ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • কলকাতা মহানগরীর প্রত্যন্ত উত্তরে, গঙ্গা তীরবর্তী

    পানিহাটি

    পরম সেবা দাস

    আমি আমেরিকায় বড় হয়েছি। আমেরিকার আটলান্টায় ইসকনের একটি খুব সুন্দর কেন্দ্র রয়েছে , যার নাম ' নিউ পানিহাটি ধাম। ' সেখানেই আমি গত ১৩ বৎসর ধরে হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের সেবায় নিয়োজিত রয়েছি। আমেরিকার নিউ পানিহাটি ধামে থাকলেও ইতিহাসের সেই মূল পানিহাটি ক্ষেত্রকে আমার দেখা হয়নি। আমি তাই শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী ও শ্রীল নিত্যানন্দ প্রভুর লীলা - স্মৃতি বিজড়িত বৈষ্ণব তীর্থ পানিহাটিকে দর্শন করার জন্য ভারতের কলকাতায় আসি। আমাকে পানিহাটি দর্শন করাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমার আরও দুই ভক্ত সঙ্গী অমিতেজস্ দাস প্রভু এবং অমৃত - জীবনী দাসী। ওনারা মূলত কলকাতারই বাসিন্দা , কিন্তু বর্তমানে আমেরিকার আটলান্টায় থাকেন।

       আমরা অমিতেজস্ প্রভুর বাড়ি থেকে প্রথমে একটি রিকশা নিয়ে টালিগঞ্জ পাতাল রেল স্টেশনে আসি। কলকাতার পাতাল রেল সত্যিই গর্ব করার মতো একটি বিষয়। বিশেষ করে স্টেশনগুলোর ঝকঝকে তক্ তকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চেহারা , পাশ্চাত্যের যে কোন পাতাল রেল স্টেশনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে ৷ এমনিতে কলকাতার রাস্তা ঘাট ইত্যাদি স্থানগুলি যেমন নোংরা ; যেখানে সেখানে যে কেউ ময়লা ফেলছে ; থুথু , পানের পিক , ইত্যাদি দিয়ে কলকাতাকে নোংরা করছে , পাতাল রেলের চেহারাটা এর ঠিক বিপরীত। যাই হোক , আমরা পাতাল রেলে যাত্রা শুরু করে কলকাতার উত্তরে অপর প্রান্তিক স্টেশন দমদমে ৩৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। দমদম স্টেশনটি মূলত একটি সাধারণ রেলওয়ে জংশন স্টেশন। পাতাল রেলও এসে সেখানে মিলেছে। আমরা পাতাল রেল থেকে নেমে এবার লোকাল ট্রেনে চেপে দমদম থেকে মাত্র তিনটি স্টেশন পরে সোদপুর স্টেশনে নামলাম। ঐ স্টেশন থেকে একটি অটোতে চেপে জনপ্রতি সাড়ে তিন টাকা ভাড়ায় আমরা পানিহাটির গঙ্গার তীরে পৌঁছলাম ।

      

    প্রভু নিত্যানন্দের গাছ

    পানিহাটির ঐ গঙ্গার তীরেই রয়েছে বাঁধানো ঘাট। সারি সারি সিমেন্টে বাঁধানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নদীতে নেমে গেছে। সেখানে উপস্থিত লোকজনদের দেখলাম কেউ গঙ্গাকে প্রণাম করছে , কেউ কাপড় কাচছে , কেউ স্নান করছে আবার কেউবা বন্ধুদের নিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে বসে গল্প গুজব করছে। সামনেই একটি ফেরীঘাট রয়েছে। মানুষেরা লঞ্চে করে গঙ্গার এপার ওপার করছে। ঐ ফেরীঘাট দেখে আমার মনে পড়ল , একবার শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন যে তিনি চান কলকাতা থেকে মায়াপুরে স্পিড বোটে করে জলপথে যাতায়াত শুরু হোক এবং যাওয়া আসার পথে সেই স্পিড বোট যেন একবার এই পানিহাটিতে থামে। পানিহাটির ঐ ঘাটের কাছেই শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর লীলা - সঙ্গী সেই বিরাট বটগাছ এখনও দণ্ডায়মান। বলা হয় এই গাছটি সাত শত বৎসরের পুরাতন। একবার বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের অন্যতম শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর দর্শন পাওয়ার জন্য পানিহাটিতে এসেছিলেন। যখন শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী সেখানে এসে পৌঁছলেন , শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু এই বটগাছের নীচে তাঁর ভক্তবৃন্দ পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন , যেন ঠিক সৌরজগতের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান অসংখ্য গ্রহ সমূহের মধ্যমণি সূর্যের মতো। এই ঘটনাটি গৌড়িয় বৈষ্ণবদের কাছে একটি অত্যন্ত বিখ্যাত একটি কাহিনী। কাহিনীটি সংক্ষেপে এইরকম—

