ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • ভগবদ্গীতার উৎসভূমি

    কুরুক্ষেত্র

    শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী মহারাজ

    আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর আগে মোক্ষদা একাদশী তিথিতে আ ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে সম্মুখ সমরে উদ্যত কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের মাঝখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভগবদ্গীতা উপদেশ প্রদান করেছিলেন । তাই এই দিনটিকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা জয়ন্তী দিবসও বলা হয় ।

        ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লী থেকে মাত্র ১০০ মাইল উত্তরে কুরুক্ষেত্র অবস্থিত । কুরুক্ষেত্র নামটি শুনলেই কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে মহাভারতের সেই বিরাট যুদ্ধের কথা মনে পড়ে । আর মনে পড়ে সেই যুদ্ধে কৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে ভগবদ্গীতা বর্ণনার কথা । কিন্তু মহাভারতের সেই যুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণের ভগবদ্গীতার উপদেশ প্রদান ঘটনা দুটির অনেক আগে থেকেই প্রাচীন সংস্কৃতি ও ইতিহাসে কুরুক্ষেত্রের এক প্রধান ভূমিকা ছিল । মহাভারতের সহস্র সহস্র বৎসর আগে এই স্থানটি ছিল বৈদিক সভ্যতার পূর্ণ মহিমায় বিকশিত হওয়ার কেন্দ্রভূমি ভগবদ্গীতা , মহাভারত , বিভিন্ন উপনিষদ ও পুরাণ সমূহ সহ নানা শাস্ত্রগ্রন্থে কুরুক্ষেত্রের ধর্মীয় গুরুত্বের বর্ণনা করা হয়েছে । শাস্ত্রে এই স্থানটিকে ধ্যান বা মনসংযমের স্থান ও দেবতাদের আলয় রূপে উল্লেখ করা হয়েছে । কুরুক্ষেত্রের পরিবেশ এখনও বৈদিক স্তোত্র উচ্চারণ , বিশেষত ভগবদ্গীতা কীর্তন করার শক্তি ও উৎসাহ যোগায় । ভগবদ্গীতার প্রথম শ্লোকেই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র রূপে উল্লেখ করা হয়েছে । এর ফলে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেও এই স্থানটি পবিত্র স্থান রূপে পরিচিত ছিল । এখনও পবিত্র ' সরস্বতী ' নদী ও হরিয়ানা রাজ্যের ' দৃষদ্বতী ' নদীর মধ্যবর্তী এক শত বর্গ মাইল জায়গার মধ্যে , যা কুরুক্ষেত্রেরই অন্তর্গত , বহু প্রাচীন মন্দির ও পবিত্র সরোবর দেখতে পাওয়া যায় ।

        পূর্বে এই কুরুক্ষেত্র ' ব্রহ্মক্ষেত্র ' , ' ভৃগুক্ষেত্র ' , ' আর্যাবর্ত ' এবং ' সমন্ত পঞ্চক ' নামে পরিচিত ছিল । পরে এটি ' কুরুক্ষেত্র ' রূপে খ্যাতি লাভ করল মহারাজ কুরুর কাজের জন্য । কিভাবে মহারাজ কুরু , যিনি পাণ্ডবদের এক অন্যতম পূর্বপুরুষ , এই ভূমিকে পারমার্থিক সংস্কৃতির এক মহান কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন , সে কথা মহাভারতে বর্ণনা করা হয়েছে ।

