ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • ভগবানের কাছে যাওয়ার প্রবেশদ্বার

    নাথদ্বার

    শ্রীমৎ ভক্তিবিকাশ স্বামী মহারাজ

    বর্তমান যুগ , এই কলিযুগটি হচ্ছে কলহ ও ভণ্ডামীর যুগ । অসংখ্য অসৎ গুণাবলী এই যুগে প্রকাশিত । কিন্তু আমি যখন নাথদ্বারে পৌঁছলাম তখন হৃদয়ঙ্গম করলাম যে ভগবান কৃষ্ণের প্রতি ভক্তির গুণাবলী এখানে এখনও অত্যন্ত সুদৃঢ় । নাথদ্বার কথাটির অর্থ হচ্ছে ভগবানের কাছে যাওয়ার প্রবেশপথ ।

        নাথদ্বার মন্দিরের শ্রীবিগ্রহ আগে বৃন্দাবনের গিরিগোবর্ধনের পাদদেশে যতীপুরা গ্রামে অবস্থিত ছিল । কিন্তু সপ্তদশ শতকে বৃন্দাবন ও অন্যান্য হিন্দু মন্দিরগুলির উপর মুঘল আক্রমণের সময় সেই শ্রীনাথজীর বিগ্রহটিকে রাজস্থানে নিয়ে আসা হয় এবং যে জায়গায় মন্দির নির্মাণ করে এই শ্রীনাথজীর বিগ্রহকে স্থাপন করা হয় সেই জায়গাটিতেই এখনকার শহরটির পত্তন হয় । কথিত আছে বৃন্দাবনের গোবর্ধন থেকে শ্রীনাথজীর এই বিগ্রহকে গোপনে রাজস্থানের বর্তমান জায়গায় সরিয়ে আনতে বত্রিশ মাস সময় লেগেছিল । যাত্রাপথে মাস ছয়েক এই বিগ্রহ আগ্রায় অবস্থান করেছিলেন । ভক্তবৃন্দ সেখানেই গোপনে ভগবানের উৎসব অনুষ্ঠানাদি উদ্‌যাপন করতেন । এইভাবে বিভিন্ন জায়গায় কিছুদিন বা কয়েক মাস অবস্থান করে করে ভক্তগণ শ্রীনাথজীর শ্রীবিগ্রহ নিয়ে রাজস্থানের মেবারের উদ্দেশ্যে রওনা হন । মেবারের পথে যাওয়ার সময় ভগবানের বিগ্রহ রাজস্থানের সিংহাদ নামক এক শহরে পৌছায় । এই সিংহাদ শহরে এক মহতী ভগবদ্ভক্ত রাজকন্যা বাস করতেন । তাঁর আকুল বাসনা ছিল ভগবান শ্রীনাথজী যেন এখানেই তাঁর ধাম রচনা করেন এবং এক দৈবস্বপ্নে পরমেশ্বর ভগবান তাঁকে ভরসা দিয়েছিলেন যে , তিনি তাই - ই করবেন । পরমেশ্বর ভগবান তাঁর ভক্তমণ্ডলীকেও প্রেরণা দান করেন যাতে আরাবল্লী পর্বতমালার পাদদেশে সেই সিংহাদ নামক স্থানে , ভক্তগণ এক মনোরম মন্দির গড়ে তুলে সেইখানে ভগবান শ্রীনাথজীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন । পরবর্তী কালে ক্রমে ক্রমে সেই সিংহাদ নাথদ্বার রূপে পরিচিত হয় ।

        নাথদ্বার রাজস্থানে অবস্থিত হলেও এখানকার অধিকাংশ তীর্থযাত্রীরাই হচ্ছেন গুজরাটি । তাই নাথদ্বারের পরিবেশটি গুজরাটিদের দ্বারা প্রভাবিত । গুজরাটিরা সারা ভারতসহ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে । সবদিক থেকেই তাঁরা এক সফল জাতি । বিশেষতঃ ব্যবসায়ে গুজরাটিরা অত্যন্ত সংস্কৃতিবান ও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন । তাঁরা যেমন আধুনিক চিন্তাধারায় চিন্তা করতে অভ্যস্ত , আবার অন্যদিকে সমান্তরালভাবে তারা কৃষ্ণেরও ঐকান্তিক ভক্ত । ভক্তি গুজরাটিদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । তাই গুজরাটিদের কখনও কখনও অত্যন্ত পুণ্যবান মানুষরূপে বলা হয়ে থাকে ।