       এক ধনী জমিদারের একমাত্র পুত্র রঘুনাথ দাস তাঁর ঐশ্বর্যময় গৃহ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে চান। তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মে উৎসর্গ করেছেন তাই না তাঁর পরিবারের বিপুল ধন সম্পত্তি , না তাঁর সুন্দরী যুবতী স্ত্রী তাঁকে তাঁর গৃহত্যাগের প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য প্রভাবিত করতে পেরেছিল। এমনকি তাঁর জমিদার পিতাও মধ্যরাতে চুপিসারে তাঁর পুত্র রঘুনাথ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তার জন্য দেহরক্ষী ভাড়া করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছ থেকে দায়িত্বশীল বিবাহিত মানুষের মতো গৃহে অবস্থানের নির্দেশ পেয়েও তিনি ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। অবশেষে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করার উপায়টিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ উপায় অবগত হয়ে শ্রীরঘুনাথ দাস হৃদয়ঙ্গম করলেন যে তাঁর নিজেকে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কাছে বিনম্রভাবে আত্মসমর্পিত হওয়া উচিত। পানিহাটির এই বটবৃক্ষের স্থানটিই সেই ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান যেখানে শ্রীরঘুনাথ দাস শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা লাভ করেছিলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর দর্শন লাভ করা মাত্রই শ্রীরঘুনাথ দাস তাঁর মস্তক শ্রীল নিত্যানন্দ প্রভুর দিব্য পাদপদ্মে স্থাপিত করলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তখন তাঁকে উপস্থিত সকল ভক্তের জন্য চিঁড়াদধি মহোৎসবের আয়োজন করতে আদেশ দিলেন।

       সেই আদেশ শিরোধার্য করে শ্রীরঘুনাথ দাস তৎক্ষণাৎ মহোৎসবের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ যেমন দই , চিঁড়া , মিষ্টি , কলা ইত্যাদি আনবার জন্য লোক পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সমস্ত কিছু আনা হয়ে গেলে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু নির্দেশিত সেই চিড়াদধি মহোৎসব শুরু হয়ে গেল। এই চিঁড়াদধি মহোৎসবের কথা ছড়িয়ে পড়তেই কাছে ও দূরের বিভিন্ন জায়গা থেকে , এমন কি বহু দূরদূরান্ত থেকেও ভক্তগণ ঐ পানিহাটির গঙ্গার তীরে সমবেত হতে থাকলেন। ক্রমে ক্রমে এত ভীড় হয়ে গেল যে ভূমিতে আর দাঁড়াবার জায়গা থাকল না। ভক্তগণ এরপর গঙ্গায় কোমর অবধি জলে নেমে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিঁড়াদধি ভক্ষণ করতে লাগলেন। হাজার হাজার ভক্ত যখন এইভাবে চিঁড়াদধি মহোৎসবের আনন্দ উপভোগ করছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তখন সবাইকে। মাঝে মাঝে উচ্চৈঃস্বরে “ হরি হরি ” ধ্বনি দেবার জন্য নির্দেশ প্রদান করছিলেন। আর তাই সেই সময় হাজার হাজার ভক্তের “ হরি হরি ” ধ্বনিতে পানিহাটির আকাশ বাতাস মুখরিত হয়েছিল।