        মহারাজ কুরু এক সোনার রথে চেপে এই স্থানে অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রে এসেছিলেন এবং তাঁর রথের সোনাকে একটি সোনার লাঙ্গল তৈরীর জন্য ব্যবহার করেছিলেন । এরপর তিনি ভগবান শিবের কাছ থেকে তাঁর বৃষ এবং যমের কাছ থেকে তাঁর মহিষ ধার নিয়ে ঐ ভূমিতে হলকর্ষণ শুরু করলেন । এরপর ইন্দ্র সেখানে উপস্থিত হয়ে মহারাজ কুরুকে , তিনি সেখানে কি করেছেন তা জানতে চাইলেন । মহারাজ কুরু উত্তর প্রদান করলেন যে তিনি সেখানে আটটি ধর্মীয় সদ্ গুণ উৎপন্ন করার জন্য ভূমিকে প্রস্তুত করছেন । সেই আটটি সদগুণ হল— সত্য , যোগ , দয়া , শুদ্ধতা , দানশীলতা , ক্ষমা , তপশ্চর্যা এবং ব্রহ্মচর্য ।

        ইন্দ্র রাজাকে একটি বর চাইতে অনুরোধ করলেন মহারাজ কুরু এই বর চাইলেন যে এই ভূমি যেন তাঁর নিজের নামে নামাঙ্কিত হয়ে চিরদিন একটি পবিত্র স্থান রূপে বিরাজ করে এবং যে কোন মানুষ , পাপী অথবা পুণ্যবান নির্বিশেষে , সেখানে মৃত্যু বরণ করবে , সে স্বর্গ লাভ করবে । ইন্দ্র রাজার এই বরের অনুরোধ শুনে উপহাস করলেন ।

        কিন্তু নির্ভীক কুরু মহা - তপশ্চর্যা সম্পাদন করে ক্রমাগত হলকর্ষণ করতে লাগলেন । ধীরে ধীরে ইন্দ্রকে তিনি জয় করলেন , কিন্তু অন্যান্য দেবতারা সন্দেহ করলেন । তাঁরা বললেন যে ত্যাগ ব্যতীত মৃত্যুর উপযুক্ত স্থান স্বর্গ নয় । শেষ পর্যন্ত কুরু এবং ইন্দ্র একটি সমঝোতায় এলেন ইন্দ্ৰ স্বীকার করে নিলেন যে , যে মানুষ সেখানে যুদ্ধরত অবস্থায় অথবা তপশ্চর্যা সম্পাদন করার সময় মারা যাবেন তিনি স্বর্গ লাভ করবেন ।

       

    মহাভারতের যুদ্ধ

    পাণ্ডবরা যখন তাদের খুল্লতাত , অর্থাৎ কাকা ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর পুত্রদের কাছে তাঁদের পৈতৃক রাজ্যের বৈধ অংশ দাবি করলেন , কৌরবরা তাঁদের কুরু রাজ্যের দক্ষিণের খান্ডব বন প্রদান করলেন । সেখানে তাঁরা ইন্দ্রপ্রস্থ নামে এক চমৎকার নগরী নির্মাণ করলেন । আজকে যেখানে দিল্লী অবস্থিত , সেখানেই ছিল সেই ইন্দ্ৰগ্রন্থ নগরী বর্তমান দিল্লীর উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত হস্তিনাপুরকে কৌরবরা তাঁদের রাজধানী রূপে রাখলেন ।

        পরে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ের পরে পাণ্ডবেরা তেরো বৎসরের জন্য নির্বাসিত হয়েছিলেন । নির্বাসন শেষ হলে পাণ্ডবগণ তাঁদের রাজ্য ফেরত চাইলেন । পাণ্ডবদের হয়ে শ্রীকৃষ্ণ , জ্যেষ্ঠ কৌরব দুর্যোধনের কাছে গিয়ে পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করলেন । কিন্তু অহংকারী দুর্যোধন কোন ভূমি দিতে অস্বীকার করলেন । দুর্যোধন বললেন “ আমি তাদের সূচাগ্র ভূমিও প্রদান করব না । ”

        সুতরাং যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠেছিল এবং কৌরব ও পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন । কারণ কুরুক্ষেত্র ছিল এক বিশাল ক্ষেত্র , যেখানে কেউ বাস করত না এবং সেখানে জল ও জ্বালানি কাঠের প্রাচুর্য ছিল ।

        আঠার দিন ব্যাপী সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবশেষে পাণ্ডবেরা জয়ী হয়েছিলেন