        নাথদ্বারে যে সকল গুজরাটি তীর্থযাত্রীরা আগমন করেন তাঁরা যে কেবল গুজরাট থেকেই আসেন এমন নয় । মুম্বাই প্রবাসী গুজরাটি , এমনকি আফ্রিকা , ইংল্যাণ্ড , আমেরিকা ও কানাডা প্রবাসী গুজরাটিরাও নাথঘারে তীর্থ করতে আসেন । মন্দিরে কিম্বা রাস্তায় নাথদ্বারের সর্বত্রই আপনি গুজরাটিদের দেখতে পাবেন ।

        গুজরাটিগণ তাদের খাদ্যের জন্যও বিখ্যাত এবং সেটি এই নাথদ্বারেও প্রতিফলিত । নাথদ্বার একটি পবিত্র স্থান হলেও তপশ্চর্যার ভূমি নয় । কৃষ্ণকে নিবেদন করার পর যে খাদ্য গ্রহণ করা হয় , তাকেই বলা হয় প্রসাদ । সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই রচনাটির নাম হতে পারতো “ নাথদ্বার , এক প্রসাদ নগরী । ” নাথদ্বার যেমন শ্রীনাথজীর বিগ্রহের জন্য বিখ্যাত তেমনি শ্রীনাথজীর প্রসাদের জন্যও খ্যাত । সে কথায় আমি পরে আসছি ।

        নাথদ্বার শহরটি শ্রীনাথজীর বিগ্রহ ও মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । এটি একটি ছোট মফস্বল শহর । এটা সঠিকভাবে বলা মুস্কিল যে এই শহরের সঠিক অধিবাসীর সংখ্যা কত। মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে একেক জনের কাছে একেক উত্তর পাওয়া যায় । তবে আমার মনে হয়েছে শহরের অধিবাসীর

        সংখ্যা প্রায় কুড়ি হাজার মতন হবে । কিন্তু এখানে নিত্য তীর্থযাত্রীর সংখ্যা তার চেয়েও বেশী । এখানে অধিকাংশ অধিবাসীর জীবিকা হচ্ছে পূজারী , মন্দিরের কর্মচারী , এবং ব্যবসা যারা বিগ্রহকে নিবেদনের জন্য ফুল , ফল , সব্জী ইত্যাদি পূজার উপকরণ বিক্রয় করে । অনেকে আছেন যারা প্রসাদ ও বিগ্রহের ছবি বিক্রয় করেন । কেউবা ভক্তিমূলক গানের ক্যাসেট ও তীর্থযাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করেন । এছাড়া হোটেল , অতিথিশালা , যান বাহনের ( যেমন বাস , অটো রিক্সা , রিক্সা ) ব্যবসায়ীরা তো রয়েছেই । আমি আগেই বলেছি যে এই ছোট শহরের সব রকম কর্মকাণ্ডই চলছে শ্রীনাথজীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে , তাই স্থানীয় মানুষদের জীবিকাও গড়ে উঠেছে এই শহরে আসা তীর্থযাত্রীদের উপর নির্ভর করে ।

        এখানকার মানুষেরা , তীর্থযাত্রীরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে ' জয় শ্রীকৃষ্ণ ' বলে সম্বোধন করেন । অনেক জায়গায় গৃহের দেওয়ালে বা প্রবেশ পথে “ জয় শ্রীকৃষ্ণ ” লেখা রয়েছে । কোনখানে বা বল্লভ সম্প্রদায়ের মন্ত্র শ্রীকৃষ্ণ শরণং মম অর্থাৎ ' ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আমার আশ্রয় ' কথাটি লেখা রয়েছে । নাথদ্বারে ইসকন বা হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের ভক্তগণ সুপরিচিত ।

