ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত চারধামের অন্যতম

    বদরিকাশ্রম

    বেণুধারী দাস ব্রহ্মচারী

    এই ভারত ভূমিকে ভগবান ও তাঁর বিভিন্ন অংশকলা অবতার বহুরূপে অবতীর্ণ হয়ে লীলাবিলাস করে একে অলঙ্কৃত করেছেন । ভগবানের বহু পার্ষদবৃন্দ ও বহু বহু আচার্যবৃন্দ তাঁদের পদাঙ্কিত ধূলি দ্বারাও এই ভারত ভূমি মহিমান্বিত । বহু পবিত্র নদীসমূহ ও তীর্থভূমি সমূহ এবং বহু বহু সাধুসস্তবৃন্দের তপস্থলী দিয়ে এই ভূমি অলঙ্কৃত বার মাসে তেরো পার্বণ অর্থাৎ বিভিন্ন তীর্থানুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ সাধুসমাগমে সাধারণ মানুষ সহজেই নিজেকে পবিত্র করে তুলতে পারে । পূর্ব - পশ্চিম - উত্তর - দক্ষিণ ও মধ্যে সর্বত্রই এই সমস্ত পবিত্র নদী ও তীর্থস্থানের বাতাবরণ ত্রিতাপদগ্ধ সংসারী গৃহী মানুষদের হৃদয়ে শাস্তির শীতলতা প্রদান করে । ভাগ্যবান মানুষ মাত্রেই এই সমস্ত সুলভ সুযোগ সুবিধাগুলি গ্রহণ করে দুর্লভ মনুষ্য জীবন সার্থক করে তুলবেন ।

       

    চারধাম

    শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য ভগবানের লীলাভূমির চতুর্দিকে ৪ টি ধাম স্থাপন করে ভারতবর্ষকে সুরক্ষিত করেছেন । পূর্বে শ্রীক্ষেত্র পুরীতে শ্রীজগন্নাথ , পশ্চিমে দ্বারকাতে শ্রীদ্বারকানাথ , উত্তরে বদ্রিকাশ্রমে শ্রীদ্রীনাথ ও দক্ষিণে রামেশ্বরে শ্রীরামচন্দ্র। ভগবান তাঁর লীলাবিলাসের উদ্দেশ্যে তিনি এই চারধামে চারলীলাকার্য সাধন করেন । একটি প্রচলিত প্রবাদে বলা হয় , “ ভগবান বদ্রিকাশ্রমে স্নান করেন , দ্বারকা ধামে বেশ পরিধান করেন , পুরীধামে ভোজন করেন এবং রামেশ্বরে শয়ন করেন । ”

        জীবের মুক্তিক্ষেত্র এই চারধাম জীব দর্শন ও স্পর্শন মাত্রই উদ্ধার লাভ করে । পূর্বপ্রান্তে নীলাচল পুরীতে দারুব্রহ্ম শ্রীজগন্নাথজীর অপূর্ব দর্শন খুবই মহিমান্বিত । ভগবান এখানে তিনি তাঁর অপূর্ব ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত ভোজনলীলা উপভোগ করেন । দিনভর বহুবার ভোগ নিবেদন হয় এবং এক একবারে বহু পদ সহ তাহা নিবেদন করা হয়-

        নীলাচলে ভোজন তুমি কর বায়ান্নবার ।
    এক এক ভোগের অন্ন শত শত ভার ॥
    ( চৈঃ চঃ মধ্য ১৫ / ২৩৯ )

    জগৎবাসীকে কৃপা করবার জন্য তাঁর এই ভোগগ্রহণলীলা যার মাধ্যমে তাঁর এই প্রসাদ গ্রহণ করে জীব তাঁর কৃপা লাভ করবে । এখানকার মহাপ্রসাদ ত্রিজগতে খুবই মহিমান্বিত হরিভক্ত মাত্রই তো কথাই নেই , এমনকি হরিবিমুখ জীবও খাওয়ার অভ্যাসবশত এই সুস্বাদু প্রসাদ গ্রহণেই সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারছেন । ভগবানের অপূর্ব দর্শন ও তাঁর অপ্রাকৃত প্রসাদ দুই জগঞ্জীবকে মুক্তি দান করছেন । ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে শ্রীদ্বারকা ধাম , যেখানে ভগবান ১৬১০৮ পত্নীসহ অপূর্ব ঐশ্বর্যমণ্ডিত দিব্য প্রাসাদে তিনি তাঁর গৃহস্থ লীলা উপভোগ করেছেন । তিনি নিজেকে ১৬১০৮ রূপে প্রকাশ করে প্রত্যেক পত্নীতে তিনি ১০ টি সন্তান সহ সেখানকার অন্যান্য যদুবংশ পরিবারের ভূমিকায় আদর্শ রাজকার্য শাসন লীলা সম্পাদন করেছেন । উত্তরে হিমালয় ক্ষেত্রে বদ্রিকাশ্রমে ভগবান তপস্যালীলা সাধন করেছেন এবং দক্ষিণে শ্রীরামেশ্বরে অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্র তিনি শয়ন লীলা উপভোগ করছেন । তাঁর অপূর্ব মনোহর শয়নমূর্তি জীবমাত্রেরই মন জয় করে । এককথায় উত্তরে তাঁর তপস্থলী , পশ্চিমে রাজকার্য শাসন , পূর্বে এসে ভোজন ও দক্ষিণে গিয়ে শয়ন , ভগবানের এই মাধুর্য্যমণ্ডিত লীলাবিলাস মানুষমাত্রের দর্শন অবশ্য কর্তব্য । এখনকার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এই চারধাম দর্শন অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে । সদ্যই আমরা বহু যাত্রীগণ সহ উত্তরে শ্রীদ্রীকাশ্রমে বদ্রীনাথ দর্শন করলাম , তারই কিছু দিক দর্শন নিবন্ধে বিবৃত করব ।

       

    শ্রীবদ্রীনারায়ণ

    এই বদ্রীনাথ ধাম ভারতের উত্তরখণ্ডে হিমালয় প্রান্তে অবস্থান করছেন । এই হিমালয় ভূখণ্ডে আবার চার ধাম রয়েছে— শ্রীগঙ্গোত্রী ( গঙ্গার উৎসস্থল ) , শ্রীমুনোত্রী ( শ্রীযমুনার উৎসস্থল ) , শ্রীকেদারনাথ ( শ্রীশিবজীর আবাসস্থল ) ও শ্রীদ্রীনাথ । আমরা যদিও এই চারধাম দর্শন করেছি ও কীর্তনাদি সহ বহু লীলাকথা শ্রবণ করেছি তথাপি আজকের প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কেবলমাত্র শ্রীদ্রীনাথ মাহাত্ম্যই কীর্তন করব ।

