ই করলেন– হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের প্রবর্তন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই শিক্ষা প্রদান করেছেন যে এই যুগে পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নাম সংকীর্তন করার মতো আত্মোপলব্ধির ফলপ্রসূ পন্থা আর নেই।

       কলকাতা পৌঁছেই আমরা প্রথমেই সেখানকার গরম ও অর্দ্রতার সঙ্গে পরিচিত হলাম। গরমের চেয়েও বিরক্তিকর ঘাম হওয়াটা আমাদের কলকাতা ইসকন মন্দিরের কাছেই ভক্তদের এক আবাসগৃহে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে স্নান করে একটু ধাতস্থ হবার পর আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলাম ভারত সরকারের ট্যুরিষ্ট ব্যুরোর অফিসে। এঁরা আমাদের চার জনের জন্য শ্রীকাকুলাম হয়ে কূর্মক্ষেত্রে যাবার ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। পরদিন সকাল বেলা ট্রেন। ট্রেন ছাড়বে হাওড়া স্টেশন থেকে।

       পরদিন খুব সকালে সাড়ে চারটের সময় , ট্যাক্সি করে আমরা হাওড়া স্টেশন অভিমুখে চললাম। ভোরবেলা কলকাতার বিখ্যাত সেই ট্রাফিক জ্যামের যাতনা নেই। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে অবাক হয়ে দেখলাম যে অত সকালেও হাওড়া স্টেশনে কত মানুষের ভীড়, ছোটাছুটি , যেন হট্টমেলার দেশ।

       কুলির সঙ্গে আমাদের মাল পত্তর বহনের দাম দরাদরি করে নেবার পর আমরা আমাদের ট্রেনের জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসবার পর আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কামারার আসনের নীচে আমাদের ব্যাগ, মালপত্তর, সবকিছু গুছিয়ে রেখে আমাদের নির্দিষ্ট আসনে বসলাম। সকাল সাড়ে ছয়টা নাগাদ আমাদের ট্রেন যাত্রা শুরু করল। আমি ট্রেনের জানালার পাশে বসে ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে গ্রাম বাংলায় প্রবেশ করা ট্রেনের দু’পাশে সবুজ কৃষি ক্ষেত্র ও প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখতে লাগলাম।

       ব্রাহ্মণ সন্ন্যাস গ্রহণ করে মহাপ্রভুর সেবক সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ব্রাহ্মণকে তা করতে নিষেধ করলেন । তিনি ব্রাহ্মণকে গৃহে থেকে সর্বদা কৃষ্ণের পবিত্র নাম জপ করতে বললেন । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন— “ এ রকম কথা আর কখনও বলবে না । বরং গৃহে থেকে কৃষ্ণের পবিত্র নাম কীর্তন করাই কল্যাণকর সকলকে ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতে প্রদত্ত শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসরণ করার শিক্ষা প্রদান কর । এইভাবে একজন গুরুরূপে এই ভূমির সকলকে উদ্ধার করার চেষ্টা কর । তুমি যদি এই নির্দেশ অনুসরণ কর , তাহলে তোমার গৃহস্থ জীবন তোমার পারমার্থিক অগ্রগতির পথে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । তুমি যদি সমস্ত নিয়ম শৃঙ্খলাগুলি অনুসরণ কর তাহলে আবার আমাদের এখানে সাক্ষাৎ হবে এবং তুমি কখনই আমার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হবে না । ” শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে ( মধ্য লীলা -৭ / ১২৭-১২৯ ) ঠিক যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে , তা হল—
    প্ৰভু কহে , — “ ঐছে বাত্ কভু না কহিবা ।
    গৃহে রহি ' কৃষ্ণ - নাম নিরন্তর লৈবা ॥ ১২৭ ॥
    যারে দেখ , তারে কহ ' কৃষ্ণ ' - উপদেশ ।
    আমার আজ্ঞায় শুরু হঞা তার ' এই দেশ ॥ ১২৮ ॥
    কতু না বাধিবে তোমার বিষয় তরঙ্গ ।
    পুনরপি এই ঠাঞি পাবে মোর সঙ্গ ॥ ১২৯ ॥

    শ্রীদোসির সঙ্গে এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলনের ভাবনায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম এবং শ্রীকৃর্মের মন্দির দর্শন করার জন্য আমাদের মন অধীর হয়ে উঠেছিল ।