       কলকাতার দশ মাইল উত্তর দিকে গঙ্গা তীরবর্তী এই পানিহাটি ঐতিহাসিকভাবে চাউল ব্যবসায়ের কেন্দ্ররূপে বিখ্যাত। প্রকৃতপক্ষে পানিহাটি কথাটির অর্থই হচ্ছে জলের নিকটবর্তী বাজার। বর্ষা শুরু হবার ঠিক পূর্বে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের সময় এই চিঁড়া - দধি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাই এই অনুষ্ঠান ভক্তদের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার একটি উপযুক্ত উপায় গত কয়েকশত বৎসর ধরে ঠিক ঐ দিনটিতে আজও চিড়া - দধি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখন ইসকনের পরিচালনায় প্রায় এক লক্ষ মানুষের সমাগমে এই চিঁড়া - দধি মহোৎসব প্রতি বৎসর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

       যে বটগাছের নীচে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসেছিলেন , সেখানকার পরিবেশ ও গাছটি আজও মানুষের মনে এক বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বেশ বোঝা যায় যে গাছটি অতীব প্রাচীন। গাছটির চারদিকে মাটি দিয়ে উঁচু করে তা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। এরপর ঐ চত্বরটিকে গ্রীল দিয়ে দেওয়ালের মতো পরিবেষ্টিত করা হয়েছে। আমরা আজ সৌভাগ্যমন্ডিত যে ঐ বটগাছটির নীচে মাটির তৈরী শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মূর্তি দেখতে পেলাম। সম্ভবত কেউ এই বিগ্রহ আরাধনার পর সেখানে তা রেখে দিয়ে গেছে। মূল বটগাছটি থেকে আরও কয়েকটি বটগাছ ও বটের ঝুরি প্রকাশিত হয়ে পুরো চত্বরটিকে যেন চাঁদোয়ার মতো আচ্ছাদিত রেখেছে। ফলে রৌদ্র সেখানে প্রবেশ করতে পারে না বলে জায়গাটি বেশ মনোরম ও শীতল। গাছের নীচে চারটি পিলারের উপর ছাদ ঢালাই করে একটি কংক্রিটের কাঠামো করা হয়েছে। সেখানে যে কেউই এসে পূজা - আর্চা , স্তব পাঠ ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন দেখলাম দুই বোন এসেছে সেখানে তাদের মৃত পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে।

      

    মন্দিরের আরতি

    পানিহাটির ঐ বটগাছের সামনেই রয়েছে একটি মন্দির। আমাদের জানা ছিল যে দুপুরের একটু পরেই মন্দিরটি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বন্ধ হওয়ার আগেই যাতে আমরা মন্দিরটি দর্শন করতে পারি সেজন্য মন্দিরের দিকে আমরা হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে পৌছে নিশ্চিত হলাম যে যাক্ আমরা এবার তাহলে মন্দির বন্ধ হবার আগেই দর্শনের সুযোগ পাব। মন্দিরের প্রবেশদ্বার পার হয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম মন্দিরের চত্বরের সামনে বসে কয়েকজন মহিলা গল্পগুজব করছে। তাদের পরণে সুতীর শাড়ি , হাতের শাখা , সিঁথির সিঁদুর দেখে বোঝা গেল এরা সবাই স্থানীয় গৃহবধু।

       মন্দিরটির এক মহান ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ঠিক এখন যেখানে মন্দিরটি অবস্থিত সেখানেই ছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ অন্যতম পার্ষদ শ্রীল রাঘব পণ্ডিতের গৃহ। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাঁর অনুগামীদের নিয়ে প্রায়ই সেই গৃহে নৃত্য , কীর্তন ও ভোজনের জন্য আসতেন। রাঘব পন্ডিত এবং তাঁর ভগিনী দময়ন্তী দেবী সর্বদাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর সেবায় অত্যন্ত ভক্তির সঙ্গে প্রসাদ নিবেদনের জন্য তাঁরা খ্যাত মগ্ন থাকতেন। ছিলেন। সাধারণত বলা হয় যে স্বয়ং শ্রীমতী রাধারানী দময়ন্তী দেবীর রান্নাঘরে রান্না করতেন।