        বহু পুরাকালে এখানে শ্রীবদ্রীনাথ ছিলেন না অর্থাৎ এ স্থানকে বদ্রীনাথ বলা হত না । পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে এই সম্পূর্ণ হিমালয় স্থানটি কেদারনাথ বা কেদারখণ্ড বলে প্রসিদ্ধ ছিল । পক্ষান্তরে বলা যায় এই সম্পূর্ণ হিমালয় ভূখণ্ডটি শ্রীশিবজীর অধিকৃত ছিল , এখানে শিব - পার্বতী অবস্থান করতেন । পরবর্তীকালে ভগবান বিষ্ণু ছল করে তাঁর কিছু অংশ দখল করে নেন , যেই অংশটি বদ্রীনাথ ধাম রূপে প্রসিদ্ধ । ঘটনাটি এই রকম— ভগবানের পরম ভক্ত শ্রীনারদমুনি ভগবানের নাম কীর্তন করতে করতে ভগবানের নিত্য আবাসস্থল ক্ষীর সাগরে উপস্থিত হয়েছেন । সৃষ্টি , স্থিতি ও পালন কর্তা ভগবান শেষ শয্যায় যোগনিদ্রায় শয়ন করে আছেন আর তাঁর স্বীয় শক্তি শ্রীমতী মাতা লক্ষ্মী দেবী সসম্ভ্রমে তাঁর পদ সম্বাহনে যুক্ত , ভক্ত নারদ তা দর্শন করে প্রণাম ও তারপর বলছেন — ' হে প্রভু । আপনি জগতের মূল বন্দনাদি করলেন । সৃষ্টিকর্তা , পালন ও ধ্বংসকর্তা আর আপনি যা করবেন তা জগতে আদর্শ হয়ে থাকবে । আপনি শেষ শয্যাতে শুয়ে আছেন আর পত্নী পাদসেবা করছেন । আপনার এই উপভোগ , এতে সংসারী লোক কি শিক্ষা লাভ করবে ? সারা সংসার তো এইভাবে ভোগে মত্ত হয়ে যাবে । ভগবানের ইচ্ছায় শ্রীনারদজী এই রকম বাক্য প্রয়োগ করেছেন , তাই মূর্খতাবশতঃ আমরা না বুঝে নারদ মুনির দোষারোপ করে যেন অপরাধীর ভাগী না হই । করুণাময় ভগবান জগতের মূঢ় জীব আমাদের প্রতি কৃপাবর্ষণ করার জন্য তাঁর এই লীলার প্রকাশ । যাইহোক শ্রীনারদের এই কঠোর বাক্য ভগবান খুব গম্ভীর ভাবে নিয়েছেন নারদ এত বড় কথা বলতে পারল । অন্ততঃ ভগবান লক্ষ্মীদেবীর সামনে নারদকে কিছু বললেন না । পরে নারদ চলে গেলে তিনি লক্ষ্মীদেবীকে বললেন , দেবী তুমি নাগলোকে যাও নাগপত্নীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসো । দেবী যখনই নাগলোকে গিয়েছেন ভগবানও তখনই ক্ষীর সাগর ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছেন এবং জায়গা খুঁজছেন কোথায় বসে তপস্যা করা যায় । আমি আর পত্নীর সেবা নেব না । আমি তপস্যা করে জগৎকে শিক্ষা দেব । জগৎবাসী কোন দান - ধ্যান - তপস্যা করতে চায় না , কেবল সকলেই ভোগে ব্যস্ত তাতে জগতের মঙ্গল হবে কি করে । তাই আমি সকলের হয়ে তপস্যা করবো , যা এই আদর্শ সকলের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে । ভগবান এই তপস্যার জায়গা অনুসন্ধান করতে করতে তিনি এই হিমালয়ে এলেন । তিনি দেখলেন যে এই পুরোটাই শিবজীর দখলে । এই জায়গার প্রাকৃতিক পরিবেশ সত্যিই মনোমুগ্ধকর । ভগবান খুবই আকৃষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে এটিই তপস্যার উপযুক্ত পরিবেশ । কিন্তু শিবজীর কাছ থেকে কিভাবে তা নেওয়া যায় ? এমতাবস্থায় দেখলেন , শিব - পাবর্তী স্নানের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করে তপ্তকুণ্ডের দিকে যাত্রা করতে উদ্যত হয়েছেন । হঠাৎ পার্বতী দেখলেন বাড়ির নিকটেই একটি অপূর্ব সুন্দর বালক বসে উচ্চস্বরে কাঁদছে । বালকটিকে শান্ত করার জন্য পার্বতী দৌড়ে গেলেন । শিবজী কিন্তু বুঝতে পেরেছেন , তিনি বলছেন তুমি তার কাছে যেও না , এ খুব ভয়ানক । সংসারের কাজ হচ্ছে হাসি আর কান্না , তুমি একে আবার তোমার সংসারের কাজে যুক্ত করছ কেন ? যার বালক সে দেখবে , তুমি ওর কাছে যেও না , ও তোমাকে ঘর ছাড়া করতে পারে , তুমি কিন্তু সাবধান হও । কিন্তু এই আকর্ষণীয় বালকটি এতটাই জ্যোতির্ময় যে পার্বতী খুবই মুগ্ধ হয়ে গেছেন , আর তিনি তো মহিলা , তাঁর হৃদয় অত্যন্ত কোমল । তিনি বলছেন প্রভু তুমি সকলকে আশ্রয় দিচ্ছ , আর এই বালক এতটাই কান্নাকাটি করছে তাকে একটু আশ্রয় দেওয়া যাবে না । মাতৃ হৃদয়ে ব্যকুলিত হয়ে ছুটে গিয়ে তাকে কোলে নিয়েছেন । ভগবান শিব মনে মনে হাঁসছেন ভাবছেন , বিষ্ণুমায়া কত শক্তিশালী — আমি বলছি তুমি একে ধরো না , তবুও মায়ায় বিমোহিত হয়ে তাকে কোলে তুলে আদর করছে । এমন কি তাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে খাটে শুইয়ে দুজনে স্নান করতে গেলেন । স্নান সেরে ঘরে ফিরে দেখলেন ভিতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ এবং অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ঘরের দরজা খুলতে পারলেন না । শিবজী মুচকী মুচকী হাসছেন , কেননা তিনি তো সব জানেন । তিনি বললেন পার্বতী এবার বুঝেছ কি হয়েছে । তুমি যে বালকটিকে ঘরে শুইয়ে রেখে গিয়েছিলে , তিনি স্বয়ং নারায়ণ । এখন তিনি এই জায়গা অধিকার করে নিয়েছেন , আমাদের অন্য কোথাও এবার যেতে হবে । তারপর শিব - পার্বতী ওখান থেকে চল্লিশ কিমি দূরে আর একটি পর্বতে অবস্থান করলেন যা এখন কেদারখণ্ড বা কেদারনাথ বলে প্রসিদ্ধ । যেখানে এখন বদ্রীনাথ মন্দির আগে এখানে কেদারনাথ থাকতেন , তাই সেখানে আদিকেদার রূপে তাঁর একমূর্ত্তি শ্রীন্দ্রীনাথ ভগবানের কাছেই রয়েছেন । খোলা বিরাট মাঠ , গাছপালা বেশী নেই । ভগবান বিষ্ণু এখানে বসে কঠোর তপস্যায় বসলেন । লক্ষ্মীদেবী নাগকন্যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ফিরে দেখলেন ক্ষীর সাগরে শেষশয্যা খালি , ভগবান নেই । কোথায় গেলেন তিনি , প্রভুর বিরহে সারা জগৎ খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন— এখানে আমার প্রভু তপস্যা করছেন । বৃষ্টি , বরফ , ঠাণ্ডা আবার কখনো কখনো লু বইছে । এত গরমের মধ্যে কি কঠোর তপস্যা । দেবীর দুঃখ হল , তিনি স্বামীর সেবা করতে ইচ্ছা করলেন । তিনি তপস্যা ভাঙাতে চাইলেন না তাই কুলগাছ বা বদ্রীগাছ ধারণ করে প্রভুর উপরে ছায়া প্রদান করলেন , লক্ষ্মীদেবী কুলগাছের রূপ ধারণ করেছিলেন তাই কুলগাছের পাতাকে মঙ্গলময় বলা হয় । সেহেতু ভগবান এখানে বদ্রীনারায়ণ বলে সকলের কাছে পরিচিত । তবে এখন সেই কুলগাছ বা বদ্রিগাছ দেখা যায় না , কিন্তু পুরাণে , মহাভারতে দেখা যায় পঞ্চপাণ্ডব যাত্রাকালে তাঁরা সেই কুলগাছ দর্শন ও তাঁর সুন্দর সুমিষ্ট ফল আস্বাদন করেছিলেন । দুর্ভাগা কলিজীবের কাছ থেকে তিনি অন্তর্হিত হয়েছেন ।