    গীতার জন্ম

    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মোক্ষদা একাদশীর দিন শুরু হয়েছিল । মোক্ষদা শব্দটির অর্থ হচ্ছে “ মুক্তি প্রদাতা । ” ঐ দিন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভগবদ্গীতার জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্ত করেছিলেন । এখন প্রতি বৎসরই ঐ দিনটি ' ভগবদ্গীতা'র জন্মদিন রূপে বিবেচিত হয় এবং কুরুক্ষেত্র সহ ভারতের অন্যান্য স্থানে ' গীতা'র সম্মানে উৎসব হয়ে থাকে । সবচেয়ে বড় উৎসবটি হয় কুরুক্ষেত্রের ' জ্যোতিসর ' - এ , ঠিক যে স্থানটিতে ' গীতা ' কথিত হয়েছিল । এই উৎসবটি রাজ্য সরকারের তরফে আয়োজিত হয় এবং এখানে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল যোগদান করেন । ঘটনাচক্রে এই একই সময়ে ইসকনে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ বিতরণের ম্যারাথন অনুষ্ঠানটি হয় এবং ভক্তগণ ভারত সহ সারা বিশ্বে শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থটি শত সহস্র সংখ্যায় বিতরণ করেন ।

       

    কুরুক্ষেত্র , রথযাত্রার মূল

    একবার কৃষ্ণ যখন সূর্য গ্রহণের সময়ে কুরুক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন , সেই সময় তিনি গোপীগণ সহ বৃন্দাবনের অন্যান্য অধিবাসীদের কুরুক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন কৃষ্ণ যখ বৃন্দাবন থেকে চলে এসেছিলেন তখন তিনি বৃন্দাবনবাসীদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে খুব শীঘ্রই তিনি ফিরে আসবেন । কিন্তু তিনি দীর্ঘ সময় ব্যাপী , প্রায় এক শত বৎসর বৃন্দাবন থেকে দূরে রয়েছেন , তাই গভীর প্রেমবশতঃ বৃন্দাবনের অধিবাসীগণ পুনরায় তাঁকে দর্শনের জন্য আকুল ছিলেন ।

        এক রাজকীয় নগরী দ্বারকার অধিবাসীরা রথে চড়ে কুরুক্ষেত্রে এসে পৌছলেন ; অন্যদিকে এক সাধারণ গোপ গ্রাম বৃন্দাবনের অধিবাসীরা গরুর গাড়ীতে করে কুরুক্ষেত্রে এলেন । যেহেতু বৃন্দাবন ও ধারকার পরিবারবৃন্দ পরস্পর আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত ছিল , তাই সেখানে এক আনন্দময় পুনর্মিলন সংঘটিত হল ।

        বৃন্দাবনের সকল অধিবাসীদের মধ্যে প্রধানা গোপী , শ্রীমতী রাধারানী অন্য সকলের চেয়ে বেশী শ্রীকৃষ্ণ - বিরহ বেদনা অনুভব করতেন । তিনি এবং অনান্য গোপীরা কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন । কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ ও গোপীদের মধ্যে প্রেমময়ী ভাব বিনিময়ই রথযাত্রা নামে সুপরিচিত উৎসবের নিহিতার্থ । তাই যখনই আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের ( ইসকন ) ভক্তগণ সারা বিশ্বের নগরীতে রথযাত্রা উৎসব পালন করেন , তাঁরা কুরুক্ষেত্রের মহিমা প্রচার করেন ।

       

    কুরুক্ষেত্রে দর্শনীয় পবিত্র স্থান

    বামন পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে যে কুরুক্ষেত্রের এই অঞ্চলে নয়টি পবিত্র নদী এবং সাতটি পবিত্র বন রয়েছে । হয়ত এই কলিযুগের কারণে এইসব নদী ও বনের অনেকগুলি অন্তর্হিত হয়েছে , তবুও এখনও যা দর্শনীয় রয়েছে , তা হল-

