ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • বৃন্দাবন

    মধুব্রত দাস

    পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবন আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক আকর্ষণীয় পবিত্র স্থান । কেউ যদি শুধু বৃন্দাবনের রাস্তায় হেঁটে বেড়ান তাহলে শহর ঘুরতে দু - তিন ঘণ্টার বেশী সময় লাগবে না । কিন্তু যদি সকল রাস্তা , অলি গলি , বৃন্দাবনের প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশী মন্দির , মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান সমূহ দর্শন করে বেড়ান তবে তাঁর বৃন্দাবন দর্শন শেষ করতে এক বৎসরেরও বেশী লাগবে । বৃন্দাবনের মন্দিরগুলির মধ্যে সাতটি মন্দির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এগুলি হল শ্রীল সনাতন গোস্বামীর মদনমোহন মন্দির , শ্রীল রূপ গোস্বামীর গোবিন্দদেব মন্দির , শ্রীল মধুপণ্ডিত গোস্বামীর রাধা - গোপীনাথ মন্দির , শ্রীল জীব গোস্বামীর রাধা - দামোদর মন্দির , শ্রীল শ্যামানন্দ পণ্ডিত গোস্বামীর রাধা শ্যামসুন্দর মন্দির , শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীর রাধা - রমণ মন্দির এবং শ্রীল লোকনাথ গোস্বামীর রাধা - গোকুলানন্দ মন্দির ।

        শ্রীশ্রীমদনমোহন মন্দির । এখানকার মদনমোহন বিগ্রহ ( পূর্বে নাম ছিল মদনগোপাল ) শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভ নির্মাণ করেছিলেন । এই বিগ্রহের বহু বছর কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি ।

        পরবর্তীকালে অদ্বৈত আচার্য প্রভু সেই মূল মদনমোহন বিগ্রহের সন্ধান পান মহাবন - গোকুলের এক প্রাচীন বটবৃক্ষের মৃত্তিকা নিম্নে । সেখানেই তিনি সেই বিগ্রহের সেবা করতেন । পরে নবদ্বীপ যাওয়ার পূর্বে মদনমোহন বিগ্রহকে মথুরায় চৌবে ব্রাহ্মণের কাছে সেবা ভার অর্পণ করেন ।

        বৃন্দাবনে অদ্বৈত আচার্য প্রভুর ভজনস্থলী , আজও যা অদ্বৈত - বট নামে খ্যাত ।

       

    শ্রীল সনাতন গোস্বামীর ভজন কুটীর ও সমাধি

    । শ্রীল সনাতন গোস্বামী ব্রজের বিভিন্ন স্থানে সাধনা করলেও , জীবনের শেষ কয়েকটি দিন তিনি গোবর্ধন পর্বতে অতিবাহিত করেছিলেন । সেখানেই শুরু পূর্ণিমা তিথিতে তিনি নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হন । কিন্তু তাঁর দেহ গোবর্ধন পর্বত থেকে নিয়ে এসে বৃন্দাবনের রাধা - মদনমোহন মন্দিরের পশ্চাতে সমাহিত করা হয় ।

        শ্রীল সনাতন গোস্বামীর সমাধির ঠিক পেছনেই গোস্বামীগণের গ্রন্থ সমাধির স্থান।

       

    শ্রীশ্রীরাধা - গোবিন্দ বিগ্রহ ।

    শ্রীগোবিন্দজীর বিগ্রহ মূলত ৫০০০ বৎসর আগে শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র দ্বারা অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । কিন্তু কালক্রমে তা কোথাও অন্তর্হিত হয় শ্রীল রূপ গোস্বামী এই বিগ্রহের অনেক খোঁজ করে না পেয়ে বিরহ অনুভবে যমুনার তীরে গাছের নীচে বসেছিলেন । তখন এক সুন্দর বালক এসে তাঁকে জানালেন নিকটবর্তী এক পাহাড়ের এক গর্তে রোজ একটি গাভী দুগ্ধ স্খলন করে । এই কথা বলেই সেই দিব্য বালক অন্তর্হিত হলেন । শ্রীল রূপ গোস্বামী এরপর সেই জায়গাটি খনন করে গোবিন্দজীর বিগ্রহকে প্রাপ্ত হন ।

        গোবিন্দজীর মন্দির , শ্রীল রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামীর শিষ্য এই অপূর্ব কৃষ্ণ মন্দিরটি ১৫৯০ সনে মহারাজ মান সিংহ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল । কয়েক সহস্র নির্মাণ শিল্পীর ৫ বৎসরের প্রচেষ্টায় মন্দিরটি নির্মিত হয় ।

       