       

    বর্তমান শ্রীবিগ্রহ

    কুল গাছ থাকবে কি , স্বয়ং ভগবান তপস্যা করছিলেন সত্যযুগে বদ্রী নারায়ণ রূপে , ত্রেতাযুগে সব মুনি ঋষিদের নিয়ে যোগ সাধনা করেছিলেন সেখানে । সমস্ত দেবতারা আসতেন , তারা সরাসরি ভগবানকে সশরীরে পূজা করতেন । হঠাৎ ত্রেতা শেষে ভগবানকে কেউ দেখতে পাচ্ছেন না । দেবতা , মুনিঋষিরা সমবেত প্রার্থনা করলেন— হে ভগবান , আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন , আমাদের দর্শন দিন । ভগবান পুনরায় আবির্ভূত হয়ে বললেন— দ্বাপর যুগে আমি কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হব এবং তার অল্প কাল পরে কলিযুগ শুরু হবে । আর সেই কলিযুগে মানুষ খুবই অধার্মিক হবে , ধর্ম কর্ম করবে না , এতটাই নিকৃষ্ট হবে যে আমি তাদের সামনে সশরীরে থাকতে পারব না । এই অলকানন্দা নদীতে একটি কুণ্ড আছে যার নাম নারদকুণ্ড । শ্রীনারদ এই কুণ্ডে তপস্যা করে আমাকে পেয়েছিল । তোমরা সেখান থেকে আমার এক মূৰ্ত্তি পাবে , তা নিয়ে তোমরা পূজা করবে । তখন থেকে সে মূৰ্ত্তি কলিযুগেও পূজা হয়ে আসছিল । আজ থেকে ১২০০ বছর আগে শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য এখানে এসেছিলেন । ১২ বছর বয়সেই তিনি বৈদিক জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন ।

        বস্তুত তিনি ছিলেন শিবের অবতার । বেদ থেকে জানতে পেরেছিলেন এখানে ভগবানের চতুর্ভূজ মূর্তি পূজা হয় । তিনি তিনমাস পায়ে হেঁটে এখানে উঠেছিলেন । তিনি এসে দেখেন পূজারিরা পূজা করছে কিন্তু সে চতুর্ভূজ মূৰ্ত্তি নেই । পূজারীদের জিজ্ঞেস করলে , তারা বলেন বহুদিন যাবৎ আমরা এই শালগ্রাম শিলা পূজা করে আসছি । তবে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি এখানে পূর্বে মূৰ্ত্তি ছিল । কিন্তু চীনাদের আক্রমণের সময় তারা মূর্তিকে কোথায় রেখেছে তা আমাদের জানা নেই । শিব অবতার তিনি জানেন , তিনি বললেন আমি যদি সেই মূৰ্ত্তি খুঁজে দিই তাহলে তোমরা পূজা করবে ? হ্যা , আমাদের পরম সৌভাগ্য পরম যত্ন সহকারে পূজা করব । শ্রীশঙ্করাচার্য কিছুটা ধ্যানস্থ হয়ে নারদ কুণ্ডে প্রবেশ করবেন তখনই পূজারীরা বাধা দিলেন— বিপদজনক এই কুণ্ড , এর সঙ্গে অলকানন্দার সংযোগ রয়েছে , তাই এই কুণ্ডে যে প্রবেশ করে আর ফিরে আসে না । কিন্তু শিবাবতার শঙ্কাচার্যের কি ভয় ! তিনি তাতে প্রবেশ করে একটি মূৰ্ত্তি তুললেন । সবাই খুবই খুশী , আমরা ভগবানকে পেয়েছি কিন্তু দেখা গেল যে সেই মূর্তিটি ভাঙা , তা বাদ দিলেন । দ্বিতীয়বার ডুব দিলেন — এবারের মূর্তিটিও ভাঙা তৃতীয়বারে , সেটাও ভাঙা — তিনি মন থেকে ভেঙে পড়লেন । তখনই হঠাৎ দৈববাণী শোনা গেল । এই মূৰ্ত্তিতেই আমি পূজা পাব । সেই মূৰ্ত্তিই এখন পূজা হচ্ছে । এই ভূখণ্ডকে নারদখণ্ডও বলা হয় । শ্রীনারদজী বদ্রীনারায়ণের শ্রেষ্ঠ পূজারী । বছরের ছয় মাস মানুষ ও ছয় মাস দেবতারা এই বদ্রীনারায়ণের সেবা করেন । এইভাবে এখানে বদ্রিনারায়ণ ভগবান প্রকাশিত হয়েছেন ।