        মাঝে মাঝে ভক্তদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের দেখা হলে তারা ' হরেকৃষ্ণ ' বলে আমাদের অভিনন্দন জানায় ।

        নাথদ্বারে রাজস্থানী গ্রামবাসীরা তাদের নিজস্ব দেশীয় ভাষা , তাদের নিজস্ব খাবার , তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোষাক ও শক্ত সমর্থ দৈহিক গঠনে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও সমুজ্জ্বল । প্রতিদিন ভোরে রাজস্থানী দুধ বিক্রেতারা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তাদের ভারী কণ্ঠে চিৎকার করে বলে “ জয় শ্রীকৃষ্ণ । জয় বংশী ধারী । ” রাজস্থানীদের উচ্চকিত ভক্তির পাশে গুজরাটিদের শান্ত ভক্তি যেন দুই মেরুর দুটি বিপরীত দিক অবশেষে নাথঘারে এসে একই বিন্দুতে মিলেছে ।

        সকাল ঠিক পাঁচটায় শ্রীনাথজীর মন্দির থেকে মাইকে সানাই বাজানো হয় । এটি হচ্ছে মন্দিরে ভগবানের মঙ্গলারতিতে যোগদানের জন্য শহরবাসী ও তীর্থযাত্রীদের প্রতি আহ্বান ধ্বনি । এছাড়া ঐ সময় মন্দিরের মূল ধনুকাকৃতি প্রবেশদ্বারের উপরে নহবতখানায় বসে বিভিন্ন ধরনের বাজনা বাজিয়ে কীর্তন করা হতে থাকে । এই ধ্বনি ও কীর্তন এক অপরূপ পারমার্থিক পরিবেশের সৃষ্টি করে ।

        বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত নাথদ্বারের শ্রীনাথজীর মন্দিরে বিদেশীদের বিশেষতঃ পাশ্চাত্যের নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল । এখন আর সেই নিষেধাজ্ঞা নেই । তবে যে কোন কারণেই হোক হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের সদস্যদের জন্য এই মন্দির সকল সময়েই স্বাগত ছিল ।

        মন্দিরে মঙ্গলারতি শুরু হয় সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় মন্দিরের দরজা খোলা হলে পর সকলে ভিতরে প্রবেশ করে । তারা হয়ত কেউ সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী বা অন্য কিছু । যাই হোক না কেন , মন্দিরে ভেদহীন রূপে সবাই একাকার । আর যখন ভগবানকে দর্শনের সময় আসে , তখন সে যে কোন উপায়েই হোক ভগবান শ্রীনাথকে দর্শন করার জন্য দর্শনার্থীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । ভগবানকে দর্শন করার নাটমন্দিরটি অনেকটা খেলার ষ্টেডিয়ামের মতো । সামনে থেকে যতটা পেছনে গেছে ততটা সিঁড়ির মতো স্তরে স্তরে উঁচুতে উঠে গেছে । প্রবেশ করার পথ একদিকে আর বাইরে বের হবার পথ অন্যদিকে । স্ত্রী ও পুরুষদের প্রবেশ পথও ভিন্ন ভিন্ন মন্দিরের স্বেচ্ছা সেবকদের চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে । প্রবেশ পথের দরজার সামনে এবং বিগ্রহের সামনে কাউকেই বেশীক্ষণ দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না । স্বেচ্ছাসেবকরা ক্রমাগত বলে চলেছে ' চল জী ' ' চল জী ' অর্থাৎ ' এগিয়ে যাও ' ' এগিয়ে যাও । বিগ্রহের সেবায়েতরা বিগ্রহের সামনে চওড়া উঁচু বেদীতে দাঁড়িয়ে এক হাতে দড়ি ধরে তাদের ভারসাম্য বজায় রেখে দর্শনার্থীদের ভীড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে আরেক হাতে গামছা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভীড়ের সামাল দিচ্ছিলেন । কাউকেই দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছিল না । চলমান রূপেই দর্শনার্থীরা বিগ্রহ দর্শন করছিলেন , প্রণাম করছিলেন । কিন্তু ঐ ভাবেই চলতে চলতে কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে সামনে থেকে আপনি শ্রীনাথজীর বিগ্রহকে সুন্দরভাবে দর্শন করতে পারবেন ।