        সহসা অনুভব করলাম ট্রেনের গতি ধীর হয়ে এসেছে । সম্ভবত কোন স্টেশন আসছে । কালো কোট পরা একজন ট্রেনের ' টি টি ' এসে আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়ে গেল , ' এর পরের স্টেশনটিই শ্রীকাকুলাম ' । শ্রীদোসিও আমাদের মনে করিয়ে দিলেন , কূর্মক্ষেত্রে যাবার জন্য শ্রীকাকুলামেই আমাদের নামতে হবে । এর পরের স্টেশন শ্রীকাকুলাম আসতেই আমরা ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম । শ্রীদোসি হয়ত অন্য কোথাও যাবেন । তাই তিনি নামলেন না । এরপর তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ।

        রেল স্টেশন থেকে শ্রীকাকুলাম শহরটির কেন্দ্রস্থল প্রায় দশ মাইল দূরে । আমরা ঐ দিনটি শ্রীকাকুলামে থেকে পরদিন ভোরে কূর্মক্ষেত্রে রওনা হবার মনস্থ করলাম । তাই আমরা একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম । বিকেলে ও সন্ধ্যায় শ্রীকাকুলাম শহরের বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির দর্শন করলাম । পরের দিন আমরা খুব ভোরে , তখনও অন্ধকার রয়েছে , এরকম সময়ে কূর্মক্ষেত্রের বাস ধরবার জন্য হোটেল ত্যাগ করলাম । রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম শ্রীকাকুলামের শহরবাসীরাও খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন । রাস্তায় ইতিমধ্যেই অনেক লোক চলাচল করছে । তারা অধিকাংশই মনে হল সকালে ভগবানের বিগ্রহ দর্শন ও আরতিতে যোগদানের জন্য স্থানীয় মন্দিরে যাচ্ছেন । রাস্তার আশেপাশের বাড়িগুলিতে দেখলাম কেউবা কুয়ো থেকে জল তুলছেন , কেউবা গরুর দুধ দোয়াচ্ছেন । আরেকটু সকাল হতেই দেখলাম একদল স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারে নগর সংকীর্তনে বেরিয়েছেন । এই দৃশ্য দেখে সত্যি খুব ভালো লাগলো । এই হল ভারত – পারমার্থিকতার পবিত্র ভূমি । নগর সংকীর্তনের ঐ মানুষগুলো যেন চৈতন্য চরিতামৃতের পাতা থেকে মূর্ত হয়ে উঠে এসেছেন । তাদের অনুরোধে আমরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কিছুটা পথ কীর্তন করতে করতে তাদের সঙ্গে হাঁটলাম । তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একটু পরেই আমরা কাছাকাছি একটি ছোট মন্দিরে এলাম । সেখানে কিছুক্ষণ কীর্তন করার পর আমরা ঐ মন্দির চত্বরে বিশ্রাম নেবার জন্য বসলাম । সেখানে বসে সকলের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক আলাপ পরিচয় হল । তারা আমাদেরকে আরও কিছু সময় তাদের সঙ্গে থাকতে বলছিল । কিন্তু আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি কূর্মক্ষেত্রে পৌছাতে চাই । তাই আমরা তাদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করে বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম ।

        একটি ৫২ আসনের সাধারণ যাত্রীবাহী বাসে আমরা উঠে পড়লাম । শ্রীকাকুলাম থেকে দূরত্ব বেশী নয় । মাত্র ২২ মাইল । এক ঘণ্টার যাত্রা পথ । বাসটিতে বেশ ভীড় ছিল । ৫২ টি বসার আসন হলেও , যাত্রী রয়েছে প্রায় ৭৫ জন । অধিকাংশ যাত্রীই স্থানীয় তীর্থযাত্রী আর বাকিরা স্থায়ী চাষী ও শ্রমিক । প্রায় এক দেড় মাইল চলার পরেই বাসটি থামছিল আর লোক ওঠা নামা করছিল । এভাবেই নানা জায়গায় থামতে থামতে অবশেষে বাসটি কূর্মক্ষেত্রে পৌছল । সমস্ত তীর্থযাত্রীরাই এখানে নামলো । আমরাও নামলাম ।