       

    নর নারায়ণ পর্বত

    শ্রীমদ্ভাগবত থেকেও জানতে পারা যায় — সৃষ্টির প্রারম্ভে ব্রহ্মা প্রথম চার কুমার সৃষ্টি করেন এবং তাদের প্রজা সৃষ্টির আদেশ দেন । কিন্তু তারা ব্রহ্মার আদেশ অমান্য করে ব্রহ্ম উপাসনায় নিমগ্ন হলেন । এতে ব্রহ্মা খুবই ক্রোধান্বিত হলেন । ফলে একাদশ রুদ্র সৃষ্টি হলেন এবং তাঁরা রুদ্রানীর সঙ্গে বহু প্রজা সৃষ্টি করলেন । কিন্তু সেই সমস্ত প্রজারা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলেন । বিরক্ত হয়ে ব্রহ্মা তাদের প্রজা সৃষ্টিতে নিবারণ করে তাদের জঙ্গলে তপস্যায় প্রেরণ করলেন । চিন্তিত হয়ে ব্রহ্মা তাঁর নাক - কান থেকে পুলস্থ , পুলহ , অত্রি , অঙ্গিরা , ভৃগু , বশিষ্ট , নারদ , মরীচী আদি ঋষিদের সৃষ্টি করলেন । সবশেষে ব্রহ্মা তাঁর ডান বক্ষ থেকে ধর্ম দেবতাকে সৃষ্টি করলেন । দক্ষ প্রজাপতির তেরটি কন্যার সঙ্গে এই ধর্মের বিবাহ হয় । কনিষ্ঠ পত্নী মূর্তির গর্তে দুই পুত্র নারায়ণ ও নর জন্মগ্রহণ করেন । দুই ভাই ব্যবহারে খুবই সুন্দর ও পিতামাতার একনিষ্ঠ সেবা পরায়ণ ছিলেন । তাদের সকলেই ভালবাসতেন ও খুবই স্নেহ করতেন । অত্যন্ত প্রীত হয়ে মাতা মূর্তি বললেন— বাছা ! আমি তোমাদের সেবায় খুবই তুষ্ট হয়েছি , কিন্তু বর দিতে চাই – বাছা । তোমাদের যা অভিলাষ প্রার্থনা কর । তারা বললেন আমরা এ সংসারে থাকতে চাই না , আমাদের অনুমতি দিন আমরা তপস্যা করতে চাই । তাই শুনে মা খুবই দুঃখিত হলেন এবং বললেন কিন্তু তোমাদের না দেখে আমি থাকতে পারব না । তোমরা মাঝে মাঝে এসে দেখা দিয়ে যাও । তারা এখানে এসে দুই ভাই তপস্যায় এতটাই লীন হয়ে গিয়েছে যে বাড়ি ভুলে গিয়েছে । সেটা তো স্বাভাবিক যে বাড়ি আর তপস্যা দুটিই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী । কিন্তু মা - বাবা ভোলেন না , তারা একদিন এখানে আসেন পুত্রদের দেখার জন্য । সেই দিন ছিল ভাদ্রমাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথি । দুই ভাই তপস্যা থেকে উঠে মা - বাবাকে খুবই সম্মান করলেন । আজও সেই তিথিতে খুব বড় অনুষ্ঠান হয় । এইভাবে নারায়ণ ও নর এখানে দুই ভাই তপস্যা করছেন ।
       

