ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • গোবর্ধন

    মধুব্রত দাস

    বৃন্দাবনের পবিত্র গোবর্ধন ক্ষেত্রে অনেক কিছুই রয়েছে , কিন্তু স্বল্প পরিসরে চিত্রের মাধ্যমে সবকিছু দর্শন করানো সম্ভব হবে না , তবুও যতখানি সম্ভব গোবর্ধনের দ্রষ্টব্য সমূহ দর্শন করব এবং গোবর্ধন সম্বন্ধে জানব ।

        মথুরার ২০ কিমি পশ্চিমে গোবর্ধন পর্বত অবস্থিত । পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র , পরম পবিত্র ব্রজমণ্ডলের মধ্যে গোবর্ধন অন্যতম দর্শনীয় স্থান । বলা হয়ে থাকে যে ৫০০০ বৎসর পূর্বেকার বৃন্দাবনের তিনটি বস্তু এখনও রয়ে গিয়েছে — বৃন্দাবনের ধুলি , যমুনা নদী ও গোবর্ধন পর্বত । গোবর্ধন পর্বত ‘ গিরিরাজ ' নামেও খ্যাত । এই গিরিরাজ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ সেবক । কেননা তিনি কৃষ্ণ , বলরাম ও গোপ বালকদের লীলার জন্য ফল , মূল , খনিজ , অপূর্ব দৃশ্য এবং তাঁদের গাভীদের জন্য তাজা ঘাস সরবরাহ করতেন ।

        ব্রজে গোবর্ধনের আবির্ভাব সম্পর্কে আদি বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে যে শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাবকালে লঙ্কায় যাওয়ার জন্য সমুদ্রের উপর সেতু তৈরীর উদ্দেশ্যে বানর ও ভালুকেরা যখন বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় পাথর সংগ্রহ করে আনছিল , তখন হনুমানজী উত্তরাঞ্চল থেকে গোবর্ধন পর্বতকে তুলে সমুদ্রে নিয়ে যাচ্ছিলেন । কিন্তু আকাশপথে যেতে যেতে তিনি এক দিব্য ঘোষণা শুনতে পেলেন , “ সেতু নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে , এখন আর কোন পাথরের প্রয়োজন নেই । ” সেই বাণী শ্রবণ করে হনুমানজী দুঃখিত হৃদয়ে আকাশ থেকে ভূমিতে নেমে এসে , যেখানে নামলেন , সেই জায়গাতেই গোবর্ধন পর্বতকে স্থাপন করলেন । এরফলে গোবর্ধন পর্বতও অসন্তুষ্ট হয়ে হনুমানজীকে বললেন , “ আপনি আমাকে শ্রীরামের পাদপদ্ম থেকে বঞ্চিত করছেন ? ” এই বলে , গিরি গোবর্ধন হনুমানজীকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে , হনুমানজী তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন , “ দ্বাপর যুগে আপনার আকাঙ্খা পূর্ণ হবে । সেই সময় স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ ইন্দ্রের পূজা বন্ধ করে , পরিবর্তে আপনার পূজার প্রচলন ঘটাবেন । " এই কথা বলে , হনুমানজী পুনরায় লাফ দিয়ে আকাশপথে শ্রীরামচন্দ্রের সামনে এসে উপস্থিত হলেন । শ্রীরামচন্দ্র তখন ঘোষণা করলেন , যত পাথর সেতু নির্মাণের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে , আমি তাদের সকলকে আমার পাদ স্পর্শে উদ্ধার করব । কিন্তু আমি গোবর্ধনের আকাঙ্খা পূরণ করব তাকে আমার হাত দিয়ে তুলে ধরে আর সে শ্রেষ্ঠ হরিদাস রূপে জগতে খ্যাত হবে । ”

