ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • গোপীবল্লভপুর

    সনাতনগোপাল দাস ব্রহ্মচারী

    পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে উড়িষ্যা ও বিহারের সীমান্ত লাগোয়া স্থান এই গোপীবল্লভপুর। আজ থেকে প্রায় চারশো বৎসর আগে কৃষ্ণভক্ত শ্রীল রসিকানন্দ ঠাকুর গুরুর নির্দেশে এখানেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর প্রাণনাথ শ্রীশ্রীগোপীবল্লভের মন্দির , যা আজও দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। চারশো বৎসর আগে এই স্থানটির নাম গোপীবল্লভপুর ছিল না। কিন্তু ক্রমে রসিকানন্দ প্রভুর সেবিত বিগ্রহ গোপীবল্লভের নামে তা হয়ে ওঠে গোপীবল্লভপুর। আজও , এই চারশো বৎসর পরেও , বংশ পরম্পরা ক্রমে রসিকানন্দ প্রভুর সেবিত শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ বিগ্রহ ও শ্রীশ্রীগোপীবল্লভ বিগ্রহের সেবা অর্চনা করে আসছেন তাঁর বংশধরগণ , যারা দেব গোস্বামী রূপে পরিচিত। এই গোপীবল্লভপুরের মন্দিরটি ছাড়াও রসিকানন্দ প্রভুর বংশধর দেব গোস্বামীগণ উড়িষ্যার রেমুনায় অবস্থিত ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির ও বৃন্দাবনে রসিকানন্দ প্রভুর গুরুদেব শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু প্রতিষ্ঠিত শ্যামসুন্দর মন্দিরটিরও তত্ত্বাবধান করে থাকেন। এই চারশো বৎসর পরেও গোপীবল্লভপুরের মন্দিরে এখনও রক্ষিত হচ্ছে শ্যামানন্দ প্রভু ও রসিকানন্দ প্রভুর ব্যবহৃত তালপাতায় লেখা ভগবদ্গীতা , তাঁদের ব্যবহৃত বাঁশী , জপমালা ইত্যাদি জিনিসপত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রদর্শিত সমস্ত নিয়ম মেনেই এখানে বিগ্রহ আরাধনা ও উৎসবাদি হয়ে থাকে। গোপীবল্লভপুর মন্দিরটি আয়তনে ছোট হলেও , পারমার্থিক ঐশ্বর্যে এটি ভারতের যে কোন সুপরিচিত মন্দিরের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। নিম্নে উল্লিখিত শ্রীল রসিকানন্দ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত কাহিনীটি থেকেই আমরা এই মন্দিরের মাহাত্ম্য ও আকর্ষণের অনুভূতি লাভ করব।

      

    শ্রীল রসিকানন্দ ঠাকুর

    সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ‘ রয়ণী ' নামে গ্রামে রাজা অচ্যুতানন্দ ও তাঁর পত্নী ভবানীদেবীর পুত্ররূপে এক সুন্দর শিশুর জন্ম হল কার্তিক মাসের দীপাবলীর রাত্রির তৃতীয় প্রহরে। নাম হল রসিক। রসিক তাঁর মাতৃগর্ভে থাকাকালীন দয়ালদাসী নামে এক ভক্তের কাছে তাঁর মা নিয়মিত কৃষ্ণকথা শুনতেন।

       শৈশবের খেলাধুলাতে লোকে বল , গাড়ি , পুতুল , বেলুন , ঝুমকা , ধুলোবালি গ্রহণ করে , কিন্তু রসিকের সে সবে মন ছিল না। কৃষ্ণছবি পূজা করা , তুলসী পূজা , কেউ কৃষ্ণকথা বললে তাকে প্রণাম করা , তার কাছে বসে কৃষ্ণকথা বললে তাকে প্রণাম করা , তার কাছে বসে কৃষ্ণকথা শোনা — এই সবই সে করত। যখন তাঁর সঙ্গী বালকেরা এসে তাঁর সঙ্গে মিশতে চাইত , তখন রসিক তাদের সঙ্গে মাখন চুরি , গরুচরানো ইত্যাদি লীলার অনুকরণ করে খেলত।