    ইন্দ্রের অপ্সরা প্রেরণ

    এইভাবে যখন দুইভাই কঠোর তপস্যা করছিলেন তখন তা দেখে ইন্দ্রের খুব ভয় হলো । তার স্বভাব বশতঃ এই তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য বসন্ত ঋতুকে ডেকে আদেশ দেন তুমি বসন্তের প্রভাব বিস্তার কর । তারপর কামদেবকে বলেন তুমি ওখানে কামভাব বিস্তার কর । তারপর অপ্সরাদের প্রেরণ করে বলেন তোমরা নৃত্য গীত করে এদের তপস্যা ভঙ্গ করে দাও । কারণ ইন্দ্রের জানা ছিল না যে ইনি হচ্ছেন ভগবান । অপ্সরাদের নৃত্য শুনে ভগবান যখন চোখ খুলেছেন তখন তারা খুব ভয়ভীত হয়েছে । কেননা তারা জানে ঋষিরা একবার যদি ক্রোধ প্রকাশ করে তারা ভস্ম হয়ে যেতে পারে । ভয়ভীত তারা দৌড়ে পালাচ্ছে , ভগবান বলছেন তোমরা পালােচ্ছ কেন ? এদিকে এসো আমাদের আশ্রমে তোমাদের একটু সেবা করি । তারা আসতে ভগবান বললেন আমি জানি তোমাদের ইন্দ্র এখানে পাঠিয়েছে ভগবান নারায়ণ ঋষি তখন একটুকরো আমকাঠ নিয়ে উনার ডানদিকের জঙ্ঘাকে ছিঁড়ে ফেললেন এবং তা থেকে অপূর্ব সুন্দরী অসংখ্য অপ্সরা নির্গত হলেন । তারা এতই জ্যোতির্ময়ী ছিলেন যে তাদের দেখে স্বর্গের অপ্সরারা খুবই লজ্জিত হলেন ও তাদের কাছে নিজেদেরকে ব্যাঙের মতো দেখতে লাগলো । ঋষি বললেন হে স্বর্গের দেবী সকল এই সুন্দরীদের মধ্য থেকে যাকে তোমাদের সব থেকে ভালো লাগে তাকে নিয়ে যাও । ভগবান নিজেই তাদের থেকে ঊর্বশীকে নির্বাচন করে ইন্দ্রের জন্য উপহার পাঠালেন । স্বর্গের দেবীরা ও ভগবান থেকে সৃষ্ট সুন্দরীরা সকলেই ভগবানের স্তুতি ও বন্দনা করলেন , ভগবান খুবই প্রসন্ন হয়ে বললেন তোমাদের অভিলাষ মতো বর প্রার্থনা কর । তারা সকলে ভগবানের দাসী হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করলে ভগবান খুবই রুষ্ট হলেন । কিন্তু ছোট ভাই সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যাতে তাদের বাসনা পূরণ হয় তার ব্যবস্থা করুন । ভগবান বললেন এ জন্মে আমি তপস্যা লীলা অভিনয় করছি । পরবর্তী দ্বাপর যুগে আমি কৃষ্ণ রূপে অবতীর্ণ হয়ে তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করব । এভাবে ত্রেতাযুগে ভগবান রামচন্দ্রের রূপে মুগ্ধ হয়েও দণ্ডকারণ্যের ঋষি সকল তাঁকে পতিরূপে বাসনা করেছিলেন । তাদের সকলের মনোবাসনা কৃষ্ণলীলায় পুরণ করেছিলেন । তাই কৃষ্ণ অবতারে রাসলীলায় শতকোটি গোপীদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন ।

       

    কৃষ্ণ - অর্জুন

    ছোট ভাই নর’এর এত তীব্র তপস্যা দেখে নারায়ণ খুব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন , আমি তোমাকে বর দিতে চাই । নর বললেন তোমার সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছি আর আমার কি চাই ? নারায়ণ বললেন যদিও তুমি আমার থেকে ছোট তথাপি তোমার শ্রেষ্ঠতার জন্য তোমার নাম আগে বলবে — তাই আমাদেরকে সবাই নর - নারায়ণ বলে ডাকবে । তারপর হঠাৎই নর বলে উঠলেন আমার ইচ্ছা হলো তুমি আমার রথের সারথি হবে । নারায়ণ হেসে বললেন হঠাৎ তোমার এ বাসনা জন্মাল কেন ? ভগবান বললেন যাইহোক এই অবতারে তা সম্ভব নয় । তবে আমি কৃষ্ণ অবতারে তোমার সারথী হব । আর নর অর্জুন রূপে এসেছিলেন এবং কৃষ্ণ তাঁর সারথি হয়ে তাঁর অভিলাষ পূরণ করেছিলেন । নর - নারায়ণ ঋষি এখন দুটি পাহাড় রূপে বিদ্যমান । নারায়ণ পাহাড়ের উপর মন্দিরে বদ্রীনারায়ণের উপাসনা হয় । আর নর পাহাড়ের উপর লোকজন বাস করে । এই জায়গা সমুদ্র তল থেকে ৩৫৮৩ মিটার উচ্চে অবস্থিত ।

       

    অলকানন্দা

    পুত পবিত্রা শ্রীগঙ্গা এই ভূখণ্ড থেকে ত্রিধারায় প্রবাহিত হয়েছেন । গঙ্গোত্রী থেকে তিনি ভাগীরথী রূপে ও কেদারনাথ থেকে মন্দাকিনী রূপে এবং এখানে তিনি অলকানন্দারূপে প্রবাহিত ভগবান চরণ হতে আবির্ভূতা গঙ্গাকে যখন ভগবান মর্তে আসার আদেশ দেন , তখন গঙ্গা ভগবানের কাছে প্রার্থনা রেখেছিলেন যে আপনার চরণপদ্মের আশ্রয় ছাড়া আমি থাকতে পারব না । তাই এখানে অলকানন্দা ভগবানের ঠিক চরণ স্পর্শ করে কলকল ধ্বনিতে মন্দিরের গা বেয়ে প্রবাহিত । দুই পয়োভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ সব সময় বেদমন্ত্র ধ্বনিতে কর্মকাণ্ডাদি অনুষ্ঠান করে চলেছেন , তার অপূর্ব শোভা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ।
       