       মন্দিরের বিগ্রহ কক্ষের পাশেই রয়েছে একটি প্রদর্শনশালা। আমরা সেটি ঘুরে দেখতে লাগলাম। দময়ন্তী দেবী মহাপ্রভুর জন্য কি কি ধরনের পদ রান্না করতেন সেখানে সেগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি রান্নায় এমন দক্ষ ছিলেন যে তার রান্না এক বৎসরেও নষ্ট হোত না। এমনকি গঙ্গার কাদা দিয়ে তিনি সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরী করতে পারতেন। সেই রান্না যত্ন সহকারে ব্যাগে ভরে নিয়ে রাঘব পণ্ডিত প্রভু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নিবেদনের জন্য জগন্নাথ পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। সে সময় এটি প্রথা ছিল যে , বিশেষত রথের সময় বঙ্গদেশ থেকে ভক্তগণ পুরীতে রথযাত্রা উৎসব পালনের জন্য গমন করতেন। সেই সময় রাঘব পন্ডিত ও তাঁর পার্ষদগণ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্য বিভিন্ন ব্যাগ ভর্তি প্রসাদ বহন করে নিয়ে যেতেন।

       ঐ প্রদর্শনশালাটিতে শ্রীমতী দময়ন্তী দেবীরও হাতে জপমালা ধরে থাকা ভঙ্গিমায় একটি মূর্তি আছে এবং সেই সঙ্গে ঐ মন্দিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী বিভিন্ন গুরুবর্গের ছবিও রয়েছে। এই সময় মন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি কানে আসায় আমি তাড়াতাড়ি প্রদর্শনশালার কিছু ফটো তুলে নিয়ে মন্দিরের আরতি দর্শন করতে গেলাম। মূল বিগ্রহ কক্ষের দরজা খোলার পর এক বৃদ্ধ পুরোহিত একটি বড় করতাল বাজাচ্ছিলেন।

       বিগ্রহ কক্ষটি মন্দিরের থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত। দরজার তিনটি স্তর। সেই দরজার সবগুলি উন্মুক্ত হয়ে গেলে আমরা গৌর নিতাই , প্রাচীন রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ ও অনেক শালগ্রাম শিলা দেখতে পেলাম। বিগ্রহসমূহ বিগ্রহ কক্ষের এতটা অন্দরে স্থাপিত হয়েছে যে তা ভালো করে দর্শন করা বেশ কষ্টকর। একজন মধ্য বয়সী মহিলা একটি করতাল তুলে নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্র কীর্তন করতে লাগলেন। যদিও তিনি বিভিন্ন মন্ত্র কীর্তন করছিলেন কিন্তু প্রত্যেক মন্ত্রের শেষে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করছিলেন। ইতিমধ্যে একজন যুবতী এসে একটি নতুন চকচকে বড় কাঁসর তুলে নিয়ে কাঁসরটি দুলিয়ে দুলিয়ে হাতুড়ি দিয়ে ঢঙ ঢঙ করে কাঁসর বাজাতে লাগলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আরতির বাদ্যের সুরের সঙ্গে তাঁর তাল মিলছিল না। আরেকজন মহিলা মন্দিরে সিলিঙে বাঁধা ঝুলন্ত ঘণ্টার দড়ি ধরে টেনে টেনে ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন।

       এটা দেখে সত্যিই ভালো লাগলো যে স্থানীয় মানুষেরা এই মন্দিরকে কতখানি গুরুত্ব দেয় ও ভালোবাসে। মধ্যাহ্নের আরতির সময়ও তাঁরা তাই মন্দিরে এসে ভীড় করেন। তাঁরা যে এসে শুধু ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকেন এমন নয় , তাঁরা কীর্তনে অংশগ্রহণ করেন। শ্রীশ্রীগৌর নিতাইয়ের কাছে হরে - কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার চাইতে আনন্দময় সেবা আর কি আছে ?