       

    সরস্বতী নদী

    সরস্বতী নদী ছাড়া আর অন্য সব নদীর গতিপথ কুরুক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন । একমাত্র বর্ষা ঋতুর সময় এখানে সরস্বতী নদী প্রবাহিত হয় । অন্য সময় তা শুকিয়ে যায় এবং তার গতিপথটুকু শুধু দৃশ্যমান হয় ।

       

    জ্যোতিসর

    এই জ্যোতিসরেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতা বর্ণনা করেছিলেন । সেই স্থানটি একটি বড় বৃক্ষের নীচে শ্বেত পাথরের একটি রথ দ্বারা চিহ্নিত রয়েছে । বলা হয়ে থাকে যে গাছটি নাকি পাঁচ হাজার বৎসরের বেশী প্রাচীন এবং অর্জুনের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের অমর কথোপকথনের প্রাচীনতম সাক্ষী । জ্যোতিসর স্থানটি কুরুক্ষেত্র শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত ।

       

    ব্রহ্ম সরোবর

    বলা হয়ে থাকে যে ব্রহ্মা এখানেই পৃথিবীর সৃষ্টি করেছিলেন । সূর্যগ্রহণের সময় প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে শত সহস্র তীর্থযাত্রী এই ব্রহ্ম সরোবরে পবিত্র স্নানের জন্য আগমন করেন । কুরুক্ষেত্রের অন্যান্য সরোবরগুলির মধ্যে এই ব্রহ্ম সরোবরই সবচেয়ে সুন্দর এবং বৃহৎ এবং এটি ' কুরুক্ষেত্র ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ' দ্বারা ভালো ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় । তীর্থযাত্রীদের কুরুক্ষেত্র আগমনের এটিই হচ্ছে প্রধান আকর্ষণ । ব্রহ্ম সরোবরের উত্তর তটে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা - আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত গৌড়িয় মঠের একটি রাধা - কৃষ্ণের মন্দির রয়েছে । পাঁচ হাজার বৎসর আগে এই কুরুক্ষেত্রে রাধা ও কৃষ্ণের পুনর্মিলনের স্মারক রূপে গৌড়িয় মঠের এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ।

       

    সমন্ত পঞ্চক

    কুরুক্ষেত্র ' সমন্ত পঞ্চক ' ( পঞ্চ সরোবর ) রূপেও পরিচিত । কেননা এখানে শ্রীকৃষ্ণের এক অবতার শ্রীপরশুরাম তাঁর বধ করা ক্ষত্রিয়দের রক্ত দিয়ে পাঁচটি সরোবর তৈরী করেছিলেন । ভগবান পরশুরাম একুশ বার অসৎ রাজা ও যোদ্ধাদের নিধন করে পৃথিবীকে বিশোধিত করেছিলেন । শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন যে এই রক্ত পরবর্তীকালে জলে পরিণত হয়েছিল ।

        এই পাঁচটি সরোবরের একটিকে ' সন্নিহিত ' বলা হয় , যার অর্থ হচ্ছে ‘ সমবেত হওয়ার স্থান ' । বলা হয় যে অমাবস্যার দিন মূর্তিমান সকল পবিত্র স্থানগণ এই সরোবরে সমবেত হন । সূর্যগ্রহণের সময় তাই সকল তীর্থযাত্রীগণ ভগবান বিষ্ণুর এক আলয় রূপে পরিচিত এই ' সন্নিহিত সরোবরে ' প্রথমে আগমন করেন ।

       

