ভক্তসঙ্গে তীর্থ দর্শন, পূণ্যভূমী- তীর্থক্ষেত্র , গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ও এসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ।

গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত, সেখানে কীভাবে যাবেন? তীর্থক্ষেত্র দর্শনে যেয়ে কোথায় থাকবেন, কি খাবেন ইত্যাদি বিষয়ে ভগবদ্ভক্তদের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ।

  • কুম্ভমেলা

    সংকর্ষণ দাস

    ভারতবর্ষের চারটি স্থানে কুম্ভস্নান উপলক্ষে বিরাট মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে , যা জনমানসে কুম্ভমেলা নামে পরিচিত । শাস্ত্রে আছে-

    গঙ্গাদ্বারে প্রয়াগে চ ধারা গোদাবরী তটে ।
    কলসাখ্যোহি যোগহয়ং প্রোচ্যতে শঙ্করাদিভিঃ ॥
    অর্থাৎ , গঙ্গাদ্বার— ( হরিদ্বার ) প্রয়াগ— ( গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম স্থান , এলাহাবাদ ) ধারা– ( উজ্জ্বয়িনী ) গোদাবরী তট— ( নাসিক ) এই চারটি স্থানে গড়ে বার বৎসর অস্তর এক একটি স্থানে কুম্ভযোগ সংঘটিত হয় ।

       

    হরিদ্বারে কুম্ভমেলা

    পদ্মিনীনায়কে মেষে কুম্ভরাশি গতে গুরৌ ।
    গঙ্গাদ্বারে ভবেৎ যোগঃ কুম্ভনামা তদোত্তমম্ ॥ —স্কন্দপুরাণ

        দেবগ্রহ বৃহস্পতি কুম্ভরাশিতে এবং সূর্যদেব মেষ রাশিতে অবস্থান করলে হরিদ্বারে কুম্ভযোগ হয়ে থাকে ।

        সাহারানাপুর জেলার অন্তর্গত হরিদ্বার একটি সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন ঐতিহ্যময় পুণ্যতোয়া গঙ্গার দক্ষিণ দিকে ' শিবালিক ' নামে একটি উচ্চ পাহাড়ের পাদমূলে এই হরিদ্বার অবস্থিত । হরিদ্বারের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তীর্থযাত্রীদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে ।

        হরিদ্বারের বিভিন্ন নাম আছে । কেউ কেউ বলেন যে , এইস্থানে মহামুনি কপিলদেবের আশ্রম ছিল বলে আজও হরিদ্বারের এই স্থানকে ' কপিল স্থান ' নামে অভিহিত করা হয় । অনেকে বলে থাকেন এর নাম ' গঙ্গাযার ' শৈব সম্প্রদায়ের সাধুরা বলে থাকেন এর নাম ' হরদোয়ার ' অর্থাৎ শিবলোকে পৌছাবার দ্বার স্বরূপ বৈষ্ণবেরা এই পবিত্র স্থানটিকে বলেন— ' হরিদ্বার ' অর্থাৎ বিষ্ণুলোকে যাবার দ্বার স্বরূপ । তবে যে যাই বলুন না কেন , এই পবিত্র তীর্থ সাধু মহাত্মার সমাগমে এক দিব্য আনন্দের অতুলনীয় পরিবেশের সৃষ্টি পারমার্থিক জীবনে হরিদ্বারের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

        এ স্থানের ' ব্রহ্মকুণ্ডের ' দক্ষিণ পাশে হর - কি - পাইরি বা ‘ হরি কি চরণ ' নামে সুপ্রসিদ্ধ ঘাটটি হরিকুণ্ডের উপর অবস্থিত । হরিঘারে একদিকে পর্বতমালা , অন্যদিকে পুণ্যতোয়া হরিভক্তি প্রদায়িনী গঙ্গার উৎপত্তি স্থান গঙ্গার মনোরম দৃশ্য সকলকেই আকর্ষণ করে । কুম্ভমেলা উপলক্ষে সাধু মহাত্মারা যখন হরিয়ারে যান তখন তারা ব্রহ্মকুণ্ড , সর্বনাথের মন্দির , মায়াদেবীর মন্দির , নীল ধারার ঘাট , কুশাবর্ত ঘাট , দক্ষেশ্বর , সতীকুণ্ড , ভীমগদা , দশাবতার মন্দির , ঋষিকুল মহাবিদ্যালয় , প্রভৃতি পবিত্র স্থানগুলি দর্শন করে শুদ্ধ ভক্তি অর্জন করে থাকেন ।

    শাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে—

    কুম্ভরাশিগতে জীবে যদ্দিনে মেষ গে রবৌ ।
    হরিদ্বারে কৃতং স্লানম্ পুনরাকৃত্তি বর্জনম্ ॥
    লোকে কুম্ভমিতি খ্যাতম্ জানীয়াৎ সর্বতোনরৈঃ ।
    গঙ্গায়া স্নান মাহাত্ম্যং নালং বক্তুং চতুন্মুখঃ ॥