       কখনও কখনও রসিককে খুঁজে পাওয়া যেত না। খোঁজাখুজির পর দেখা যেত ঘরের কোনায় আসন করে বসে ধ্যান করছে। ধ্যানস্থ হয়ে হাতে একটা জপের মালা নিয়ে হরিনাম জপ করছে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে / হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। তাকে সেভাবে নাম করতে দেখে কেউ বিঘ্ন করতে আসত না। কিন্তু সে দুই - তিন প্রহর কাটিয়ে দিত। যখন তাকে প্রশ্ন করা হত , তুমি বাপু হরিনাম করছ , ভালই। কিন্তু সাত - আট ঘন্টা ধরে নাম করছ কেন ? খাওয়া - দাওয়া করছ না কেন ? সে বলত — আমি একলক্ষ নাম জপ না করে আহার করব না। দয়াল দাসীর কাছেই সে শুনেছিল লক্ষ নাম করতে হয়। হরে কৃষ্ণ মন্ত্র তাঁর কানে দয়ালদাসীই দিয়েছিলেন।

       একদিন তাঁর বাবা তাঁকে ডেকে বললেন , তোমাকে দেখি যে , পাড়ায় কত ছেলেদের সঙ্গে খেলায় মেতে থাকো। অন্ন - জলও ত্যাগ করে খেলতেই থাকো। তাই আমার নির্দেশ , তুমি কাল থেকে ঘরে বসে নিজের মনে খেলবে। বাইরে যাবে না। বালক রসিক বলল , ' বাবা , আমি খেলতে যাব না , ঘরেও খেলব না। তুমি ঘরে রোজ ভাগবত কথা শোনাবে তো ? ' পিতা বালকের কথা শুনে আনন্দিত হলেন। একজন পন্ডিতকে আনিয়ে পিতা - পুত্র নিত্য ভাগবত কথা শুনতে লাগলেন। তারপর বালক রসিককে পড়ানোর জন্য বাসুদেব চক্রবর্তীর টোলে ভর্তি করানো হল। অল্প বয়সেই সমস্ত অধ্যয়নের বিষয় আয়ত্ত করতে রসিকের কোনও অসুবিধা হয় নি।

       একদিন শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করতে গিয়ে রসিক মূর্ছা গেল কৃষ্ণপ্রেমে। হরি দুবে নামে এক ব্যক্তি ' কৃষ্ণ কৃষ্ণ ' উচ্চারণ করে তাঁর চেতন ফিরিয়ে আনলেন। কিশোর বয়সে রসিকের মনে বৈরাগ্যের উদয় হল।

       কিন্তু পিতা তাঁর বিবাহের উদ্‌যোগ করলেন। হিজলীর রাজা বলভদ্রের কন্যার সঙ্গে। রাজা বলভদ্র রসিকের হাতে কন্যা সমর্পণের কথা দিয়েই দেহত্যাগ করলেন ।

       বিবাহিত রসিক বনবাসী পঞ্চপান্ডবদের স্মৃতিস্থান পর্যটন করতে লাগলেন। সংসারের কোন কিছুতেই মন বসে না। একদিন নির্জনে বসে হৃদয়ে চিন্তা করতে লাগলেন , আমাকে দীক্ষা নিতে হবে , কারও অভয়চরণ আশ্রয়ে থেকে জীবন যাপন করতে হবে। নইলে তো জীবন বৃথা। আমাকে পথ দেখাবে কে ?

       এমন চিন্তা করতে করতে একদিন রাত্রে তিনি এক দিব্য স্বপ্ন দেখলেন। শ্রীকৃষ্ণ এসে বলছেন ' তোমার উপদেষ্টা— শ্যামানন্দ তাঁকেই গুরুরূপে গ্রহণ কর। অচিরেই তাঁর দেখা পাবে। একদিন মহাপ্রভুর পার্ষদ হৃদয়চৈতন্য প্রভুর শিষ্য শ্যামানন্দ পণ্ডিত হরিনাম সংকীর্তন প্রচার ক্রমে ঘাটশিলা গ্রামে এসে পৌছালেন। সেই গ্রামেই রসিকের আবাস ছিল রসিক কৃষ্ণ নির্দেশিত তাঁর সেই গুরুদেবকে বহু প্রণতি মিনতি করলে পর শ্যামানন্দ প্রভু রসিককে আলিঙ্গন করলেন। শ্যামানন্দ তাঁর গৃহে চারমাস অবস্থান করে সমগ্র গ্রামে হরিভক্তি প্রচার করলেন।

       শ্যামানন্দ প্রভুর কাছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রে দীক্ষিত হলেন রসিকানন্দ। হৃদয়ে এক বিশেষ আনন্দ লাভ হল।