    বাণ গঙ্গা

    বাণ গঙ্গা বা ভীষ্ম কুন্ড নামে পরিচিত এই পবিত্র স্থানটি কুরুক্ষেত্র থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় পাণ্ডবগণের পিতামহের ভ্রাতা ভীষ্ম এখানে শর শয্যায় শায়িত ছিলেন । যখন তিনি অর্জুনকে তাঁর তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বলেন অর্জুন হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে ভীষ্ম সাধারণ জলের জন্য পিপাসার্ত বোধ করছেন না । তাই অর্জুন তাঁর বাণ দ্বারা মেদিনী ভেদ করে গঙ্গাকে আনয়ন করলেন এবং গঙ্গা সেখানে প্রবল বেগে ফোয়ারার মতো বার হল এবং ভীষ্ম সেই পবিত্র জল পান করলেন । অর্জুনের এই মহান কর্মের জন্য ভীষ্ম তাঁর প্রতি ধন্যবাদ আপন করলেন । অতঃপর যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের পথ সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করলেন।

        বাণ গঙ্গায় শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের একটি বিগ্রহ এবং হনুমানজীর ২৬ ফুট উঁচু একটি বিগ্রহ রয়েছে । তীর্থযাত্রীরা ইচ্ছে করলে সেখানে পূজো দিতে পারেন ।

       

    বাণ গঙ্গা ( দয়ালপুর )

    ব্রহ্ম সরোবর থেকে মাইল দুয়েক দূরে এটি একটি ছোট গ্রাম । এখানেও অর্জুন ভূমিতে বাণ চালনা করে গঙ্গাকে আনয়ন করেছিলেন । তবে এবারে তিনি জয়দ্রথের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় তাঁর রথের ঘোড়াদের জল খাওয়ানোর জন্য গঙ্গাকে আনয়ন করেছিলেন ।

       

    কর্ণবধ

    কর্ণবধ হচ্ছে এক দীর্ঘ পরিখার নাম যেখানে অর্জুন কর্ণকে বধ করার আগে কর্ণের রথের চাকা আটকে গিয়েছিল বলে বলা হয়ে থাকে ।

       

    পরাশর / দ্বৈপাইন

    থানেশ্বর শহর থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে রয়েছে শ্রীল ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনির আশ্রম । মহাভারতের যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ থেকে পলায়ন করে দুর্যোধন এখানকার সরোবরে লুকিয়ে ছিলেন । পান্ডবেরা যখন তাকে লড়াই করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানালো তখন তিনি জল থেকে উঠে এসেছিলেন ।

       

    পেহোয়া

    থানেশ্বর শহর থেকে ১৭ মাইল পশ্চিমে পেহোয়া অবস্থিত । পূর্বে এই স্থানটি ' পৃথুডাক ' নামে পরিচিত ছিল । যার অর্থ হচ্ছে “ পৃথুর ডোবা । " শ্রীকৃষ্ণের শাসন শক্তির এক অবতার রাজা পৃথু , এখানে তাঁর পিতার শ্রাদ্ধকর্ম সম্পাদন করেছিলেন । এখনও প্রতিদিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পিণ্ড দান করার জন্য শত শত তীর্থযাত্রী আগমন করেন ।

       

    চক্রব্যূহ

    থানেশ্বর শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে এই ' চক্রব্যূহ ' অবস্থিত , যেখানে দুর্যোধন এক চক্রাকার ব্যূহের আকারে তার সেনাবাহিনীকে সাজিয়েছিল এবং এই সেই স্থান যেখানে অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করা হয়েছিল ।

       

    দধিচি তীর্থ

    অনেক কাল আগে সরস্বতী নদীর তীরে , দধিচি মুনির আশ্রম ছিল । শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তৈরী করার জন্য ইন্দ্র দধিচি মুনির অস্থি প্রার্থনা করেছিলেন । দধিচি মুনি ইন্দ্রের ইচ্ছা পূরণে সম্মত হয়ে তাঁর জীবন পরিত্যাগ করেছিলেন ।

       