        বলা হয়ে থাকে যে বৃন্দাবনের গোবর্ধন পর্বতের একটি বড় শিলা থেকে শ্রীনাথজী স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছিলেন । তাঁর সুন্দর অবয়ব সেই শিলার মধ্যেই নিহিত ছিল । পরে তিনি সেই শিলা থেকে আবির্ভূত হন । শ্রীনাথজীর পরিহিত পোষাকও নয়নাভিরাম সারা দিনে বেশ কয়েকবার তাঁর পোষাকের সাজ পরিবর্তিত হয় । রাজস্থানের আবহাওয়া হচ্ছে গরমকালে প্রচণ্ড গরম এবং শীতকালে প্রচণ্ড শীত । তাই গরমকালে শ্রীনাথজীকে হাল্কা ধরনের সাজ পোষাকে সাজানো হয় এবং শীতকালে , বিশেষত মঙ্গল আরতির সময় তাঁকে গরম পোষাক দিয়ে এমনভাবে আবৃত করা হয় যে শুধু তাঁর মুখটুকু দর্শিত হয় ।

        যদিও মন্দিরে এখন বিদ্যুত সংযোগ এসেছে এবং সন্ধ্যাবেলা সর্বত্র বিদ্যুতের বাতি জ্বলে কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্ধ্যাবেলা শ্রীনাথজীর বিগ্রহের সামনে আগেকার ঐতিহ্য অনুযায়ী মশাল জ্বালানো হয় । ভগবান শ্রীনাথজীর ঠোঁটের ঠিক নীচে একটি বড় হীরকখণ্ড জ্বলজ্বল করছে । বলা হয়ে থাকে যে এটি মুঘল সম্রাট আকবর ভগবানকে নিবেদন করেছিলেন ।

        এখানে মঙ্গলারতির পর দর্শনারতি চলতেই থাকে । কারণটা হল মুখিয়াজীরা ( এখানে পুরোহিতকে মুখিয়াজী বলা হয় ) যতবারই বিগ্রহের সামনের পর্দা ফেলে দেন ততবারই দর্শনার্থী জনতা হৈ হৈ করেন ' আরেকটু রাখুন ' ' আরেকটু রাখুন ' বলে । ফলে মুখিয়াজীরা আবার পর্দা তুলে নেন । এইভাবে মুখিয়াজীরা বেশ কয়েকবার পর্দা ফেলেন এবং দর্শনার্থীদের অনুরোধে আবার তুলে নেন । শেষ পর্যন্ত মন্দিরে প্রবেশের সদর দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এরকম হতেই থাকে । ভগবানকে দর্শনের সময় দর্শনার্থীরা চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিতে থাকেন “ জয় কানাইয়ালাল ! জয় বংশীধারী ! ” অবশেষে মন্দিরের সদর দরজা বন্ধ হলে পর বাঁশের তৈরী একটি পর্দা সদর দরজার সামনে ফেলে দেওয়া হয় । এটা বোঝায় যে এখন দর্শন শেষ ।

        শ্রীনাথজীর দর্শন সকালবেলার মতন শেষ হয়ে যাবার পর মন্দির ও মন্দিরের চত্বরের মার্জন সেবা শুরু হয় । মনে করবেন না যে মন্দিরের ভক্ত বা সেবায়েতগণ এই মার্জনের কাজটি করেন বা এই মার্জনের কাজের জন্য লোক রাখা হয়েছে । না , তেমন নয় । মন্দির ও মন্দির চত্বর মার্জন করেন শ্রীনাথজীর দর্শনে আসা তীর্থযাত্রীরা । মন্দিরের চত্বরের বিভিন্ন কোণে ঝাড়ু ও মার্জনের জন্য অন্যান্য সামগ্রী রাখা থাকে । দর্শনার্থীরা সেবা ও ভক্তির মনোভাব নিয়ে মনের আনন্দে এই মার্জনের কাজটি করেন । এটি এখানকার অনেকদিনের ঐতিহ্য ।