    শ্রীশ্রীরাধা - গোপীনাথ মন্দির ।

    প্রকৃত বিগ্রহ এখানে নেই । তিনি জয়পুরে পূজিত হচ্ছেন । শ্রীশ্রীরাধা দামোদর মন্দির । শ্রীল জীব গোস্বামী দ্বারা স্থাপিত । এখানেই শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী পূজিত রাধা - বৃন্দাবনচন্দ্র বিগ্রহ রয়েছেন । শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীরাধারমণ মন্দির । এই রাধারমণ মন্দিরটি নিধিবন উদ্যানের নিকটবর্তী । মুঘল আমলে আওরঙ্গজেবের আক্রমণের ফলে যখন বৃন্দাবনের অধিকাংশ মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল , কিন্তু এই রাধারমণ মন্দিরটি আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যায় । আওরঙ্গজেব এই মন্দিরটিকে একটি সাধারণ বসবাসের গৃহ বলে সেই সময় ভুল করেছিল ।

        শ্রীশ্রীরাধারমণের শ্রীবিগ্রহ । ১৫৪২ সনের বৈশাখ মাসে শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীর শালগ্রাম শিলার দ্বারা এটি প্রকাশিত হয়েছিল । এই বিগ্রহের সঙ্গে শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীর অন্যান্য শালগ্রাম শিলাও পূজিত হয়ে থাকেন । প্রত্যেক বছরই বৈশাখ পূর্ণিমার সময় ১০০ লিটার দুধ ও অন্যান্য পবিত্র দ্রব্যাদি সহযোগে এই শ্রীশ্রীরাধারমণ বিগ্রহের অভিষেক হয়ে থাকে । এই বিগ্রহের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে এই বিগ্রহের সঙ্গে শ্রীমতী রাধারাণী নেই । কিন্তু বিগ্রহের বামদিকে গোমতি চক্র পূজিত হয়ে থাকেন । বৃন্দাবনের গোস্বামীগণের আরাধ্য বিগ্রহগুলির মধ্যে এই রাধারমণ বিগ্রহ হল একটি , যা আজও বৃন্দাবনে রয়েছে । অন্যান্য বিগ্রহসমূহকে আওরঙ্গজেবের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য জয়পুরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল । এই বিগ্রহের রান্নাঘরের আগুন ৪৩৫ বছর আগে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল , যা কখনও নেভানো হয়নি এবং তা আজও প্রজ্জ্বলিত রয়েছে ।

        এই মন্দিরের পূজার্চনার মান অতীব উন্নত । ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা - আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ চেয়েছিলেন যে তাঁর শিষ্যরা যেন বিগ্রহ আরাধনার বিষয়টি এই মন্দিরের পূজারীদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৌপিন এবং আসন শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামী দ্বারা জগন্নাথ পুরী থেকে আনীত হয়ে এই মন্দিরে রক্ষিত হচ্ছে । বছরে তিন থেকে চার বার উল্লেখযোগ্য কোন সময়ে এই কৌপিন ও আসন জনসাধারণের কাছে প্রদর্শিত হয়ে থাকে । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গোবর্ধন শিলাও এই রাধারমণ মন্দিরে রক্ষিত হচ্ছে ।

       

    কেশী ঘাট ।

    একদা এই স্থানে কৃষ্ণের হাতে কংস প্রেরিত কেশী দানব নিহত হয়েছিল । একবার কংস দানব কেশীকে এই বলে বৃন্দাবনে প্রেরণ করল যে তুমি যেই বালকের মস্তকপোরে ময়ূরপুচ্ছ দর্শন করবে সেই বালককেই তুমি হত্যা করবে । সেইদিন কৃষ্ণসখা মধুমঙ্গল কৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন ' হে সখা তুমি যদি তোমার ময়ূরপুচ্ছ তোমার পীত বসন ও মধুর মুরলী দিয়ে আমাকে সাজিয়ে দাও তাহলে সকল গোপ ও গোপীগণ আমাকে আদর করে সুস্বাদু লাড্ডু খেতে দেবে । কৃষ্ণ তখন মধুমঙ্গলকে সেইভাবে সাজিয়ে দিল । এদিকে হল কি , কংস প্রেরিত দানব কেশী মধুমঙ্গলকেই ময়ূরপুচ্ছ সমন্বিতভাবে দর্শন করল এবং সে তখন মধুমঙ্গলকে হত্যা করতে উদ্যত হল । কৃষ্ণ তত্ক্ষণাৎ এসে মধুমঙ্গলকে রক্ষা করে কেশী দানবকে হত্যা করলেন । যদিও মধুমঙ্গল মূৰ্চ্ছা গিয়েছিল কিন্তু অচিরেই জ্ঞান ফিরে পেয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন এবং তার ময়ূরপুচ্ছ ও পীত বসন কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিলেন ।

  • পরবর্তী তীর্থস্থান ২৪ ) শ্রীমতী রাধারাণীর জন্মস্থান
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।