ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • যেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মহিমা আজও জাগ্রত

    কানাই নাটশালা

    শ্রীমৎ শচীনন্দন স্বামী মহারাজ

    কার্তিক মাসটি কৃষ্ণভক্তগণের কাছে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ মাস । এই মাসে পরমেশ্বর ভগবানের নিত্য সহচরী শ্রীমতী রাধারাণীর প্রতি , দৈনন্দিন ভগবৎ শ্রবণ ও কীর্তন উৎসর্গ করে , তাঁকে আরাধনা করার মাধ্যমে , ভক্তগণের ভগবৎ - সেবাশক্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধি করার উপদেশ দেওয়া হয়ে থাকে । বলা হয়ে থাকে , যদি সম্ভব হয় , তাহলে একটু নির্জন পরিবেশে বা জায়গায় এই কার্তিক মাসে ভগবৎ - ভজন করা শ্রেয় । কিন্তু যে কেউই যে কোন স্থানে এই নীতিটি হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে প্রয়োগ করতে পারে , কেননা এই মহামন্ত্রে রাধা ও কৃষ্ণ উভয়কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে “ হে ভগবৎ - শক্তি ( রাধা ) , হে ভগবান ( কৃষ্ণ ) , দয়া করে আমাকে তোমার সেবায় নিয়োজিত কর । ”

        উপযুক্ত নির্জন পারমার্থিক পরিবেশের কথা বলতে গিয়ে আমার মনে পড়ে ' কানাই নাটশালা ' জায়গাটির কথা । অনেক বৎসর আগে মায়াপুর থেকে একদল ভক্তের সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে আমি কানাই নাটশালায় গিয়েছিলাম । সেই সময়েই আমি এই জায়গাটির দিব্য নির্জনতার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । ঝাড়িখণ্ড অরণ্য নামক এক সুপ্রাচীন গভীর অরণ্য এই কানাই নাটশালাকে ঘিরে রয়েছে । অরণ্য এখনও আগের মতোই তমাল , অশ্বত্থ , বট , সপ্তপর্নী , স্বর্ণচাঁপা , কদম্ব ইত্যাদি বহুবিধ উপকারী বৃক্ষে ভরা রয়েছে আম , লিচু , আমলকী , সবেদা ইত্যাদি ফলের গাছও । সবুজ অরণ্যে ছায়িত কানাই নাটশালার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পবিত্র গঙ্গা নদী অরণ্যে রয়েছে চিতাবাঘ আর সাপ । গঙ্গায় রয়েছে শুশুক ।

        অনেকদিন পর দ্বিতীয়বারের জন্য আমি এই দিব্যভূমি কানাই নাটশালায় আবার গিয়েছিলাম ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের কার্তিক মাসে এবং পুরো কার্তিক মাসই আমি সেখানে অতিবাহিত করেছিলাম । ইসকনের প্রধান বিশ্বদপ্তর শ্রীমায়াপুর থেকে জীপ গাড়ি করে আমি ও আমার সহযোগীগণ রওনা দিয়েছিলাম । ছয় ঘণ্টার যাত্রা পথে দু’বার আমরা গঙ্গা পার হলাম । একবার গঙ্গার ওপরের সেতু দিয়ে আরেকবার মালদার সন্নিকটের কোন একটি জায়গা থেকে ফেরীতে গঙ্গা পার হয়ে ওপারে কানাই নাটশালায় পৌঁছে গেলাম । সেই শান্ত পরিবেশ এখনও রয়েছে । উপরক্ত এখন সেখানে ইসকনের একটি মন্দির হয়েছে এবং গঙ্গার তীরে স্থাপিত হয়েছে ইসকনের অপূর্ব এক অতিথিশালা । সামনেই গঙ্গায় ভক্তদের জন্য এক স্নানঘাট নির্মিত হয়েছে । স্থানীয় গ্রামবাসীগণও সেখানে স্নান করতে আসেন । গঙ্গার পারটিও মনোরম । নদী তীরে ছড়িয়ে আছে ঢালু পাথর আর কুমীরের গুহা । কুমীরের গুহা শুনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই । একসময় এখানে নদীতে কুমীর ছিল । কিন্তু এখন আর নেই । তবে কুমীরের পরিত্যক্ত গুহাগুলি এখনও রয়ে গেছে । গুহাগুলি বেশ বড় । এখন গঙ্গাপারের ঐ গুহায় বসে যে কেউই নিশ্চিন্তে হরিনাম জপ করতে পারেন ।