        শ্রীনাথজীর জন্য সেবার দর্শনার্থীদের এই মনোভাবটি নাথদ্বারের একটি আমি যেদিন শ্রীনাথজীর মন্দিরে গিয়েছিলাম সেদিন অন্যতম বৈশিষ্ট্য । দেখলাম মন্দিরের একদিকে রান্নার জন্য চেরাই করা কাঠ স্তূপ করা রয়েছে এবং মন্দিরের জনৈক সেবায়েত দর্শনার্থীদের ‘ আসুন সেবা করুন ' বলে আহ্বান জানাচ্ছিলেন সেই স্তূপীকৃত কাঠগুলো রান্নাঘরে নিয়ে যেতে হবে । এই ছিল সেই সেবা । অনেক দর্শনার্থীই সেই সেবায় যোগ দিয়েছিল । আমিও সেই সেবায় যোগ দিলাম এবং ভগবান শ্রীনাথজীর সেবা করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যান্বিত মনে করলাম । যেমন ঐ মন্দিরে নানা ধরনের সেবায় যে কেউই যোগ দিতে পারে । যেমন আপনি রান্নার জন্য শাক সব্জী কাটায় সাহায্য করতে পারেন , দুধ থেকে মাখন প্রস্তুত করতে পারেন , মালা গাঁথতে পারেন ইত্যাদি আরও নানা সেবায় যোগদান করতে পারেন । আমি দেখেছি অনেক ধনী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে , বৌরাও খুশী মনে এমন দাসসুলভ সেবায় আনন্দের সঙ্গে সেবা করছে । উন্মুক্ত চত্বরে খুব সকালের রোদের মধ্যে চক্রাকারে বসে দর্শনার্থীরা সব্জী কাটার সেবা করছিল আর তাদের মাঝখানে একজন পণ্ডিত বসে শাস্ত্রপাঠ করছিলেন ।

        মন্দিরের আর এক দিকের আর একটি চত্বরে বসে সংস্কৃতি মনস্ক একদল লোক বা তীর্থযাত্রী কীর্তন করছিলেন । কিন্তু খুব কম লোকই তা বসে শুনছিল । কেননা প্রত্যেকে শ্রীনাথজীর নানারকম সেবায় ব্যস্ত ।

        কেউ হয়ত প্রশ্ন করতে পারে যে “ কৃষ্ণের মন্দিরতো মুম্বাইতেও রয়েছে , এমনকি অনেক মানুষের বাড়িতেও মন্দির রয়েছে , তাহলে মানুষেরা কেন দূর দূরান্ত থেকে এখানে এই মন্দিরের সেবা ও বিগ্রহ দর্শন করতে আসে ? ” এর একটাই উত্তর হল মানুষেরা হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে এই মন্দিরের বিগ্রহ অত্যস্ত বৈশিষ্টপূর্ণ , শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় ।

        পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক এবং অদ্বিতীয় । কিন্তু তাঁর প্রতিটি মন্দিরের আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতা বিভিন্ন রকমের । এখানের পরিবেশটিও নিশ্চিতরূপে চমৎকার । নানাভাবে আপনি উপলব্ধি করবেন যে আপনি যেন এক পারমার্থিক জগতে প্রবেশ করেছেন , যেখানে সকলেই কৃষ্ণসেবা করছেন । যে সকল ভক্তগণ এই মন্দিরে বাস করেন এবং যে সকল ভক্তগণ এই মন্দির দর্শন করতে আসেন তাঁরা সকলেই এখানে এক কৃষ্ণ সেবার পরিবেশ গড়ে তোলেন । তাঁরা সকলকে আহ্বান জানান “ আসুন ভগবানের সেবা করুন , ভগবানকে দর্শন করুন , ভগবানের প্রসাদ গ্রহণ করুন এবং এইভাবে সবসময় কৃষ্ণচেতনায় সুখী হউন । "