    তপ্তকুণ্ড

    এই ভূখণ্ড হিমালয় - এ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা । কোথাও কোথাও বরফ পড়তে দেখা যায় , কিন্তু তার মধ্যে এই হিমালয়ে এত ঠাণ্ডার মধ্যে চারটি ধামেই তপ্ত কুণ্ড রয়েছে , যাতে স্নান করে যাত্রিগণ তাদের পথ পরিশ্রম ক্লান্তি দূর করেন । তপ্ত কুণ্ডের জল এতটাই গরম যে যাত্রীরা কাপড়ে চাল বেঁধে ওখানে রাখছেন । পাঁচ মিনিটের মধ্যে তা ভাত হয়ে যাচ্ছে । এবং তা ভগবানকে ভোগ দিয়ে প্রসাদ হিসেবে খাচ্ছেন । ওখান থেকে একটা ধারা নিয়ে অন্য কুঁয়োতে স্নান করা যায় । এখানে বদ্রীনাথেও তপ্তকুণ্ডের অবস্থান দেখা যায় । বিভিন্ন পুরাণে এই তপ্তকুণ্ডের বর্ণনা পাওয়া যায় । একবার ভৃগু ঋষি এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন যে মেয়েটি আগে এক রাক্ষসের বাগদত্তা ছিল । কিন্তু কোন কারণে সেখানে না হয়ে ভূগু ঋষির সঙ্গে বিবাহ হয় । ইতিমধ্যে ভূগুঋষির দ্বারা তিনি গর্ভবর্তী হন । এমন একসময় ঋষি তপস্যার উদ্দেশ্যে গেলে গৃহে কেবল ঋষি পত্নী একাই ছিলেন । তার প্রতি লোভবশত রাক্ষস সেই সুযোগে ঋষির আশ্রমে আসেন । পাশে যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করেন অগ্নিদেব ! আপনি অবশ্যই জানেন এই মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল । অগ্নি সরল মনে বলেছেন হ্যা , আর সেই সুযোগে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে তিনি ঋষি পত্নীকে হরণ করে নিয়ে যান । কিন্তু পথিমধ্যে গর্ভবর্তী ঋষিপত্নীর হঠাৎ প্রসব হয়ে যায় । যেহেতু সে ছিল ঋষির সস্তান চ্যবন ঋষি , সে ছিল খুবই ব্রহ্মতেজ সম্পন্ন । তার এই তেজে রাক্ষস তৎক্ষণাৎ ভস্মীভূত হয়ে যায় । ইতঃবসরে ভৃগু ঋষি বাড়ি ফিরে দেখেন পত্নী বাড়ীতে নেই । পাশে অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি রাক্ষস দ্বারা অপহৃত সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন । তাতে মুনি এতটাই ক্রোধান্বিত হলেন যে তিনি অগ্নিকে দোষারোপ করে তাকে অভিশাপ দিলেন তুমি সর্বগ্রাসী সর্বভুক হবে । অভিশপ্ত অগ্নিদেব এই শাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সমগ্র জগৎ ঘুরতে ঘুরতে প্রয়াগে এলেন । প্রয়াগে ব্যাসদেবের প্রতিনিধিত্বে এক বড় ধর্মসভা অনুষ্ঠান চলছিল । করজোড়ে অগ্নিদেব প্রার্থনা করলেন , হে ঋষিগণ আপনারা আমাকে ভৃগুঋষির শাপ থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় বলুন । ব্যাসদেব কৃপাপূর্বক বললেন হে অগ্নিদেব ! তুমি বদ্রিকাশ্রমে যাও ওখানে তুমি অবশ্যই পাপমুক্ত হবে । পাপমুক্ত হওয়ার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে তুমি তপস্যা কর , আর তার ফলে তুমি অবশ্যই মুক্ত হবে । তার তপস্যায় ভগবান আবির্ভূত হলে , অগ্নি পাপ মুক্ত হওয়ার আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন । ভগবান বললেন এই ধামের মহিমা এতটাই যে যা দর্শন মাত্রেই জীবকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করে । তুমি এমনিতেই সমস্ত কলুষ মুক্ত হয়েছ , আর এখন থেকে তুমি এখানেই অবস্থান করো এস্থান ছেড়ে যেও না । এখানে যত মানুষ আসবে তাদেরকে তুমি পাপ থেকে মুক্ত করো । এইভাবে ভগবানের আদেশে অগ্নিদেব অগ্নিকুণ্ড বা তপ্তকুণ্ড রূপে এখানে সহ চারটি ধামে অবস্থান করছেন । তীর্থযাত্রী মাত্রই ঐ কুণ্ডে স্নান করে সমস্ত কলুষ তো মুক্ত হবেনই পরস্ত্র হাল্কা উষ্ণতায় স্নান এতটাই আরামদায়ক যে সকলের পথশ্রমের ক্লান্তি নিবারণ করে । মহিলা ও পুরুষদের দুটি আলাদা কুণ্ডে পৃথকভাবে স্নানের ব্যবস্থা রয়েছে ।

       

    নারদ কুণ্ড

    শ্রীনারদ মুনি এখানে ৬০,০০০ বছর তপস্যা করেছিলেন । তিনি সরাসরি ভগবানের উপাসনা করতেন । একবার ভগবান হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান । নারদজী কঠোর তপস্যা করেও দর্শন না পেয়ে সরাসরি বেরিয়ে পড়েন ভগবানকে খোঁজার জন্য । বহুদূর অন্বেষণ করার পর তিনি তৃষ্ণায় কাতর হয়ে একটা কুটিরের কাছে এলেন এবং কুটীরে এক ঋষির কাছে জল প্রার্থনা করলেন । ঋষি জমিতে একটু আঘাত করেছেন এবং জমি ফেটে ১০০০ সুন্দরী স্ত্রী একটি বড় থালায় জল নিয়ে বেরিয়েছেন । যখনই নারদ জল খেতে যাচ্ছেন তখনই তারা বাধা দিয়ে বলল , না এটা খাবার জল নয় । তুমি এই জলে প্রবেশ করে স্নান কর তারপর তোমাকে জল খাওয়াবো থালাটা বড় , জল কম তাই নারদ বলছেন আমার আঙ্গুল ডুবে না আমি স্নান করব কিভাবে সুন্দরী মহিলারা বলল আপনি এতে প্রবেশ করুন না , তাতেই হবে । আর নারদ তাতে প্রবেশ করেছেন এগোচ্ছেন এগোচ্ছেন তার অস্ত খুঁজে পাচ্ছেন না । আর ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ দেখছেন সুন্দর সাম্রাজ্য তার মধ্যে সোনার রাজপ্রাসাদ , বিভিন্ন মণি মুক্তা দিয়ে দেওয়াল বাঁধানো সুন্দর সাজানো বাগান , ফোয়ারা , পাখিদের গুঞ্জন , একটা সুন্দর পরিবেশ । সেটি ছিল বৈকুণ্ঠ শ্বেতদ্বীপ যেতে যেতে তিনি শঙ্খ , চক্র , গদা ও পদ্মধারী চতুর্ভুজ একজন পুরুষকে দেখে নিজ প্রভু মনে করে দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন । কিন্তু তিনি বললেন আমি নারায়ণ নই , তিনি আরো আগে আছেন । আবার একজন চতুর্ভূজ পুরুষ দেখে প্রণাম করতেই তিনি বললেন নারায়ণ আরো আগে । সেখানে সকলেই চতুৰ্ভূজ , সকলেই সারূপ্য মূর্তিতে অবস্থিত । এভাবে যেতে যেতে শেষে শ্রীনারায়ণের কাছে পৌছান । নারদ ভগবানের খুবই স্তবস্তুতি করেছেন , ভগবান প্রসন্ন হয়ে কিছু বর দিতে চাইলে , নারদজী বললেন , আমি জানতে চাই কি পদ্ধতিতে পূজা করলে জীব আপনাকে পেতে পারে । ভগবান শ্রীনারায়ণ পঞ্চরাত্র শ্রীনারদকে পূজা পদ্ধতি জ্ঞান প্রদান করেছিলেন যা নারদপঞ্চরাত্র বলে প্রসিদ্ধ । ৫ রাত্রে যেই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে নারদ আর শ্বেতদ্বীপে নেই , তিনি দেখলেন যে সেই ঋষির কাছে বসে রয়েছেন যে ঋষি নারদকে চতুর্ভূজ দেখিয়েছেন এবং বললেন আমিই তোমাকে জ্ঞান দিয়েছি । এভাবে সেখানে নারদকুণ্ড হয়েছে ।
       