       রসিকানন্দ ঠাকুর মনে মনে ঠিক করেছিলেন ভ্রাতৃবিরোধ , সম্পত্তি দ্বন্দ্বাদি বিভিন্ন বিপত্তি এড়িয়ে কোনও তীর্থে পালিয়ে ভজন সাধন করবেন , তাঁর অনুগতা পত্নীও যদি বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে তাঁর সঙ্গে যায় — তাতেও অসুবিধা নেই। কিন্তু তাঁর গুরুদেব শ্যামানন্দ প্রভু নিষেধ করে বলেছিলেন , ' তোমার গৃহে গোপীবল্লভ বিগ্রহ রয়েছে। এই গ্রামের নাম গোপীবল্লভপুর। এটিই বৃন্দাবন। এখানেই বাস কর , আর নিত্য হরিনাম কর। হরিভক্তি প্রচার কর। '

       সেইমতো রসিকানন্দ দিনযাপন করলেন একদিন শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভু বললেন — ' আচন্ডালে সবাইকে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রে দীক্ষিত করে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রেমে ভাসিয়ে তাদের দুঃখদুর্দশা থেকে পরিত্রাণ কর।

       রসিকানন্দ ঠাকুর গুরুদেবের নির্দেশ নিয়ে হরিনাম সংকীর্তন প্রচার করতে লাগলেন। বহু পাষন্ডী , বহু যবনজাতি , এমনকি পাগলা হাতি থেকে শুরু করে সবার মধ্যেই কৃষ্ণভক্তির জাগরণ ঘটালেন।

       কথিত আছে একজন দুষ্ট যবন ঈর্ষার বশীভূত হয়ে শ্রীল রসিকানন্দকে জব্দ করবার উদ্দেশ্যে এক পাগলা হাতীকে পাঠিয়েছিলেন। পাগলাহাতি গ্রামাঞ্চলে গাছপালা বাগান নষ্ট করতে লাগল। লোকজন ভয়ে ইতস্ততঃ দৌড়াতে লাগল। কিন্তু সেই পাগলা হাতিটি যখন রসিকানন্দের কাছে আসে , তখন রসিকানন্দদেব হাতিটির শুঁড়ে হাত দিয়ে হরেকৃষ্ণ বললেন। হাতিটি তৎক্ষণাৎ শান্ত ভদ্র হয়ে গেল। তিনি হাতিটির নাম দিলেন গোপালদাস। রসিকানন্দের সেই অদ্ভুত প্রভাব দেখে সবাই পরম বিস্ময়ান্বিত ও চমৎকৃত হয়েছিলেন। শ্রীল রসিকানন্দের অলৌকিক শক্তির প্রভাবে আকৃষ্ট হয়ে তৎকালীন ময়ূরভঞ্জের রাজা শ্রীবৈদ্যনাথ ভঞ্জ , পটাশপুরের রাজা শ্রীগজপতি , ময়নার রাজা চন্দ্রভানু , পাঁচেটের রাজা শ্রীহরিনারায়ণ , ধারেন্দার রাজা শ্রীভীম , শ্রীকর , উড়িষ্যার নবাব আহম্মদ বেগ প্রভৃতি বহু ব্যক্তি তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। একদিন জঙ্গল থেকে দুটি বাঘ বেরিয়ে এলে রসিকানন্দদেব হরিনাম উচ্চারণ করে তাদের হিংস্রভাব ছাড়িয়েছিলেন।

       গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ প্রভুর পদাঙ্কপূত স্থান জলেশ্বরের কাছে বাঁশদা গ্রাম। একদিন ঊষাকালে সাতজন সেবককে সঙ্গে নিয়ে রসিকানন্দ প্রভু হরেকৃষ্ণ সংকীর্তন করতে করতে বাঁশদা থেকে রেমুনা পর্যন্ত চলতে লাগলেন ।

       রেমুণায় পৌঁছে শ্রীক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির প্রাঙ্গণে তাঁরা নৃত্য কীর্তন করছিলেন। তারপর গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করেই রসিকানন্দ প্রভু শ্রীগোপীনাথের অঙ্গে লীলাপ্রবিষ্ট হলেন। আর সঙ্গী সাতজনও সেই প্রাঙ্গণে দেহরক্ষা করেন।

       সেই দিনটি ছিল ১৫৭৪ শকাব্দের ( ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দ ) ফাল্গুন মাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথি ৷ গোপীনাথের মন্দির প্রাঙ্গণে রসিকানন্দ ঠাকুরের পুষ্পসমাধি এবং সাতজন ভক্তের সমাধি বিদ্যমান। প্রতিবছর এই তিরোধান স্মরণ উপলক্ষে রেমুণাতে শিবচতুর্দশীর পর থেকে বারোদিন ব্যাপী বিশেষ মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ৫ ) শৈল শ্রীক্ষেত্র
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।