        শ্রীনাথজীর সেবার আর একটি অঙ্গ হচ্ছে , ভগবানকে বস্তু অর্পণ করা । ভোর বেলা শ্রীনাথজীর মন্দিরের সামনে নানা ধরনের দোকান বসে । যেমন , দুধের দোকান , সব্জীর দোকান , ফুলের দোকান , ফলের দোকান ইত্যাদি । আপনার ইচ্ছে মতো আপনি এইসব দোকান থেকে যে কোন দ্রব্য কিনে ভগবানকে আপনি নিবেদন করতে পারেন । দর্শনার্থীরা শ্রীনাথজীর সেবার জন্য প্রচুর টাকা পয়সা দক্ষিণা রূপে নিবেদন করেন । ভারতের মধ্যে অন্যতম বিত্তশালী মন্দির হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের তিরুপতি মন্দির । বলা হয় যে তারপরেই অন্যতম বিত্তশালী মন্দির হচ্ছে নাথদ্বারের এই শ্রীনাথজীর মন্দির ।

        জনসাধারণ মন্দিরে শ্রীনাথজীর সেবার জন্য ঘি ও শস্যও প্রদান করেন । শ্রীবিগ্রহের জন্য সমস্ত রান্নাই খাঁটি ঘি দিয়ে প্রস্তুত হয় । ভক্ত দর্শনার্থীরা প্রচুর যি দান করে শ্রীনাথজীর প্রসাদ প্রস্তুতের জন্য তাঁরা দশ পনেরো , কুড়ি কিলোর টিনে করে ঘি দান করেন । সবই খাঁটি ঘি । কখনও এমন হয়েছে । ঘিয়ের টিন ভর্তি একটি পুরো ট্রেন এসে হাজির হয়েছে নাথদ্বার স্টেশনে । দাতা নিজের নাম গোপন রেখেছিলেন । প্রতিটি টিনে শুধু লেখা ছিল “ শ্রীনাথজীর কাছ থেকে , শ্রীনাথজীকে । ” এত যি রাখার জন্য একটি ট্যাঙ্ক করতে হয়েছিল । টিনের ঘি একটু গরম করে সেই ট্যাঙ্কে ঢেলে দেওয়া হয় । ঐ ট্যাঙ্ক থেকে একটি পাইপ লাইন চলে গেছে রান্নাঘরে সেখানে পাইপের কলের মুখ খুলে রান্নার প্রয়োজন অনুযায়ী যি নেওয়া হয় । খাঁটি ঘি অবশ্যই খুব দামী একটি জিনিস কিন্তু শ্রীনাথজীর আরাধনার জন্য অর্থ কোন বাধাই নয় । শস্যের গুদামঘরও ছিল খুব সুন্দর যত্ন করে সাজানো । প্রতিটি শস্যের কতটা জমা হল আর কতটা রান্নার জন্য গেল তার সঠিক হিসাব রাখা হচ্ছে প্রতিদিন । সমস্ত শস্যই শ্রীনাথজীর রান্নার জন্য ব্যয় করা হয় , এতটুকু শস্যও অন্যায়ভাবে কেউ বাইরে বিক্রি করতে পারবে না । শস্যের গুদাম ঘরের হিসাবের পন্থাটি এত কড়া বিভিন্ন শস্য ও দ্রব্য সামগ্রীর জন্য মন্দিরে ভিন্ন ভিন্ন বহু গুদামঘর রয়েছে । দর্শনার্থীরা ইচ্ছে করলে এইসব গুদামঘর ঘুরে দেখতে পারেন । এখানে কোন লুকোচুরির ব্যাপার নেই । শস্য ও অন্যান্য দ্রব্য ছাড়াও ভগবান শ্রীনাথজীর জামা - কাপড় ও অলঙ্কারের জন্য আলাদা একটি গুদাম ঘর আছে । মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে একটি ঘর রয়েছে , যেটির নাম হচ্ছে ' শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডার ’ । এই নামটি এই মন্দিরের প্রথম ম্যানেজার শ্রীকৃষ্ণ দাসজীর নামানুসারে রাখা হয়েছে । এই ঘরটি হচ্ছে মন্দিরের কোষাগার এবং একাউন্টেন্ট'এর অফিস । এখানে সোনা , রুপো , মুক্তা , হীরে ইত্যাদি মূল্যবান রত্ন ও শ্রীনাথজীর মূল্যবান পোষাক সমূহ জমা থাকে । প্রতিটি গুদাম ও কোষাগারের সম্মুখে প্রহরী রয়েছে ।