        কিন্তু শ্রীশ্রীরাধা - কৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে এই কানাই নাটশালার সম্পর্কটি কি ? স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে এই স্থানটিকে শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র ভূমি ' গুপ্ত বৃন্দাবন ' রূপে বিবেচনা করা হয় । বলা হয়ে থাকে যখন শ্রীমতী রাধারাণী একাকী শ্রীকৃষ্ণের মধুর সঙ্গের আস্বাদন করতে চাইতেন , তিনি এখানে আসতেন । পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নামের , হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে । সংকীর্তন আন্দোলন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কর্তৃক এখানেও বিস্তৃতি লাভ করেছিল ।

        শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গয়া গিয়েছিলেন এবং সেখানে কৃষ্ণ আরাধনার জন্য কীর্তনীয় গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার পর সেখান থেকে রাধা - কৃষ্ণ অনুসন্ধানার্থে বৃন্দাবনে যেতে চান । শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীব্রহ্ম সংহিতা গ্রন্থের বিশ্লেষণে এক জায়গায় লিখেছেন “ শুদ্ধ আত্মা , দিব্য গোপী ও গোকুলেশ্বর সর্বাকর্ষক শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ধাবিত হন । " এই কৃপা কি করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল তা শ্রীচৈতন্য ভাগবত ( আদি খণ্ড ১৭ / ১১৫-১৩৭ ) গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে—

        “ একদিন মহাপ্রভু এক নির্জন স্থানে বসে তার দশাক্ষরী মন্ত্রে নিমগ্ন হলেন । সে সময় তিনি সরাসরিভাবে তাঁর হৃদয়েশ্বরকে প্রত্যক্ষ করলেন । কিছুক্ষণ পর তাঁর বাহ্য চেতনা ফিরে এলে তিনি কৃষ্ণকে ডেকে ডেকে এইভাবে ক্রন্দন করতে লাগলেন ' হে আমার প্রিয় কৃষ্ণ । হে হরি , আমার জীবন ও প্রাণ । আমার হৃদয়কে অপহরণ করে তুমি কোথায় চলে গেলে ? আমি তোমায় প্রত্যক্ষ করেছি , হে প্রভু , কিন্তু এখন তুমি কোথায় চলে গেছ ?

        মহাপ্রভু তখন কাঁদতে কাঁদতে পরম প্রেমভাবে নিমগ্ন হয়ে কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অপূর্ব শ্লোক আবৃত্তি করতে লাগলেন । তাঁর দেহ ধূলি দ্বারা আচ্ছাদিত হচ্ছিল কারণ তিনি ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে উচ্চস্বরে কাতরভাবে কৃষ্ণকে ডাকছিলেন , ' হে আমার প্রিয় কৃষ্ণ , আমাকে ফেলে রেখে , তুমি কোথায় চলে গিয়েছ ? তিনি কৃষ্ণ বিরহের ভক্তি অনুভব সাগরে অত্যন্ত কাতর হয়েছিলেন । তাঁর শিষ্যেরা তাকে অত্যন্ত যত্নে শান্ত করলেন । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তখন তাঁদের বললেন ‘ তোমরা নবদ্বীপে ফিরে যাও ; আমি ইহ জীবনে আর সেখানে ফিরে যাব না । আমাকে অবশ্যই বৃন্দাবনে যেতে হবে , যেখানে আমি আমার প্রাণনাথ শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করব । শিষ্যগণ মহাপ্রভুকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হৃদয় কাতরভাবে ভক্তিতে নিমগ্ন ছিল । একদিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে কৃষ্ণপ্রেমে মত্ত হয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন । ' হে কৃষ্ণ ! আমি তোমাকে কোথায় খুঁজে পাব ? এই আহ্বান করতে করতে হাঁটতে লাগলেন ।