        বাস থেকে নেমে , যেহেতু আমরা কিছুই চিনি না , তাই ঠিক করলাম আমরা ঐ স্থানীয় তীর্থযাত্রীদের অনুসরণ করব । চারদিকে গাছপালা , মাঠ , কুঁড়ে ঘর । তারই মাঝে পায়ে চলা সরু গ্রামীণ পথ । কোথাও রাস্তার পাশে স্থানীয় বাসিন্দারা বসে আছে , বাচ্চারা খেলা করছে । এভাবেই চলতে চলতে আমরা একটি সরোবরের ধারে পৌঁছালাম । আর সরোবরের এপারে দাঁড়িয়ে ওপারে অধিষ্ঠিত ভগবান কূর্মদেবের সুপ্রাচীন মন্দিরটি দেখতে পেলাম সরোবরটির নাম কূর্ম সরোবর । সরোবরটির ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে অবশেষে ওপারে এলাম । সরোবরটি থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে মন্দিরের পথের দিকে । মন্দিরের প্রবেশ দ্বার ও মূল মন্দিরের মাঝে রয়েছে একটি সুউচ্চ তাল গাছ । আমরা যখন মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের দিকে যাচ্ছিলাম , তখন দেখলাম সমস্ত তীর্থযাত্রীরা মন্দিরের দিকে দৌড়তে শুরু করেছে যেন আর একটু পরে পৌঁছলে মন্দিরে শ্রীবিগ্রহ আর দেখতে পাওয়া যাবে না । অদৃশ্য হয়ে যাবে । ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করার আকাঙ্খা পুরণের জন্য তারা ছিল সকলে শিশুর মতো উৎসাহিত । ভক্তের মন এমনই হয় , শিশুর মতো সরল ।

        আমরা যখন ভগবান কুর্মদেবের মন্দিরের মূল প্রবেশ দ্বারের সামনে এলাম , দেখলাম দরজা বন্ধ । সকল তীর্থযাত্রীরা মন্দির চত্বরের এদিক ওদিক বসে দরজা খোলার অপেক্ষা করছে । জানলাম যে দরজা খুলতে আরও এক ঘণ্টা দেরী আছে । তাই আমাদের হাতের ক্যামেরা রেডি করে আমরা মন্দিরটির চারদিকে ঘুরে পরিক্রমা করলাম । আমরা যখন পরিক্রমা করছিলাম তখন একটি গ্রামের ছোট ছেলে এসে বায়না ধরল , সে আমাদের চারদিক ঘুরিয়ে দেখাবে , বিনিময়ে সে মাত্র এক টাকা দেবে । মূল মন্দিরের দক্ষিণ কে একটি ছোট গোল টিলার উপর একটি ছোট মন্দির । আমরা যখন সেই মন্দিরটির দিকে অগ্রসর হলাম , তখন সেই ছেলেটি আমাদেরকে বললো ' মহাপ্রভু পাদ মহাপ্রভু পাপ । আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সে কি বলতে চাইছে । তবে মনে হল সে যেন ইঙ্গিত করছে ওখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পাদপদ্ম চিহ্ন রয়েছে । আমরা যখন ঐ মন্দিরের কাছে গেলাম , ছেলেটি ভিতরে ঢুকে হাত দিয়ে একটি জায়গা দেখিয়ে বলতে লাগলো , ' এখানে ' , ' এখানে ' । আমরা ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে একটি বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত মার্বেল খন্ডের মধ্যে দুটি বড় পদচিহ্ন রয়েছে । নীচে তেলেণ্ড লিপিতে এবং দেওয়ালে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ' মহাপ্রভু ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে কূর্মক্ষেত্র দর্শন করেছিলেন । পরমহংস শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর দ্বারা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই পাদপদ্ম - চিহ্ন প্রতিষ্ঠিত হল ।

        আমাদের গুরুদেব শ্রীল প্রভুপাদের গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর কূর্মক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তীর্থযাত্রার স্মারক রূপে এই ছোট মন্দিরটি নির্মাণ করে সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্ম - চিহ্ন স্থাপন করেন । আমরা সেই মন্দিরে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের পরম গুরুদেবের উদ্দীপ্ত উপস্থিতি অনুভব করছিলাম । এখন আমাদের এই কূর্মক্ষেত্র তীর্থযাত্রায় একটি তৃতীয় মাত্রা যুক্ত হল । আমরা শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি ।