    কুরুক্ষেত্রে শ্রীল প্রভুপাদ

    পৃথিবীতে সমস্ত ঘটনাই কৃষ্ণের আয়োজন । এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা চলে যে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা - আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক পাশ্চাত্যে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের পশ্চাৎপদটি এই কুরুক্ষেত্রেই গঠিত হয়েছিল । আমরা যারা শ্রীল প্রভুপাদের জীবন কাহিনী পড়েছি তারা জানি শ্রীল প্রভুপাদের পাশ্চাত্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচারে যাওয়ার পেছনে সিন্ধিয়া ষ্টীম নেভিগেশন কম্পানী'র সর্বময় কর্ত্রী শ্রীমতী সুমতী মোরারজীর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । তিনি তাঁর জাহাজে বিনামূল্যে শ্রীল প্রভুপাদের আমেরিকা যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । এছাড়াও আরও নানাভাবে তাঁর ধর্মপরায়ণ ও দানশীল বৈশিষ্ট্যের দ্বারা তিনি শ্রীল প্রভুপাদকে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে সাহায্য করেছিলেন ।

        এই শ্রীমতী সুমতী মোরারজীর সঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল এই কুরুক্ষেত্রে । সেটা ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কথা । শ্রীল প্রভুপাদ তখনও সন্ন্যাস গ্রহণ করেননি । বানপ্রস্থ অবস্থায় ছিলেন । সেই সময় তিনি প্রথমবার কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন এবং সেই একই সময়ে ধর্মশীলা শ্রীমতী সুমতি মোরারজী কুরুক্ষেত্র তীর্থ দর্শনে এসেছিলেন । শ্রীল প্রভুপাদ একটি গাছের নীচে বসে তাঁর জপমালায় জপ করছিলেন । শ্রীল প্রভুপাদকে দেখে শ্রীমতী সুমতি মোরাজীর মনে হল ইনি নিশ্চয়ই কোন উচ্চস্তরের সাধু হবেন । তাই তিনি শ্রীল প্রভুপাদের কাছে গিয়ে প্রণাম করে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন । শ্রীমতী মোরারজী শ্রীল প্রভুপাদের বিনম্রতা ও দৃঢ় ভক্তি দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন । এই ঘটনার অনেক পরে শ্রীল প্রভুপাদ যখন আমেরিকায়

        কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীমতী সুমতি মোরারজীর সাহায্য প্রার্থনা করে মুম্বাইতে শ্রীমতী মোরারজীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন , শ্রীমতী মোরারজী কুরুক্ষেত্রে শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে তাঁর সেই প্রথম পরিচয়ের কথা শ্রীল প্রভুপাদকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ।

        ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে ট্রেনে করে অমৃতসর যাচ্ছিলেন । ট্রেন যখন কুরুক্ষেত্র স্টেশনে এসে দাঁড়াল , শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর শিষ্যদের বললেন , “ দেখ , ঠিক এখানেই , পাঁচ হাজার বৎসর আগে শ্রীকৃষ্ণ ' ভগবদ্গীতা ' বর্ণনা করেছিলেন । অনেকে বলে যে কুরুক্ষেত্রের কোন অস্তিত্ব নেই , সেটা একটি পুরাণ কাহিনীর জায়গা , দেহ ও ইন্দ্রিয় সমূহের ক্ষেত্রের প্রতীক । তারা বলে যে এটি একটি রূপক স্থান । কিন্তু এখানে , আমরা এখন কুরুক্ষেত্র স্টেশনে রয়েছি । ” শ্রীল প্রভুপাদ যখন এই কথাগুলো বলছিলেন , তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল এবং বিস্তীর্ণ প্রাত্তরের উপর এক কমলা রঙের আকাশ শোভা পাচ্ছিল ।

        “ তারা কিভাবে বলে যে কুরুক্ষেত্র কোনও সত্যিকারের স্থান নয় ? ” শ্রীল প্রভুপাদ বলে চললেন । “ এখন সেটি আমাদের সামনেই রয়েছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান রূপে গণ্য হয়েছে । ”

        ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ লা ডিসেম্বর তারিখে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন । দিল্লী ফিরে আসার আগে তিনি স্থির করলেন যে কুরুক্ষেত্রের একটি স্বল্পোন্নত জায়গা জ্যোতিসর ' , যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন , সেই জায়গাটি দেখতে যাবেন । সেখানে গিয়ে হেঁটে হেঁটে তিনি সমস্ত জায়গাটি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন । এই পর্যবেক্ষণ করার প্রায় দশ মিনিট পর তিনি তাঁর সঙ্গী শিষ্যবৃন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এই জায়গাটি বিষয়ে তোমাদের কি মনে হচ্ছে ? " প্রত্যেকেই সেই জায়গাটি সম্বন্ধে উৎসাহ দেখালেন কেননা তাঁরা সেখানে যেন এক পারমার্থিক তরঙ্গ অনুভব করছিলেন । সেই সময় এক গভীর , অনন্ত জ্ঞান ও শান্ত পরিবেশ চারদিকে যেন ব্যাপ্ত হয়েছিল । শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের বললেন , “ ইসকনের এখানে একটি কৃষ্ণ ও অর্জুনের মন্দির গড়ে তোলা উচিত । ”

        শ্রীল প্রভুপাদের এই ইচ্ছা বা আদেশ পূরণের উদ্দেশ্যে গত ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীল প্রভুপাদের আবির্ভাব শতবার্ষিকীর সময় কুরুক্ষেত্রের জ্যোতিসরে ইসকনের ভক্তগণ কৃষ্ণ ও অর্জুনের মন্দির গড়ে তোলার জমি কেনার জন্য সচেষ্ট হয় এবং শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কৃপায় তারা সেখানে ছয় একর জমি ক্রয় করতে সমর্থ হয়েছে । ঠিক যে স্থানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভগবদ্গীতা বলেছিলেন , সেই স্থানটি থেকে ইসকনের জমিটি মাত্র ১০০ গজ দূরে অবস্থিত । ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে হরিয়ানা রাজ্যের রাজ্যপালের উপস্থিতিতে ইসকনের মন্দির তৈরীর উদ্দেশ্যে ভূমি পূজা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে । বর্তমানে থানেশ্বরে ব্রহ্ম সরোবর থেকে দু'মাইলের মধ্যে একটি স্থানে ইসকনের একটি ছোট মন্দির রয়েছে । জ্যোতিসরে শ্রীল প্রভুপাদ যেখানে মন্দির নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন , সেটি বাস্তবায়িত করার জন্য ভক্তরা এখন পরিকল্পনা , মন্দিরের নক্সা এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত রয়েছেন ।

        শ্রীল প্রভুপাদের আবির্ভাব শতবার্ষিকীর সময় কুরুক্ষেত্রের এক প্রধান রাজপথের চৌমাথার নাম শ্রীল প্রভুপাদের নামে ' ভক্তিবেদাত্ত চক ' রাখা হয়েছে ।

       

    কুরুক্ষেত্রে কিভাবে যাবেন

    কুরুক্ষেত্র হরিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত । দিল্লী থেকে ট্রেনে কুরুক্ষেত্র যেতে মাত্র চার ঘণ্টা সময় লাগে । এছাড়া হাওড়া , মুম্বাই , বরোদা , আগ্রা , সিমলা ও চণ্ডীগড় থেকেও ট্রেনে সরাসরি কুরুক্ষেত্র যাওয়া যায় ।

       

    কোথায় থাকবেন

    অনেক কুরুক্ষেত্রে বিনামূল্যের ধর্মশালা রয়েছে । সাধারণতঃ ধর্মশালার ঘরগুলি পরিষ্কারই থাকে , তবে সেটি অন্যথায় আপনার পছন্দ ও রুচির উপর নির্ভর করছে । কুরুক্ষেত্রের সবচেয়ে ভালো হোটেলটির নাম ‘ নীলকণ্ঠি কৃষ্ণধাম যাত্রী নিবাস । জ্যোতিসরে নির্জন ভূমিতে রয়েছে ' ক্যানাল গেষ্ট হাউস । '

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ২৩ ) বৃন্দাবন
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।