        কিছুদূর যাবার পর মহাপ্রভু দেবতাদের প্রতিনিধি দ্বারা উচ্চারিত এক আকাশবাণী শ্রবণ করলেন । সেই আকাশবাণীতে যা বলা হয়েছিল তা হল এই ' হে শ্রেষ্ঠ ঘিজ রত্ন , এখন বৃন্দাবনে গমন করবেন না । যখন সঠিক সময় হবে তখন নিশ্চয়ই আপনি সেখানে গমন করবেন । এখন আপনার নবদ্বীপের গৃহে ফিরে যান । আপনি চিন্ময় জগতের প্রভু এবং এই জগতের মানুষদের উদ্ধারের জন্য আপনার পার্ষদগণসহ অবতরণ করেছেন । দয়া করে আপনার সংকীর্তন আন্দোলন শুরু করুন । যখন আপনি ভগবৎ - প্রেমের সম্পদ বিতরণ করবেন , তখন আপনার কীর্তন অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডকে প্লাবিত করবে । আমরা আপনার দাস , আর তাই আমরা এই স্মরণ আপনার পাদপদ্মে নিবেদন করলাম ।

        তাঁর বৃন্দাবন যাত্রার বাসনাকে তৎক্ষণাৎ দমন করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নবদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন । পরম ভক্ত ও পণ্ডিত শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর তাঁর রচিত শ্রীশচীনন্দন বিজয়াষ্টকম্ সংস্কৃত কবিতার প্রথম স্তবকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গয়া থেকে ফিরে আসার যাত্রার বর্ণনা যেভাবে করেছেন তার অর্থ হল ' গয়া থেকে ফেরার পথে আমি এক অসাধারণ পুরুষকে দর্শন করেছিলাম । তাঁর রূপ অত্যন্ত সুন্দর এবং কণ্ঠস্বর ঠিক ঝঞ্ঝঞা বিক্ষুব্ধ মেঘের গর্জনের মতো । তাঁর দুই নয়ন দিয়ে অশ্রু বর্ষিত হচ্ছিল এবং তিনি ভূমিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন । ভগবৎ প্রেমের উচ্ছ্বাসে তাঁর কণ্ঠ রূদ্ধ ছিল । সেই মহাপ্রভুর জয় হোক । '

        গৃহে ফেরার পথে , শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ঘুরপথে যাচ্ছিলেন । গঙ্গা পার হয়ে একাকী তিনি কানাই নাটশালায় গমন করলেন । এই গুপ্ত বৃন্দাবনেই তিনি প্রথম তাঁর সংকীর্তন আন্দোলনের এক রূপ প্রদান করলেন । কানাই নাটশালায় আগমনের পূর্ব পর্যন্ত মহাপ্রভু এক অপরাজেয় পণ্ডিতের ভূমিকায় লীলা করছিলেন । কিন্তু কানাই নাটশালায় পৌঁছানোর পর তাঁর লীলার রূপাত্তর হল , সেখানে এক অসাধারণ ভক্তের ভূমিকা গ্রহণ করলেন , যা আগে দর্শিত হয়নি । এই স্থান থেকেই কৃষ্ণ অনুসন্ধানের ভাবে ভাবিত হয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সংকীর্তন আন্দোলনের সূচনা করলেন । শ্রীচৈতন্য ভাগবত গ্রন্থের মধ্যখণ্ড ২ / ১৮০-১৯৫ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর প্রিয়জনদের কাছে কানাই নাটশালাকে যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন তাঁর অর্থ এইরকম—