        সহসা শঙ্খ ধ্বনি ও মন্দিরের ঘণ্টার শব্দে আমরা সচকিত হলাম অর্থাৎ এখন মন্দিরের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে । আমরা মন্দিরের দিকে ছুট লাগালাম । আমাদের চটি ছেড়ে আমরা খালি পায়ে সারিবদ্ধভাবে অন্যান্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে একের পর এক খিলান পেরিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হলাম । মন্দির যেমন বিরাট , মন্দিরের মূল দরজাটিও তদনুপাতে বিরাট । চারদিকে স্থাপত্য শৈলিতে ভরা বড় বড় স্তম্ভের যেন শেষ নেই । আমরা একটি বড় চত্বর পার হয়ে এসে দেখলাম সেখানে বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের একটি বড় স্তম্ভ বা গরুড় স্তম্ভ রয়েছে । স্তম্ভটি সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জ নির্মিত । এছাড়াও সেখানে ৫০০ সুন্দর স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি বিরাট মণ্ডপ বা নাটমন্দির রয়েছে । পাথরের স্তম্ভগুলিতে ভগবানের বিভিন্ন লীলা কাহিনী খোদিত হয়েছে । ঐ নাটমন্দিরে একদল সঙ্গীতজ্ঞ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুর বাজিয়ে চলেছেন । ঢোলক , করতাল , বীণা ও সানাইয়ের সুরে সেখানে এক অপূর্ব স্বর্গীয় পরিবেশ রচিত হয়েছে । বিরাট চত্বরটি ছাড়িয়ে এরপর আমরা একটি ছোট করিডোরের মধ্যে প্রবেশ করলাম । করিডোরটির চওড়া এতটাই কম যে বড় জোর পাশাপাশি দুটো লোক দাঁড়িয়ে একসঙ্গে যেতে পারে । ফলে এখন আমাদের সারিবদ্ধভাবে অগ্রসর হওয়ার গতি ধীর হয়ে পড়েছে ।

        ছবি এই মন্দিরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পাদপদ্ম চিহ্ন রয়েছে করিডোর জায়গাটি , যার মধ্যে দিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি , সেটি প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন । মাঝে মাঝে দেওয়ালে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো । সেই প্রদীপের আলোতেই যেটুকু আলোকিত বাতাসে ঘিয়ের প্রদীপের ধোঁয়া , ধূপ ও কর্পূরের গন্ধ মিশে আছে । দূরের থেকে মন্ত্র পড়ার শব্দ ভেসে আসছিল এবং যত অগ্রসর হচ্ছিলাম সেই ধ্বনি তত স্পষ্ট হচ্ছিল । আর কয়েক পা এগোনোর পরেই পরিবেশ ভক্তিরসে পূর্ণ হয়ে উঠল । বিগ্রহের সামনে এগিয়ে যাবার জন্য দুজন দুজন করে ছাড়া হচ্ছিল । আমরা জোড় হাতে প্রণামের ভঙ্গিতে আমাদের সময় আসবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম ।

        এরপর আমরা প্রাচীন বিগ্রহের সামনে এলাম । সেই বিরাট বিগ্রহ অপূর্ব , বর্ণনাতীত । সেই বিগ্রহ কক্ষটি কয়েকটি মশাল দ্বারা আলোকিত। দেওয়াল ও উপরের ছাদ বিষ্ণুর দশাবতারের লীলা - কাহিনীর রঙিন খোদিত চিত্র দ্বারা শোভিত। গোম্বুজাকৃতি গোল ছাদের কেন্দ্রস্থলের সবচেয়ে উচ্চ জায়গাটি থেকে একটি সহস্র পাপড়ির পাথরের পদ্ম ঝোলানো রয়েছে । মেঝেতে কালো ও সাদা মার্বেল চক চক করছে । ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণের খালি গা , পরণে সাদা সিল্কের ধুতি , কপালে ও বাহুতে তিলক । তাঁরা তীর্থযাত্রীদের পূজা সম্পাদনের ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য ঘরের মধ্যে চলাফেরা করছেন । ভগবান কূর্মদেবের উপরে রূপার আচ্ছাদন , ফুল ও তুলসী পাতা দিয়ে সাজানো । সেখানে উচ্চ পৃষ্ঠদেশ সমন্বিত ভগবান কূর্মদের অবস্থান করছেন । মণিমুক্ত ও একটি ময়ুরপুচ্ছযুক্ত সোনার মুকুট তিনি মস্তকে ধারণ করেছেন । এই ময়ূরপুচ্ছ হচ্ছে বিষ্ণু বা কৃষ্ণ-অবতারের প্রতীক । ডান দিকে রয়েছেন ভগবান

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ৭ ) অন্তর্বেদী
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।