        এছাড়াও রয়েছে পুষ্প কক্ষ । যেখানে নিত্য পূজার ফুল , মালা ইত্যাদি জমা পড়ছে । রয়েছে দর্জি কক্ষ । যেখানে ভগবান শ্রীনাথজীর নিত্য নতুন পোষাক তৈরী হচ্ছে । রয়েছে গোলাপ কক্ষ । যেখানে গোলাপ ফুল থেকে গোলাপ জল ও গোলাপ সুগন্ধি তৈরী হচ্ছে । আছে একটি প্রকাশনা দপ্তর । যেখানে পারমার্থিক গ্রন্থ বিক্রয় হয় এছাড়া পারমার্থিক বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয় । এইভাবে দুধ , মাখন ও ছানা ও মিশ্রির জন্য একটি ভিন্ন কক্ষ রয়েছে । শস্য ও মশলা গুঁড়ো মেসিন সহ একটি আলাদা ঘর রয়েছে ।

        ' শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত ' গ্রন্থে আমরা পাই যে গোপাল বিগ্রহ ( সেই একই বিগ্রহ এখানে শ্রীনাথজী নামে অবস্থান করছেন ) মাধবেন্দ্র পুরীকে বলছেন “ আমার গ্রামে কেউ যেন কখনও ক্ষুধার্ত না থাকে । ” সেই দৃশ্য আমরা নাথদ্বারে দেখতে পাচ্ছি , এখানে গোপাল আছেন এবং এখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকেন না । এমনকি রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত দু'বেলা পেট ভরে শ্রীনাথজীর প্রসাদ ভক্ষণ করছে । ফলে এখানকার কুকুরদেরও চেহারা বেশ ভালো । নাদুস নুদুস । এমন স্বাস্থ্যবান কুকুর আমি ভারতে বা পৃথিবীর অন্য কোন জায়গার রাস্তায় দেখিনি । অনেক সৌভাগ্যের ফলে তারা এই নাথদ্বারে কুকুর হয়ে জন্মেছে । সারাদিন ধরে এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের প্রসাদ বিতরিত হচ্ছে । মধ্যাহ্নের রাজভোগের পর মাত্র এক টাকায় এখানে এক গ্লাস বিভিন্ন শব্জীর পাতার জুস খেতে পাবেন , যার স্বাদ অপূর্ব । এই মন্দিরে এছাড়াও আচার , চাটনি , রায়তা , দই , ডাল , ভাজা সব্জী , ঘি দিয়ে মাখা বড় চাপাটি ইত্যাদি এতরকম প্রসাদ পাওয়া যায় যে একজনের ভোজনের পক্ষে তা যথেষ্টরও বেশী । বিকেলে সিঙাড়াও পাওয়া যায় । এছাড়া দুগ্ধজাত বিভিন্ন মিষ্টি দ্রব্য তো রয়েছেই ।

        এখানকার মন্দিরের বাইরের দোকানগুলিতে কম দাম ও বেশী দাম ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের খাদ্য দ্রব্য ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া যায় এবং সব কিছুরই এক দর , কোন দামা দামীর ব্যাপার নেই ।

        শ্রীনাথজীর এমন কিছু শুকনো প্রসাদ আছে যা বেশ কয়েক মাসেও নষ্ট হয় না । তাই যারা বিদেশের দূর - দূরান্ত থেকে এখানে তীর্থ করতে আসেন তারা