        সেখানে আমি এক অতি সুন্দর নবীন বালককে দর্শন করেছিলাম যার গায়ের রঙ উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ , ঠিক যেন তমাল তরুর বাকলের মতো কালো । তার কুঞ্চিত কেশ , সে টাটকা বনফুল , গুঞ্জা ফলের মালা ও বর্ণময় ময়ূরের পালক দ্বারা শোভিত । তাঁর মণি মুক্তাসমূহ এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে তার ফলে আমি তাঁকে ঠিকভাবে দর্শন করতে পারি নি । তাই তার হাতে বাঁশরী শোভিত , তাঁর অপরূপ রূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব । তার কোমল পাদপদ্ম যুগল ছিল নূপুর শোভিত । তাঁর দৃঢ় , কৃপাময় বাহু পর্বতের দৃঢ়তার সৌন্দর্যকেও পরাজিত করে । আর আমি কিভাবেই বা তার স্বর্ণাভ - পীত রেশমী ধুতি , তার মৎস্যাকৃতি উজ্জ্বল কুণ্ডল এবং তার পদ্ম পাপড়ির মতো নয়নদ্বয়ের বর্ণনা করতে পারি ? তিনি স্মিত হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং আমাকে আলিঙ্গন করার পর সহসা দ্রুতবেগে চলে গেলেন ।

        শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলেন । ভক্তগণ তাঁকে তাড়াতাড়ি তুলে ধরে ' কৃষ্ণ , কৃষ্ণ ' কীর্তন করে তাঁকে কিছুটা শান্ত করলেন । কিন্তু তাঁকে একেবারে শান্ত করা গেল না । তিনি অনবরত ' কোথা কৃষ্ণ ? ' বলে ক্রন্দন করতে লাগলেন । ” ভক্তগণ এরপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে কীর্তনে নেতৃত্ব দিতে বললে , তিি তাই করলেন । তিনি যে সংকীর্তন আন্দোলন শুরু করলেন তারও উদ্দেশ্য হচ্ছে ' কোথা কৃষ্ণ ? কোথা কৃষ্ণ ? ' রূপ কৃষ্ণানুসন্ধান ।

        আমরাও শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশ স্মরণ করে এই পবিত্র স্থানে অবস্থানকে আমাদের জপ ও কীর্তনের মনোনিবেশের প্রতি উৎসর্গ করি । শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত , আদি লীলার ৪/১০৮ শ্লোকের তাৎপর্থে বলেছেন— “ যারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয়ের অধীনে রয়েছি , তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে কৃষ্ণবিরহগতভাবে তাঁর ভগবৎ - আরাধনার ভাবটিই ভগবানের প্রকৃত আরাধনা । যখন বিরহ অত্যন্ত গভীর হয়ে ওঠে তখন ভক্ত কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের স্তর প্রাপ্ত হয় । তথাকথিত ভক্তরা খুব সহজেই কল্পনা করে যে তারা বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে । এইরকম ভাবনা হয়তো উপকারীও , কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রদর্শিত বিরহের মনোভাবের মাধ্যমেই কৃষ্ণ প্রাপ্তি সম্ভব । ”

        নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে কানাই নাটশালার সকল স্ত্রী , পুরুষ নির্বিশেষ অধিবাসীগণ এক অপূর্ব বাৎসরিক অৰ্চনা উৎসব উদযাপন করেন । সেইদিন তারা মা গঙ্গা ও সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে সারা দিন রাত ধরে তাদের ভক্তি নিবেদন করেন । বিকেল পাঁচটা নাগাদ তারা ঝুড়ি ভর্তি ফল , ফুল , শস্য , নানাবিধ সব্জী ও মিষ্টান্ন দ্বারা নৈবেদ্য সাজিয়ে গঙ্গার তীরে এসে তাদের পূজা করেন এবং সূর্যাস্ত থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত কোমর অবধি গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভক্তি সঙ্গীত বাদ্যযন্ত্রসহ নিবেদন করে তাদের ব্রত পালন করেন । মা গঙ্গা ও সূর্যদেবের কাছ থেকে তারা যা লাভ করছেন তারা সেদিন ভক্তি সহকারে তা তাদের নিবেদন করেন । তাদের ভক্তির এই উৎসব দর্শন করা আমার পক্ষে ছিল এক সুন্দর অভিজ্ঞতা ।