        গোবর্ধনের ব্রজ মণ্ডলে অবস্থান বিষয়ে গর্গ - সংহিতায় অন্য একটি কাহিনী বর্ণিত হয়েছে । সেটি হল , পুলস্ত্য মুনি একবার দ্রোণাচল পর্বতে পৌঁছলে , দ্রোণাচল পর্বতের সন্তান গোবর্ধনকে দেখে তাঁর খুব পছন্দ হল । গোবর্ধন অতি সুন্দরভাবে নির্জন অথচ সুন্দরী বৃক্ষ লতা ও তৃণের সবুজে পূর্ণ ঠিক আদর্শ । তপস্যা স্থল । পুলস্ত্য মুনি গোবর্ধনকে তাঁর নিবাসস্থল কাশীতে নিয়ে যাবার আকাঙ্খা করলেন । কেননা সেখানে এমন সুন্দর কোন পাহাড় নেই । তিনি দ্রোণাচল পর্বতের কাছে গিয়ে গোবর্ধনকে নিয়ে যেতে চাইলেন যাতে কাশীতে সুন্দর গোবর্ধন পর্বতোপরে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ভজন সাধন করতে পারেন । পাছে পুলস্ত্য মুনি অভিশাপ দেন সেই ভয়ে দ্রোণাচল সম্মত হলেন , কিন্তু মনে মনে গোবর্ধনকে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না । কিন্তু গোবর্ধন একটি শর্তে যেতে রাজী হলেন যদি পুলস্ত্য মুনি পথে যেতে যেতে কোথাও তাঁকে হাত থেকে নামিয়ে রাখেন , গোবর্ধন আর সেখান থেকে যাবেন না , সেই স্থানেই অবস্থান করবেন । পুলস্ত্য মুনি গোবর্ধনের সেই শর্তে রাজী হলেন এবং যোগবলে গোবর্ধন পর্বতকে তাঁর হাতের তালুতে উত্তোলন করে কাশীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন । কিন্তু যখন তাঁরা ব্রজে পৌঁছলেন , কৃষ্ণের কথা গোবর্ধনের মনে উদয় হল , এবং গোবর্ধন অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠলেন । এতটাই ভারী হয়ে উঠলেন যে পুলস্ত্য মুনি আর তাঁকে বহন করতে পারছিলেন না এবং বিশ্রামের জন্য গোবর্ধনকে হাত থেকে নামাতে বাধ্য হলেন । অতঃপর স্নান করে কিছু খেয়ে মুনি বিশ্রাম গ্রহণ করে , তিনি যখন পুনরায় যাত্রা করার জন্য গোবর্ধনকে উত্তোলন করতে গেলেন , গোবর্ধন রাজী হলেন না । পুলস্ত্য মুনি তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করও গোবর্ধন পর্বতকে এতটুকুও নড়াতে পারলেন না । অবশেষে ক্রুদ্ধ হয়ে পুলস্ত্য মুনি গোবর্ধন পর্বতকে অভিশাপ দিলেন , “ তুমি প্রতিদিন তিল পরিমাণ রূপে ক্ষয় প্রাপ্ত হবে । ” কৃষ্ণলীলা সমাগত জেনে গোবর্ধন সেই অভিশাপ স্বীকার করে সেখানেই থেকে গেলেন । সেই থেকে গোবর্ধন পর্বত আজও ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে চলেছেন । তবে ভক্তগণ বলেন , সেটি পুলস্ত্য মুনির অভিশাপের জন্য নয় , সেটি ঘটছে শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর তাঁর বিরহের ফলে । ৫০০০ বৎসর আগে গোবর্ধন পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়োর উচ্চতা ছিল ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ । এখন কমতে কমতে তা মাত্র ২৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট । গোবর্ধন পর্বতের আকার ময়ূর সদৃশ । রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড তার চোখ , মানসি গঙ্গা ও গোবর্ধন শহর তাঁর ঝুঁটি এবং অপ্সরা ও নব কুণ্ড তার পুচ্ছ ।

        গোবর্ধন যাওয়ার পথে দিল্লী - আগ্রা রোড চটিকরা নামে একটি গ্রাম আছে যেখানে নন্দ মহারাজ গোকুল থেকে নন্দগ্রাম যাওয়ার পথে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন । এখনও সেখানে একটি পথ নির্দেশ রয়েছে । কিছুদূর যাওয়ার পরই ব্রজের সর্ববৃহৎ বটবৃক্ষটি চোখে পড়বে । গোবর্ধন পরিক্রমা সাধারণত ঐতিহ্যগতভাবে শুরু হয় মানসী গঙ্গা থেকে রাধাকুণ্ড থেকে ২৫ মিনিট হাঁটা পথে রয়েছে কুসুম সরোবর । এখানে একসময় প্রচুর সুগন্ধী ফুল ফুটতো এবং শ্রীমতী রাধারাণী তাঁর সখীদের নিয়ে সরোবরের ধারে ফুল তুলতে আসতেন । শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমতী রাধারাণীর বহু লীলাও এখানে সংঘটিত হয়েছে ।