        যে সময় বৃহস্পতি কুম্ভরাশিতে ও সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করে সেই সময় হরিদ্বারে মহাকুম্ভযোগ সংঘটিত হয়েছে বুঝতে হবে । এই মহাযোগে হরিদ্বারে স্নান করলে পুনর্জন্ম হয় না । অর্থাৎ আমাদের সেই দুর্বিষহ গর্ভ-যন্ত্রণার অবসান হয় । এই স্থানের গঙ্গাস্নানের মাহাত্ম্য ব্ৰহ্মাও চতুর্মুখে বর্ণনা করতে সমর্থ হন না ।

       

    প্রয়াগে কুম্ভমেলা

    প্রয়াগ অর্থে যাগ ( যজ্ঞ ) স্থল । এই প্রয়াগ জেলায় শৃঙ্গবেরপুরে শ্রীরামচন্দ্রের মিত্র গুহক চণ্ডালের রাজধানী ছিল । ইহা গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গম স্থান — তীর্থ বিশেষ । একে তীর্থরাজ বলে — ' স তীর্থরাজো জয়তি প্রয়াগঃ ' । অনেকে অনুমান করেন মহাভারতের বারণাবত নগর এখানে ছিল । প্রয়াগের বর্তমান নাম এলাহাবাদ । এলাহাবাদের অশোকস্তম্ভে প্রয়াগ শহরের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ আছে । স্তম্ভটি খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০ অব্দে মহারাজ অশোক তৈরি করান । প্রয়াগ শহরটি কিছুকাল মোগলদের রাজধানী ছিল । এই তীর্থরাজ প্রয়াগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং তাঁর অন্তরঙ্গ পার্যদেরা পদব্রজে পরিভ্রমণ করেছিলেন ।

        স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে –

    “ মেষরাশি গতে জীবে মকরে চন্দ্র ভাস্করৌ ।
    অমাবস্যা তদা যোগঃ কুম্ভাখ্যস্তীৰ্থনায়কে । ”

        বৃহস্পতি মেষরাশিতে ও চন্দ্র - সূর্য মকর রাশিতে এবং তিথি অমাবস্যা হলে তীর্থরাজ প্রয়াগে অমৃত কুস্তযোগ হয়ে থাকে ।

       

    উজ্জ্বয়িনীতে কুম্ভমেলা

    উজ্জয়িনী বিশালা এবং অবন্তী নামেও প্রসিদ্ধ প্রাচীন নগরী। গ্রীকরা একে ওজিনি ( Ozene ) বলত । রাজা বিক্রমাদিত্যের সময়েই এটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে । সেই প্রাচীন উজ্জ্বয়িনী এখন ভূগর্ভে । তারই অর্ধক্রোশ দূরে উত্তরে বর্তমান শহরটি তৈরি হয়েছে । এখানে অনেক হিন্দু মন্দির দেখা যায় । শহরের দক্ষিণদিকে জয়পুররাজ জয়সিংহের তৈরি মানমন্দির আছে । এই উজ্জ্বয়িনীতেও কুম্ভমেলা হয়ে থাকে । স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে-

    “ ঘটে সূরিশশি সূর্য্যাঃ দামোদরে স্তিতা যদা ।
    ধারায়াং চ তদা কুম্ভো জায়তে খলু মুক্তিদঃ ॥ ”

        বৃহস্পতি তুলা রাশিতে , সূর্য ও চন্দ্র সংযোগ ও তিথি অমাবস্যা হলে উজ্জ্বয়িনীতে ( ধারা ) কুম্ভযোগ হয়ে থাকে ।

       

    নাসিকে কুম্ভমেলা

    নাসিক হল মহারাষ্ট্রের একটি শহর । খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্ৰীষ্টীয় ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত নাসিক জেলা অন্ধ্রভৃত্য , চালুক্য , যাদব প্রভৃতি রাজগণের অধিকারে ছিল । পরে মোগল ও ইংরাজ অধিকারে যায় ।

        নাসিক শহরটি অতি পবিত্র তীর্থ। গোদাবরীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত । শহরের কাছে নদীর দুধারে অনেক মন্দির আছে । নদীগর্ভেও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আছে ।

        গোদাবরী নদীর বামতীরে রামায়ণ বর্ণিত পঞ্চবটী বন । এখানে লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাসিকা ছেদন করেছিলেন বলে এর নাম হয়েছে ' নাসিক ' ।

       

    স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে—

    কর্কের্গুরুস্তথা ভানুশ্চন্দ্ৰশ্চন্দ্ৰক্ষয়স্তথা ।
    গোদাবর্য্যাং তদা কুম্ভো জায়তেহবনিমণ্ডলে ॥

    বৃহস্পতি কর্কট রাশিতে, সূর্য ও চন্দ্র অবস্থান করলে এবং অমাবস্যা যোগ হলে গোদাবরী তটে নাসিকে কুম্ভযোগ হয়ে থাকে । হরেকৃষ্ণ । চলবে...
  • * * * Anupamasite-এ আপনাকে স্বাগতম। আপনার পছন্দমত যে কোন ধরনের লেখা পোস্ট করতে এখানে ক্লিক করুন।   আপনাদের পোস্ট করা লেখাগুলো এই লিংকে আছে, দেখতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ * * *

    জ্ঞানই শক্তি ! তাই- আগে নিজে জানুন , শেয়ার করে প্রচারের মাধ্যমে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।