        এবারে আসছি ' কানাই নাটশালা ' এবং এখানকার বর্তমান ইসকন মন্দিরের ইতিহাসের কথায় কানাই নাটশালা অতীতকাল থেকেই ছিল এক পবিত্র স্থান । কিন্তু এখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শুভাগমনের ফলে এই স্থানটি পবিত্রতম হয়ে ওঠে । ফলে অতি শীঘ্রই এই স্থানটি বিভিন্ন যোগী ও ভক্তদের বসবাসের স্থান হয়ে ওঠে । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শুভানুগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মের এক মন্দির স্থাপন করেন । সেই সময় এখানে গরীব বাবা নামক এক যোগী বাস করতেন । তিনি সেখানে এক মন্দির স্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীরামাবতার রূপ ও তাঁর ভক্ত হনুমানজীর পূজা করতেন এক বটগাছের নীচে বসে এই পবিত্র স্থানের প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রতিদিন রামায়ণ পাঠ করে সময় অতিবাহিত করতেন । তিনি খুব বড় করে এখানে যজ্ঞও করতেন । সেই সময় হাজার হাজার মানুষ আসতো । এমনকি অনেক দূর দূরান্ত থেকে কেউ কেউ হাতীতে চেপেও সেই সশন করতে আসতো । এই গরীব বাবা হয়ে গেলেন তখন তাঁর একমাত্র শিষ্য নৃসিংহ বাবাকে ডেকে একদিন তিনি এই নির্দেশ প্রদান করলেন “ দেখ , আমরা হচ্ছি রামের ভক্ত । আমরা প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলার সঙ্গে সম্পর্কিত এই পবিত্র স্থানের অধিকারী নই । তুমি যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে এবং যখন আর এই মন্দির ও এই পবিত্র স্থানের যত্ন নিতে পারবে না , তখন তুমি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তদের কাছে এই পবিত্র স্থানের ভার অর্পণ করবে । ”

        তাঁর গুরুর আদেশ অনুযায়ী নৃসিংহ বাবা তাই - ই করেছিলেন । তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তিনি নবদ্বীপ ও মায়াপুরে গমন করলেন কানাই নাটশালায় তাঁর গুরুদেবের মন্দিরটির দায়িত্ব উপযুক্ত কারো হাতে সমর্পণের উদ্দেশ্যে তিনি নবদ্বীপ ও মায়াপুরের বহু মন্দির ভ্রমণ করলেন । অবশেষে তিনি শ্রীমায়াপুরের ইসকন কেন্দ্রে এলেন । শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের সঙ্গে নৃসিংহ বাবা দেখা করলে পর তিনি সেই বৃদ্ধ যোগীকে মধ্যাহেলর প্রসাদ ভোজনে আপ্যায়িত করলেন । কিন্তু নৃসিংহ বাবা উত্তরে বললেন , “ আমি এখানে আহারের জন্য আসিনি । আমি আপনাকে কিছু প্রদান করতে এসেছি । " আসলে নৃসিংহ বাবা ফল ছাড়া অন্য কিছু আহার করতেন না । সে যাই হোক , কানাই নাটশালার ভার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামীদের হাতে অর্পণ করার পরিকল্পনা শ্রবণ করে শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে নৃসিংহ বাবার সঙ্গে কানাই নাটশালায় প্রেরণ করলেন । কানাই নাটশালা ঘুরে এসে ভক্তগণ যে রিপোর্ট দিলেন তা পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক ছিল । স্থানটি যেন জনমানব বর্জিত , জঙ্গলের মধ্যে এক নির্জন স্থান । মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ছে এবং নৃসিংহবাবার অবর্তমানের সুযোগে মন্দিরের বিগ্রহ যেন কারা চুরি করে নিয়েছে ।