    পঞ্চশিলা

    নারদ মুনি যে শিলার উপরে বসে তপস্যা করেছিলেন তা নারদশিলা বলে প্রসিদ্ধ রয়েছে । সেখানে শ্রীমূর্তিতে নারদজী বিরাজিত । গড়ুরদেবের তপস্থলীতে গড়ুর শিলা এবং বরাহ শিলা , মার্কণ্ডেয় শিলা ও নরসিংহ শিলা এই স্থানে বিদ্যমান রয়েছেন ।
       

    বদ্রীবিশাল

    বদ্রীনারায়ণকে কখনও কখনও বস্ত্রীবিশাল বলেও অনেকে সম্বোধন করেন । জায়গাটি অতীব সৌন্দর্য্যময় ও বিশাল ভূখণ্ড তাই বদ্রীবিশাল বলা হয় । তবে পুরাণে দেখা যায় সত্যযুগে বিশাল নামে এক রাজা ছিলেন । সেই রাজা অন্য রাজার কাছে পরাস্ত হয়ে সমস্ত পাট হারান । তিনি এখানে এসে তপস্যা করে রাজ্য ফেরৎ পাওয়ার জন্য ভগবান বিষ্ণু তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বললেন তোমার কি অভিলাষ রাজা বললেন আমার রাজ্য ফেরৎ পেতে চাই , আমাকে কৃপা করুন । ভগবান হেসে বললেন কি মূর্খ তুমি । তুমি এখানে এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে ফিরে যেতে চাইছ কেন । এখানে থেকে তপস্যা করে জীবন সার্থক কর । রাজা বললেন না আমার তপস্যা করার এখন বয়স হয়নি , আপনি কৃপা করুন যেন আমি আমার রাজ্য ফেরৎ পেতে পারি । ভক্তের বাসনা , ভগবান বললেন তথাস্ত , তুমি রাজ্য ফিরে পাবে , তার সঙ্গে আমি এই কৃপা করছি আমার নামের সঙ্গে তোমার নাম যুক্ত থাকবে । এখন থেকে এই ভূখণ্ডকে বিশালখণ্ড বলবে এবং সবাই বদ্রীবিশাল বলে জয়গান করবে ।

       

    ঘণ্টকৰ্ণ কাহিনী

    ওখানে এক পিশাচ ছিল , যে কেবল মানুষের রক্ত খেত । কিন্তু সে ছিল শিবের পরম ভক্ত , শিব ছাড়া কাউকে মানে না । শিব নাম ছাড়া অন্য নাম যাতে কানে না শুনে তাই কানে দুটি বড় বড় ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখত । সে ছিল বিষ্ণুবিদ্বেষী । তার নাম ঘন্টকর্ণ । শিব একবার তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে , সে মুক্তি প্রার্থনা করল , শিবজী চিন্তা করলেন আমি দান করতে অক্ষম আর তাহলে এ বিষ্ণুদ্রোহীর মুক্তি কি করে সম্ভব ? তাই শিব বললেন তুমি মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু প্রার্থনা কর । সে নারাজ হলে শিব বললেন মুক্তির জন্য তোমাকে ভগবান বিষ্ণুর কাছে যেতে হবে । সে চিন্তা করল আমিতো বিষ্ণুবিদ্বেষী , তিনি কি করে আমাকে বর দেবেন ? শিবজী বললেন ভগবান বিষ্ণু অত্যন্ত করুণাময় , তিনি এখন কৃষ্ণরূপে দ্বারকালীলা করছেন– তুমি দ্বারকা গিয়ে তাঁর কৃপা প্রার্থনা কর , তিনি অবশ্যই তোমার উপর করুণা করবেন । ঘণ্টকর্ণ দ্বারকাতে এসে কৃষ্ণের দর্শন করতে চাইলে দ্বারকাবাসী বললেন কৃষ্ণ পুত্রলাভের উদ্দেশ্যে শিবের কৃপালাভ করার জন্য কৈলাসে গেছেন । ঘণ্টকর্ণের মাথা গুলিয়ে গেছে — সে চিন্তা করছে আমি মুক্তি চাইলে শিবজী বললেন মুক্তি কেবল ভগবান দিতে পারেন , এখন দেখছি সেই কৃষ্ণ শিবের কৃপালাভ করার জন্য শিবের দ্বারস্থ । এখন কে বড় শিব না কৃষ্ণ ? দ্বারকা থেকে কৈলাসে যাচ্ছেন , পথে এই বদ্রিকাশ্রমে দেখছেন কৃষ্ণ মুনি ঋষিদের সঙ্গে বসে ধ্যান , করছেন । কৃষ্ণকে দেখে তাঁর কৃপালাভ করার জন্য সে উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করেছে । ভগবান চোখ খুলে তাকে খুবই বকাবকি করেছেন । তুই কে এখানে জোরে জোরে কান্না কাটি করছিস , যা মুনি ঋষিদের ধ্যানে ব্যাঘাত হচ্ছে । সে তখন কৃষ্ণের চরণে পড়ে গিয়ে বলল আমি শিব ভক্ত ঘণ্টকর্ণ , আপনার চরণে অপরাধী । কিন্তু আমার প্রভু আপনার কাছে পাঠিয়েছে আপনার কৃপালাভ করার জন্য , আমাকে মুক্তি দিন । ভগবান সন্তুষ্ট হয়ে তাকে কৃপা করলেন এবং তাকে ক্ষেত্রপাল করে সেই ধামের সেবায় নিযুক্ত করলেন । মন্দির চত্বরেই একপাশে ঘণ্টকর্ণ মূর্তি পূজিত হচ্ছেন ।
       