        কুসুম সরোবরে যে কচ্ছপ রয়েছে , বলা হয় যে তাঁরা এক একজন যারা কচ্ছপ শরীর ধারণ করে শত শত বৎসর এখানে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণে দিব্যলীলার ধ্যান করছে । কথিত হয় যে এইসকল কচ্ছপদের খাওয়ালে আপনার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে । এই সরোবরে স্নান করাও একটি পবিত্র কর্ম । বর্তমান কুসুম সরোবর ঘাটটি ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভরতপুরের মহারাজা জাবরহ সিংহের দ্বারা তৈরী হয়েছিল । সরোবরের পশ্চিম দিকে তাঁর পিতা রাজা সুরজমলের নামে একটি গম্বুজও রয়েছে । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও এখানে স্নান করেছিলেন । নিকটেই রয়েছে উদ্ধব মন্দির । চার হাজার আট শত বৎসর আগে শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

        এখানে নারদ কুণ্ডও রয়েছে । রয়েছে নারদ বন । যেখানে অবস্থান করে নারদ মুনি ভক্তিশাস্ত্র রচনা করেছিলেন । নারদমুনির একটি মূর্তিও রয়েছে । গোবর্ধন পরিক্রমার অন্যতম একটি সুন্দর স্থান হল শ্যাম কুটির । এখানে রাস লীলা হোত । এই শ্যাম কুটির থেকেই গোবর্ধন পর্বতের উচ্চতা ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে । এই জায়গাটি আরও একটি কারণে বিখ্যাত এই জন্য যে এখানে এক গোবর্ধন শিলার উপরে শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলের চিহ্ন রয়েছে । কথিত হয় যে শ্রীকৃষ্ণ যখন বাঁশী বাজাতেন , তখন গোবর্ধন পর্বতের শিলা গলিত হতে শুরু করত । আর সেই গলিত শিলার উপরেই শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের চিহ্ন পড়ত ।

        এখনও গোবর্ধনে চড়ে বেড়ানো গাভীদের দৃশ্য আমাদের শ্রীকৃষ্ণের গোচারণলীলার কথা মনে করায় মানসী গঙ্গার উত্তর পাড়ে রয়েছে সুদর্শন চক্র যারা সৃষ্ট চক্রতীর্থ । নিকটেই রয়েছে চাকলেশ্বর শিবলিঙ্গের মন্দির যা বৃন্দাবনে পূজিত পাঁচটি শিব লিঙ্গের অন্যতম । মানসী গঙ্গার কাছেই রয়েছে শ্রীল সনাতন গোস্বামীর ভজন কুটির । একসময় এখানে মশার উৎপাতে শ্রীল সনাতন গোস্বামী যখন এই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যোত হন , তখন চাকলেশ্বর শিব এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে আগমন করে বলেন , এই স্থানে আর কখনও মশার উপদ্রব হবে না , তিনি যেন এই স্থান ত্যাগ না করেন । সেই থেকে আজও এই স্থানে মশার উপদ্রব নেই ।

        নিকটবর্তী এক মন্দিরে রয়েছে শ্রীনন্দ মহারাজের বিগ্রহ । মুখারবিন্দ মন্দির । সেখানে দুটি শিলা রয়েছে । একটি শিলা শ্রীকৃষ্ণের মুকুটের প্রতিচ্ছবি দ্বারা চিহ্নিত । কাছে রয়েছে ব্রহ্মকুণ্ড , যেখানে কৃষ্ণের শক্তি পরীক্ষার জন্য গোপবালকদের লুকিয়ে রাখার অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন । রয়েছে মানসী দেবীর মন্দির । মানসী দেবী ব্রজধামে পূজিতা চারজন দেবীর অন্যতমা । অন্য দেবীরা হলেন , কামবনে বৃন্দাদেবী , বৃন্দাবনে যোগমায়া দেবী , এবং মথুরায় পাতালেশ্বরী দেবী ৷

        এখানকার ' দান - গতি ' স্থানটি সম্বন্ধে বলা হয় যে এখানে পথটি আগে ছিল এক সরু গলি , এবং গোপীগণ দুধ ও দুগ্ধজাত উৎপাদন নিয়ে গোবর্ধনের অপর পারে যাবার জন্য এই পথটি ব্যবহার করতেন । আর কৃষ্ণ তাদের পথ আটকে কর স্বরূপ দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি আদায় করতেন । এর কিছুদূরেই একটি শিলায় রয়েছে শ্রীমতী রাধারাণীর পাদপদ্মের চিহ্ন ।

        এই গোবর্ধনেও রয়েছে ইসকনের একটি মন্দির , যা পূর্বে ছিল মধ্যপ্রদেশের ছত্তারপুরের মহারাজের এক প্রাসাদোপম সুন্দর আবাসস্থল । এখানে একটি ছোট বেদীতে অপূর্ব এক গোবর্ধন শিলার আরাধনা করা হয় ।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ২৬ ) কানাই নাটশালা
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।