        সেইসব শুকনো প্রসাদ বিদেশের আত্মীয় বন্ধুদের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান । তাই স্বয়ং শ্রীনাথজীর মতোই শ্রীনাথজীর প্রসাদও বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হবে নাই বা কেন । তিনিই স্বয়ং এই বিশ্বের ঈশ্বর , পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং ।

        শ্রীনাথজীর রূপটি হচ্ছে গিরি গোবর্ধন ধারণের লীলায় রত স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপ । তাই তিনি তাঁর বাম হাতখানি উপরে তুলে আছেন । তাঁর ডান হাতটি তিনি মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় কোমরে রেখেছেন । অনেকে একথাও বলেন আসলে বাম হাত দিয়ে ভগবান শ্রীনাথ ভক্তদের তাঁর কাছে আসার আহ্বান করছেন আর তাঁর ডান হাতে ভক্তিরসামৃত ধারণ করে আছেন । তাঁর নয়নপদ্ম দুটি নিম্নমুখী । এর দ্বারা তিনি নির্দেশ করছেন যে আমরা যেন সর্বদা তাঁর শ্রীচরণকমলেই আমাদের ভক্তি নিবেদন করে শরণাগত হই ।

        ভারতের অধিকাংশ মন্দিরগুলি থেকে শ্রীনাথজীর মন্দিরের কারুকার্য ভিন্ন প্রকৃতির । অধিকাংশ মন্দিরেই থাকে বিশাল বর্ণাঢ্য গম্বুজ , যাকে মন্দির শিখর বলে এবং তা বহুদুর থেকে দেখা যায় । কিন্তু শ্রীনাথজীর মন্দিরটি এবং শ্রীবল্পভাচার্যের অনুগামীদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভজন কুটিরগুলি বসতবাড়ির মতো দেখতে হয় । এগুলিকে ' হাভেলী ' বলা হয় । এর দ্বারা বোঝানো হয় । যে এগুলি শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ মহারাজের বৃন্দাবন ভবনের মতো । শ্রীনাথজীর মন্দিরকেও তাই ' নন্দভবন ' বা ' নন্দালয় ' বলা হয়ে থাকে । প্রকৃতপক্ষে রাজস্থানের এই মেবার অঞ্চলে এলে বৃন্দাবনের কথা মনে পড়ে যায় । মেবারের স্নিগ্ধ মনোরম পর্বতমালা ঠিক গিরি গোবর্ধনের মতো আর বিপাশা নদীটিকে যমুনা নদীর মতো মনে হয় ।

        শ্রীনাথজীর সেবকেরা বলেন যে , এই শ্রীবিগ্রহটি হচ্ছে নিকুঞ্জনায়ক নামে পরিচিত শ্রীকৃষ্ণের আদি রূপ । পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই রূপটির মধ্যে যেহেতু অন্য সব রূপই বিধৃত রয়েছে তাই ভক্তজনেরা তাঁকে শ্রীরাধানাথ এবং শিশু শ্রীকৃষ্ণ এই উভয়রূপেই প্রকটিত দেখে থাকেন । এই কারণেই মাঝে মাঝে শ্রীবিগ্রহের বিনোদনার্থে তাঁকে শিশুদের বিভিন্ন খেলনা নিবেদন করা হয় আবার কখনও রাখাল বালকের উপযোগী পাচনবাড়ি অর্পণ করতে দেখা যায় । বৃন্দাবনের গোপীদের সঙ্গে প্রণয়লীলা জন্যও শ্রীনাথজী সমধিক সুবিদিত । তাঁর সমক্ষে ভজন বা ভক্তিগীতিতে যদিও তাঁর শৈশব লীলার বিবরণ বেশী থাকে , তবু সেই সব গানের বেশীর ভাগের মধ্যেই গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের ভাব বিনিময়ের প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনা বিধৃত রয়েছে ।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ১৯ ) পুষ্কর
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।