    সরস্বতী নদী ও ভীমপুল

    এখানে মন্দির থেকে প্রায় ৩ কিমি দূরে মনোগ্রাম অবস্থিত । যেখানে অলকাপুরী থেকে সরস্বতী এই ধরাধামে নেমে এসেছে । তীব্র গর্জন করতে করতে তিনি প্রবাহিতা । পঞ্চপাণ্ডবদের মহাপ্রস্থান যাত্রাকালে এই রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন এই বৃহৎ নদীর পারাপার নিয়ে খুবই চিন্তাস্বিত হয়ে পড়েছিলেন । তখন ভীম একটি বড় পাথর দিয়ে এই নদীর উপর দিয়ে সেতু নির্মাণ করে দেন , সেটা ভীম পুল নামে প্রসিদ্ধ । এই নদীর তীরে শ্রীব্যাসমুনির আশ্রম ছিল , তিনি যখন ভাগবত রচনা করছিলেন তখন সরস্বতীর তীব্র গর্জন তাতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল । মুনি সরস্বতীর কাছে তার জন্য প্রার্থনা করেন , তাতে সরস্বতী ভ্রুক্ষেপ না করায় মুনি সরস্বতীকে অভিশাপ দান করেন , তুমি অস্তঃসলিলা হয়ে যাও । তাই কিছুটা সরস্বতী প্রবাহিত হয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায় , আর তাকে দেখা যায় না । সরস্বতী মুনির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ব্যাসদেব তাকে ' তুমি ত্রিবেনীতে প্রকাশিত হবে ' বলে আশীর্বাদ করলেন ।
        ভাগবতের আবির্ভাব স্থল , ব্যাসগুম্ফা ও গনেশ গুম্ফা

    এই সরস্বতী নদীর তীরে শম্যপ্রাস নামক স্থানে ব্যাস আশ্রম ছিল । একদা তিনি ধ্যান মগ্ন হয়ে কলিযুগের ধর্ম বিপর্যয় দর্শন করলেন ।

    স কদাচিৎ সরস্বত্যা উপস্পৃশ্য জলং শুচিঃ ।
    বিবিক্ত এক আসীন উদিতে রবিমণ্ডলে ॥
    ( ভাঃ ১/৪/১৫ )

    পূর্ণজ্ঞানসম্পন্ন মহর্ষি তাঁর দিব্য দৃষ্টির দ্বারা এ যুগের প্রভাবে জড় জগতের অধঃপতন দর্শন করলেন । তিনি দেখলেন যে , এই যুগের শ্রদ্ধাহীন জনসাধারণের আয়ু অত্যন্ত হ্রাস পাবে এবং সত্ত্বগুণের অভাবে তারা ধৈর্য্য হীন হয়ে পড়বে । তাই কলিজীবের চিন্তা করে বেদকে সরলীকৃত করার উদ্দেশ্যে চার ভাগে ভাগ করলেন । তারপর স্ত্রী শূদ্র ও দ্বিজবন্ধুদের জন্য মহাভারত আদি ইতিহাস রচনা করলেন । তবুও চিত্তে তিনি সস্তোষ লাভ করতে পারেন নি , তিনি খুবই চিন্তাম্বিত ছিলেন । তখনই তাঁর গুরুদেব শ্রীনারদ মুনি সেখানে আবির্ভূত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করলেন এবং বললেন তুমি সরাসরি ভগবানের মহিমাসমন্বিত ভাগবত রচনা কর । এত বিশাল গ্রন্থ কিভাবে তিনি রচনা

        করবেন চিন্তান্বিত হলে , নারদ মুনি সিদ্ধিদাতা গণেশজীকে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করলেন । তিনি লিখতে রাজী হলেন কিন্তু অভিমান বশতঃ ব্যাসদেবকে বললেন যে আমি লেখা শুরু করলে বন্ধ করবো না । ব্যাসদেবও প্রতিশ্রুত করালেন যে আমি যা শ্লোক বলব , তুমি তার অর্থ না বুঝে লিখবে না । এইভাবে উভয়েই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে লেখার কাজ শুরু হলো । যখনই ব্যাসদেবের মাথায় শ্লোক শেষ হয়ে যায় তখন একটি কঠিন শ্লোক বলেছেন যা বুঝতে গণেশের একটু সময় লেগে যায় আর তখনই ব্যাসদেব আরো কিছু শ্লোক চিন্তা করে ফেলতেন । এই নারদজীর কৃপায় ও গণেশের সাহায্যে শ্রীমদ্ভাগবত নামক মহাকাব্য রচিত হয় । যেখানে বসে শ্রীমদ্ভাগবত রচিত হয়েছিল সেস্থান ব্যাসগুফা নামে পরিচিত । গুফায় বিরাজিত ব্যসমুনির দর্শন অপূর্ব মাধুর্যময় । কিছুদূরে গণেশজীর বাসস্থলী গণেশ গুফা বিরাজমান । শ্রীমদ্ভাগবতের ভাগবত পাঠের পূর্বে আমরা সদাই এই মন্ত্র পাঠ করি—

    নারায়ণং নমস্কৃত্য নরং চৈব নরোত্তমম্ ।
    দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ॥

    সংসার বিজয়ী গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত উচ্চারণ করার পূর্বে পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ , ভগবৎ অবতার নর - নারায়ণ ঋষি , বিদ্যাদেবী সরস্বতী এবং ব্যাসদেবকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি ।

        নর নারায়ণ পর্বতের মধ্যে অবস্থিত এই বদ্রিকাশ্রম ক্ষেত্র খুবই মাধুর্য্যমণ্ডিত । এই বিশাল ভূখণ্ড যদিও বহু বাড়ি ঘর , দোকান ঘাট , হোটেল রেস্তোরা দ্বারা বহু জনবহুল হয়ে উঠেছে । তাতে অবশ্য তীর্থ যাত্রীগণের সুষ্ঠুভাবে থাকা - খাওয়ার সুবন্দোবস্ত ও সমাধান হয়েছে । যাই হোক মন্দিরের ঘণ্টা কাসর বাদ্যের ধ্বনি , অলকানন্দার স্বচ্ছ জলের তীব্র গতিধারা , তীর্থযাত্রীদের মুখে হরিকীর্তন ও সাধুসন্তদের বেদমন্ত্রের উচ্চারণ ধ্বনি সংসার দগ্ধ জীবের হৃদয়কে আদ্র করে তোলে । আর এখানকার মৃদু মন্দ হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাবরন মানুষের মনকে জয় করে নেয় । তাই বলি মানুষ মাত্রই সকলের এই ধাম দর্শন কর্তব্য ।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ২২ ) কুরুক্ষেত্র
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।