        ইসকনের ভক্তগণ জানতেন এই পবিত্র স্থানে এক মুঠো ধূলোর দাম লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েও পরিমাপ করা যাবে না । তাই তারা মন্দিরটি গ্রহণ করতে অত্যন্ত উৎসাহিত হলেন । তাঁরা পুরানো মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধা - কানাইলালের বিগ্রহ স্থাপন করলেন এবং একটি নতুন বড় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করলেন । এই নতুন মন্দির নির্মাণের জন্য মাটি খোঁড়ার সময় শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের পাদপদ্মের চিহ্ন সমন্বিত একটি ধাতুর ফলক এবং শ্রীনৃসিংহদেবের একটি ছোট বিগ্রহ পাওয়া গেল । মথুরা বল্লভ দাস নামক মায়াপুর ইসকন কেন্দ্রের এক ব্রহ্মচারী নিয়মিত সেখানে বিগ্রহ অর্চনার ভার গ্রহণ করলেন । মন্দিরের চারদিকের জঙ্গলে হিংস্র বাঘ ও বিষধর সাপ থাকলেও আশ্চর্যজনকভাবে তারা ভক্তদের প্রতি ছিল শান্ত । কখনও কোন মন্দিরের ভক্তের সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটেনি । পূজারী মথুরা বল্লভ জানালেন “ আমি প্রতিদিন ভোর তিনটের সময় গঙ্গায় স্নান করে আমার সেবা শুরু করি । আমি দেখেছি এই জঙ্গল বাসের যে কোন অসুস্থতা আমার এই গঙ্গাস্নানের মধ্যে দিয়ে সেরে যায় । ” নৃসিংহবাবার কথা স্মরণ করে তিনি বললেন , “ আমার এখন নৃসিংহবাবার সেই দৃশ্য মনে পড়ে , তিনি অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় প্রায় ছেঁড়া রামায়ণ থেকে প্রতিদিন পাঠ করে যাচ্ছেন এবং পাঠ করতে করতে কখনও তিনি কেঁদে উঠতেন । ” নৃসিংহ বাবা আরও পাঁচ বৎসর , জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেছিলেন ।

        একবার সেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত সন্তোষ সিংহের সঙ্গে আলাপ হল । তাঁর ব্যবসাটি হল ফেরী যোগে মানুষকে গঙ্গা পারাপার করা । কিন্তু তিনি ভক্তদের বিনামূল্যে গঙ্গা পারাপার করান । তাঁর এই উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন , “ আমার যখন এই ভবসাগর পার হওয়ার সময় আসবে তখন যেন আমি ভক্তদের আশীর্বাদে বার বার এই জন্ম - মৃত্যুর সমুদ্রকে সহজেই পার হয়ে যেতে পারি , এই আমার কামনা । ”

        শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তিভাবকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য কানাই নাটশালা এক বিশেষ স্থান । এই স্থান দর্শন করার মাধ্যমে যে কেউই বর্তমান জড়জাগতিক যুগের ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে সহজেই মুক্ত হতে পারে । আর কেউ যদি এখানে এসে একবার হরিনামের নৌকায় আরোহণ করতে পারে তাহলে তিনি সহজেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপার চিন্ময় ভাবতরঙ্গকে অনুভব করতে পারবেন । পৃথিবীতে যে এমন সুন্দর একটি স্থান আজও লুকিয়ে আছে তা এখানে না এলে বোঝা যাবে না ।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ২৭ ) বাংলাদেশ
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।