      

    শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্যের সঙ্গে পরিচয়

    আরতির পর আমরা সমবেত সবাই হাঁটু মুড়ে বসলাম। পুরোহিত এরপর সবার মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে দিলেন। এরপর সবাইকে মন্দির ছেড়ে যাবার আগে একটি বড় ট্রেতে করে প্রসাদ নিয়ে এসে সবার হাতে এক চামচ করে প্রসাদ দিলেন।

       মন্দিরের ঠিক পেছনেই একটি সরু জায়গা রয়েছে। সেখানে আমাদের ও আরও কয়েকজনকে মধ্যাহ্নের প্রসাদ ভোজনের জন্য আপ্যায়িত করে বসানো হল। সেখানে বছর পঞ্চাশের জনৈক দর্শনার্থী আমার গলায় ক্যামেরা ঝোলানো দেখে আমার সঙ্গে আলাপ করে কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন যে তিনি কলকাতার একটি সংবাদপত্র অফিসে কাজ করেন এবং ফটোগ্রাফি তাঁর নেশা। আজ তিনি নিত্যানন্দ প্রভুর আরেক লীলাস্থলী খড়দহ থেকে তাঁর পরিবার নিয়ে এখানে এসেছেন। তিনি আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণভাবে কথা বলছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর ই - মেলের ঠিকানা দিলেন এবং কিভাবে খড়দহে যেতে হবে তাঁর পথ নির্দেশ দিলেন। কথায় কথায় আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ আপনি কি ইসকন থেকে এসেছেন ? ” এরপর তিনি জানালেন “ আমি যদিও ইসকনের সঙ্গে যুক্ত নই কিন্তু আমি শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য। ”

       মন্দির চত্বরে রাঘব পন্ডিতের সমাধি রয়েছে। সেখানে একটি লতানো ফুলের গাছ এমনভাবে সমাধির উপরিভাগে চাঁদোয়ার মতো ছেয়ে আছে যেন সে সমাধিকে ছায়া দানের সেবা করছে। সেই সমাধিকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতে করতে কয়েকবার পরিক্রমা করে আমরা ঘাটের দিকে রওনা হলাম। ঘাটের পথে যেতে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর বটগাছ তলায় দেখলাম এক দরিদ্র বৃদ্ধা শুয়ে রয়েছেন। অমৃতা জীবনী মাতাজী তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারল , সে একজন বিধবা , আগে এই পানিহাটিতেই থাকতেন। এখন তার ঘর বাড়ি বলে কিছু নেই। কিছুদিন আগে পানিহাটির চিঁড়া - দধি মহোৎসব উপলক্ষে তিনি এখানে চিঁড়া - দধি খেতে এসেছিলেন। সেই থেকে তিনি শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর বটগাছের নীচেই আশ্রয় নিয়েছেন। রাতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। মানুষেরা তাঁকে যা দান করেন তাতেই তাঁর দুবেলা আহারের সংস্থান হয়। দৃশ্যত তাঁর অবস্থা দেখে আমাদের খুবই খারাপ লাগলো। যদিও জানি পারমার্থিকভাবে তিনি অত্যন্ত ভাগ্যবান। নিত্যানন্দ প্রভুর লীলাস্থানের পূর্ণ শরণাগত হবার ভাগ্য কজনের হয় ? আমরা চলে আসবার সময় অমৃতা জীবনী মাতাজী তাঁর হাতে কিছু টাকা দিলেন। তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা গ্রহণ করলেন। পানিহাটির শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর স্মৃতি বিজড়িত গঙ্গাতীরবর্তী সেই বটতলা ছেড়ে যাবার সময় মনটা বেশ খারাপ লাগছিল। শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কাছে প্রার্থনা জানালাম এবারে আমেরিকার আটলান্টায় আমাদের ' নিউ পানিহাটি ধামে ’ ফিরে গিয়ে যেন সাফল্যের সঙ্গে চিঁড়া - দধি মহোৎসবের আয়োজন করতে পারি।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ৪) গোপীবল্লভপুর
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।